প্রেমাতাল - পর্ব 44-45-46-47। Golpo Porun

প্রেমাতাল

(মৌরি মরিয়ম)

Prematal
This Photo is from Pexels

প্রেমাতাল - পর্ব ৪৪

মৌরি মরিয়ম

সবাই একে একে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। শুধু চম্পা ঘরের এক কোনায় বসে কাঁদতে লাগলো। তিতির উপুর হয়ে শুলো। পিঠটা বিছানায় রাখতে পারছে না। পিঠের এমন কোন যায়গা নেই যে স্কেল পড়েনি। কোথাও কোথাও একই যায়গায় বারবার পড়েছে। উপুর হয়েও ব্যাথা অনুভব করলো। বুকে, পেটেও বোধহয় দুএকটা লেগেছে। বাবা এসে এভাবে দেখে অস্থির হয়ে পড়েছিল। ভাইয়া এসে ওর গায়ের দাগ দেখে কেঁদে ফেলেছিল। কিন্তু মনের ভেতর এর চেয়েও যে কত ব্যাথা আর দাগ রয়েছে তার খবর তো কেউ রাখেনা।

তিতির বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করলো। বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে মুগ্ধ। তিতির বলল,

-"চম্পা, দরজাটা লক করে চলে যা।"

চম্পা চুপচাপ দরজা লক করে বেড়িয়ে গেল। তিতির ফোন দিল মুগ্ধকে। মুগ্ধর গলায় আতঙ্ক!

প্রেমাতাল - সকল পর্ব

-"তিতির, কি হয়েছে তোমার? ফোন করলে তখন আমি মিটিং এ ছিলাম। পরে এতবার ফোন করলাম ধরলে না?"

তিতির গলাটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,

-"এরকম তো আগেও হয়েছে।"

-"হ্যা কিন্তু আজ আমার মনটা কেমন করছিল! কি হয়েছে বলোতো?"

-"বাবা-মা, ভাইয়া সবাই আমার রুমে ছিল তাই ধরতে পারিনি।"

-"কেন তুমি কি অসুস্থ? আর ভয়েসটা এমন লাগছে কেন? দুপুরে তো সুস্থই ছিলে। কি হলো এর মধ্যে?"

-"বলবোনে, তুমি কোথায়?"

-"অফিসে।"

-"এখনো বাসায় যাওনি?"

-"না, ৮ টার মত বেজে যাবে বের হতে। অনেক কাজ। তুমি বলো না কি হয়েছে?"

-"বাসায় যাও তারপর বলবো।"

-"না তিতির আমার টেনশান হচ্ছে। বলো প্লিজ। নাহলে কাজে মন বসাতে পারবো না।"

-"নতুন কিছু না, তোমার আমার ব্যাপারটা নিয়েই বাসায় আবার একটু ঝামেলা হয়েছে।"

-"তিতির, তোমাকে কি মেরেছে?"

তিতিরের কান্না পেল। কি করে পারে ও সবকিছু বুঝতে? মুগ্ধ আবার বলল,

-"কি হলো চুপ করে আছো কেন? তোমাকে কি মেরেছে?"

তিতির ক্ষীণ কন্ঠে বলল,

''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন

-"হ্যা।"

মুগ্ধ বুঝি কিছু একটা তে ঘুষি দিল। প্রচন্ড শব্দ হলো। আর বলল,

-"উফ! এটাই শুধু বাকী ছিল।"

মুগ্ধর গলাটা রাগে কাঁপছে। তিতির কিছু বলল না। মুগ্ধ বলল,

-"কে মেরেছে? নাকি সবাই মিলে?"

-"মা।"

-"কি দিয়ে মেরেছে?"

-"স্কেল।"

-"কি এমন বলেছিলে?"

-"ডিটেইল টা রাতে বলি?"

-"আচ্ছা, তোমাকে কি অনেক মেরেছে?"

মুগ্ধ এমনভাবে বলল যেন ওর গায়ে ব্যাথা লাগছে। তিতির হেসে ফেলল। বলল,

-"মোটামুটি। কিন্তু তুমি আহ্লাদ করছো বলে ব্যাথাটা কমে যাচ্ছে।"

-"আমাকে শান্তনা দিও না তো।"

-"এখন তুমি সামনে থাকলে আমার কপালে একটা কিস করতে, তাইনা?"

-"ধুর! কি সময় কি কথা!"

-"আমাকে একটা কিস করো। দেখবে আমার অর্ধেকটা ব্যাথা চলে যাবে।"

-"ফোনের মধ্যে কিস করতে পারিনা আমি। ফোনে কিস করে লাভ কি? তুমি কি পাবে?"

-"হুম পাব।"

মুগ্ধ একটা কিস করলো। তিতির বলল,

-"তুমি এত দুষ্টু কেন বলোতো?"

-"কেন?"

-"এইযে কিস করতে বললাম কপালে আর করলে ঠোঁটে!"

মুগ্ধ হেসে দিল। তিতির যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য এসব বলছে তা বুঝতে বাকী রইলো না মুগ্ধর।

ব্যাথায় কুঁকড়ে ছিল তিতির। রাতে খেতে গেল না। কেউ ডাকতেও এল না। ১০ টার দিকে ফোন দিল মুগ্ধ। তিতির বলল,

-"বাসায় গিয়েছো?"

-"হ্যা।"

-"ফ্রেশ হয়েছো?"

-"হুম।"

-"খেয়েছো?"

-"তুমি তো জানো তিতির আমি এত তাড়াতাড়ি খাই না। যাই হোক, এখন তো বলো কি এমন বলেছিলে যে মা তোমাকে এত মারলো?"

সকালে মাকে প্রেগনেন্সির কথা বলা থেকে শুরু করে পুরো ঘটনাটা তিতির মুগ্ধকে খুলে বলল। শুধু মারের ব্যাপারটা ডিটেইলে বলল না। বললে শুধু শুধু অনেকটা কষ্ট পাবে মুগ্ধ।

সব শুনে মুগ্ধ বলল,

-"যেটুকু আশা ছিল রাতেও পানি ঢেলে দিলে।"

-"মানে?"

-"তোমার ফ্যামিলির কাছে তুমি আমাকে আরো খারাপ বানিয়ে দিলে।"

-"কিভাবে? শেষে তো জানলোই যে আমি প্রেগন্যান্ট না।"

-"হ্যা, কিন্তু যেহেতু তুমি প্রেগনেন্সির কথা বলতে পেরেছো সেহেতু আমি তোমার সাথে করেছি। এটাই ভাবছে মা তুমি দেখে নিও।"

-"রাগ করোনা প্লিজ। আমি বুঝতে পারিনি এমন হবে। আমি ভেবেছিলাম এবার রাজী হয়ে যাবে।"

-"তুমি আমার সাথে একবার ডিসকাস করে নিতে পারতে। তাহলে তো আমি নিষেধ করতাম।"

-"সরি, আসলে আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।"

-"হায়রে আমার সারপ্রাইজিং প্রিন্সেস রে! সবকিছুতেই কি সারপ্রাইজ দেয়া লাগে? লাগে না বরং লাইফের বড় বড় ডিসিশান দুজনে মিলে নিতে হয়।"

-"সরি, এমন আর কখনো হবে না। এরপর থেকে সবকিছু তোমার সাথে ডিসকাস করে করবো।"

-"সেই সুযোগটা তুমি পাবে কোথায়? আমার সাথে তো তুমি থাকতেই পারবে না। কদিন পর তোমার বিয়ে হয়ে যাবে অন্য কারো সাথে। আর আমারও।"

তিতিরের প্রচন্ড কান্না পেল। কিন্তু ও কাঁদল না। মুগ্ধ বলল,

-"তিতির, কাল একটু দেখা করবে?"

-"কখন?"

-"দিনের বেলায় তো পারব না। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের হলেও ৫/৬ টা বাজবে। ধানমন্ডি যেতে আরো ১ ঘন্টা।"

-"তার মানে সন্ধ্যাবেলা। ঠিকাছে, পারব।"

পরেরদিন সন্ধ্যাবেলা ওদের দেখা হলো। তিতিরের সারাটা শরীর ব্যাথা হয়ে আছে। হাটতেও কষ্ট হচ্ছে। তিতিরের গলির সামনে থেকে মুগ্ধ ওকে পিক করে নিল। তারপর একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামাতেই তিতির বলল,

-"এখানে যাব না।"

-"তাহলে কোথায় যাবে বলো?"

-"কোন নদীর পাড়ে।"

-"কোন নদীর পাড়ই রাতের বেলা সেফ না। নদীর পাড়ে অন্য কোনদিন নিয়ে যাব।"

-"আমি কোন রেস্টুরেন্টে যেতে চাচ্ছি না। এমন কোথাও যেতে চাচ্ছি যেখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না।"

-"এমন যায়গা এখন কোথায় পাব?"

-"গাড়িতেই থাকি। গাড়িটা কোথাও পার্ক করো।"

-"কতক্ষণ থাকতে পারবে?"

-"৯ টা?"

-"বাসায় প্রব্লেম হবে না?"

-"আমার খোঁজখবর আজকাল সেভাবে কেউ রাখেনা। ভালমতো বুঝে গেছে আমি আর যাই করি পালাবো না। ৯ টার মধ্যে বাসায় না গেলে ফোন করবে।"

মুগ্ধ একটানে হাতিরঝিল চলে গেল। পৌঁছে জিজ্ঞেস করলো,

-"নামবে?"

-"না।"

মুগ্ধ অভ্যাসবসতই কথা বলতে বলতে তিতিরের একটা হাত নিজের কোলের মধ্যে নিচ্ছিল। তিতির হাতটা দিতে সংকোচ করছিল। কিন্তু ততক্ষণে মুগ্ধ দেখে ফেলেছে ওর হাতে মারের দাগ গুলো। নীল হয়ে আছে। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে মুগ্ধর কান্না পেল। কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করে বলল,

-"আর কোথায় মেরেছে?"

-"এতকিছু হিসেব করে কি মেরেছে? ইচ্ছেমত মেরেছে। পরে গিয়েছিলাম তাই পিঠেই বেশি লেগেছে।"

-"উল্টো ঘোরো।"

-"কেন?"

-"ঘোরো তুমি।"

মুগ্ধর চোখমুখ শক্ত। তিতির জানে কেন মুগ্ধ ওকে ঘুরতে বলছে। কিন্তু এখন ওর কথা না শুনলে তো তুলকালাম বাধাবে। তিতির এসব ভাবতে ভাবতেই মুগ্ধ তিতিরকে ধরে উল্টো ঘুরিয়ে চুলগুলো সরালো। সাথে সাথেই দেখতে পেল ঘারের উপর মারের দাগ। মুগ্ধ তিতিরের কামিজের চেইনে হাত দিতেই তিতির বলল,

-"কি করছো?"

-"একদম চুপ।"

তারপর মুগ্ধ চেইনটা খুলল। পুরো পিঠটা দেখে শিউরে উঠলো। পিঠে একফোঁটা যায়গা নেই যেখানে দাগ নেই। একটা দাগের উপর বাকা হয়ে পড়েছে আরেকটা দাগ। সারা শরীরটাই নীল হয়ে আছে। এটাকে মার বলে না। এটাকে বলে পেটানো। এলোপাথারি পিটিয়েছে ওকে। এই দৃশ্য দেখামাত্রই রাগে মুগ্ধর কপালের দুপাশের রগদুটো ফুলে উঠলো। দাঁতে দাঁত কাটলো। অতঃপর চোখ ভরে গেল জলে। চেইনটা লাগিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে বাইরে তাকালো। তিতির ওকে স্বভাবিক করার জন্য জড়িয়ে ধরলো। সেই ফাঁকে মুগ্ধর চোখ দিয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তেই তিতির দেখার আগে তা নিজের হাতে মুছে ফেললো। তিতির বলল,

-"এই, এত কিপটামি করছো কেন? হোল্ড মি।"

-"ধরার জন্য যায়গা থাকা লাগবে তো। কোথাও তো বাদ রাখেনি।"

মুগ্ধর গলা কাঁপছিল। তিতির ওকে আরো ভাল করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর মুগ্ধও তিতিরকে খুব সাবধানী হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধ ধরতেই তিতিরের পিঠে ব্যাথা লাগলো কিন্তু অন্তরে লাগলো হাজার ফুলের ছোঁয়া। তিতির বলল,

-"এরকম আরো হাজারবার মার খেয়েও যদি তোমাকে পাওয়া যায় তাহলে আমি তাতে খুশিমনে রাজী।"

মুগ্ধ বলল,

-"এইটুকুন একটা মেয়ে তোমার কত ধৈর্য! আল্লাহ তোমাকে অনেক সুখী করবে দেখো।"

-"সেই সুখটা তুমি ছাড়া যেন না হয় সেই দোয়াটা করো!"

