প্রেমাতাল - পর্ব 40+41+42+43 । মৌরি মরিয়ম

প্রেমাতাল

(মৌরি মরিয়ম)

Prematal
This Photo is from Pexels


প্রেমাতাল - পর্ব ৪১

মৌরি মরিয়ম

সকাল সকাল গাড়ি ছুটে চলেছে গোয়াইনঘাটের পথে। শহর ছেড়েছে অনেকক্ষণ। গোয়াইনঘাট থেকে নৌকায় করে যাবে বিছনাকান্দি। মুগ্ধ ড্রাইভ করতে করতে বলল,

-"একটা সুপুরুষ ছেলের সাথে কিস করতে করতে একটা মেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে আমি আগে জানতাম না। তাও আবার দাঁড়ানো অবস্থায়!"

তিতির মন খারাপ করে বলল,

-"আর কত পচাবে?"

-"আজীবন পচাব, আজীবন খোঁটা দিব। কি করে পারলা ওই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়তে? আর তারপর এত ডাকলাম উঠলেই না।"

-"কখনোই এত ডাকোনি। হয়তো একটা ডাক দিয়েছো, আমি উঠিনি তাই আর ডাকোনি।"

-"আজ্ঞে না ম্যাম, আমি আপনাকে কম হলেও ৪/৫ বার ডেকেছি।"

-"ইশ না।"

-"এখন এই কথা বললে একটা গাড্ডা দিব মাথার মধ্যে।"

-"সরি।"

-"এখন সরি বলে কি হবে? ২ রাত থাকবো তার মধ্যে একটা চলেই গেল।"

-"আমি কি ইচ্ছে করে ঘুমিয়েছি বলো?"

-"কি জানি!"

-"মানে কি? তুমি ভাবছো আমি ইচ্ছে করে ঘুমিয়েছি?"

তিতিরের অপরাধবোধ দেখে মুগ্ধর খুব মজা লাগছিল। ওকে আরো তাতানোর জন্য বলল,

-"হতেও পারে।"

-"নাহ, বিশ্বাস করো। কখন ঘুমিয়েছি টেরই পাইনি।"

-"ভাল করেছ।"

-"আমি সত্যি সরি। আমাকে মাফ করে দাও।"

মুগ্ধ অভিমানী কন্ঠে বলল,

-"এখন এগুলো বলে লাভ নেই। সারারাত আমার একা একা অনেক কষ্ট হয়েছে। ঘুমই আসছিল না। তারপর ভোরের দিকে ঘুমিয়েছি।"

তিতির নিজের কান ধরে বলল,

-"এই দেখো কান ধরছি। এবার তো মাফ করো।"

মুগ্ধ ভাব ধরে বলল,

-"ঠিকাছে ঠিকাছে। কান ধরতে হবে না।"

-"আমি আজ রাতে এক মিনিটের জন্য ঘুমাবো না।"

-"এহ, জোকস অফ দ্যা ইয়ার।"

-"সত্যি।"

প্রেমাতাল - সকল পর্ব

মুগ্ধ এবার হাসি হাসি মুখ করে বলল,

-"তোহ, সারারাত জেগে কি করবে?"

তিতির এবার লজ্জা পেল। কিন্তু ওর কথার অর্থ না বোঝার ভান করে বলল,

-"কি আর করবো? যা করি তাই করবো! ওই মানে গল্পগুজব আর কি! আর ঘুমালে তুমি ঘুমানোর পর ঘুমাবো।"

মুগ্ধ এতক্ষণ পর হেসে দিল। তিতিরের বুকের ভার নেমে গেল। বুঝতে পারলো মুগ্ধ আসলে রাগ করেনি দুষ্টুমি করছিল। কিন্তু রাগ করার মতই একটা ঘটনা ঘটেছে। গতরাতে কিস করতে করতেই কি করে যে ঘুমিয়ে পড়লো। ইশ এত সফটলি আদর করছিল মুগ্ধ, আরামেই ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। দোষ কি তাহলে ওর? তিতির যখন এসব ভাবছিল মুগ্ধ তখন বলল,

-"দেখা যাবে বাসর রাতেও তুমি নাক ডেকে ঘুমাবে। আর আমি বসে বসে মশা মারবো।"

একথায় তিতির চমকে তাকালো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধরও খেয়াল হলো, যেখানে ওদের বিয়েই হবে না সেখানে এসব কি নিয়ে ভাবছে মুগ্ধ! দুজনেই চুপ হয়ে গেল। কেউ এই বিষয়ে আর কোন কথা বলল না।

দুপাশে জমি মাঝখানে রাস্তা। জমির কোথাও কোথাও বৃষ্টির কারনে পানি উঠে গেছে। হঠাৎ গাড়ি থামালো মুগ্ধ। তিতির বলল,

-"কি হলো?"

-"তরমুজ খাব।"

তিতিরের নজরে পড়লো রাস্তা দিয়ে একটা তরমুজের ভ্যান যাচ্ছে। মুগ্ধ নেমে দুটো তরমুজ কিনে আনলো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল,

-"তোমার না তরমুজ প্রিয়?"

-"হুম। তোমারও তো প্রিয়।"

-"সেজন্যই নিলাম।"

-"হ্যা কিন্তু কেটে আনলে না কেন? কাটবো কি করে?"

-"তরমুজ আবার কাটা লাগে নাকি?"

-"তো খাব কি করে?"

-"যখন খাব তখনই দেখো।"

কিছুদূর গিয়ে মুগ্ধ একটা কালভারটের সামনে গাড়ি থামালো। তারপর তিতিরকে বললো,

-"নামো।"

''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন

তিতির নামলো। মুগ্ধ একটা তরমুজ নিয়ে নামলো। তারপর কালভারটের পাথুরে ফুটপাতের সাথে বারি দিতেই তরমুজটা ফেটে গেল। আরেকবার বারি দিতেই তরমুজটা ভেঙে কয়েকটা অসমান টুকরা হয়ে গেল। তিতির হেসে দিল।

তিতির পড়ে ছিল থ্রি-কোয়ার্টার আর শার্ট। মুগ্ধ পড়ে ছিল হাফ প্যান্ট আর টি-শার্ট। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওরা যখন ভাঙা তরমুজ কামড়ে কামড়ে খাচ্ছিল লোকজন যেতে যেতে হা করে দেখছিল। তিতির বলল,

-"উম্মম্মম্মম্ম, তরমুজটা অন্নেক মিষ্টি।"

-"হুম। কালো তরমুজগুলো মিষ্টিই হয়।"

-"এই, দেখো এরকমভাবে তরমুজ খেয়ে আমার হাতমুখ পুরো মেখে গেছে।"

মুগ্ধ হাসলো। তিতির বলল,

-"হাসছো কেন?"

-"এমনি।"

-"এমনি না, এমন দুষ্টুমার্কা হাসি তুমি তখনই দাও যখন তোমার মাথায় কোনো দুষ্টুমি ঘুরতে থাকে।"

মুগ্ধ হাসি হাসি মুখ করেই বলল,

-"আচ্ছ, তারাতারি খেয়ে শেষ করো। রওনা হতে হবে।"

-"বলো না কেন হাসলে?"

-"পরে বলছি বাবা। একটু পরে বলি?"

-"আচ্ছা।"

তরমুজ খাওয়া শেষ হতেই আবার দুজনে গাড়িতে উঠলো। মুগ্ধ গাড়ি স্টার্ট দিল। তিতির বলল,

-"ইশ তরমুজের রস লেগে মুখ, গাল আর হাতগুলো কেমন আঠা আঠা মিষ্টি মিষ্টি হয়ে আছে! তোমারও এমন হয়েছে?"

-"কই না তো। দেখো তুমি।"

-"আসলেই তোমার এরকম হলো না কেন?"

-"আমি কি তোমার মত হালুম হুলুম করে খেয়েছি নাকি?"

-"ইশ, আমি বলে হালুম হুলুম করে খেয়েছি? তুমি এটা বলতে পারলে?"

মুগ্ধ হাসতে লাগলো। তিতির বলল,

-"আচ্ছা যাও আমি হালুম হুলুম করেই খেয়েছি। খুশি? এবার আমার ব্যাগ থেকে একটু পানিটা বের করে দাও। হাতমুখ ধোব।"

গাড়ি থামালো মুগ্ধ। বলল,

-"দেখি কেমন মিষ্টি মিষ্টি হয়েছে?"

একথা বলেই মুগ্ধ আচমকা তিতিরের ঠোঁটে চুমু খেল। তারপর বলল,

-"তোমার ঠোঁট এম্নিতেই অনেক মিষ্টি। তরমুজের রস তার কাছে তুচ্ছ।"

তিতির লজ্জা পেয়ে লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিল। মুগ্ধ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল,

-"এটা করবো ভেবেই তখন হেসেছিলাম।"

তিতির আর কিছু বলল না।

গোয়াইনঘাট থেকে ওরা একটা নৌকা নিল। সাথে জুটে গেল ছোট্ট একটা গাইড। বয়স ১৩/১৪ হবে। নৌকা চলতে শুরু করতেই মুগ্ধ তার সাথে আর মাঝির সাথে গল্প জুড়ে দিল। তিতির খেয়াল করলো নদীর চারপাশটা বড্ড সুন্দর। সবুজ আর সবুজ। নদীর পানিটাও কি সুন্দর। দূরের পাহাড়গুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মুগ্ধ মাঝিকে বলল,

-"মামা, আগে পান্থুমাই চলো। ওদিকটা ঘুরে বিছনাকান্দি যাবা।"

মাঝি মাথা নাড়লো।

দূর থেকেই প্রথমবার যখন পান্থুমাই ঝরনা দেখতে পেল তিতির দুইহাত নিজের গালে রেখে চিৎকার করে উঠলো,

-"ওয়াও, এটা কি দেখতে পাচ্ছি আমি?"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"এটাই পান্থুমাই ঝরনা।"

-"এত সুন্দর কিভাবে? উফফফ।"

নৌকা আরো যত কাছে যেতে লাগলো ঝরনার পানি পড়ার শব্দ আরো কাছে আসতে লাগলো। বিশাল বিশাল সবুজ গাছে ভরা দুই পাহাড়ের মাঝখানে সুন্দরী ললনার মত কোমর বাঁকিয়ে আছে পান্থুমাই। একসময় নৌকাটা থামিয়ে দিল মাঝি। তিতির বলল,

-"মামা, থামালেন কেন এখন? যান না। আমি ওই ঝরনার নিচটায় যাব।"

মাঝি কিছু বলার আগেই মুগ্ধ বলল,

-"প্রথমত, ওই ঝরনার নিচে গেলে স্রোত নৌকা উলটে দেবে। দ্বিতীয়ত, ওই ঝরনাটা ইন্ডিয়াতে।"

-"মানে কি এত সুন্দর একটা ঝরনা কিনা ইন্ডিয়াতে? অথচ এত কাছে! ধ্যাত শুধু দেখতেই পারলাম। ছুতে পারলাম না।"

-"হুম, যদিও ঝরনাটা আমাদের দেশে না কিন্তু আমরা বাংলাদেশীরা তাও ঝরনাটা দেখতে পারি। অথচ ওটা ইন্ডিয়াতে হওয়া স্বত্তেও ইন্ডিয়ানরা দেখতে পারে না। দেখতে হলে ওদের ভিসা নিয়ে এপাড়ে আসতে হবে। নাহলে ওই ব্রিজটা দিয়ে কোথাও যেতে হবে।"

তিতির ব্রিজটা দেখলো। একদম ঝরনার সামনে দিয়ে একটা ব্রিজ এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে চলে গেছে। তারপর বলল।

-"ওদের ঝরনা ওরা কেন দেখতে পারবে না?"