মুগ্ধ হাসলো। তিতির জিজ্ঞেস করলো,

-"হাসছো যে?"

-"এমনি।"

সেদিন বাসায় এসে রাতের বেলা লুকিয়ে চোখের জল ফেললো মুগ্ধ। ওর অসহায়ত্ব, অপারগতা আর মাথা গরম করে করা ভুলের কারনে আজ তিতির এতটা শাস্তি পাচ্ছে। নিজেকে মনে হলো নর্দমার কীট।

তারপর কদিন ধরে মুগ্ধ অনেক চিন্তাভাবনা করলো। তিতিরের সাথে ঠিকমতো কথা বলল না। দেখা করলো না। তাই সপ্তাহখানেক পর এক ছুটির দিনের সকালে তিতির হুট করে গিয়ে উপস্থিত হলো মুগ্ধর বাসায়। পিউ দরজা খুলে ওকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো।

-"ভাবীইইইই! ওয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ!! কতদিন পর তোমাকে দেখলাম। ভেতরে এসো।"

-"কেমন আছো পিউ?"

-"ভাল, তুমি কেমন আছো ভাবী?

-"আমিও ভাল। আন্টি কোথায়?"

-"মা রান্নাঘরে। দাঁড়াও, ডেকে আনছি।"

ততক্ষণে মা নিজেই চলে এল কে এসেছে দে জন্য। তিতিরকে দেখেই বলল,

-"ওমা, এ আমি কাকে দেখছি? আমার মা যে!"

তিতির সালাম দিয়ে বলল,

-"কেমন আছেন আন্টি?"

-"ভাল মা। তোমার চেহারাটা দিন দিন এমন কেন হয়ে যাচ্ছে মা? জীবনে যাই হয়ে যাক, সেটা তোমাকে দেখলে যেন কিছুতেই বোঝা যায় মা। একটু নিজের যত্ন নিতে হবে।"

-"চেষ্টা তো করি আন্টি।"

-"হুম। অলওয়েজ স্ট্রং থাকবে। আল্লাহ যা করে ভালর জন্যই করে।"

তিতির চুপ করে রইলো। মা আবার বলল,

-"চলো নাস্তা করবে।"

-"আন্টি আমি নাস্তা করে এসেছি। আমি এখন কিছু খাব না। দুপুরে ভাত খাব একসাথে।"

-"আচ্ছা ঠিকাছে। মুগ্ধর কাছে যাও, ঘরেই আছে। ওঠেনি এখনো।"

একথা বলে আন্টি রান্নাঘরে চলে গেল। পিউ তিতিরকে টেনে নিয়ে গেল ভাইয়ের ঘরের সামনে। তারপর বলল,

-"যাও যাও, কেউ তোমাদের ডিস্টার্ব করবে না।"

তিতির লজ্জা পেল। পিউ আবার বলল,

-"আরে ধুরো, লজ্জা পেতে হবে নাগো ভাবি। তুমি যাও তো।"

পিউ চলে যেতেই তিতির দরজা ঢেলে ভেতরে ঢুকলো। মুগ্ধ নেই ঘরে। ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ। ও ওয়াশরুমেই গেছে বোধহয় তাহলে। তিতির ব্যাগটা সোফার উপর রেখে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আন্টি এভাবে বললো কেন, খুব কি চেঞ্জ এসেছে ওর মধ্যে?

মুগ্ধ টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এল। বেড়িয়ে তিতিরকে দেখেই অবাক হয়ে গেল। তিতির ওর দিকে তাকাতেই একটু অপ্রস্তুত বোধ করল। বলল,

-"তুমি কখন এলে?"

-"কিছুক্ষণ আগে।"

-"হঠাৎ?"

-"ফোন ধরছিলে না তো কি করবো? আমি থাকতে পারছিলাম না।"

মুগ্ধ টাওয়ালটা বারান্দায় মেলে দিতে দিতে বলল,

-"আমাকে ছাড়াই তো থাকতে হবে সুন্দরী। থাকতে পারছোনা বললে তো আর হবে না।"

-"এভাবে বলছো কেন?"

তিতির দাঁড়িয়ে ছিল। মুগ্ধ তিতিরের উল্টো পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

-"আমি এতদিন খুব সিরিয়াসলি চিন্তা করলাম সবটা নিয়ে। আমি আগেই জানতাম তান্না কখনো আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবে না। কিন্তু তোমার বাবা-মায়ের আশায় ছিলাম, যদি কখনো তাদের মন গলে! কিন্তু তোমাকে যেদিন মারলো সেদিন থেকে আমি বুঝে গিয়েছি তাদের মন কখনো গলবে না। তাই যদি হয় তাহলে আমাদের আর যোগাযোগ না রাখাই উচিৎ। সেটা আমাদের দুজনের জন্যই ভাল হবে।"

তিতির মুগ্ধর কাছে গিয়ে ওর বুকে হাত রেখে বলল,

-"এমন কথা বলোনা প্লিজ।"

-"আমি না ভেবে বলছি না। গত এক সপ্তাহ ধরে দিনরাত আমি এসব নিয়েই ভেবেছি তিতির।"

-"বাবা-মা না মানলে কি? আমরা আমাদের মত সম্পর্ক রাখবো। সেটা তো আর তারা আটকাতে পারবে না।"

-"না তিতির, এভাবে সম্পর্ক রাখা যায়না।"

তিতিরের কান্না পেয়ে গেল। বলল,

-"তুমি এরকম কথা বলছো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।"

-"আমি রিয়েলিটি যা তাই বলছি।"

-"তুমি যখন কাউকে বিয়ে করবে তখন আমি নিজেই সরে যাব। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত তো সম্পর্ক রাখাই যায়।"

-"আমি কখনো বিয়ে করবো না"

-"আমিও তো করবো না। তাহলে সম্পর্কটা রাখতে দোষ কি?"

-"দোষ আছে। তোমার সাথে কথা বললে আমি কন্টিনিউয়াসলি কথা না বলে থাকতে পারিনা। তোমার সাথে দেখা করলে ডেইলি দেখা করতে ইচ্ছে করে। তোমার একটু কাছে গেলে আরো কাছে যেতে ইচ্ছে করে।"

-"তাতে সমস্যাটা কি? আমি কি তোমাকে কিছুতে নিষেধ করেছি?"

-"না কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে স্মৃতির পাল্লা ভারী হচ্ছে।"

তিতির এবার কেঁদেই ফেললো। মুগ্ধ বলল,

-"কাঁদছো কেন? কেঁদে কি হবে? কাঁদলে যদি সমস্যা মিটে যেত তো দুজন মিলে কাঁদতাম। কিন্তু মিটবে না, কান্না থামাও নাহলে আমি কথা বলতে পারবো না। আমি এই কথাগুলো তোমাকে দু'তিন দিনের মধ্যেই বলতাম। তুমি আজ আসায় আজ বলছি।"

সবসময়ই তিতির কাঁদলে মুগ্ধ পাগল হয়ে যায়, চোখ মুছিয়ে দেয়, বুকে নিয়ে আদর করে কান্না থামায়। আর আজ ও কত স্বাভাবিক। বন্ধ ঘরের মাঝেও দূর থেকে এসব বলছে! একবার চোখটাও মুছিয়ে দিচ্ছে না! এই কি তিতিরের চেনা মুগ্ধ! পুরো পৃথিবীটা ভেঙে পড়লো তিতিরের মাথার উপর। তিতির মুগ্ধকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,

-"তুমি এভাবে বলোনা। আমার তোমাকে অচেনা লাগছে।"

-"না আমি বলবো। যত কষ্টই হোক তিতির বাস্তবতাটা ফেস করতেই হবে।"

তিতির কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না। মুগ্ধ একটু থেমে আবার বলল,

-"ধরো সিলেটে আমরা যেভাবে ছিলাম, আমি যা পেয়েছি আসার পর থেকে তা আমার প্রতিদিন পেতে ইচ্ছে করে। একটা রাত আমি ঠিক করে ঘুমাতে পারিনি। সম্পর্ক থাকলে আমাদের মধ্যে আরো অনেক কিছু হবে কারন, এখন আমাদের মধ্যে কন্ট্রোলটা নেই বললেই চলে। আগে আমরা জানতাম একদিন না একদিন আমরা দুজন দুজনের হবোই। তাই তুমিও আগে সবকিছুতেই বাধা দিতে, আমিও তোমার বাধা শুনতাম। শত ফাজলামো করলেও কখনোই সেভাবে আগাইনি। আর এখন যখন দুজনেই জানি আমাদের এক হওয়াটা আর কখনোই সম্ভব না, তখন তুমিও কিছুতেই বাধা দাও না আর আমিও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনা। পাগল হয়ে গিয়েছি দুজন দুজনের জন্য। কন্ট্রোললেস হয়ে গিয়েছি। শুধু মনে হয় আর তো পাব না, এই শেষ। অসম্পূর্ণ, অনিশ্চিত সম্পর্কগুলো এমনই হয়।"

তিতির চুপচাপ সব শুনছে আর কাঁদছে। মুগ্ধ আবার বলল,

-"তিতির, যতই বলি বিয়ে করবো না বিয়ে করবো না বিয়ে আমাদের করতেই হবে। কারন আমাদের ফ্যামিলি। তোমার যে ফ্যামিলি! এমন কিছু করবে যে তুমি বাধ্য হবে বিয়ে করতে। আর আমার মা! সে তো প্রতিনিয়ত আমাকে বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। এখনো সাকসেসফুল হয়নি কিন্তু কবে যে হয়ে যাবে জানিনা। বিয়ে আমাদের দুজনেরই করতে হবে তিতির কিন্তু যে কোন একজনের আগে হবে। সেই দিনটি হবে আমাদের দুজনের জীবনের সবচেয়ে অসহ্যকর দিন। সেদিন আমরা দুজনই থাকবো অসহায়। অসহায়ত্বের চেয়ে কষ্টের কিছু নেই এই পৃথিবীতে। আমরা যদি এর পরেও সম্পর্ক রাখি তাহলে আরো ক্লোজ হতে থাকবো। তখন ওই দিনটি ফেসই করতে পারবো না তিতির।"

তিতির ঝাঁপিয়ে পড়লো মুগ্ধর বুকে। জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-"তুমি এমন করোনা প্লিজ। যতদিন একসাথে থাকা যায় আমরা থাকিনা প্লিজ? যতটুকু পাব ততটুকুতেই তো শান্তি।"

মুগ্ধ তিতিরকে জড়িয়ে ধরলো না। বলল,

-"না তিতির, শান্তি নেই। আমি নিশ্চিন্তে তোমাকে আদর করতে পারিনা। মন খুলে কথা বলতে পারিনা। সবসময় হারানোর ভয়, অতঙ্ক। এভাবে পারছি না আর। এই ঝুলন্ত অবস্থার একটা শেষ হওয়া চাই।"

তিতির কাঁদতে কাঁদতে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই হাটু গেড়ে বসে পড়লো। মুগ্ধর হাটু জড়িয়ে ধরে বলল,

-"আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না প্লিজ। আমি মরে যাব।"

মুগ্ধ তিতিরকে উঠালো না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তিতিরকে এভাবে কষ্ট দিতে ওর বুকটা ছিড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মুগ্ধ শক্ত করলো নিজেকে। অনেকক্ষণ পর তিতির নিজেই উঠে দাঁড়ালো। কান্না আরো বাড়লো। কাঁদতে কাঁদতেই মুগ্ধর বুকে হাত রেখে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে বলল,

-"এই তুমি দেখছো না আমি কাঁদছি?"

মুগ্ধ চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। তিতির উন্মাদের মত মুগ্ধর হাতদুটো দিয়ে নিজের চোখের জল মুছিয়ে বলল,

-"আমার চোখের পানি মুছে দাওনা। দাওনা মুছে।"

মুগ্ধ ওর চোখের পানিও মুছে দিল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তিতির এবার মুগ্ধর বুকে মাথা রেখে ওকে জড়িয়ে ধরলো। একটু পর মুগ্ধর হাতদুটো নিজের কোমরে রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-"ধরো না আমাকে।"

মুগ্ধ ধরলো না। তিতিরের কান্না থামলোই না। আবার বলল,

-"এমন করোনা, আমি মরে যাব। প্লিজ এমন করোনা। আমাকে দূরে সরিয়ে দিওনা। আমাকে ছোড়ো না।"

মুগ্ধ এতক্ষণে বলল,

-"তাহলে তুমি ছাড়ো, তোমার ফ্যামিলিকে!"

তিতির অবাক হয়ে তাকালো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ আরো বলল,

-"হ্যা যেহেতু তারা অপশন দিয়েই দিয়েছে হয় ফ্যামিলি নাহয় আমি। দেন ইউ হ্যাভ টু পিক অনলি ওয়ান।"

তিতির মুগ্ধকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কিছু বলল না শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মুগ্ধ বলল,

-"তুমি আজ আর যেওনা। আজই বিয়ে করবো। তাহলেই তো আমাদের আর দুজন দুজনকে ছেড়ে থাকতে হবে না।"

-"তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছো?"

-"যদি তাই ভাবো তবে তাই।"

তিতির চোখ মুছলো। বিশেষ লাভ হলোনা, সংগে সংগে আবার গাল ভিজে গেল নতুন চোখের জলে। বলল,

-"আমি জানি আমার ফ্যামিলির কাছে তুমি অনেক অপমানিত হয়েছো। তোমার তাদের উপর রাগ থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তবু তো আমার ফ্যামিলি। আমি রাগ করতে পারিনা, উল্টো আমার ফ্যামিলি নিয়ে তুমি কিছু বললে আমার গায়ে লাগে। এখন যাই ব্যবহার করুক, ছোটবেলা থেকে যে ভালবাসা আর সাপোর্ট দিয়েছে তা আমি ভুলতে পারিনা। আর সবাই যেমন তেমন আমার বাবার জন্য আমি পারিনা। আর তুমি যে ভালবাসাটা আমাকে দিয়েছো তা সব মেয়েদের স্বপ্ন থাকে। তুমি আমার রক্তে মিশে গেছো, তা থেকে আলাদা করতে পারবো না কিছুতেই। তাই বাবা আর তুমি দুজনকেই আগলে থাকতে চেয়েছিলাম। যাই হোক, আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছো তুমি! আর করতে হবে না। আজ থেকে তুমি ফ্রি।"

একথা বলেই তিতির ব্যাগটা সোফার উপর থেকে তুলে বেড়িয়ে যাচ্ছিল ঘর থেকে। মুগ্ধ বলল,

-"কোথায় যাচ্ছো?"

-"বাসায়।"

-"দাঁড়াও, আমি তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।"

তিতির পিছনে ফিরে তাকিয়ে হেসে বলল,

-"লাগবে না, আমি চলে যেতে পারবো।"

তিতিরের চোখ উপচে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। মুগ্ধ বলল,

-"হ্যা আমি জানি তুমি একা যেতে পারবে কিন্তু যেহেতু তুমি আমার বাসায় এসেছো, আমার একটা দায়িত্ব আছে।"

-"নাহ, আমার প্রতি আজ থেকে তোমার আর কোন দায়িত্ব পালন করতে হবে না। অনেক দিয়েছো তুমি আমাকে, কোনদিনও ভুলবো না।"

কথা শেষ করেই তিতির বেড়িয়ে গেল। ঘর থেকে বের হতেই মুগ্ধর মা বলল,

-"তিতির, তুমি কাঁদছ কেন মা?"

-"আন্টি আমি চলে যাচ্ছি। মাফ করবেন বলেছিলাম দুপুরে একসাথে খাব। সেটা এখন আর সম্ভব না।"

ততক্ষণে মুগ্ধ বেড়িয়ে এসেছে ঘর থেকে। তিতির বেড়িয়ে যেতেই মা পেছন পেছন যাচ্ছিল। মুগ্ধ বলল,

-"ওকে যেতে দাও মা।"

প্রেমাতাল - পর্ব ৪৫

মৌরি মরিয়ম

মুগ্ধ আটকালো না তিতিরকে। ওর মা এসে আচমকাই ওর গালে একটা চড় মারলো। মুগ্ধ আকাশ থেকে পড়লো! মা শেষ কবে ওকে মেরেছিল মনে করতে পারছে না। পিউ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। মুগ্ধ বলল,

-"এটা কি হলো?"

মা বলল,

-"তুই মেয়েটাকে এভাবে কাঁদালি কেন?"

-"মা মাঝেমধ্যে না আমি তোমাকে বুঝেও বুঝিনা। এমনিতে অন্য মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য পাগল হয়ে থাকো। সারাদিন রাত আমাকে বলতে থাকো বিয়ে কর, বিয়ে কর। আর আজ তিতিরকে কাঁদিয়েছি বলে তুমি আমাকে মারলে?"

-"না বোঝার কি আছে? আমি তো তিতিরকে খুব পছন্দ করি। ওর মত লক্ষী, ধৈর্যশীল আর সংসারী মেয়ে খুব কমই হয়। ও তোর বউ হলে মরেও নিশ্চিন্তে থাকতাম। কিন্তু তিতিরের ফ্যামিলি তো কোনদিন ওকে তোর সাথে বিয়ে দেবে না। সেজন্যই আমি তোকে বিয়ে দিতে চাই। বয়স কি কম হয়েছে?"

-"কমই তো, মাত্র ৩১ গেল।"

-"তোর বাপ এই বয়সে এক ছেলের বাবা হয়েছিল।"

"হ্যা কিন্তু বাবা তো.."

কথা শেষ করতে দিল না মা। তার আগেই বলল,

-"আরেকটা চড় মারবো এটা নিয়ে কথা প্যাঁচালে।"

মুগ্ধ থেমে গেল। মা বলল,

-"যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বল"

মুগ্ধ বলল,

-"কোনটা?"

-"কি হয়েছে? ও ওভাবে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল কেন?"

-"মা আজ আমি ওর সাথে অনেক কড়া কথা বলেছি। অনেক কষ্ট দিয়েছি ওকে।"

-"কেন?"

-"দরকার ছিল এটার।"

-"কি বলছিস তুই? মেয়েটা সারাক্ষণ ফ্যামিলি থেকে কষ্ট পায়, কোথায় তুই একটু সাপোর্ট দিবি তা না তুই উল্টো কষ্ট দিচ্ছিস আর বলছিস দরকার ছিল?"

-"হ্যা দরকার ছিল। এবার ও খুব শীঘ্রই চলে আসবে আমার কাছে। যেটা ও এতদিন পারছিল না।"

-"এত সিওর হচ্ছিস কি করে?"

-"আমি ওকে খুব ভালভাবে চিনি মা। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকাতে হয়। আজ আমি আঙুল বাঁকিয়েছি, এখন শুধু ঘি ওঠার অপেক্ষা।"

-"এজন্যই বলে ছেলেরা অমানুষ। মেয়েদের নিয়ে বাজী খেলতে ওরা একটুও ভাবে না।"

-"হ্যা মা, তুমি ঠিক বলেছো। ছেলেরা অমানুষই হয়। কারন, তাদের কাছে প্রিয়জনের একদিনের হাসির চেয়ে সারাজীবনের সুখটা বেশি ইম্পরট্যান্ট। আর তার জন্য তারা সবকিছু করতে পারে।"

একবুক কান্না মুগ্ধর গলায় এসে আটকে গেল। মায়ের এবার কষ্ট হলো। কাছে এসে মুগ্ধর গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। মুগ্ধ বলল,

-"একবার দেখেছো ওর গায়ের দাগগুলো? এমন মার মেরেছে শরীরের একটা যায়গাও বাদ রাখেনি। কি অমানুষিক নির্যাতন করেছে ভাবতেও পারবে না।"

মা অবাক হয়ে বলল,

-"সেকি! কে মেরেছে? কবে মেরেছে? কই আমিতো কোন দাগ দেখলাম না।"

-"সপ্তাহখানেক আগে ওর মা মেরেছে ৩ ফিট লম্বা স্কেল দিয়ে। পুরো শরীর নীল হয়ে গিয়েছিল। এখন কি অবস্থা জানিনা। ফুলহাতা জামা পড়েছে বলে দেখতে পাওনি।"

-"ইশ।"

মায়ের চোখ ছলছল করছিল, মুগ্ধরও। মুগ্ধ বলল,

-"যেদিন মেরেছে তার পরদিনই আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম মা। ওকে দেখে এসে থেকে আমার মাথা খারাপ হয়েছিল। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। অথচ মেয়েটা হাসিমুখে আমাকে শান্তনা দিচ্ছিল। কিভাবে পারলো এরকম একটা মেয়েকে এভাবে আঘাত করতে? বলো না মা এমন ফ্যামিলি কখনো দেখেছো তুমি? আজ মেরেছে কাল এর থেকে খারাপ কিছু করবে। আমি আর ভরসা করতে পারছি না ওকে ওর ফ্যামিলির কাছে রেখে। আবার নিয়ে আসার অধিকারও নেই। কি করবো বলো? তাই আমি এটাই চেয়েছি হয় ও ফ্যামিলিকে ছেড়ে আমার কাছে চলে আসুক নাহয় ওর ফ্যামিলির কাছেই থাকুক, তারা মারুক কাটুক যা খুশি তাই করুক.. জানবোও না অসহায়ত্বেও ভুগবো না। অপশন দুটো অথচ চুজ করতে হবে একটা। অপশন কিন্তু আমি দিইনি, ওর ফ্যামিলি দিয়েছিল কিন্তু আমরা মানছিলাম না। খুব বড় ভুল ছিল সেটা আমাদের। যে সম্পর্কের কোন ভবিষ্যৎ নেই সেই সম্পর্ক এভাবে চলতে পারেনা মা। এর তো একটা শেষ হওয়ার দরকার ছিল। করে দিলাম শেষ। বাট শি উইল কাম ব্যাক।"

মা মুগ্ধর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,

-"হুম, সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা। বি স্ট্রং।"

-"আমি তো স্ট্রং ই মা। খুব স্ট্রং, পাথরের মত। দেখলে না যার চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি আমি গড়াতে দিইনি আজ তার চোখের হাজার ফোঁটা জল ঝরলাম। আমি সবই পারি মা।