-"কারন ঝরনাটা একদম সীমান্তে, এবং পুরোটাই আমাদের দেশে মুখ করা।"

-"ইয়েস! একদম ঠিক হয়েছে।"

এতক্ষণে ঝরনার কাছে যেতে না পারার আফসোস কাটলো তিতিরের।

মাঝি নৌকা ঘুরিয়ে চলল বিছনাকান্দির পথে। নদীটি মোটেও গভীর না। কাছাকাছি যেতেই নৌকা এক যায়গায় আটকে গেল। যায়গাটা বোধহয় একটু উঁচু। গাইড রাজু আর মুগ্ধ নামলো নৌকায় ধাক্কা দিয়ে যায়গাটা পার করার জন্য। নামতেই দেখলো ওখানে হাটু সমান পানি। তিতির মুগ্ধকে বলল,

-"আমিও নামবো।"

মুগ্ধ বলল,

-"নামবে? নামো।"

তিতিরও নেমে ধাক্কা দিল। ধাক্কা দিতেই পানি ছিটকে এসে খানিকটা ভিজিয়ে দিল ওদেরকে। তিতিরের খুব আনন্দ হলো। হাসতে লাগলো, ওকে এভাবে হাসতে দেখে মুগ্ধরও ভাল লাগলো। নৌকা যখন আবার একা একা চলতে শুরু করলো মুগ্ধ বলল,

-"এবার ওঠো তিতির।"

-"না আমি উঠবো না। নৌকা ধরে ধরে পানির মধ্যে হাটবো।"

মাঝি বলল,

-"আপু সামনে তো অনেক পানি। হাটতে পারবেন না ওখানে।"

মুগ্ধ কথা না বাড়িয়ে তিতিরকে কোলে উঠিয়ে নৌকায় তুলে দিল। তারপর নিজেও উঠলো। তিতির রাগী রাগী মুখ করে মুগ্ধর দিকে তাকালো। মুগ্ধ হাসি হাসি মুখ করে একটা ফ্লাইং কিস ছুড়লো। তবে সেলিব্রেটিদের মত হাত দিয়ে শূন্যে ভাসিয়ে নয় শুধুই ঠোঁটের ইশারায়। তারপর তিতির মিষ্টি একটা হাসি দিল।

এই যায়গাটায় নদী থেকে পাথর উঠানো হয়। পাথর উঠিয়ে নদীর পারে একের পর এক রেখে রেখে পাথরের পিরামিড বানিয়ে ফেলেছে কতগুলো।

তিতির সেই পাথরের পিরামিড গুলোই দেখছিল। আর দেখছিল বিছনাকান্দির পাহাড়। না পৌঁছালেও পাহাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। দুপাশে পাহাড়, মাঝখানে ফাঁকা। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো দুপাশের পাহাড় একদম সমান উচ্চতার। আল্লাহ বুঝি গজফিতা দিয়ে মেপে মেপে বানিয়েছেন। তিতির ভেবেছিল দূর থেকে পাহাড়গুলোকে নীল মনে হচ্ছে। কিন্তু এখন দেখছে পাহড়গুলো আসলেই নীল রঙের। পাহাড়ের নীচের দিকটা গাঢ় নীল, উপরটা হালকা নীল। মুগ্ধ বলল,

-"তিতির, এদিকে তাকাও.. পানিটা দেখো।"

তিতির তাকাতেই দেখতে পেল পানিটা স্পষ্ট দুই রঙের। একপাশে নদীর পানি যেমন হয় হালকা সবুজ ভাব, আরেকপাশে স্বচ্ছ নীল পানি। পানির নিচের বালু, ছোট ছোট মাছ, শৈবাল সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিতির এক্সাইটমেন্টে মুগ্ধর হাত চেপে ধরে বলল,

-"এটা কি করে সম্ভব?"

-"সবই আল্লাহর সৃষ্টি।"

-"উফফ এত সুন্দর পানি।"

তিতির নীলপানি গুলো হাতে করে উঠালো। হাতের মধ্যেও পানিগুলো নীলই দেখালো। তিতির মুগ্ধকে বলল,

-"দেখো, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আকাশের রিফ্লেকশান বুঝি। কিন্তু পানিগুলো আসলেই নীল।"

-"নীলই তো। এখানে সবই নীল। এখনি বুঝবে না। পৌঁছে নিই তখন বুঝতে পারবে।"

বিছনাকান্দি পৌঁছেই তিতিরের চোখে নীলের নেশা ধরে গেল। আকাশ নীল, পাহাড় নীল, পানি নীল। নীলের যে কতরকম শেড হতে পারে তা বিছনাকান্দি এলেই দেখা যাবে। ওরা নৌকা থেকে যেখানে নেমেছে তার একটু সামনে থেকেই পাথর শুরু। ছোট বড় অসংখ্য পাথর। সামনেই ভারতীয় সীমান্ত, ওপাশে শিলং। শিলং থেকে বয়ে আসা নদীটিই সেই নীল পানির উৎস। অজস্র পাথরের বুকের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে নদীটি। এখানে নদীতে হাটুসমান পানি। তার নিচে পাথর। যেখানে ওরা নৌকা থেকে নেমেছে সেখানে গিয়ে নদী গভীর হয়েছে। নীল সৌন্দর্য দেখতে দেখতে তার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল তিতির! নিজের অবচেতন মনেই একটার পর একটা পাথর লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে নেমে যাচ্ছিল পানিতে। মুগ্ধ মাঝির ফোন নাম্বার নিচ্ছিল যাওয়ার সময় যোগাযোগ করার জন্য। নাম্বার নিয়ে তাকাতেই দেখে তিতির অনকদূর নেমে গেছে। মুগ্ধ দৌড়ে এক পাথর থেকে অন্য পাথরে গিয়ে গিয়ে ভেজা পিচ্ছিল পাথরে যাওয়ার আগেই ধরে ফেলল। রেগে গিয়ে বলল,

-"তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি তো আল্লাহর রহমতে কম না, তাহলে মাঝে মাঝে এমন গাধামি কেন করো?"

তিতির অবাক হয়ে বলল,

-"আমি কি করলাম?"

-"আমি ফোন নাম্বারটা নেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা গেল না? একা একা নামছিলে কেন? সাহস ভাল কিন্তু এত সাহস তো ভাল না।"

-"ইশ, সরি। তুমি যে আসছিলে না খেয়ালই করিনি। আমি তো ভেবেছি তুমি সাথেই আছো।"

-"খেয়াল করবেনা কেন?"

-"আরে এত সৌন্দর্য দেখে আমার তো মাথাই ঠিক নেই, পাগল হয়ে যাচ্ছি। রাগ করোনা প্লিজ।"

-"ড্যাম ইওর রাগ। জানো পাথরগুলো কতটা পিচ্ছিল? পিছলে পড়ে গেলে শুধু ব্যাথাই পাবে তা না স্রোতের সাথে ভেসে হারিয়ে যাবে নদীর মধ্যে।"

-"আমি তো সাঁতার জানি।"

-"হেহ! সাঁতার জানে। স্রোতের ভয়াবহতার ব্যাপারে কোন আইডিয়া আছে?"

তিতির প্রায় কান্না করে দিচ্ছিল। চোখে পানি ছিল না কিন্তু গলাটা কেঁপে উঠলো যখন বলল,

-"সরি আর এরকম করবো না।"

মুগ্ধর বুকটাও সাথে সাথে কেঁপে উঠলো। বলল,

-"আরে আরে কাঁদছ নাকি? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তাই একটু কড়া কথা বলে ফেলেছি।"

তিতির সামলে নিল। বলল,

-"না, ঠিকাছে।"

মুগ্ধ তিতিরকে কোলে তুলে নিল। তারপর পানির মধ্যে নামতে নামতে বলল,

-"বকেছি তো পরে বেশি আদর করে পুষিয়ে দেব। মন খারাপ করোনা প্লিজ। তুমি যদি পা পিছলে পড়ে যেতে? ব্যাথা পেতে না বলো? পাথরের সাথে ঘষা খেয়ে তোমার এই সুন্দর সুন্দর পা গুলো ছিলে যেত না?"

-"তুমি আমার পা দেখেছো কিভাবে?"

-"কেন তুমি যখন যখন থ্রি-কোয়ার্টার পড়েছো তখন তখনই তো দেখেছি।"

-"যখন যখন বলতে? আমি তো ট্যুরে যাওয়া ছাড়া পড়িনা।"

-"ওইতো, নাফাখুম ট্রিপে দেখেছি। আজ দেখেছি।"

-"মানে কি? এখন নাহয় বুঝলাম দেখেছো আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড, তাকাতেই পারো! কিন্তু নাফাখুম ট্রিপে তো আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড ছিলাম না, তখন কেন দেখেছো?"

মুগ্ধ অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

-"না মানে, এত সুন্দর জিনিস দেখে কি চোখ ফিরিয়ে রাখা যায় বলো? তাছাড়া আমি ততদিনে তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম। আকর্ষণ টা একটু বেশিই ছিল। তোমার সবকিছুতে নজর দিতাম।"

তিতির চোখ বড় বড় করে বলল,

-"সবকিছু বলতে?"

ততক্ষণে ওরা পানিতে নেমে গিয়েছে। তিতিরকে পানির নিচে পাথরের উপর বসিয়ে দিয়ে বলল,

-"না না, নেগেটিভলি নিও না। মানে আমি তোমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। একদিন তোমার পেটও দেখে ফেলেছিলাম।"

তিতিরের চোখগুলো এবার বেড়িয়ে আসতে চাইলো। বলল,

-"নাফাখুম ট্রিপে?"

-"হুম।"

-"কিভাবে?"

-"ওইযে যেদিন আমরা রেমাক্রি পৌঁছেছিলাম তুমি গোসল করে বাইরে এসে কাপড় মেলে দিচ্ছিলে তখন তোমার টপসটা উঠে গিয়ে পেট বের হয়ে গিয়েছিল।"

-"তার মানে তো এক্সিডেন্টলি বের হয়ে গেছিল। আর তুমি কিনা হা করে দেখছিলে?"

-"না বাবা, আমি একবার দেখে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম।"

-"কে জানে!"

-"কিন্তু তারপর অনেকদিন চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠতো সেই দৃশ্য, উফফফ!"

তিতির ওর বুকে একটা কিল দিয়ে বলল,

-"যাহ, অসভ্য একটা।"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"আচ্ছা শোনো না, যখন তোমাকে কোলে তুলে হাটছিলাম তখন আশেপাশের মানুষগুলো তাকিয়ে ছিল।"

-"হুম, খেয়াল করেছি আমি। দেখুক গিয়ে।"

-"তুমি খুব এনজয় করো না? মানুষ যখন হা করে দেখে আমাদের?"

-"করি তো। খুব প্রাউড ফিল করি আমি।"

মুগ্ধ হাসলো।

কথা বলতে বলতেই মুগ্ধ পানিতে শুয়ে পড়লো। কিন্তু একটা হাত দিয়ে তিতিরকে ধরে রেখেছিল। তিতির বলল,

-"এই এত স্রোতের মধ্যে তুমি শুয়ে পড়লে যে? আমার ভয় লাগছে।"

মুগ্ধর পুরো শরীর পানির নিচে। মাথাটা পানি থেকে উঠিয়ে বলল,

-"কিছু হবে না, প্রটেকশন আছে। ওই দেখো পা একটা পাথরে আটকে রেখেছি।"

-"প্লিজ ওঠো তুমি। আমার ভয় করছে কারন, আমার বসে থাকতেই প্রব্লেম হচ্ছে। তুমি ধরে না রাখলে স্রোতের তোরে কবেই ভেসে যেতাম।"

-"তুমি আমাকে নিয়ে নাফাখুমের মত ভয়ঙ্কর যায়গায়ও ভয় পাওনি আর এখানে ভয় পাচ্ছো?"

-"ওখানে তো সেফটি বেল্ট ছিল।"

-"এখানেও পা ঠেকানো ওই পাথরটা সেফটি।"

-"উফ তিতির তুমি না!"

উঠে বসলো মুগ্ধ। তারপর বলল,

-"আমি তোমাকে ধরে রেখেছি, তুমি একটু শোও।"

-"এত মানুষের মধ্যে আমি শোবো?"

-"এত মানুষ কোথায় পেলে? বিছনাকান্দিতে অনেক মানুষ হয়। এখন তো মানুষ নেই বললেই চলে।"

-"তবু, যেকয়জন আছে তারা আমার অপরিচিত।"

-"বাপরে, বিছনাকান্দির বিছনায় না শুয়ে গেলে অনেক বড় কিছু মিস করবে। কেউ তোমার দিকে তাকিয়ে নেই বাবা। একা থাকলে হয়তো তাকাতো, কিন্তু এত হ্যান্ডসাম একটা ছেলে আছে সাথে। ওরা তো বুঝে তাকালে চোখ গেলে দেব।"

তিতির একটা হাসি দিয়ে শুয়ে পড়লো পানির মধ্যে। মুগ্ধ হাত ধরে থেকে বলল,

-"পুরো শরীর পানির নিচে ডুবিয়ে দাও। শুধু মাথাটা পাথরটার উপরে রাখো তাহলে কানে পানি যাবেনা।"

তিতির তাই করলো। মুগ্ধ বলল,

-"আরে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন? চোখ বন্ধ করে রাখো।"

তিতির চোখ বন্ধ করলো। মুগ্ধ আবার বলল,

-"হাতদুটো দুপাশে ছড়িয়ে দাও পাখির মত তাতে পানির মধ্যে শরীরের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পারবে।"

তিতির তাই করলো। তারপর মুগ্ধ ওকে ছেড়ে দিল। ছেড়ে দিতেই তিতির তাকিয়ে বলল,

-"আমি পারবো ব্যালেন্স রাখতে কিন্তু তুমি ধরে থাকো ভাল লাগে।"

-"না তিতির। কিছু কিছু জিনিস ফিল করতে একা হওয়া প্রয়োজন। এখানে কোন মানুষজন না থাকলে দুজনে মিলে ফিল করা যায় এমন কিছু ফিল করাতাম তোমাকে। যেহেতু মানুষজন আছে তাই একটা কথাও না বলে যেভাবে বললাম ওভাবেই থাকো কিছুক্ষণ। আমি পাশেই আছি।"

তিতির আর কথা বলল না। মুগ্ধ যেভাবে বলল সেভাবেই শুয়ে রইলো। কোনো অজানা পাহাড়ের অজানা ঝরনার গা বেয়ে নেমে আসা হিমশীতল পানি তিতিরের সারা অঙ্গ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এভাবে ছোঁয়ার জন্য আবার শাস্তি দেবে না তো মুগ্ধ? একথা ভেবে নিজের মনেই হেসে উঠলো তিতির। আস্তে আস্তে টের পেল নদীর কলকল ধ্ধনিতে মুখরিত চারপাশ। শব্দটা যেন ওর বুকের ভেতর হচ্ছে, আসলে তা তো না। কিন্তু শব্দটা পানির মধ্যে আর স্রোতের পানিগুলো কানের এত কাছে যে অন্য কোনো শব্দ আর কানে আসছে না। শব্দটা আস্তে আস্তে কেমন যেন করুন শোনালো। কিন্তু এত অসাধারণ যে কোনো ওস্তাদের বাজানো সানতুর, সেতার বা সারদের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হলো না। কখন যে তিতিরের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে মিশে গেল সে পিয়াইন নদীর নীল জলে তা কেউ জানলো না।

একসময় মুগ্ধ বলল,

-"এবার চোখ দুটো খুলে আকাশের দিকে তাকাও।"

তিতির তাকাতেই অন্যরকম এক অনুভূতি রইলো। একটু আগের সব অনুভূতি তো রইলোউ সাথে আরো যোগ হলো খোলা নীল আকাশের সৌন্দর্য। এবার মনে হতে লাগলো ও এমন কোনো অচেনা জগতে আছে যেখানে একই সাথে পাখির মত আকাশে ওড়া যায় আবার জলকন্যার মত পানিতে সাঁতারও কাটা যায়।

কয়েক ঘন্টা পানিতে থাকার পর যখন ওরা পানি থেকে উঠলো হঠাৎই বৃষ্টি নামলো, ব্যাপক বৃষ্টি। তিতির চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টিবিলাস করছিল। কিন্তু মুগ্ধর প্রচন্ড ক্ষুদা লেগেছে। দুপুর পেড়িয়ে বিকেল হয়ে গিয়েছে, সেই সকালে খেয়ে বেড়িয়েছে। পথে আসতে আসতে হাবিজাবি খেয়েছে,

-"তিতির, খুব ভুল হয়ে গিয়েছে একটা জিনিস।"

তিতির চোখ খুলে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,

-"কি?"

-"ভাত খেয়ে পানিতে নামা উচিৎ ছিল। স্রোত ছিল যে অনেক, স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে পানিতে থাকায় এনার্জি শেষ।"

-"আহারে! তো খেয়েই নামতে।"

-"খেয়াল ছিল না, তাছাড়া তখন তো আর ক্ষিদেও ছিল না।"

-"ও।"

-"তোমার ক্ষিদে পায়নি?"

-"বুঝতে পারছি না। আসলে আমি এখনো ঘোর থেকে বের হতে পারছি না।"

-"স্বাভাবিক, প্রথমবার এমনই হয়। কিন্তু আমার তো ভাত খাওয়ার জন্য জানটা বের হয়ে যাচ্ছে।"

-"ইশ।"

ততক্ষণে মাঝি আর রাজু ওদের দেখতে পেয়ে চলে এসেছে। তিতির ওদের জিজ্ঞেস করলো,

-"ওই দোকানটাতে ভাত পাওয়া যায়?"

রাজু বলল,

-"না আফু, চিপস, কেক, বিস্কুট আছে।"

মুগ্ধ বলল

-"ভাত হাদারপাড় ছাড়া পাওয়া যাবে না না?"

-"না।"

তিতির বললো,

-"হাদারপাড় গিয়ে খাই তাহলে।"

মুগ্ধ বলল,

-"আমার লাশ যাবে তাহলে। কারন, ওইটা অনেক দূর।"

-"ধুর, তোমার যত আজেবাজে কথা।"

তিতির দোকানে চলে গেল।"

মুগ্ধ বলল,

-"আরে আরে, কোথায় যাও?"

-"তোমার লাশ হওয়া ফেরাতে।"

দোকানে গিয়ে বলল,

-"ভাই, এখানে ভাত পাওয়া যাবে?"

দোকানদার বলল,

-"না।"

-"চাল পাওয়া যাবে?"

মুগ্ধ ততক্ষণে দোকানের সামনে চলে এল। বলল,

-"আরে পাগল এটা কি চালের দোকান?"

দোকানদার বলল,

-"এইখানে চাল নাই।"

তিতির বলল,

-"প্লিজ কিছু চাল বিক্রি করুন, যেভাবেই হোক। আমার স্বামী ক্ষুধার জালায় মারা যাচ্ছে।"

তিতিরের কথায় মাঝি আর রাজু হেসে দিল। মুগ্ধ আর দোকানদার হা করে চেয়ে রইলো। তিতির বলল,

-"প্লিজ ভাত নাহলে চাল কিছু একটার ব্যবস্থা করুন।"

দোকানদার কিছু বলার আগেই মুগ্ধ বলল,

-"এই আমার ক্ষিদে নেই, চলো। অযথা বিরক্ত করছো ওনাকে, থাকলে তো দিতোই।"

মুগ্ধ জোর করে নিয়ে যাচ্ছিল তিতিরকে। পেছন থেকে দোকানদার ডাকলো,

-"ও ভাই দাঁড়ান।"

ওরা দাঁড়ালো। দোকানদার বলল,

-"আমার বউ খুদের ভাত পাডাইছিল। আমি আর আমার ভাই খাওয়ার পরও আছে। খাইবেন?"