তিতির মুগ্ধর বাসা থেকে বের হয়েই একটা সিএনজি নিল। চোখের পানি মুছে শেষ করতে পারছে না। মুগ্ধ এতটা বদলে গেছে? সত্যি বদলে গেছে নাকি অন্যকিছু? মাথায় কিছু ঢুকছে না। মুগ্ধ এতটা নিষ্ঠুর কবে হলো? হ্যা অন্যদের সাথে মুগ্ধর নিষ্ঠুরতা ও আগে দেখেছে কিন্তু ওর সাথে? কি করে পারলো মুগ্ধ। একবার চোখটা মুছিয়ে দিল না! ওর হাতদুটো কোমরে রাখার পর ও জড়িয়ে না ধরে হাত সরিয়ে নিল! ব্ল্যাকমেইল করলো! কিন্তু মুগ্ধ তো জানে তিতির শুধু বাবার জন্যই যেতে পারেনা। পৃথিবীর সবাই জাহান্নামে যাক কিন্তু মুগ্ধ কেন ওকে বুঝবে না? ওর সবকিছু বোঝার মানুষ যে এখন একমাত্র মুগ্ধই ছিল। আজ সেও কিনা বুঝে না বোঝার ভান করলো। ঠিকই আছে, মুগ্ধ কত কষ্ট করেছে ওর জন্য! বিনিময়ে কিছুই তো পেল না। আর কত কষ্ট করবে? একদম ঠিক কাজ করেছে মুগ্ধ। এসব ভাবতে ভাবতেই কাঁদছিল আর ওড়নায় চোখ মুছছিল তিতির। কিন্তু যতই মুছছে সাথে সাথে আবার ভিজে যাচ্ছে চোখদুটো।

দুপুর নাগাদ তিতির বাসায় ফিরলো। বাবা, ভাইয়া নামাজ পড়তে গিয়েছে। ভাবী ড্রইং রুমে টিভি দেখছে, মা বোধহয় গোসলে। নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকালো তিতির। মুগ্ধর দেয়া সব জিনিসগুলো বের করে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল কতক্ষণ। কাঁদতে কাঁদতেই মুগ্ধর ছবি বের করলো। এই একটা ছবিই আছে, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে, কালো টি-শার্ট পড়া। চোখে সানগ্লাস। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কি সুন্দর করে হাসছে, হাসিটা দেখলেই বুকের ভেতরটা ধুক ধুক করে। তিতির ছবিটাতে অসংখ্যবার চুমু খেল পাগলের মত। তারপর মুগ্ধর পাঠানো মেসেজগুলো বারবার পড়লো। ভয়েস রেকর্ডগুলো প্লে করতেই তিতিরের এতক্ষণের নীরব কান্নাটা ভয়ঙ্কর কান্নায় পরিণত হলো। চিৎকার করে করে কাঁদতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাবী দরজায় নক করলো। কান্নার আওয়াজ পেয়ে এসেছে। তিতির দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে ভাবীকে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বলল,

-"ভাবী, ভাইয়াকে একটু রাজী করাও না। তুমি বললে ভাইয়া মানবে। মুগ্ধকে ছাড়া তো আমি বাঁচবো না কেউ বোঝে না কেন?"

ভাবী জড়িয়ে ধরে বলল,

-"পাগলী মেয়ে! তুমি তো জানো তোমার ভাইয়া আমার কোন কথাই শোনে না। তবু আমি ওকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, লাভ হয়নি।"

মা ডাইনিং টেবিলে লাঞ্চ রেডি করতে করতে বলল,

-"এত কান্নাকাটি কিসের?"

তিতির দৌড়ে গেল মায়ের কাছে। মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-"মা, মাগো.. আমাকে তুমি মেরে ফেলো মা। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মুগ্ধকে ছাড়া আমার লাইফ ইম্পসিবল।"

মা স্বাভাবিক মুখে বলল,

-"তাহলে মরেই যা। আজিমপুরে রেখে আসবো।"

তিতিরের বলতে ইচ্ছে হলো, 'আমি কি আসলেই তোমার নিজের পেটের মেয়ে?'

কিন্তু বলতে পারলো না। মা বলল,

-"প্লেট, গ্লাস গুলো টেবিলে সাজিয়ে দে যার যার যায়গামত।"

তিতির দেখলো ৫ টা প্লেট ৫ টা গ্লাস টেবিলের এক কোনায় রাখা। রাগ সংবরণ করতে একটা গ্লাস উঠিয়ে মাটিতে ছুড়ে ভেঙে ফেলল তিতির। মা বলল,

-"আরো চারটা আছে।"

তিতির প্লেটগুলো হাতে উঠিয়ে আছাড় মেরে ভাঙলো। মা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তিতিরের দিকে। তারপর তিতির এক হাতে সবগুলো গ্লাস ধাক্কা দিয়ে ভেঙে ফেললো। মা বললো,

-"যা যা ভাঙলি সব তোর বাপের টাকায় কেনা তাই টের পেলি না। এক পয়সা আয় করার যোগ্যতা তো নেই নষ্ট করার যোগ্যতা খুব ভালভাবে আছে। যা পরিস্কার কর।"

চম্পা বলল,

-"খালা, আমি সব পরিস্কার করতাসি।"

-"না তুই করবি কেন? তুই কি নোংরা করেছিস? যে নোংরা করেছে সে পরিস্কার করবে।"

তিতির পানিসহ পানির জগটাও আছাড় মেরে ভাঙলো। তারপর ভাঙা কাঁচের উপর দিয়ে হেটে চলে গেল নিজের ঘরে। পায়ের মধ্যে যে কতগুলো কাঁচের টুকরো ঢুকেছে! প্রথম যখন ভাঙা কাচের উপর পা ফেলল তখন যা ব্যাথা না লাগলো তার চেয়ে অনেক বেশি লাগলো পরের স্টেপগুলোতে। প্রত্যেকবার পা ফেলার সময় ভাঙা কাচের টুকরোগুলো একটু একটু করে ভেতরে ঢুকছিল। ঘরের দরজা লাগিয়ে ওখানেই বসে পড়লো তিতির। বাম পা টা কোলের মধ্যে নিয়ে একটা একটা কাচ বের করছিল আর সেখান দিয়ে রক্ত পড়ছিল। তারপর একইভাবে ডান পায়ের নিচের কাচগুলোও বের করে ফেলল তিতির। রক্তে লাল হয়ে গেছে জামাকাপড়, ফ্লোর সবকিছু। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে উঠে আলমারি থেকে একটা ওড়না বের করে দু'টুকরো করলো। তারপর তা দিয়ে পা'দুটোকে বেধে নিল। তারপর চোখের পানি মুছে নিল। ওর সবকিছু এখন থেকে ওরই করতে হবে। এই পৃথিবীতে আজ আর ওর বলে কেউ নেই। সবাই যার যার।

সেদিন থেকেই তিতির একটা চাকরির চেষ্টা করতে লাগলো। মায়ের খোঁটাটা দিনরাত শুধু কানে বাজে। দেখতে দেখতে তিতিরের মাস্টার্স শেষ হয়ে গেল। তারপর একটা চাকরিও পেয়ে গেল। প্রথম মাসের স্যালারি পেয়েই তিতির যা যা ভেঙেছিল তা তা হুবহু ডিজাইনের এক সেট করে কিনে নিয়ে এল। মা দেখে নির্বিকার রইলেন।

এখন তিতিরের দিনকাল ব্যস্ততায় কাটে। সকালে অফিসে যায় সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে। প্রায় একটা বছর পার হয়ে গেছে। সেদিনের পর আর একদিনও কথা হয়নি মুগ্ধর সাথে। না মুগ্ধ ফোন করেছে, না তিতির। বাবা মা তিতিরের বিয়ের জন্য এক ছেলেকে ঠিক করেছে, তান্নার বন্ধু। যে প্রায়ই বাসায় আসে আর তিতিরকে তার সামনে বসে থাকতে হয়। ছেলেটির নাম সুহাস। সুহাস ইঞ্জিনিয়ার, বেশ স্মার্ট, সুন্দর দেখতে, নম্রভদ্র। যেমনটা তিতিরের ফ্যামিলি চেয়েছিল। সুহাস যখন কথা বলে তিতির তা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্যকান দিয়ে বের করে দেয়ারও প্রয়োজন মনে করে না, শোনেই না। মুগ্ধর কথা ভাবতে থাকে। সুহাস যতক্ষণ সামনে থাকে তিতিরের মুখের দিকে হা করে চেয়ে থাকে। প্রতিদিন রাতে ফোন করে তিতির হাই হ্যালো করে ঘুমের ভান করে তখন সুহাস নিজেই ফোন রেখে দেয়। সুহাস আর ওর ফ্যামিলি যখন প্রথম দেখতে আসে তিতিরকে তখনই পছন্দ করে ফেলে। আর সুহাসের মা ওকে আংটি পড়িয়ে দেয়। সেদিনই সুহাসকে তিতির মুগ্ধর কথা সবটা খুলে বলেছিল। সব শোনার পর ও বলেছিল,

-"আমি এসব আগে থেকেই জানি। তান্না বলেছিল আমাকে।"

-"আপনি সব জেনেও আমাকে বিয়ে করবেন?"

সুহাস হেসে বলেছিল,

-"হ্যা, না করার তো কারন দেখছি না। বিয়ের আগে রিলেশনশিপ সবার থাকে। আমারও গার্লফ্রেন্ড ছিল। এনিহাও ব্রেকাপ হয়ে গিয়েছে, এখন আমি কি তার জন্য চিরকুমার হয়ে বসে থাকবো? সেটা তো আর সম্ভব না।"

-"আমাদের রিলেশনশিপ টা আজকালকার টিপিক্যাল রিলেশনশিপের মত ছিল না। অন্যরকম ছিল, আমি কখনোই ভুলতে পারবো না ওকে।"

-"এরকম মনেই হয় তিতির। কিন্তু বিয়ের পর সব অন্যরকম হয়ে যায়। সময় সব ঠিক করে দেয়।"

-"কিছুই ঠিক হবেনা, আমি জানি। আপনি কি এটা মেনে নিতে পারবেন যে আপনার স্ত্রী অন্য একজনকে ভালবাসে?"

-"তুমি বয়সেই বড় হয়েছো তিতির বাট স্টিল ইউ টক লাইক আ টিনেজার।"

-"যাই হোক, আমি এক্ষুনি বিয়ে করতে পারবো না। আগে ওর বিয়ে হবে তারপর আমি বিয়ে করবো। ততদিন অপেক্ষা করতে পারবেন?"

-"তোমার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারবো।"

-"প্রথমদিনেই এরকম সিনেমার ডায়ালগ দিচ্ছেন কি করে?"

-"ওয়েল, প্রথম দিন হতে পারে আমাদের দেখা হওয়ার কিন্তু আমি তোমাকে অনেকদিন আগেই দেখেছিলাম। তখন তুমি বোধহয় ভার্সিটিতে পড়ো কেবল। সেদিনই তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছিলাম।"

তিতির আর কথা বাড়ায়নি। শেষে বলেছিল,

-"ঠিকাছে অপেক্ষা করেন। ওর বিয়েটা হয়ে গেলেই আমাদেরটাও হবে।"

-"ওকে আমার কোন তাড়া নেই। আমার শুধু তোমাকে পেলেই হবে।"

কিন্তু আজও তিতির প্রতিটা রাত মুগ্ধর সাথে কথা বলার তৃষ্ণা মেটায় পুরোনো ভয়েস রেকর্ডিং শুনে। আদরের তৃষ্ণা মেটায় পুরোনো আদরের স্মৃতিগুলো রোমন্থন করে। কোনদিন এসব ভেবে খুব ভাল লাগে কোনদিন আবার প্রচন্ড কান্না পায়। কোনদিন মিটিমিটি হাসে, কোনদিন কাঁদে। মাঝেমাঝে ভাবে একটা মিরাকল কি হতে পারে না? এভাবেই কাটছে তিতিরের জীবন।

আর মুগ্ধর প্রতিটি দিন কাটে অফিসের কাজের ব্যস্ততায়। আর রাত কাটে তিতিরকে ভেবে। একমাত্র মুগ্ধর বালিশটাই জানে মুগ্ধর চোখেরও জল গড়ায়। আজও মুগ্ধ অপেক্ষায় আছে তিতিরের।

মুগ্ধ ঘুমিয়ে ছিল। দিনটি শুক্রবার, অফিস নেই তাই বেশিক্ষণ ঘুমানো। হঠাৎ বুকের ভেতর কোন তপ্ত ছোঁয়া অনুভব করতেই চোখ মেলে তাকালো। তাকিয়ে দেখলো তিতির ওর বুকের মধ্যে শুয়ে আছে। মুগ্ধও তিতিরকে আরো ভাল করে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে লাগলো। এ আর নতুন কি! মুগ্ধর প্রতিদিনকার স্বপ্ন। কিন্তু হঠাৎই মনে হলো তাপটা যেন বেশি। আবার চোখ মেলে তাকালো। ঘুমটাকে ঝেড়ে ফেলে আবার তাকালো। এটা তো স্বপ্ন নয়, এটা বাস্তব। প্রচন্ড গরম তিতিরের শরীর। কপালে, গলায় হাত দিল। জ্বরে শরীর পুরে যাচ্ছে তিতিরের। মুগ্ধকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে তিতির হেসে ঘোর লাগা অসুস্থ স্বরে বলল,

-"আমি চলে এসেছি।"

মুগ্ধ বলল,

-"চলে এসেছো মানে? আর এত জ্বর নিয়ে এলেই বা কিভাবে?"

তিতির মুগ্ধর গলাটা জড়িয়ে ধরে জ্বরের ঘোরেই বলল,

-"তোমার এই স্লিপ্পি ভয়েসটা না খুব সেক্সি। কতদিন পর শুনলাম! আমি খাব।"

মুগ্ধ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো তিতিরের দিকে।

প্রেমাতাল - পর্ব ৪৬

মৌরি মরিয়ম

তিতিরের শরীর প্রচন্ড গরম। চোখগুলো লাল হয়ে আছে, অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছে। ও বোধহয় জ্বরের ঘোরে নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে পারেনি তাই চলে এসেছে। জ্বর কমলে, ঘোর কাটলে তো চলেই যাবে। শুধু শুধু মায়া বাড়াতে এল মেয়েটা!

-"এই দাওনা। খাবোতো!"

মুগ্ধর ঘোর কাটলো। বলল,

-"কি দেব?"

-"তোমার ঘুমু ঘুমু ভয়েসটা।"

-"ভয়েস কি খাওয়া যায় পাগলী?"

-"হুম খাওয়া যায়, আচ্ছা তোমাকে দিতে হবে না, আমি নিয়ে নিচ্ছি।"

একথা বলেই তিতির মুগ্ধর গলায় একটা গভীর চুমু খেল। মুগ্ধর চোখদুটো আবেশে বুঁজে গেল। বুকের ভেতরটা কাঁপছে। প্রায় এক বছর পর! ভালবাসা এমন কেন হয় আজ এতবছর পরেও মনে হয় যেন প্রথম স্পর্শ!

কিছুক্ষণ পর তিতির টায়ার্ড হয়ে মুগ্ধকে ছেড়ে বালিশে মাথা রাখলো। মুগ্ধ বলল,

-"একা একা কেন এলে? আমাকে ফোন করতে আমি নিয়ে আসতাম।"

তিতির সেকথার কোন উত্তর না দিয়ে মুগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে ঝুলে বলল,

-"এই আমকে আজকেই বিয়ে করবে?"

-"সে সব পরে হবে, আগে বলো এত জ্বর নিয়ে এলে কেন?"

-"তোমার কাছে না এলে আমার জ্বর কি কোনদিনও ভাল হতো? হতো না, এখন তোমার কাসে এসেছি এক্ষুনি ভাল হয়ে যাব।"

কথাগুলো বেঝে বেঝে যাচ্ছিল। সেই পুরোনো অনুভূতি। বৃষ্টির ফোটাগুলো যেমন একটার উপর একটা পরে লাফালাফি করে তেমনটাই ওর বলা প্রতিটি শব্দ একটার উপর আরেকটা পরে লাফালাফি করছে দুরন্ত বালিকার মত। "র" গুলো শোনাচ্ছে অনেকটা "ল" এর মত। বাচ্চা একটা! মুগ্ধ বলল

-"তুই এত পাগলী কেন রে?"

-"তুমি একটা পাগল যে তাই আমি একটা পাগলী!"

বলেই হিহি করে হেসে দিল তিতির। মুগ্ধর মনে হল এ যেন হাসি নয়, প্রচন্ড গরমের তাপদাহের পর কালবৈশাখীর উন্মাদ হাওয়া! হাসতে হাসতে তিতির পরে যাচ্ছিল। মুগ্ধ দুহাতে তিতিরকে আলিঙ্গন করে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

-"চোখমুখ এত শুকিয়ে গিয়েছে কেন? খাওনা ঠিকমতো?"

-"খাওয়া মজ্জা না।"

-"থাপ্পড় দিব একটা ধরে।"

তিতির আবার হাসলো। মুগ্ধ বলল,

-"সকালেও নিশ্চই কিছু খাওনি।"

-"খেয়েছি তো।"

-"কি খেয়েছো?"

-"তোমার ঘুমু ঘুমু ভয়েস! উম্মম্মম্ম! ইয়াম ইয়াম, মজ্জা মজ্জা!"

মুগ্ধর হাসি পেল। বলল,

-"চুপচাপ শুয়ে থাকো। আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।"

-"নাহ নাহ নাহ, আমি তোমাক্কে খাবো!"

মুগ্ধ এবার না হেসে পারলো না। বলল,

-"আমাকে তো খালি পেটে খেতে পারবে না। আগে কিছু খেয়ে নাও তারপর আমাকে খেয়ো।"

-"ওহ তাই তো। মিষ্টি তো খাওয়ার পরে খেতে হয়।"

-"হুম। তুমি শুয়ে থাকো, আমি আসছি।"

মুগ্ধ উঠে ফ্রেশ হয়ে একটা টি-শার্ট পড়ে রুম থেকে বের হলো। বের হতেই দেখলো স্নিগ্ধ ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছে। মুগ্ধকে দেখেই স্নিগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,

-"ভাইয়া ভাবীর কি অবস্থা? দেখে খুব অসুস্থ লাগছিল।"

-"ওর মারাত্মক জ্বর।"

-"আমারও দেখে সেটাই মনে হচ্ছিল।"

-"আমি দরজা খুলতেই ভাবী বলে, 'স্নিগ্ধ আমি একেবারে চলে এসেছি।' আসল ঘটনা কি ভাইয়া?"

-"আমাকেও তাই বলছে। গড নোজ কি হয়।"

-"বলো কি? ওর ভাই যদি আবার ঝামেলা করে?"

-"করলে করুক, রাস্তার কুকুরদের আমি ভয় পাই না। কিন্তু তিতিরের উপর অত্যাচার করে এটাই আমার ভয়।"

-"সেটাই তো ভাইয়া। আর আম্মুও ঢাকায় নেই এই সময়।"

-"মা যেন কবে আসবে?"

-"পরশু আসার কথা।"

-"আচ্ছা আমি কথা বলে নিচ্ছি মায়ের সাথে। আর পিউ কোথায়?"

-"পরশু আপুর র্যাগ ডে না? এরেঞ্জমেন্ট করছে। কাল রাতে না বলল সকাল সকাল ও বেড়িয়ে যাবে। আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই ও চলে গেছে।"

-"ওহ। আচ্ছা ঠিকাছে।"

-"বুয়া এসে নাস্তা বানিয়ে দিয়ে গেছে। তুমি আর ভাবী খেয়ে নাও।"

-"হুম।"

মুগ্ধ দেখলো ডাইনিং টেবিলে কিছুই নেই। স্নিগ্ধ বলল,

-"নাস্তা রান্নাঘরে বোধহয়।"

মুগ্ধ রান্নাঘরে ঢুকলো। হটপটে রুটি রাখা। পাশেই সবজি আর ডিমের অমলেট। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। কে বলেছে বুয়াকে এত আগে আগে অমলেট করতে। সব পান্তা হয়ে গেছে। মুগ্ধ ঠান্ডা অমলেটগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে দুটো কাঁচা ডিম বের করে পোচ করতে করতেই তিতির চলে এল রান্নাঘরে। পেছন থেকে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরতেই মুগ্ধ চমকে উঠলো। বলল,

-"আরে, তুমি অসুস্থ শরীরে রান্নাঘরে কেন আসলা রে বাবা?"

-"আমি আর তোমাকে ছাড়া আর থাকবো না তাই চলে এসেছি। জানো আমি এতদিন তোমাকে ছাড়া অনেক কষ্টে ছিলাম।"

একথা বলে কেঁদেই ফেলল তিতির। মুগ্ধ চুলা বন্ধ করে পেছনে ফিরে তিতিরের চোখের পানি মুছে দিয়ে জড়িয়ে ধরল। বলল,

-"আমি জানি।"

-"আর আমিও জানি যে তোমারও কতটা কষ্ট হয়েছে।"

মুগ্ধ তিতিরের কপালে চুমু দিয়ে বলল,

-"হয়েছে এবার খেয়ে নাও পাখিটা।"

তিতির মুগ্ধর বুকে কামড় দিতে লাগলো। মুগ্ধ বলল,

-"আরে কামড়াচ্ছো কেন?"

-"তুমি যে খেতে বললা?"

-"আমাকে পরে, আগে রুটি খাও। চলো রুমে চলো।"

তিতির কেবিনেটের উপর উঠে বসলো। তারপর পা ঝোলাতে ঝোলাতে বলল,

-"আমি যাব না। এখানে বসে খাব।"

-"এখানে গরম। রুমে চলো।"

-"আজ আমি কোথাও যাব না-হুমায়ুন আহমেদ স্যারের এই বইটা পড়েছো?"

-"পড়েছিবাবা। চলো তো।"

-"আজ আমি কোথাও যাব না। এখানে বসে খাব নাহলে খাব না।"

অবশেষে মুগ্ধ তিতিরের কথাই মেনে নিল। রান্নাঘরে বসেই তিতিরকে খাইয়ে দিল। তিতির বলল,

-"আমাকে ডিম দিবেনা। জানোনা আমি ডিম খাইনা।"

-"আচ্ছা এই দেখো, শুধু সবজি দিয়েছি।"

তিতির মুখে নিয়ে বলল,

-"এহ সবজিটা একদম মজা হয়নি। পচা পচা পচা। আমি খাবো না।"

-"আরে বাবা, পচা না, তোমার জ্বর তাই মজা লাগছে না।"

-"মা রান্না করলে অন্নেক মজা হয়। দ্মন পচা হয়না। মা কোথায়? মাকে দেখছি না কেন? আমি মায়ের কাছে যাব।"

তিতির নেমে গেল। মুগ্ধ হাত ধরে থামিয়ে বলল,

-"এই শোনো, মা বাসায় নেই কুমিল্লা গিয়েছে।"

-"সেকী! তাহলে আমাদের বিয়ে কি করে হবে?"

-"স্নিগ্ধ গিয়ে নিয়ে আসবে।"

-"আচ্ছা।"

হাসি ফুটলো তিতিরের মুখে। তিতির আবার বসলো। তারপর বলল,

-"এই তুমি না আগে পুরোটা ডিম একবারে মুখে নিয়ে খেতে?"

-"হুম।"

-"এখন খাওনা, আমি দেখবো।"

মুগ্ধ তাই করলো। তিতির হাসতে হাসতে পড়ে যাচ্ছিল। মুগ্ধ ধরে ফেলল আর তিতির মুগ্ধর বুকে মাথা রেখে বলল,

-"তোমার বুকটাতে এত শান্তি কেন?"

-"ভালবাসো যে অনেক তাই।"

-"শুধু সেজন্য নয়।"

-"তাহলে?"