তিতিরের মুখে বিশ্ব জয় করার হাসি ফুটে উঠলো। মুগ্ধ কিছু বলার আগেই লাফিয়ে পড়ে বলল,

-"হ্যা খাবে, খুদের ভাত তো ওর খুব প্রিয়।"

মুগ্ধর মনে পড়ছে না খুদের ভাত কবে ওর প্রিয় ছিল।

দোকানদার উঁচু উঁচু করে বেড়ে একপ্লেট খুদের ভাত দিতেই তিতির মুগ্ধর হাতে দিয়ে বলল,

-"এই নাও খাও।"

আরেকপ্লেট যখন দিতে নিল, তিতির বলল,

-"না না আর লাগবে না। আমি খাব না। ওর জন্যই চাইছিলাম।"

মুগ্ধ এখনো খাওয়া শুরু করছেনা দেখে দোকানের দাওয়ায় বসে তিতির হাত ধুয়ে নিজেই খাইয়ে দিল। মুখে দিয়ে মুগ্ধর মনে হলো অমৃত খাচ্ছে। শুধু ক্ষুদার জন্য না। রান্নাটাও ছিল চমৎকার। বোম্বাই মরিচ দিয়ে রান্না করেছে বোধয়। ঘ্রাণেই অর্ধেক পেট ভরে গেল। বাইরে ঝুমবৃষ্টি হচ্ছে। ভেজা শরীরে বিয়ে না করা বউ কিংবা বউয়ের থেকেও বেশি এমন মানুষটার হাতে তারই ভালবাসা দিয়ে জোগাড় করা খাবার খেতে খেতে মুগ্ধর বুকের ভেতর আবেগের তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। মেয়ে হলে হয়তো এতক্ষণে কেঁদেই ফেলতো। নাইবা পেল ওকে সারাজীবনের সহধর্মিণী হিসেবে, যা পেয়েছে ওর কাছ থেকে এমনকি এখনো পাচ্ছে তা অনেকে ভালবেসে সার্থক হয়ে বিয়ে করা বউয়ের কাছ থেকেও এর একশোভাগের এক ভাগ পায়না। মুগ্ধ বলল,

-"শুধু আমাকে দিচ্ছো কেন? এতটা কি আমি একা খেতে পারবো?"

-"হ্যা পারবে।"

-"না পারবো না, তুমিও খাও। আর এটা অনেক টেস্টি। না খেলে মিস করবে।"

-"উফ তুমি খাও তো।"

-"তুমি না খেলে আমিও খাব না।

অগত্যা তিতিরও খেল মুগ্ধর সাথে। খাওয়া শেষ হতেই তিতির দোকানদারকে বলল,

-"ভাই আপনার নাম কি?"

-"সুরুজ আলী।"

-"সুরুজ ভাই আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি আপনার এই ঋণ কোনদিনও শোধ করতে পারবো না। আপনি জানেন না আপনি আমার কত বড় উপকার করলেন।"

সুরুজ আলী কোন অজানা কারনে লজ্জা পেল। বলল,

-"না না আপা কি যে বলেন।"

মুগ্ধ বলল,

-"সুরুজ ভাই, আমি জানি আপনি এটা বিক্রি করেন না। আপনার স্ত্রী যত্ন করে আপনার জন্য রান্না করে পাঠিয়েছে। তবু আমরা ক্ষুদার সময় খেয়েছি। আপনি যদি দামটা রাখেন আমি খুব খুশি হব।"

সুরুজ আলী বলল,

-"না না, ভাইজান আমি টাকা রাখতে পারমু না। এটা তো আমার ব্যবসার জিনিস না। আর বাড়তিই ছিল।"

-"তবু ভাই, রাখেন। আর লজ্জা দিয়েন না। এমনিতেই আমার বউ অনেক লজ্জায় ফেলেছে।"

সুরুজ আলী টাকা রাখতে চাচ্ছিল না। মুগ্ধ জোর করে তার হাতের মুঠোও টাকা গুঁজে দিল। তিতির বলল,

-"সুরুজ ভাই, আজ থেকে আপনি আমার ভাই। আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আপনার বাড়িতে বেড়াতে আসব। ভাবীকে বলবেন এরকম খুদের ভাত রান্না করতে। এটা পৃথিবীর অন্যতম সুস্বাদু খাবার।"

সুরুজ আলী অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। লোকটি বোধহয় খুব আবেগী। কারন, তিতিরের কথায় তার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে বলল,

-"অবশ্যই আসবেন আপা।"

নৌকার কাছে যেতে যেতে তিতির বলল,

-"আমি তোমাকে লজ্জায় ফেলেছি না?"

মুগ্ধ একহাতে ওকে বুকে ধরে হাটতে হাটতে বলল,

-"এত ভালবাসিস কেন রে পাগলী?"

তিতির আহ্লাদে আটখান হয়ে গেল। মুগ্ধ আবার বলল,

-"আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসবে, না?"

-"যেটা বাস্তবে কখনো হবার নয় সেটা যদি কল্পনাতে ভেবে সুখ পাওয়া যায় তাতে দোষের কি?"

মুগ্ধ তিতিরের কপালে একটা চুমু দিল। তিতির চোখ বন্ধ করে তা সাদরে গ্রহন করলো। তারপর বলল,

-"আচ্ছা, তখন যে বলেছিলে মানুষজন না থাকলে দুজনে মিলে উপভোগ করা যায় এমন কিছু করতে। সেটা কি?"

-"তোমাকে একবার আমার বুকে, আরেকবার পিঠে নিয়ে সাঁতার কাটতাম।"

-"সিরিয়াসলি?"

-"হ্যা।"

-"পারবে তুমি?"

-"কেন পারবো না? তোমার ওজন কত ৫০?"

-"না, ৪৮।"

-"আর আমার ৮০, ভরসা হয়না? তাছাড়া পিউকে পিঠে নিয়ে সাঁতরাতে পারলে তোমাকে নিতে পারবো না? তোমরা তো অলমোস্ট সেম। ওর ওজন হয়তো তোমার থেকে সামান্য বেশি।"

-"তাহলে প্লিজ চলো... এখন তো মানুষজন একদম নেই বললেই চলে।"

মুগ্ধ হাসতে লাগলো।

বৃষ্টি, ব্যাপক বৃষ্টি! ঝুমবৃষ্টি... নদীর নীল পানিতে বৃষ্টির ইয়া বড় বড় ফোঁটা পড়ছে, আর শামুকের শেপ তৈরি হচ্ছে পানিতে। তার মধ্যে উলটা সাঁতার দিচ্ছে মুগ্ধ। মুগ্ধর বুকের উপর ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে তিতির। যতটা কষ্ট হবে ভেবেছিল মুগ্ধ ততটা হচ্ছে না। কারন, তিতিরও পা দিয়ে সাঁতরাচ্ছে মুগ্ধর বুকের উপর শুয়ে। দুজনই একসাথে পা দিয়ে পানিগুলোকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে সাঁতার কাটছে আর পাগলের মত হাসছে। হাসির শব্দ ফাঁকা যায়গায় বার বার বাজছে। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন মিলিয়ে যাচ্ছে তখন বড্ড করুণ শোনাচ্ছে। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসেনা ওদের। ওরা আজ ভাসছে। আজ ওরা মানুষ নয়। ওরা জলমানব আর জলমানবী।

To be continued...

প্রেমাতাল - পর্ব ৪১

মৌরি মরিয়ম

গোয়াইনঘাটে নৌকার ঘাট থেকে কিছুটা আগে গাড়ি রেখেছিল মুগ্ধ। সাঁতরে সাঁতরে শরীর ক্লান্ত দুজনেরই। যা খেয়েছিল তা সব শেষ। এটুকু হেটে গাড়ির কাছে আসতেও খুব কষ্ট হলো। এসে মুগ্ধ বলল,

-"তুমি গাড়িতে ঢুকে চেঞ্জ করে নাও। তোমার হয়ে গেলে আমি ঢুকবো।"

-"এখানে আমি চেঞ্জ করবো?"

-"হ্যা কে আছে দেখবার জন্য? আশেপাশে তো কেউ নেই।"

-"তা ঠিক, তবুও।"

-"আরে মানুষ গাড়িতে সেক্স করতে পারলে তুমি চেঞ্জ করতে পারবে না?"

-"ছিঃ তুমি অলওয়েজ নোংরা কথা বলতে পছন্দ কেন করো?"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"আমি একটা নোংরা লোক যে তাই।"

তিতির গাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। মুগ্ধ বলল,

-"নিচু হয়ে চেঞ্জ করে নাও। চিন্তা করোনা কেউ আসতে নিলে আমি তোমাকে বলবো। আর আমিও তাকাবোনা।"

তিতির চেঞ্জ করে সামনে চলে গেল। তারপর মুগ্ধ ঢুকে চেঞ্জ করে গাড়ি স্টার্ট দিল। তখনও বাইরে তুমুল বৃষ্টি।

হাদারপাড় পৌঁছতেই মুগ্ধ বলল,

-"তিতির চলো ভাত খেয়ে নিই, এখানে ভাতের হোটেল আছে।"

-"এখন আবার নামতে ইচ্ছে করছে না। একেবারে রিসোর্টে গিয়ে খাই।"

-"ক্ষিদে পেয়েছে খুব।"

-"ও, আচ্ছা চলো তাহলে।

কয়েক কদম হেটেই ওরা একটা হোটেলে ঢুকলো। খেতে খেতে তিতির বলল,

-"এই ভাতগুলো এমন কেন?"

-"আতপ চালের ভাত যে!"

-"আমরা কোন চালের ভাত খাই তাহলে?"

-"সিদ্ধ চালের।"

-"ও। ধুর এগুলো আমার গলায় আটকাচ্ছে।"

প্রেমাতাল - সকল পর্ব

-"আহারে আমার তিতিরপাখিটা রে। এইবেলাটা একটু কষ্ট করে খেয়ে নাও। রাতে রিসোর্টে খাব।"

-"অন্য কোনো হোটেলে খেতাম।"

-"লাভ নেই পুরো সিলেটে আতপ চালের ভাত হয়। রিসোর্টে আছি বলে যা চাচ্ছি তাই পাচ্ছি। ইভেন সিদ্ধ চালের ভাতও।"

-"ও।"

মুগ্ধ গপাগপ পেটপুরে খেয়ে নিল। কিন্তু তিতির কোনরকমে অর্ধেকটা ভাত খেল। তারপর বাইরে আসতেই দেখলো সন্ধ্যা নেমে গেছে। মুগ্ধ বলল,

-"এখানে মেলা হচ্ছে দেখলাম, যাবে?"

তিতির অবাক হয়ে বলল,

-"এই বৃষ্টিতে মেলা হচ্ছে?"

-"সিলেটে তো ডেইলিই বৃষ্টি হয়। তার জন্য কিছু থেমে থাকে না। আর স্টল আছে তাই কোন প্রব্লেমও নেই। ঢাকার বাইরের মেলাগুলো কিন্তু অনেক উপভোগ্য হয়।"

-"ও, আচ্ছা চলো যাই ঘুরে আসি।"

-"চলো। ভিজে যাব কিন্তু যেতে যেতে।"

-"ভিজলে ভিজবো। একেবারে রিসোর্টে গিয়ে চেঞ্জ করে নেব।"

-"আচ্ছা, চলো তাহলে।"

মেলায় ঘুরতে ঘুরতে তিতির বুঝলো মুগ্ধর কথা ঠিক, ঢাকা শহরের মেলার থেকে এখানকার মেলা বেশি সুন্দর। খুব ভাল লাগলো ওর। একটা দোকানে ঘুরতে ঘুরতেই মুগ্ধ ডাক দিয়ে বলল,

-"এই এদিকে এসো।"

তিতির মুগ্ধর কাছে গিয়ে বলল,

-"কি?"

মুগ্ধ ওকে একটা লাল মনিপুরী শাড়ি দেখিয়ে বলল,

-"দেখো, শাড়িটা সুন্দর না?"