-"তোমার বুকে ম্যাজিক আছে।"

-"ওটা তোমার বুকেও আছে।"

তিতির ওড়না সরিয়ে, জামার ভেতরে তাকিয়ে তাকিয়ে বলল,

-"কই দেখিনা তো।"

-"আমারটা দেখতে পাও?"

-"নাতো।"

-"হুম, কারন... ম্যাজিক অলওয়েজ ইনভিজিবল হয়।"

-"ওহ।"

-"এবার রুমে চলো। তোমার ঘুম দরকার। চোখগুলো লাল হয়ে আছে, মনে হয় সারারাত একফোঁটা ঘুমাওনি। আমার কাছে আসবে বলে শুধু ভোর হওয়ার অপেক্ষা করেছো।"

-"হুম, তুমি মনের কথা বুঝতে পারো। তুমি খুব ভাল।"

-"আচ্ছা, এবার চলো।"

তিতির ওর সেই বিখ্যাত স্টাইলে মুগ্ধর গলা ধরে ঝুলে ঝুলে বলল,

-"তাহলে আমাকে কোলে নাও... কোলে করে নিয়ে চলো রুমে।"

-"আচ্ছা এটুকু কষ্ট করে হেটে চলো। রুমে গিয়ে কোলে নিচ্ছি।"

-"নাহ, আমি হাটতে পারিনা। তোমার কোল মজা।"

-"ওইজন্যই তো রুমে গিয়ে কোলে নিব। ড্রয়িংরুমে স্নিগ্ধ বসে আছে। ওর সামনে কি করে কোলে নেই বলো?"

-"তাহলে কি হয়েছে? ওরও তো শিখতে হবে। ও যদি তোমার মত না হয় তাহলে ওর গার্লফ্রেন্ড কষ্ট পাবে না? ওরও শিখতে হবে কিভাবে গার্লফ্রেন্ড কে কোলে নিতে হয়।"

মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,

-"পাগলামি করেনা বাবা, ও আমার ছোট ভাই না? আমি ওর সামনে এটা করতে পারি?"

-"তাও ঠিক! কিন্তু ওর শিখতে হবে তো।" -"ওর শিখতে হবেনা ও পেকে ঝুনা হয়ে গেছে। আমি এতদিনেও যা করতে পারিনি ও অলরেডি ওর গার্লফ্রেন্ডের সাথে তা করে ফেলেছে।"

-"তুমি কিভাবে জেনেছো? ও তোমাকে বলেছে?"

-"না বলেনি। কিন্তু আমি জানতে পেরেছি।"

-"ওহ। তাহলে হেটেই যাচ্ছি। কিন্তু প্রমিস করো, রুমে গিয়েই কোলে নিবে।"

মুগ্ধ তিতিরের কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,

-"রুমে চলোই না, কোল থেকে নামাবোই না।"

অবশেষে মুগ্ধ বোঝাতে সক্ষম হলো এবং তিতির হেটেই রুমে গেল। রুমে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়েই মুগ্ধ তিতিরকে কোলে নিল। তারপর মুগ্ধ ওকে কোলে নিয়ে রুমের ভেতর হাটতে হাটতে বলল,

-"আমার তিতিরপাখিটার যে এখন একটু ঘুম দরকার।"

-"তাহলে আমাকে কোলে নিয়ে বিছানা পর্যন্ত যাও।"

মুগ্ধ তাই করলো। তিতির বিছানায় শুয়ে বলল,

-"তুমিও শোও আমার সাথে।"

-"শুচ্ছি দাঁডাও, আগে তোমাকে একটা অষুধ খাইয়ে নেই।"

-"ই না। আমি ওষুধ খাবো না, ওষুধ খুব বাজে হয়।"

মুগ্ধ তিতিরের পাশে বসে বলল,

-"না খেলে তোমার সাথে শুবো না।"

-"তুমি খুব পচা। দাও ওষুধ দাও।"

মুগ্ধ ওকে একটা প্যারাসিটামল আর পানি দিল। তিতির বলল,

-"এতবড় অষুধ? খেতে গেলে আমি মরে যাব।"

-"ওকে, আমি ব্যবস্থা করছি।"

মুগ্ধ ওষুধটাকে ভেঙে চার টুকরা করে দিল। তিতির সেগুলো একটা একটা করে খেল। তারপর মন খারাপ করে বলল,

-"জানো বাবা সবসময় বড় ওষুধগুলো আমাকে ভেঙে দিত।"

মুগ্ধ বলল,

-"বাবারা তো এমনই হয়।"

-"কিন্তু আমার বাবা সবচেয়ে ভাল বাবা।"

-"আচ্ছা, ঠিকাছে।"

মুগ্ধ উঠে যাচ্ছিল। তিতির বলল,

-"কোথায় যাও?"

-"আসছি।"

মুগ্ধ এক বালতি পানি নিয়ে এল। যখন তিতিরের মাথায় পানি ঢালছিল তখন তিতির বলে উঠলো,

-"এই তুমি আমার চুল ধুয়ে দিচ্ছো?"

-"হুম।"

-"তুমি কি আমাকে গোসলও করিয়ে দেবে?"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"প্রয়োজনে দেব।"

-"কবে দিবে?"

-"যেদিন প্রয়োজন পড়বে।"

-"কবে প্রয়োজন পড়বে?"

-"তাতো জানিনা।"

মাথায় পানি দেয়া শেষ করে মুগ্ধ নিজের টাওয়াল দিয়ে ভাল করে তিতিরের মাথাটা মুছে দিল। তিতির তো আহ্লাদে আটখানা। তারপর মুগ্ধ যখন টাওয়াল মেলে দিতে বারান্দায় গেল তিতির তখন বলল,

-"আমি তো ওষুধ খেয়েছি। এখন তো শোও।"

-"বালতিটা রেখে এসেই শুচ্ছিরে বাবা।"

মুগ্ধ যখন তিতিরের ডানপাশে শুয়ে পড়লো। তিতির মুগ্ধর গলা ধরে বলল

-"এই তুমি আমাকে বিয়ে করবে না? কিছু তো বললে না।"

-"তোমাকে বিয়ে করার জন্যই তো এতকিছু করলাম। অবশ্যই করবো।"

-"আমি তোমার বুকে ঘুমাবো।"

মুগ্ধ তিতিরকে বুকে টেনে নিল। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মুগ্ধর আসলে টেনশন হচ্ছিল। তিতির যখন সুস্থ হবে তখন তো চলে যাবে, কিছুই করতে পারবেনা মুগ্ধ। এতদিন ওকে ছেড়ে থাকার একটা অভ্যাস তৈরি হয়েছিল যা আজ ভেঙে দিল। এবার ও যখন চলে যাবে ভেতর থেকে কলিজাটা ছিঁড়ে নিয়ে যাবে। কেন এল ও? কিছুক্ষণ পর তিতির মাথা উঠিয়ে বলল,

-"শোনো আমরা কখন বিয়ে করবো আজকে সন্ধ্যায় নাকি আজকে রাত্রে?"

-"ঘুমিয়ে ওঠো আগে। ওষুধ খেয়েছো তো জ্বর কমে যাবে, তখন বলবো।"

-"না এক্ষুনি বলতে হবে।"

-"না এখন ঘুমাতে হবে।"

তিতির মুগ্ধকে অবাক করে দিয়ে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-"তুমি আসলে আমাকে বিয়েই করতে চাওনা। আমি বুচ্ছি এবার। এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ।"

-"আরে পাগলী! না না একথা কে বলল?"

-"আমি সব ছেড়ে সারাজীবনের জন্য চলে এলাম আর এখন তুমি বলছো বিয়ে করবে না! এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ।"

মুগ্ধ তিতিরকে খুব নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,

-"না বাবা, আমি সত্যি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তোমাকে বিয়ে করার জন্যই তো কত কষ্ট করলাম, বোঝোনা তুমি? কিন্তু তুমি সুস্থ না হলে বিয়ে কি করে করবো বলো? আর মায়েরও তো আসতে হবে। তুমি একটু ঘুমিয়ে ওঠো তারপর এগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।"

-"ওহ, আচ্ছা।"

-"এইতো আমার লক্ষীটা। একটু অবুঝ হলেও বোঝালে সব বোঝে।"

তিতির একটা বিশ্বজয় করার হাসি দিল। তারপর মুগ্ধ তিতিরের মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রইলো। তিতিরের জ্বর মনে হচ্ছে আরো বাড়ছে। মুগ্ধর বুকটা প্রায় সেদ্ধ হয়ে গেছে। প্রচন্ড গরম! তবু খুব শান্তি লাগছে মুগ্ধর। পরম শান্তি! অনেকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকার পর মুগ্ধ যখন ভাবলো তিতির ঘুমিয়ে পড়েছে তখনই তিতির মাথা উঠিয়ে বলল,

-"এই দেখোনা, আমার ঠোঁট ফেটে কি হয়েছে!"

মুগ্ধ বুঝলো তিতির কি চাইছে। কোন কথা না বলে আস্তে করে তিতিরকে উপরে উঠিয়ে ঠোঁটে আলতো চুমু খেল।

দুপুরবেলা তিতির ঘুম থেকে উঠলো। ওর এখন জ্বর নেই। রুমে একা শুয়ে আছে। যতদূর মনে পড়ে ও মুগ্ধর সাথে শুয়েছিল। মুগ্ধ কোথায় গেল! ঘর থেকে বের হয়ে কাউকে দেখতে পেল না। রান্নাঘরে যেতেই দেখলো মুগ্ধ রান্না করছে, পিউ হেল্প করছে। তিতিরকে দেখতে পেয়েই পিউ এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো।বলল,

-"ভাবী!"

তিতিরও পিউকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-"কেমন আছো?"

-"যেমন তেমন ছিলাম গো! তোমাকে দেখে খুশিতে লাফাতে ইচ্ছে করছে।"

তিতির পিউয়ের গালে একটা চুমু দিল। পিউ বলল,

-"ভাবী! সত্যি চলে এসেছো? পার্মানেন্টলি?"

-"হ্যা।"

মুগ্ধ তাকালো তিতিরের দিকে। তিতিরও তাকিয়েছিল। চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নিল তিতির। পিউ তিতিরের কপালে হাত দিয়ে ভাইয়ের দিকে ফিরে বলল,

-"ভাইয়া, ভাবীর কিন্তু এখন জ্বর নেই।"

মুগ্ধ বলল,

-"এখন তাহলে ওর কথা গ্রহণযোগ্যতা পাবে।"

তিতির মিটিমিটি হাসতে লাগলো। পিউ বলল,

-"ভাইয়া তোর আর কিছু লাগবে?"

-"না, রান্না অলমোস্ট কম্পলিট।"

-"আমি তাহলে গোসলে যাই।"

-"আচ্ছা, যা।"

পিউ রান্নাঘর থেকে বের হয়ে যেতেই তিতির মুগ্ধর পাশে এসে দাঁড়ালো। মুগ্ধ তিতিরের কপালে হাত দিয়ে বলল,

-"বাহ, জ্বর নেই দেখছি। কয়দিন ধরে জ্বর তোমার?"

-"চারদিন।"

-"এতদিনের ওষুধগুলো কি আগের মত ফুলের টবে গিয়েছে?"

-"হ্যা।"

-"ঠিক হয়নি। ওষুধ খেলে আরো আগে সুস্থ হয়ে যেতে।"

-"ওষুধ ভেঙে দেয়ার কেউ ছিলনা।"

-"বাবা?"

-"বাবা ছিল, কিন্তু দেয়নি। হয়তো ভেবেছে আমি বড় হয়েছি, এখন খেতে পারবো।"

মুগ্ধর রান্নাটা ততক্ষণে পুরোপুরি শেষ। চুলা বন্ধ করে হাত থেকে গ্লাভস খুলে রাখলো। তারপর আচমকা তিতিরের হাত ধরে একটানে বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তিতিরও ধরলো। এতক্ষণে মুগ্ধর মনে হলো তিতিরকে ও পেয়েছে! কারন, তিতির এখন স্বজ্ঞানে। মুগ্ধ ওই অবস্থাতেই তিতিরকে জিজ্ঞেস করলো,

-"তুমি কি সত্যি সত্যি চলে এসেছো তিতির?"

-"হ্যা, সত্যি এসেছি।"

-"আর যাবে না তো?"

-"নাহ। মরে গেলেও আর যাব না।"

-"বাসায় কি বলে বেড়িয়েছো?"

-"কিছুনা। শুধু একটা মেসেজ করে দিয়েছি ভাইয়াকে।"

-"কি লিখেছো?"

-"লিখেছি আমি মুগ্ধর কাছে চলে যাচ্ছি। আজ আমরা বিয়ে করবো।"

-"তান্না কি রিপ্লে দিয়েছে?"

-"ভাইয়া লিখেছে, আর কোনদিনও ফিরে আসবি না। আমার বোন একটু আগের মেসেজটা দেয়ার সাথে সাথে মারা গেছে। বাবা-মাও মেসেজটা দেখে বলেছে তাদের মেয়ে মৃত।"

-"তারপর?"

-"আমি আর কোন রিপ্লে দেইনি।"

-"এই মেসেজ কখন দিয়েছো?"

-"সকালে।"

মুগ্ধ এবার তিতিরকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুহাতে ওর মুখটা তুলে চোখে চোখ রেখে বলল,

-"কিকরে আসতে পারলে বলোত? ভয় করেনি?"

-"নাহ, শুধু খারাপ লেগেছে। কি করবো যতকিছুই করিনা কেন এখন আর তাদের খুশি করতে পারিনা। অন্যদিকে তোমাকে ছেড়েও থাকতে আর পারছিলাম না। তাই শেষমেশ তোমার কথাই মেনে নিলাম যে বিয়ের পর একদিন না একদিন মেনে নেবে।"

-"আমি জানতাম তুমি আসবে। আমার ভালবাসার উপর এটুকু বিশ্বাস আমার ছিল। আর এজন্যই আমি তোমার সাথে সেদিন ওরকম নিষ্ঠুর আচরণ করেছিলাম। সেদিনের জন্য আমাকে তুমি মাফ করে দিও তিতিরপাখি।"

-"হুম। আমি পরে সেটা বুঝেছিলাম।"

-"সেদিনের ব্যবহারের জন্য রাগ নেই তো?"

-"নাহ। তোমার যদি আদর করার অধিকার থাকে তো রাগ, শাসন এবং খারাপ ব্যবহার করার অধিকারও আছে। সেদিন খুব কষ্ট পেলেও পরে বুঝেছিলাম আমি।"

মুগ্ধ তিতিরের কপালে চুমু দিয়ে বলল,

-"আজ আমার জীবন সার্থক।"

-"এবার বলো কবে বিয়ে করবো?"

-"কাল।"

-"কাল কেন? আজই বিয়ে করবো আমি। কাল হয়ে গেলে আর বিয়ে করবো না।"

-"কেন?"

-"কি থেকে কি হয়ে যায় ঠিক নেই।"

-"তাহলে তো মোটেও তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করাটা ঠিক হবে না। কখনো যেন তোমার মনে না হয় যে তুমি এভাবে চলে এসে হুট করে বিয়ে করে ভুল করেছো। আজ সারারাত চিন্তা করো আর তোমার ফ্যামিলি কি একশন নেয় দেখো। তাছাড়া, মাকে ছাড়া শুধু আমি তুমিই তো বিয়ে করতে পারবো না। আজ স্নিগ্ধকে পাঠাচ্ছি মাকে নিয়ে আসার জন্য। কাল এলেই বিকেলে আমরা বিয়ে করবো। ঠিকাছে?"

-"ওহ, মা কোথায় গিয়েছে?"

মুগ্ধ মনে মনে হাসলো। একবার বলা স্বত্তেও ভুলে গেছে তিতির। জ্বরের ঘোরে ছিল কিনা। নিশ্চই তখনকার অনেক কথাই ভুলে গিয়েছে। বলল,

-"কুমিল্লা গিয়েছে।"

-"ওহ। আচ্ছা ঠিকাছে। তাহলে কালই।"

লাঞ্চের পর পিউ আর তিতির বিয়ে নিয়ে টুকটাক প্ল্যানিং করছিল। বিকেলেই স্নিগ্ধ রওনা দিয়ে দিল কুমিল্লার উদ্দেশ্যে। তারপর পিউ বলল,

-"ভাইয়া আমার একটু বেরোতে হবে।"

-"কোথায় যাবি আবার।"

-"উফ ভাইয়া আমি তো বড় হয়েছি না? আমার অনেক পারসোনাল কাজ থাকতে পারে।"

-"ওহ, আচ্ছা আচ্ছা যাহ।"

পিউ চলে যাওয়ার পর মুগ্ধ তিতিরকে বলল,

-"তোমার ননদ তো আমাদের প্রেম করার সুযোগ করে দিয়ে গেল। কিন্তু অসুস্থ মানুষের সাথে কি প্রেম করবো আমি?"

-"কই এখন তো আর আমি অসুস্থ না।"

-"তাই না?"

মুগ্ধ হঠাৎ তিতিরকে কোলে তুলে হাটা শুরু করলো। প্রায় পুরো ফ্ল্যাট চক্কর দেয়া শেষ। তখন তিতির জিজ্ঞেস করলো,

-"কি হলো তোমার? কোলে নিয়ে ঘুরাঘুরি করছো যে?"

-"সেকি! তুমিইনা সকালবেলা কোলে ওঠার জন্য লাফাচ্ছিলে?"

তিতির তো আকাশ থেকে পড়লো,

-"ইশ! কখন?"

-"হ্যা, এখন তো অস্বীকার করবেই।"

সকালবেলা যা যা হয়েছে সবটা মুগ্ধ ডিটেইলে বলল তিতিরকে। স্নিগ্ধর সামনে কোলে উঠতে চেয়েছে, স্নিগ্ধকে শেখাতে চেয়েছে সেটা শুনে তো তিতির লজ্জায়ই মরে যাচ্ছিল। মুগ্ধ দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,

-"সুন্দরী, এগুলো ঘোরে তোমার মনে, না?"

প্রেমাতাল - পর্ব ৪৭

মৌরি মরিয়ম

পুরোটা বিকেল ওরা বারান্দায় কফির মগ হাতে গল্প করে কাটিয়ে দিল। বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে গল্প। খুব সিরিয়াস টাইপের গল্প। প্রায় এক বছর কে কিভাবে কাটিয়েছে, কার জীবনে কি হয়েছে সেসব গল্প। তিতির মুগ্ধকে সুহাসের কথাটা সব খুলে বলততেই মুগ্ধ খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেল। বলল,

-"তার মানে তো বিয়ে পুরো ঠিকই হয়ে গিয়েছিল। তুমি যেভাবে চলে এসেছো, ছেলেটা কিভাবে নেবে ব্যাপারটা কে জানে।"

-"যেভাবে মন চায় সেভাবে নিক। আমি তো আর ওর সাথে প্রেম করিনি। ফ্যামিলি ঠিক করেছে।"

-"এলেই যখন বিয়েটা ঠিক হওয়ার আগেই আসতে।"

-"কেন তোমার কি কোন প্রব্লেম হচ্ছে? হলে বলো আমি এক্ষুনি চলে যাব।"

মুগ্ধ তিতিরের ডানপাশে বসে ছিল। ডানহাতটা দিয়ে তিতিরকে টেনে বুকে নিয়ে বলল,

-"আরে পাগলী, তা বললাম কখন? জাস্ট এটাই বলতে চাচ্ছি এখন তোমার ফ্যামিলি বলবে তুমি তাদের মুখ পুড়িয়েছো।"

-"যা মন চায় বলুক, এখন আর আমি কিছুতেই কেয়ার করি না। বিয়েটা দু'মাস আগে ঠিক হয়েছে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর আমি আরো ভাল করে বুঝলাম যে তুমি ছাড়া অন্য কাউকেই আমার ভাল লাগবে না। মন বসবেনা কারো প্রতি।অন্যকারো হয়ে থাকার চেয়ে সারাজীবন একা থাকাটা অনেক সহজ।"

-"আচ্ছা, আচ্ছা বাদ দাও। যা হয়েছে হয়েছে। তুমি যে ফাইনালি এসেছো এটাই সবচেয়ে বড় কথা।"

তিতির মুগ্ধর বুকে মাথা রাখলো। মুগ্ধ বলল,

-"তোমার জ্বরটা আবার আস্তে আস্তে আসছে মনে হচ্ছে।"

-"আসুক।"

-"ডাক্তার দেখিছিলে?"

-"না।"

-"৪/৫ দিন ধরে এত জ্বর আর তুমি ডাক্তার দেখাওনি?"

-"না।"

-"অফিসে গিয়েছো?"

-"যেদিন জ্বর এসেছিল সেদিন গিয়েছিলাম, পরে আর যেতে পারিনি।"

-"ও।"

-"আচ্ছা তিতির এখন যদি তোমার ফ্যামিলির কেউ তোমাকে নিতে আসে?"

-"আমি যাব না।"

-"সত্যি তো?"

-"১০০%।"

-"তিতির, কষ্ট পেও না। দেখো আমাদের বিয়ের পর তোমার বাবা-মা একদিন না একদিন মেনে নেবে।"

-"সত্যি মানবে তো?"

-"হুম মানবে, যখন আমাদের একটা বেবি হবে, তখন বেবিটাকে দেখলেই গলে যাবে।"

-"যদি না মানে?"

-"আরে মানবে মানবে। প্রত্যেকেরই নাতি-নাতনীর প্রতি অন্যরকম ভালবাসা থাকে। মুখ দেখলে দুনিয়া ভুলে যায়। আর কাজটা খুব দ্রুত করে ফেলবো বুঝলে। তান্নার বেবি হওয়ার আগে আমাদের টা হলে ভাল হয়।"

-"যদি ভাইয়ার আগে হয়?"

-"প্রব্লেম নেই তো। আমাদের আগে হলে ভাল, পরে হলেও ক্ষতি নেই। কেন তোমার ভাবী কি প্রেগন্যান্ট নাকি?"

-"নাহ।"

-"তাহলে তো হলোই, কাল আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে। একদম নগদ নগদ আমি তোমাকে প্রেগন্যান্ট করে দেব। ওনলি আদর আর আদর। নো প্রটেকশন!"

-"ধ্যাত!"

লজ্জা পেয়ে তিতির উঠে দৌড় দিল। মুগ্ধ গেল পেছন পেছন। মুগ্ধ তিতিরকে ধরে ফেলতেই তিতির নিজেকে ছোটাতে চাইছিল। দুজনেই হাসছে, ধস্তাধস্তি তুমুল পর্যায়ে এমন সময় কলিং বেল বাজলো। মুগ্ধ ছেড়ে দিল ওকে। বলল,

-"যাও তোমার ননদ চলে এসেছে। বেঁচে গেলে।"

তিতির দরজা খুলেই হা হয়ে গেল। ইকরা দাঁড়িয়ে আছে। ইকরার সাথে ওর প্রথম দেখা হয়েছিল মুগ্ধর এক জন্মদিনে। তারপর আরো কয়েকবার দেখা হয়েছে মুগ্ধদের বাসায়, অনেক আগে যখন ওদের সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল। এমনিতে ইকরা যেমনই হোক, খুব মিশুক। যতবার ওদের দেখা হয়েছে ততবারই হাত ধরে 'তুমি খুব লাকি' 'জাদু জানো নাকি? নাহলে মুগ্ধ ভাইয়ার মত মানুষ গলে যায়!' এই টাইপের কথাবার্তা বলেছে ইকরা। আর প্রতিবারই তিতির ওকে অবাক চোখে দেখেছে আর ভেবেছে একটা মানুষ এত সুন্দর হয় কি করে!