-"হ্যা সুন্দর।"

-"তোমার জন্য নিই।"

-"এই না। এমনিতেই যেটা কাল কিনেছো ওটা বাসায় নিতে পারবো না। আরেকটা নিয়ে কি হবে?"

-"আজকে রাতে পড়বে। আমি হা করে দেখবো। দেখোনা শাড়িটা কত্ত সুন্দর লাল। তোমাকে খুব ভাল দেখাবে এটাতে।"

-"লাল শাড়িতে তো কত্ত দেখেছো! আচ্ছা কালকের শাড়িটাও তো অর্ধেকটা লাল। রিসোর্টে গিয়ে ওই শাড়িটা পড়বোনে তখন দেখো। এটা কিনে শুধু শুধু টাকা নষ্ট করোনা।"

-"টাকা নষ্ট বলছো কেন? এসব শাড়ির দাম বেশি না। তাছাড়া, আমি দেখবো। সেটার কি দাম নেই? এজন্যই আমি কোনকিছু কেনার আগে বলিনা। বলে কিনতে গেলেই তুমি এরকম উল্টাপাল্টা কথা বলে মুড নষ্ট করে দাও। এরকম করলে তোমার সংসার ভেসে যাবে কিন্তু।"

-"আচ্ছা আচ্ছা, সরি খুব ভুল হয়েছে আমার। যাও কেনো।"

মুগ্ধ শাড়িটা কিনে নিল। তারপর বলল,

-"তিতির, আমি একটু ওয়াশরুমে যাব। ৫ মিনিটে আসছি, তুমি এই দোকানটাতেই দাঁড়াও। অন্য কোথাও যেও না। ফোন কিন্তু গাড়িতে। পরে হারিয়ে গেলে খুঁজে পাবনা।"

-"তুমি চিন্তা করোনা, আমি এখানেই থাকবো।"

তিতির শাড়ির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ চোখে পড়লো পাশেই একটা লোক কিছু একটা বিক্রি করছে। মানুষ খুব খাচ্ছে। তিতির লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো,

-"মামা, এগুলো কি?"

লোকটা উত্তর দিল,

-"ভাং এর শরবত।"

তিতিরের মনের ভেতরটা নেচে উঠলো.. ভাং এর শরবত! শুধু শুনেই এসেছে, জীবনে খায়নি। এখন দেখেই খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মুগ্ধ এলে কিছুতেই খেতে দেবে না। বলবে, 'নেশা হয়ে যাবে।' আরে বাবা হোক না, একটু আধটু নেশা হলে কি হয়!

সাতপাঁচ ভেবে মুগ্ধ আসার আগেই এক গ্লাস খেয়ে ফেলল তিতির। পরে আরেক গ্লাস দিতেই মুগ্ধ চলে এল। ওকে দেখতে পেয়ে বলল,

-"তিতির, কি খাচ্ছো এগুলো?"

-"ও তুমি চলে এসেছো? অনেক মজার জিনিস, খাওনা।"

একথা বলেই গ্লাস টা মুগ্ধর দিকে ধরলো।

-"আগে বলবে তো কি এটা?"

-"সারপ্রাইজ! খাও না।"

মুগ্ধ খেয়ে বলল,

-"এটা তো ভাং, তুমি এটার আগেও খেয়েছো?"

-"এক গ্লাস মাত্র।"

-"সর্বনাশ করেছো।"

তারপর ভাং এর দাম মিটিয়ে তিতিরকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। গাড়িতে উঠেই তিতির বলল,

-"এই তুমি রাগ করেছো?"

মুগ্ধ ঝারি দিয়ে বলল,

-"নাহ, আনন্দে নাচছি।"

-"এত রাগ কেন করছো? ভাং তো অনেক মজা।"

-"কিছুক্ষণের মধ্যেই নেশা হয়ে যাবে, তখনকার পাগলামিগুলো কে সামলাবে?"

তিতির দুষ্টু দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,

-"কেন তুমি।"

-"একটা কথাও বলবেনা আমার সাথে।"

মুগ্ধ এমন ব্যবহারে তিতিরও রাগ করলো। কি এমন করেছে ও! এক গ্লাস ভাং ই তো খেয়েছে। তার জন্য এমন ব্যবহার? তিতির সত্যিই আর একটা কথাও বলল না।

রিসোর্টে ফিরে তিতিরের দিকে তাকাতেই মুগ্ধ দেখতে পেল তিতির ঘুমাচ্ছে। ওর গায়ের কাপড় খানিকটা শুকিয়ে গেছে। ওর নিজের গায়ের কাপড়েরও পানি ঝরে গেছে। কখন ঘুমিয়ে পড়লো মেয়েটা? ইশ এভাবে বকাটা উচিৎ হয়নি। কিন্তু মাঝেমাঝে এমন বোকামি করে মেয়েটা!

পাড়ি পার্ক করে তিতিরকে কোলে নিয়ে রুমে চলে গেল। ভেতরে ঢুকে ওকে কোলে নিয়েই দরজাটা লক করে দিল। তারপর ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে যাচ্ছিল এমন সময় তিতির ওর কলার টেনে ধরে মিষ্টি একটা হাসি দিল। মুগ্ধ হেসে বলল,

-"ঘুমের ভান করা হচ্ছিল?"

-"এত বকলে কি করবো তাহলে?"

তিতিরের গলা শুনেই মুগ্ধর বুঝতে বাকী রইলো না যে ওর নেশা হয়ে গেছে। আর হবেই বা না কেন ওরই তো মাথাটা ঝিমঝিম করছে। বলল,

-"এত বকলাম কোথায়? কিন্তু এত বকার মতই কাজ করেছো তুমি।"

-"একটু ভাং ই তো খেয়েছি। খেলে কি কয়?"

-"নেশা হয়রে বাবা।"

তিতির মুগ্ধর কলার ধরে টেনে আনলো নিজের কাছে, একদম কাছে। তারপর বলল,

-"নেশা হলেই তো ভাল। নিজেকে কেমন হালকা হালকা লাগে। দুনিয়াটা ঘুরতে থাকে বেশ লাগে আমার।"

মুগ্ধ মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। তিতির আচমকা ওর ঘাড়ে হাত রেখে আরো কাছে এনে ওর ঠোঁটে উথাল পাথাল চুমু দিতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইন্টারকমে ফোন এল। মুগ্ধ উঠে যেতেই তিতির চিৎকার করে বলল,

-"কে ফোন করেছে? আমি ওর চাকরি খাব।"

''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন

মুগ্ধ একথায় হেসে দিল। তারপর ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ম্যানেজার বলল,

-"স্যার আপনার ওয়ালেট টা পড়ে গিয়েছিল রিসিপশানে। আমি কি এটা এখন পাঠিয়ে দেব? নাকি পরে?"

-"ওহ! থ্যাংকস আ লট। প্লিজ পাঠিয়ে দিন।"

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই কেয়ারটেকার ছেলেটি ওয়ালেট নিয়ে এল। মুগ্ধ সেটা কালেক্ট করে ভেতরে আসতেই তিতির ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে বলল,

-"আমি ওই শাড়িটা পড়বো।"

-"ওহ হো। ওটা তো গাড়িতে। তোমাকে কোলে করে নিয়ে এলাম না? ওগুলো তো আনা হয়নি। দাঁড়াও নিয়ে আসছি।"

তিতির মুগ্ধকে আরো শক্ত করে ধরে বলল,

-"না তুমি যেতে পারবে না, ওই বদ ছেলেটাকে বলো দিয়ে যেতে। তাহলে মাফ করে দেব একটু আগে যে ডিস্টার্ব করেছে সেজন্য।"

মুগ্ধ তিতিরের কোমর জড়িয়ে ধরে হেসে বলল,

-"ওর কাছে কি গাড়ির চাবি আছে? পাগলী! তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি নিয়ে আসছি।"

মুগ্ধ শাড়ি, ভেজা কাপড় সব নিয়ে এসে ঘরে ঢুকে বলল,

-"আমি ভেজা কাপড়গুলো বারান্দায় মেলে দিয়ে আসি। তুমি শাড়িটা পড়ে নাও।"

তিতির শাড়ি পড়ে বারান্দায় গিয়ে দেখলো মুগ্ধ ডিভানে বসে আছে। তিতির মুগ্ধর সামনে গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখালো আর বলল,

-"কেমন লাগছে আমাকে?"

মুগ্ধ তিতিরের সামনে দাঁড়িয়ে কোমর জড়িয়ে বলল,

-"পরী, আমার পরী।"

তিতির তার সেই মিষ্টি হাসিটা দিল। মুগ্ধ বলল,

-"চোখ বন্ধ করো।"

তিতির চোখ বন্ধ করলো। মুগ্ধ মেলা থেকে কেনা একপাতা টিপ বের করলো পকেট থেকে। তারপর একটা লাল টিপ পড়িয়ে দিল তিতিরের কপালে। তিতির চোখ খুলতেই বলল,

-"শাড়ির সাথে টিপ না হলে চলেই না।"

তিতির মুগ্ধর গলাটা ধরে পায়ের বৃদ্ধাঙুলের উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে মুগ্ধর একদম কাছে চলে গেল। ও চাইছে মুগ্ধ ওকে আদর করুক। মুগ্ধও বুঝতে পারলো। তিতিরের কোমরটা আরো শক্ত করে ধরে চুমু খেল ওর ঠোঁটে। অনেকক্ষণ ধরে। তারপর হঠাৎ ই বিদ্যুৎ চমকালো। বৃষ্টি নামলো। তারপর আচমকাই তিতিরকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে ঢুকলো মুগ্ধ। তিতির বলল,

-"চলোনা, ভিজি।"

-"ভিজবো। সারাদিন তো প্রাকৃতিক বৃষ্টিতে ভিজেছিই। এবার অন্য বৃষ্টিতে ভিজবো।"

-"কোন বৃষ্টি?"

-"দেখাচ্ছি।"

মুগ্ধ তিতিরকে কোলে করে হেটে হেটে নিয়ে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিল। যতক্ষণ কোলে ছিল তিতির ততক্ষণই মুগ্ধর গলাটা জড়িয়ে ধরে মোহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। তেমনি মুগ্ধও তাকিয়ে ছিল তিতিরের ঠিক চোখের দিকে।

তিতিরকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই ওর আঁচলটা পেটের উপর থেকে সরে গেল। এই দৃশ্য দেখামাত্রই মুগ্ধ যেন সব কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলল। নাভিতে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিল কতক্ষণ। তারপর ঠোঁট না সরাসরি জিহ্বা দিয়ে আদর করতে লাগলো ওর নাভিতে। তিতির মুগ্ধর চুলগুলো খামচে ধরে সাপের মত মোড়ামুড়ি করতে লাগলো। উফফ কি করছে মুগ্ধ! ও তো সুখে মরেই যাবে! কিছু বলতে গিয়েও তিতির একটা কথাও বের করতে পারলো না। হঠাৎ মুগ্ধ ওর খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো ঘষে দিল তিতিরের পেটে। তিতির ব্যাথায় একটা চিৎকার দিল। মুগ্ধ ওর ঠোটে চুমু দিয়ে চিৎকার থামালো। তারপর তাকিয়ে রইলো তিতিরের দিকে। কি মায়া! আল্লাহ কি পৃথিবীর সব মায়া ওর মুখটাতে দিয়ে রেখেছে? তিতির চোখ খুললো। মুগ্ধর চোখে চোখ পড়তেই লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিল। মুগ্ধ তিতিরের মুখটা ধরে কপালে একটা চুমু দিল। তিতির আবেশে চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল। মুগ্ধ বোঁজা চোখদুটিতেও চুমু দিল। তারপর গালে চুমু দিল, তারপর ঠোঁটের আশেপাশে। তারপর আবার ঠোঁটে চুমু খেল। এরপর নেমে গেল গলায়। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিল। তিতির ততক্ষণে মুগ্ধর কান কামড়াতে শুরু করে দিল।

তারপর মুগ্ধ উঠে বসলো। তিতিরের কোমরটা ধরে ওকেও উঠিয়ে বসিয়ে আঁচলটা ফেলে দিল। আবার চুমু দিতে যাচ্ছিল এমন সময় তিতির ওকে বাধা দিল, টি-শার্টটা খুলতে বলতে চাইলো। কিন্তু সমস্ত আবেগ যেন গলার মধ্যে আটকে গেছে। বলতে না পেরে নিজেই খুলে ফেললো, মুগ্ধও হেল্প করলো। তারপর তিতির পাগলের মত কামড় দিতে লাগলো মুগ্ধর বুকে। মুগ্ধর খুব ব্যথা লাগছিল কিন্তু বাধা দেয়নি কারন একই সাথে ওর ভালও লাগছিল। আস্তে আস্তে তিতির কামড়ানো থামালো। এবার চুমু দিতে শুরু করলো। বুক থেকে চুমু দিতে দিতে উপরে উঠতে লাগলো। গলায় চুমু দিল তারপর গালে চুমু দিতেই মুগ্ধ তিতিরের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। তারপর চুমু দিল। তিতিরও চুমু দিল। যেন প্রতিযোগিতা লেগেছে কে কার থেকে বেশি আর নিবিড়ভাবে চুমু দিতে পারে! ততক্ষণে মুগ্ধর হাত চলে গেল তিতিরের কোমরে। শাড়ির কুচিগুলো ধরে কোমর থেকে খুলে পুরো শাড়িটাই ছুড়ে ফেলে দিল ফ্লোরে। তারপর মুগ্ধ তিতিরকে উলটো ঘুড়িয়ে ভেজা চুলগুলো সরিয়ে ঘাড়ে চুমু দিল। একটা, দুটো, অসংখ্য। প্রত্যেকটা চুমুতে তিতির কেপে কেপে উঠছিল। ওর ব্লাউজের ফিতাটা মুগ্ধ একটা টান দিয়ে খুলে ফেলল। ব্লাউজের পিছনের হুকগুলো খুলে পিঠে চুমু দিল। তারপর ব্লাউজটা টেনে খুলবার সময় বাধা দিল তিতির। কোনরকমে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,

-"লাইট টা বন্ধ করে নাও প্লিজ।"

অস্থির মুগ্ধ বলল,

-"না, কেন?"

-"আমার লজ্জা লাগবে নাহলে।"

-"হুম, লাগুক। আমি তো তোমার লজ্জাটাই দেখতে চাই। আই লাভ ইট।"

-"না প্লিজ, আমি তাহলে মরে যাব।"

-"আমি তো তাহলে কিচ্ছু দেখতে পারবো না।"

-"দেখা লাগবে না। আরেকদিন দেখো। আজ লাইটটা বন্ধ করো। পায়ে পড়ি তোমার।"

বাইরে তখন তুমুল বর্ষন। বাতাস আর বৃষ্টির তোড়ে বারান্দার দরজার পর্দা ভেতরে এসে উড়ছে। মুগ্ধ গিয়ে লাইট টা বন্ধ করে ফিরে এল। তবু বাগানের লাইটের যতটুকু আলো আসছে তাতে সব স্পষ্ট না হলেও আবছা দেখা যাচ্ছে সবই। তারপর ব্লাউজটা খুলে ফেললো। তিতির লজ্জায় উপুর হয়ে শুয়ে পড়লো। কি করবে ও? একদিকে মুগ্ধ কাছে আসতেই লজ্জায় মরে যায় অপরদিকে নিজের সর্বস্ব তুলে দিতে ইচ্ছে করে ওর জিম্মায়। মরতে ইচ্ছে করে মুগ্ধর হাতে। মুগ্ধ উপুর হয়ে শুয়ে থাকা তিতিরের সারা পিঠে চুমু দিতে লাগলো। তারপর তিতিরকে নিজের দিকে ফেরাতেই তিতির মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধও ধরলো। কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর মুগ্ধ তিতিরকে আবার শুইয়ে দিল। ঠোঁটে চুমু খেল। তারপর চুমু খেল গলায়, বুকে, পেটে। তিতিরের কাঁপতে কাঁপতে বেহুশ হয়ে যাবার অবস্থা। কিছু ভাললাগা থাকে না অসহ্যকর? সেরকমই কিছু ছিল।

তিতির চোখ বন্ধ করে ছিল। হঠাৎই মুগ্ধর ঠোঁটের স্পর্শ পেল পায়ে। লাফিয়ে উঠে নেশাভরা কন্ঠে বলল,

-"ছিঃ ছিঃ কি করছো?"

-"ছিঃ বলছো কেন?"

-"আমার পায়ে মুখ দিচ্ছো কেন?"

-"তো কি হয়েছে?"

-"আমার পাপ হবে।"

-"কিচ্ছু হবেনা। তোমার পায়ের উপর লোভ আমার কতদিনের জানো? একটু আদর করতে দাও।"

তিতির আর কিছু বলল না। জানে আর কিছু বলেও লাভ নেই, মুগ্ধ শুনবে না। দুইপায়ে মন ভরে চুমু খেয়ে মুগ্ধ উঠে এল। তিতিরের নাভির দু'ইঞ্চি নিচে চুমু খেতে খেতে মনে হলো কি করছে ও! আর তিতিরও আজ কিছুতেই বাধা দিচ্ছে না। ও তো ভাং খেয়ে আউট অফ মাইন্ড হয়ে গিয়েছে। কাল ঘুম থেকে উঠে যদি এসবের জন্যই আফসোস করতে থাকে? তাহলে মুগ্ধ নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না। মুগ্ধ সরে গিয়ে শুয়ে পড়লো তিতিরের পাশে। তিতির মুগ্ধর হাতটা সরিয়ে বাহুতে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরলো ওকে। মুগ্ধও ওকে একহাতে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো। কিচ্ছুক্ষণ পর তিতির ওর উপড়ে উঠে শুয়ে ওর বুকে মাথা রাখলো। মুগ্ধ বুঝতে পারছে তিতির আরো আদর চাইছে। ওরও যে ইচ্ছে করছে। কি করবে? তিতিরের চুলে হাত বুলিয়ে বলল,

-"তিতিরপাখি?"

-"হুম।"

-"আমাদের এখানেই থেমে যাওয়া উচিৎ না?"

তিতিরের বলতে ইচ্ছে করলো, 'না থামা উচিৎ না' কিন্তু পারলো না। বলল,

-"জানিনা।"

-"উচিৎ, কারন এটা পাপ।"

তিতির মুগ্ধর বুকের উপর থেকে মাথা না তুলেই বলল,

-"পাপ কেন হবে? আমরা তো দুজন দুজনকে ট্রু লাভ করি। প্রায় গত ৬ বছর ধরে তো তোমাকে আমি আমার বর বলেই মেনে এসেছি। আর তুমিও তো আমাকে বউই ভাব।"

-"শুধু ভাবিই না। মনেপ্রাণে মানিও সেটা। কিন্তু আমাদের বিয়ে তো হয়নি না?"

-"আমার ফ্যামিলির জন্য হয়নি। আমার বাবা মা রাজী হলে অন্তত দু'বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়ে যেত।"

-"হ্যা, কিন্তু হয়নি তো বাবা। আর এর থেকেও ইম্পরট্যান্ট কথা হলো তোমার আমার বিয়ে কখনোই হবে না তাই তোমার ভার্জিনিটি নষ্ট করার কোনো রাইট আমার নেই। যখন অন্যকারো সাথে তোমার বিয়ে হয়ে যাবে, আজকের ভুল টাই তোমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াবে সেদিন। তাই কোন ভুল করতে চাচ্ছি না।"

তিতির আর কিছু বলল না। মনে মনে বলল, 'মুগ্ধ তুমি এতটা ভাল না হলেও পারতে।' কখন ওর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল তা ও টের না পেলেও মুগ্ধ পেল। কিন্তু কিছু বলল না। শুধু জড়িয়ে ধরে রইলো। মনে মনে বলল, 'তিতির, জানি আমাদের বিয়ে অসম্ভব। তবু যদি কখনো কোনভাবে এই অসম্ভবটা সম্ভব হয় তাহলে এই মুহূর্তে যতটা কষ্ট তোমাকে দিলাম তার হাজার গুন সুখ তোমার পায়ের কাছে এনে দেব।'

To be continued...