ইকরা বলল,

-"ভেতরে ঢুকতে দেবে না?"

তিতির হেসে বলল,

-"হ্যা হ্যা এসো।"

ইকরা আর তিতির ড্রইংরুমে বসলো। ততক্ষণে মুগ্ধ রুম থেকে বেড়িয়ে এসেছে। ইকরাকে দেখেই ওর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কিছু বলল না। তিতির বলল,

-"ইকরা আপু তোমাকে কফি দেই?"

ইকরা হেসে বলল,

-"না না, আমি এখন কিছু খাব না। তুমি কখন এলে?"

তিতির বলল,

-"আজ সকালে এসেছি।"

-"তিতির তুমি কি অসুস্থ? তোমাকে কেমন যেন লাগছে।"

-"হ্যা আপু, একটু জ্বর ছিল।"

ইকরা তিতিরের কপালে হাত দিয়ে বলল,

-"জ্বর তো এখনো আছে। ওষুধ খেয়েছো?"

-"হ্যা খেয়েছি।"

এতক্ষণে মুগ্ধ কথা বলল,

-"তুই হঠাৎ এখানে?"

ইকরা বলল,

-"এমনি তোদের খোঁজ নিতে এলাম, মামী নেই তার মধ্যে তোরা কেমন আছিস সেটা জানার জন্যই।"

-"তোর মামী তো আজ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে নেই, খোঁজ নেয়ার কথা আজ মনে পড়লো?"

-"আমি প্রতিদিনই বাসায় এসে খোঁজ নিই। তুই থাকিস অফিসে জানবি কি করে?"

-"ওহ, ভেরিগুড!"

-"আর কাউকে দেখছিনা। বাসায় কি তোরা দুজনই?"

-"হ্যা, আমরা দুজনই। কোন প্রব্লেম?"

-"নাহ, আমার কি প্রব্লেম।"

-"দেন ইউ ক্যান গো নাও, আমরা একটু বিজি ছিলাম।"

ইকরা চোখমুখ শক্ত করে উঠে চলে গেল। মুগ্ধ গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিল। এতক্ষণ তিতির কথা বলছিল না। এবার বলল,

-"এভাবে না বললেও পারতে।"

-"প্লিজ তুমি এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলো না তো। আমি শিওর ও কোন না কোন ভাবে জেনেছে যে স্নিগ্ধ, পিউ কেউ বাসায় নেই আর তুমিও এসেছো। তাই স্পাইগিরি করতে এসেছে আমরা কি করছি না করছি সেটা নিয়ে।"

-"কিন্তু ও কিভাবে জানবে?"

-"জানার ইচ্ছে থাকলে অনেকভাবে জানা যায়। ও যদি না জেনে আসতো তাহলে তোমাকে দেখে অবাক হতো। কিন্তু ও অবাক হয়নি।"

-"ওহ, তাই তো।"

মুগ্ধ এবার তিতিরের কপালে হাত দিয়ে বলল,

-"তোমার জ্বর একটু একটু করে বাড়ছে। আমার মনে হয় ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ।"

-"ধুর, আমি যাবনা। তোমার কাছে এসেছি এখন আমার জ্বর এমনিতেই চলে যাবে।"

-"তুমি জেদ করছো কেন?"

তিতির কোন উত্তর না দিয়ে মুগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলল,

-"তোমার চেয়ে বড় ওষুধ দুনিয়ায় আর নেই। আমি বাসায় বিছানা থেকেও নামতে পারছিলাম না আর তোমার কাছে এসে আমি দৌড়াদৌড়ি করছি। তুমি পাশে থাকলে আমার কোন ডাক্তার লাগবে না। আমি এমনিতেই ভাল হয়ে যাব।"

মুগ্ধ তিতিরকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিল। তারপর ওর মাথার কাছে বসে বলল,

-"রেস্ট নাও তাহলে।"

-"আচ্ছা।"

মুগ্ধ তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তিতির বলল,

-"ইকরাকে দেখলে আমার কি মনে হয় জানো?"

-"কি?"

-"মনে হয় একটা মানুষ এত সুন্দর হয় কিভাবে? আমি চোখ ফেরাতে পারিনা জানো?"

-"তিতির, তুমি ওর থেকে অনেক বেশী সুন্দরী ছিলে। আমাদের আলাদা হওয়ার পর থেকে তোমার উপর দিয়ে যেসব ঝড় গিয়েছে তার প্রভাবে তোমার চেহারা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমাদের বিয়ের পর দেখবে আবার ঠিক হয়ে গিয়েছে।"

-"আমি আগে সুন্দর ছিলাম একথা ঠিক কিন্তু ওর মত সুন্দর তো ছিলাম না। ওর চোখ, চুল, স্কিন, ঠোঁট সবকিছু এত সুন্দর! আর কি স্লিম ফিগার মাশাল্লাহ।"

-"কি যে বলো তুমি! ওর চোখগুলো তো মাছের মত ছোট ছোট। আর চুল! ডেইলি চুলের মধ্যে কত কি লাগিয়ে বসে থাকে জানো? আর দুদিন পরপর বিউটি পার্লারে যায়। আর স্কিন? স্কিন কোত্থেকে দেখলে বুঝলাম না সব তো আধ ইঞ্চি মেকাপে ঢাকা থাকে অলওয়েজ। আর ঠোঁট! জঘন্য টেস্ট, খালি দেখতে ভাল হলে তো হবে না। আর ফিগার! কি বলবো তিতির, ওই পিচ্চি পিচ্চি.. না মানে এলসিডি টাইপ ফিগার আমার ভাল লাগে না। আমার তোমার মত ফিগার ভাল লাগে। আর শুধু আমি কেন বাংলাদেশের সব ছেলেরাই জানে মেয়েদের 32 ফিগারের চেয়ে 36 কতটা বেটার। কেন সেটা আর নাইবা বলি।"

তিতির লজ্জা পেয়ে মুগ্ধকে মারতে লাগলো। মুগ্ধ হাসতে হাসতে বলল,

-"আরে আমাকে কেন মারছো?"

-"মুখে লাগাম নেই কেন?"

-"এটা তো আমার জন্মগত স্বভাব।"

তিতির থেমে গেল। তারপর সিরিয়াস হয়ে বলল,

-"একটা কথা জিজ্ঞেস করি? রাগ করবে না তো?"

-"না না বলো না?"

-"তুমি যে বললে ইকরার ঠোঁটের টেস্ট খারাপ! তুমি কি টেস্ট করেছো নাকি?"

মুগ্ধ একথা শুনে একটা দীর্ঘস্বাস ফেলে বলল,

-"আমার লাইফের ফার্স্ট লিপকিস ওর সাথেই।"

ম্যাজিকের মত এই কথাটা শোনার সাথে সাথেই তিতিরের চোখ জলে ভরে যায়। ও ইকরার সাথে যত ভাল ব্যবহারই করুক না কেন ও মনে মনে তো ইকরা কে অপছন্দই করে। ব্যাপারটা খেয়াল করে মুগ্ধ একটা হাত তিতিরের গালে রেখে বলল,

-"কষ্ট পেওনা তিতির।"

-"নাহ, কষ্ট পাচ্ছি না তুমি বলো?"

-"ছোটবেলায় ওর সাথে আমার সম্পর্কটা খুব ভাল ছিল। ওরা তো ঢাকাতেই থাকতো। ছুটিতে কুমিল্লা যাওয়ার আগে চিটাগাং যেত ওরা। তখন আমরা অনেক মজা করতাম। একসাথে খেলতাম, ঘুরতাম আরো কত যে মজা করতাম। কাজিনরা যেমন হয় আরকি! তখন আমি ছোট, এসএসসি দিব। ও বোধহয় সিক্সে পড়ে এক্সাক্টলি মনে নেই। তখন একদিন বিকালে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, ও এসে আমাকে কিস করে। ঘুমের ভেতর ছিলাম তো, আমিও করেছি। কিছুক্ষণ পরেই ঘুম ভেঙে যায় এবং কতক্ষণ সময় লাগে বুঝতে যে কি হচ্ছে! যখন বুঝলাম তখন আমি ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিই। আমার লাইফের জঘন্যতম এক্সপেরিয়েন্স। তারপর থেকে আমি কাউকে কিস করার কথা ভাবতেই পারতাম না। পরে তো বড় হতে হতে আসল ব্যাপারটা বুঝেছি।"

তিতির নীরবে কাঁদছে। মুগ্ধ ওকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতেই টের পেল তিতিরের জ্বর বেড়েই চলেছে। পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

-"কেঁদোনা প্লিজ। আমি তো ইচ্ছে করে করিনি। ওর প্রতি আমার কোন ফিলিংসই নেই। ভার্সিটির ট্যুরে কক্সবাজারে গিয়ে কি হয়েছিল তা তো তুমি জানো! ওকে ওভাবে দেখেও আমার মধ্যে কিছুই হয়নি।"

তিতির এতক্ষণ চুপচাপ কাঁদছিল। এবার ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করে দিল। মুগ্ধ থামানোর চেষ্টা করছিল। ওদিকে তিতির ওকে আঁকড়ে ধরে বলছে,

-"তোমাকে আমি কাউকে দেবনা। তুমি শুধু আমার। তোমার দিকে কাউকে তাকাতেও দেবনা আমি। খুন করে ফেলবো।"

-"আচ্ছা তোমার যা ইচ্ছে হয় করো।"

তিতির ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-"ইকরার কত বড় সাহস ও তোমাকে টাচ করে! ওর হাত কেটে টুকরো টুকরো করে মালা বানিয়ে ওর গলায় ঝুলিয়ে দেব। বদমাইশ মেয়ে কোথাকার।"

-"সেজন্যই তো সহ্য করতে পারিনা ওকে। দেখোনা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি।"

তিতিরের কান্না থামছেই না। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,

-"শয়তান মেয়েটার এতবড় সাহস ও তোমার ঠোঁটে কিস করেছে? ওর ঠোঁট কেটে কুচিকুচি করে দোপেঁয়াজা করে আমি কুকুরকে খাওয়াবো।"

তিতিরের এধরণের কথায় মুগ্ধর হাসার কথা। কিন্তু হাসতে পারলো না। উল্টো খুব খারাপ লাগতে লাগলো তিতিরের এমন কান্না দেখে। কতটা ভালবাসে তিতির ওকে। অথচ তিতির এভাবে চলে না এলে তো সারাজীবন আলাদাই থাকতে হতো। ওর চোখ মুছে দিয়ে মুগ্ধ বলল,

-"কেঁদোনা, প্লিজ এমনিতেই তুমি আমার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছো। আমার অনেক খারাপ লাগছে। দেখো, আমি তোমার সব কষ্ট দূর করে দেব। তোমাকে আনেক অনেক সুখে রাখবো।"

তিতির হঠাৎ মুগ্ধর বুক থেকে উঠে সোজা হয়ে বসলো। তখনও কাঁদছিল। তারপর নিজের হাত দিয়ে মুগ্ধর ঠোঁট মুছে দিতে দিতে বলল,

-"ইকরা আমার সম্পত্তিতে কেন হাত দিল? কেন কিস করলো এই ঠোঁটে? ওকে মেরে ফেলবো আমি।"

তারপর ওর ওড়না দিয়ে মুগ্ধর ঠোঁট মুছতে লাগলো। মুছতে মুছতে বলছিল,

-"ইকরাকে আমি মেরে ফেলবো, মেরে ফেলবো।"

তিতিরের চোখে তখন অঝর শ্রাবন! মুগ্ধর বুকটা ফেটে যাচ্ছে।

প্রেমাতাল - সকল পর্ব

To be continued...

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url