প্রেমাতাল - পর্ব ৪২

মৌরি মরিয়ম

তিতির কখন যেন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। মুগ্ধ ওকে বুকের উপর থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর উঠে দাঁড়াতেই বুঝতে পারলো শরীরটা ভার হয়ে আছে। বুকের ভেতর ব্যাথা করে উঠলো। বুকে হাত দিতেই দেখতে পেল বুকের লোমগুলো ভিজে গেছে তিতিরের চোখের জলে। বুকের ভেতরটায় হাহাকার করে উঠলো। ও জানেনা একটা মেয়েকে আদর করে তারপর চূড়ান্ত আদরের সময় ছেড়ে দিলে কেমন লাগে কিন্তু নিজেকে দিয়ে এটা বুঝতে পারছে একটা ছেলের কেমন লাগে! তিতির যেমন হাজার ফোঁটা চোখের জল ফেলেছে ওর বুকের উপর তেমনি ওর নিজেরও হাজার ফোঁটা চোখের জল বুকের ভেতর জন্ম নিয়ে বুকের ভেতরই ঝরে গেছে। তিতিরের গায়ে চাদর টেনে দিয়ে বারান্দায় চলে গেল মুগ্ধ।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরের আবছা অন্ধকারে থাকা পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুগ্ধ বুঝতে পারছিল ওর চোখ জ্বলছে। কাঁদলে নাকি হালকা লাগে? বুকের ভেতর এত কান্না অথচ কাঁদতে পারছে না কেন ও? কান্নার কি কোন মন্ত্র আছে? যেটা পড়ে মেয়েরা এত কাঁদে? নিশ্চই আছে যেটা ও জানেনা আর জানেনা বলেই কাঁদতে পারেনা। সারা শরীরের রক্ত যেন ফুটছে। আবার যেতে ইচ্ছে করছে তিতিরের কাছে, কিন্তু না ও যাবে না। তিতির কষ্ট পেয়েছে, আবার কষ্ট দেয়ার মানে হয়না। আর ওরও উচিৎ কন্ট্রোলে থাকা। কিন্তু সারাটা রাত কিভাবে কাটাবে ও? বারান্দার মধ্যে পায়চারী করলো কিছুক্ষণ। নিজের শরীরটাকে ব্লেড দিয়ে কেটে কুচিকুচি করতে পারলে বোধহয় এ অস্থিরতা কমতো। আরো কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে ফিরে গেল মুগ্ধ। ওর টি-শার্ট, তিতিরের শাড়ি সব ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ওগুলো তুলে রাখলো। তারপর খেয়াল হলো ও এখনো সেই আধাভেজা হাফপ্যান্ট টা পড়ে আছে। চেঞ্জ করে নিল। তারপর শুয়ে পড়লো। তিতির ওর দিকে ফিরে ঘুমাচ্ছে। এলোমেলো চুলগুলো চোখের উপর এসে পড়েছে। চুলগুলো চোখের উপর থেকে সরিয়ে দিল মুগ্ধ। তিতির ওর ছোঁয়া পেয়ে ঘুমের ঘোরেই ওকে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধর একটু শান্তি লাগলো। তিতিরকে আবার বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো। একফোঁটা না ঘুমিয়ে কাটলো মুগ্ধর রাতটা। সারাটা রাত ধরে যত আজগুবি চিন্তা করছিল। তার মধ্যে একবার তান্নাকে খুন করার প্ল্যানও করে ফেলেছিল।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ওরা ঢাকা রওনা দিল। দুপুরের মধ্যে ঢাকা পৌঁছে গেল। তিতির ওদের বাসার গলির মোড়েই নেমে গেল। নামার আগে মুগ্ধ বলল,

-"থ্যাংকস ফর লাস্ট টু ডেস।"

তিতির হাসলো। মুগ্ধ আবার বলল,

-"সেদিন অফিসের জন্য যখন বাসা থেকে বের হয়েছিলাম, তখন ভাবিওনি এরকম কিছু হতে পারে। দুদিন, দুরাত যেন স্বপ্ন দেখলাম।"

-"থ্যাংক ইউ টু গত দুটো দিন আমাকে দেয়ার জন্য। আমার কাছেও স্বপ্নই ছিল।"

তিতির গাড়ি থেকে নেমে জানালা দিয়ে তাকিয়ে বলল,

-"কাল তোমার একটা কথার রিপ্লাই দিতে পারিনি। আজ দেই?"

-"সিওর। কোন কথাটা?"

-"কাল বলছিলে না আমার ভার্জিনিটি নষ্ট করার রাইট তোমার নেই? কিন্তু তুমি কি এটা জানো আমার মনের ভার্জিনিটি তুমি অনেক আগেই নষ্ট করে দিয়েছো।"

মুগ্ধ হা করে চেয়ে রইলো। তিতির বলল,

-"আসি তাহলে। ভাল থেকো, নিজের যত্ন নিও।"

তিতির হাটা শুরু করতেই মুগ্ধ গাড়ি থেকে নেমে এক দৌড়ে চলে গেল তিতিরের কাছে। বলল,

-"তুমি রাগ করেছো কালকের জন্য? আই এম রিয়েলি সরি।"

-"রাগ করিনি। এটা বলার ছিল কিন্তু কাল বলতে পারিনি তাই আজ বললাম। সত্যিই রাগ করিনি। রাগ করলে কথা বলতাম? যাই হোক, তুমি এখন যাও। তোমাকে এখানে আমার সাথে কেউ দেখলে কি হবে জানোই তো।"

-"ওকে। আর সবসময় তো ফোন দেইনা, মাঝে মাঝে দিলে ধরো প্লিজ।"

তিতির হেসে বলল,

-"আচ্ছা, যাও এখন.. টাটা।"

বাসায় ফিরে তিতির গতকাল রাতের ঘটনাগুলো নিয়েই ভাবছিল। ইশ কি সুন্দর করে আদর করে মুগ্ধ! আচ্ছা ওর যখন অন্য কোন মেয়ের সাথে বিয়ে হবে তখন কি তাকেও মুগ্ধ এভাবেই আদর করবে? না! মরেই যাবে ও তাহলে! মুগ্ধ শুধু ওর। সেই মুগ্ধ অন্য কোন মেয়েকে ওর মত করে আদর করবে, অন্য কোন মেয়ে ওর মুগ্ধকে স্পর্শ করবে এটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। আগুন জ্বালিয়ে দেবে, প্রয়োজনে খুন করবে। তবু ওর মুগ্ধকে ও অন্য কারো হতে দেবে না। আচ্ছা এমন কিছুই কি করা যায়না যাতে বাবা-মা রাজি হয়ে যায় মুগ্ধর সাথে বিয়ে দিতে? আর কিছুই কি করার নেই? তিতির কাগজ পেন্সিল নিয়ে বসলো। উল্টোপাল্টা আঁকিবুকি করলে তিতিরের মাথায় ভাল ভাল আইডিয়া আসে। তাই করলো। কিন্তু কোন আইডিয়া এল না। সন্ধ্যাবেলা বাসার সবাই সিরিয়াল দেখতে বসেছে। এমন সময় তিতির চা বানাতে গিয়ে টিভিতে একটা বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল শুনতে পেল। সাথে সাথে ওর মাথায় একটা আইডিয়া এল। আইডিয়াটা নিয়ে সারারাত ভাবলো। ইয়েস, এর চেয়ে ভাল আইডিয়া হতেই পারেনা। বাবা-মা রাজী হতে বাধ্য।

খুশিতে ঘুমই আসছিল না তিতিরের। মুগ্ধকে ফোন করলো কিন্তু কিছু বলল না। একবারে সারপ্রাইজ দেবে।

মুগ্ধর মনটা বোধহয় খারাপ। সব কথাতে শুধু হু হা করছে। তিতির জিজ্ঞেস করলো,

-"তোমার মনটা কি খারাপ?"

-"হ্যা তিতির, আমি কালকের জন্য লজ্জিত।"

-"কেন?"

-"অতটা উচিৎ হয়নি। আমার মাথা ঠিক ছিলনা।"

তিতির হেসে বলল,

-"কেন ভাং এ ধরেছিল তোমাকে?"

-"জানিনা, হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। আমার কোন কিছুতে নেশা হয়না। কিন্তু ভাং টাতে আমি অভ্যস্থ নই।"

-"বাদ দাও না। কাল যা গেছে গেছে। ওটা নিয়ে আর ভেবোনা। সামনের দিনের কথা ভাবো।"

-"আমি তো কোন আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না।"

এসব কথায় তিতিরের খারাপ লাগছিল। তাই ও প্রসঙ্গ পালটে বলল,

-"তোমাকে অনেক অনেক থ্যাংকস কাল রাতের জন্য। তুমি আমাকে দেখিয়ে দিয়েছো ভালবাসার বৃষ্টি কাকে বলে। তুমি আমাকে ফিল করিয়েছো সুখ কতটা সুখের হতে পারে!"

মুগ্ধর বুকের ভার হালকা হলো এটা ভেবে যে, যাক ঘুরে এসে তিতিরের মনটা তো ফ্রেশ হয়েছে। একটু হলেও ভাল আছে আগের চেয়ে। কিন্তু তখনও মুগ্ধ জানেনা কি চলছিল ওর মনের মধ্যে।

পরদিন দুপুর ১১/১২ টার দিকে তিতির হুট করে রান্নাঘরে গিয়ে বলল,

-"মা তোমার সাথে আমার কথা আছে।"

-"এখন রান্না করছি, পরে বলিস।"

-"ইটস আর্জেন্ট।"

মা ওর দিকে ফিরে বলল,

-"কি বল?"

-"আমি প্রেগন্যান্ট।"

মায়ের হাত থেকে খুন্তিটা পরে কয়েকবার উল্টিপাল্টি খেয়ে একসময় থেমে গেল। তিতিরের একফোঁটা ভয় করলো না। বরং কথাটা বলতে পেরে বেশ হালকা লাগলো।

To be continued...

প্রেমাতাল - পর্ব ৪৩

মৌরি মরিয়ম

মা কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শীতল গলায় বলল,

-"কি করে হলো এসব?"

তিতির তো আকাশ থেকে পড়লো। নিজের মেয়েকে কেউ এসব জিজ্ঞেস করে? এমনি লজ্জা লাগছে আবার ডিটেইল জানতে চাচ্ছে। এমন তো না যে মা জানেনা কি করে মানুষ প্রেগন্যান্ট হয়। ওকে চুপ থাকতে দেখে মা আবার জিজ্ঞেস করলো,

-"কি করে হলো? আমরা তো বিয়েটা ভেঙে দিয়ে বলেছিলাম এ বিয়ে কক্ষনো সম্ভব না। যোগাযোগ রাখিস না, তুইও তো বলেছিলি যোগাযোগ নেই। তাহলে প্রেগন্যান্ট হলি কি করে?"

তিতির মনে মনে ভাবলো, ও আচ্ছা মা এই ব্যাপারে জানতে চেয়েছে! বলল,

-"আমাদের মধ্যে আবার যোগাযোগ হয়েছে মা। আমরা দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতে পারি না।"

-"এই অকাজ কোথায় করেছিস? ওই বদমাইশ টা তোকে হোটেলে নিয়ে গেছে?"

তিতির লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিল। কিন্তু মাঝপথে থেমে গেলে হবে না ওকে বলতেই হবে। বলল,

-"না মা। ওর বাসায়।"

-"কি করে হয় এসব? দেশে কি প্রটেকশন ছিল না?"

তিতিরের লজ্জায় এবার মরেই যেতে ইচ্ছে করছিল। চুপ করে রইল। মা একটু থেমে আবার বলল,

-"আমি আগেই বুঝেছিলাম এই ছেলে সুবিধার না।"

তিতির যেকোনো মূল্যে মুগ্ধকে চায়। বুকে সাহস রেখেই বলল,

-"মা ও তো জোর করে আমার সাথে কিছু করেনি। যা হয়েছে আমার স্বজ্ঞানে, স্বইচ্ছায় হয়েছে।"

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে মা এব্যাপারে আর কথাই বাড়ালো না। প্রসঙ্গ পালটে বলল,

-"তুই প্রেগন্যান্সির কথা জানলি কি করে?"

-"টেস্ট করিয়েছি।"

-"বাহ! আমার মেয়ে দেখছি অনেক এডভান্স।"

তিতির মনে মনে আল্লাহ কে ডাকতে লাগলো যেন মা এটা জিজ্ঞেস না করে যে কোথায় টেস্ট করিয়েছে। তাহলে তো মহাবিপদ। ঠিক তখনই মা জিজ্ঞেস করলো,

-"কোথায় টেস্ট করিয়েছিস?"

-"হসপিটালে।"

-"কয় মাস?"

কি বলবে! আন্দাজে বলে দিল,

-"আ.. দুই মাস হবে।"

-"এরকম আন্দাজে বলছিস কেন? ঠিক করে জানিসও না? আবার মা হতে যাচ্ছে! যত্তসব।"

"মা হতে যাচ্ছে" এই কথাটা শুনে একটা অদ্ভুত ফিলিং হলো। ফিলিং টা তো জোস! ওকে নিশ্চুপ দেখে মা বলল,

-"কবে টেস্ট করিয়েছিস?"

-"দেড় মাস আগে।"

-"দেড় মাস আগে মানে? দ্বিতীয় মাসে যাস নি?"

প্রতি মাসে যেতে হয়! নাকি মা বিশ্বাস করতে না পেরে ঢপ মারছে! কিছুই বুঝতে পারছে না তিতির। মা বলল,

-"আমি জানতাম ওই ছেলে এরকম ইরেস্পন্সিবলই হবে।"

তিতিরের খুব অসহায় লাগলো। মা মুগ্ধকে দোষ দিচ্ছে! মুগ্ধ যদি ইরেস্পন্সিবল হয় তাহলে দুনিয়াতে রেস্পন্সিবল বলে কোন শব্দই নেই। কিন্তু তিতির কোন প্রতিবাদই করতে পারলো না। যাই হোক, বিয়ের পরে তো জানাজানি হবেই যে ও মিথ্যে বলেছিল তখন তো মায়ের ভুল ভাঙবে, তখন ঠিকই বুঝবে মুগ্ধ কতটা ভাল। দুজনে এটুকু খারাপ হয়ে যদি সারাজীবনের জন্য দুজনে এক হতে পারে তো দোষের কি?

মা রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল,

-"তোর ভাবীকে বল বাকী রান্নাটা শেষ করতে। আমার মাথা ঘুরছে। তোর বাপ ভাই কে একথা আমি কি করে বলবো আমি জানিনা।"

মা নিজের রুমে ঢুকতেই তিতির লাফিয়ে উঠলো। ইয়েস! মা পজেটিভ। চিন্তার চোটে বকতেও ভুলে গেছে!

লাঞ্চের সময় সবাই স্বাভাবিক। তার মানে মা এখনো কাউকে কিছু বলেনি। মাকে চিন্তিত দেখালো। চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল। লাঞ্চ শেষ করে তিতির নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকালো। এরপর মুগ্ধকে কল করলো। মুগ্ধ ফোন ধরেই বলল,

-"তিতির, পরে কল করছি। এখন একটু ব্যস্ত আছি।"

-"শোনো, শোনো.. এক মিনিট দাওনা। শুধু একটা কথাই বলবো।"

-"আচ্ছা বলো।"

-"তুমি বাবা হতে চলেছো।"

মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,

-"হোয়াট?"

তিতির হেসে বলল,

-"হুম।"

মুগ্ধ কিছু বলার আগেই একটা মেয়ের মিষ্টি গলা পাওয়া গেল। মুগ্ধকে বলল,

-"মে আই কামিং স্যার?"

-"নো।"

-"ওহ, সরি স্যার। একচুয়েলি ওনারা চলে এসেছে।"

-"এসেছে তো কি হয়েছে? বসতে বলেন, চা-কফি খাওয়ান। আমি ডেকে নিব। আপনি এখন যান।"

-"ওকে স্যার।"

তারপর মুগ্ধ বলল,

-"হ্যা বলো কি হয়েছে? ইন শর্ট বলবে। ক্লায়েন্ট বসে আছে, আমি মিটিং এ বসবো।"

-"ওহ, সরি আমি দুষ্টুমি করছিলাম।"

-"নাহ এটা শুধু দুষ্টুমি না। কাহিনী কি তাড়াতাড়ি বলো।"

-"আরে সিরিয়াসলি এটা দুষ্টুমি ছিল। তুমি ফ্রি থাকলে দুষ্টুমিটা আরেকটু কন্টিনিউ করতাম। জাস্ট তোমাকে এই ফিলিং টা দেয়ার জন্য যে বাবা হচ্ছো শুনলে কেমন লাগে, হোক না মিথ্যেমিথ্যি।"

-"এরকমটা হলে আমি বিজি শুনেও এক মিনিট চাইতে না বলার জন্য।"

-"আরে নারে বাবা। সত্যি আমি বুঝতে পারিনি যে তুমি এরকম বিজি। আর তুমি কি বাবা হওয়ার মত কিছু করেছো যে বাবা হবে?"

-"না।"

-"তাহলে? যাই হোক, ওই মিষ্টি কণ্ঠী মেয়েটা কে?"

-"আমার কলিগ।"

-"তো ওরকম ঝাড়ি মারলে কেন? মিষ্টি করেই তো বলতে পারতে।"

-"অফিসের কলিগ আমার ঘরের বউ না যে মিষ্টি করে কথা বলবো। আর ও ঝাড়ি আরেকটা খাবে আমি না বলার পরেও ভেতরে আসবার জন্য, যেতে বলার আগ পর্যন্ত বেহায়ার মত দাঁড়িয়ে থাকবার জন্য। কারন, ও দেখেছিল আমি ফোনে কথা বলছি। কেউ ফোনে কথা বলার সময় তার সাথে কথা বলতে হয়না এটা নরমাল

ম্যনার। এটুকু না জেনে চাকরি করতে চলে আসলে তো হবে না।"

-"থাক, এত বকাবকি করো না।"

-"এটাই সিস্টেম। আমার বস আমাকে ঝাড়বে। আমি আমার জুনিয়র কে ঝাড়বো, ও আবার ওর জুনিয়র কে গিয়ে ঝাড়বে। এই হ্যায়ারারকি সব যায়গায় আছে।"

-"আচ্ছা বাবা, আচ্ছা মাথা ঠান্ডা করো। এতটা মাথা গরম করার মত কিছু হয়নি। তুমি আসলে বাবা হচ্ছো না। আমি দুষ্টুমিই করছিলাম। তুমি যাও মিটিং এ বসো।"

একথা বলে তিতির একটা চুমু দিলো। মুগ্ধ বলল,

-"এসবে আমার কিছু হয়না, লাইভ লাগে আমার।"

-"গতকালই তো লাইভ দিলাম।"

-"হ্যা সেটা তো অনেক আগে।"

-"আচ্ছা, ঠিকাছে যাও তোমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, বাই।

-"বাই, কিন্তু কিছু ঘাপলা আছে। রাতে দেখছি ব্যাপারটা।"

একথা বলে মুগ্ধ ফোন রেখে দিল।

বিকেলে মা এসে দরজায় নক করলো। তিতির দরজা খুলতেই মা বলল,

-"১০ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নে।"

-"কেন মানে? ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগবে না? ওই ইরেস্পন্সিবল টা তো তোকে ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যায়নি!"

-"নিয়েছে তো মা।"

-"নিয়েছে তো টেস্ট করাতে। দু'মাস হয়ে গেছে অথচ একবারও চেকাপ করাতে নেয়নি যখন, তখন তো ও অবশ্যই ইরেস্পন্সিবল। যাই হোক, এত কথা বলার সময় নেই। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়।"

একথা বলে মা চলে গেল।

তিতির ভাবনায় পড়ে গেল। কি হবে এখন? ডাক্তারের কাছে গেলে তো ধরা পড়ে যাবে ও আসলে প্রেগন্যান্ট না। তখন? কি করবে? মুগ্ধকে ফোন করে যে বুদ্ধি চাবে সেটাও সম্ভব না। ও এখন মিটিং এ, ফোনটা নিশ্চিত সাইলেন্ট করা। তবুও একটা ফোন করলো। মুগ্ধ ধরলো না। টেনশানে তিতিরের গা কাঁপছে। এতদূর এসে ধরা খেয়ে প্ল্যানটা ভেস্তে যাবে ভাবতেই তিতিরের কান্না পেল। ইশ, কেন মিথ্যের উপর ভর করে ব্ল্যাকমেইল করতে গেল? মুগ্ধকে বলে সত্যি সত্যি প্ল্যান করে প্রেগন্যান্ট হত! তারপর নাহয় ব্ল্যাকমেইল টা করতো! এত তাড়াহুড়ার তো কিছু ছিল না। উফ কি হবে এখন? এসব চিন্তাভাবনার মধ্যে তিতিরের মনে এই কথাটাই এল যে, ডাক্তারকে রিকোয়েস্ট করে যদি ম্যানেজ করা যায়? সে যদি মাকে সত্যিটা না বলে তাহলেই তো আর কোন প্রব্লেম নেই কিন্তু কোন ডাক্তার কি সেটা করতে রাজী হবে? কেন হবে না যদি সেভাবে বোঝানো যায়? কিন্তু আলাদা করে কথা বলার সুযোগটাই যদি না পায়? পাবে না কেন? ও বলবে যে ওর মায়ের সামনে লজ্জা লাগছে। তাহলে তো ডাক্তার ওর মাকে সামনে রাখবে না। অবশেষে এই ভরসায় তিতির বের হলো। মা একটা কথাও বলল না পুরো রাস্তায়।

তিতিরকে ওদের এলাকারই একটা ক্লিনিকে নিয়ে আসা হয়েছে। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকেই তিতিরের চক্ষু চড়কগাছ! ইমা আন্টি! এটাই ইমা আন্টির ক্লিনিক তাহলে? ড. ইমা তিতিরের মায়ের বান্ধবী। একে কি করে কনভেন্স করবে ও? হায় খোদা। মানুষ নিজের অবিবাহিত মেয়ের প্রেগনেন্সি চেকাপ করাতে পরিচিত মানুষের কাছে যায় এই প্রথম দেখলো ও। সবাই তো এরকম কেস এ লুকিয়ে চুরিয়ে অপরিচিতদের কাছেই যায় গোপন রাখার জন্য।

চেম্বারে ঢুকে বসার পর তিতির বলল,

-"মা তুমি বাইরে যাও।"

ড. ইমা বলল,

-"ওর বোধহয় লজ্জা লাগছে। স্বাভাবিক প্রথমবার তো। তুই বাইরে অপেক্ষা কর। আমি ডেকে নেব।"

তিতিরের মা বলল,

-"না না আমি বাইরে যাব না। ওর মোটেও লজ্জা লাগছে না। আমার চোখের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে সব কথা বলেছে। ওর লজ্জাশরম সব গেছে। যে মেয়ে বিয়ে না করেই কারো সাথে শুতে পারে তার আবার লজ্জা কিসের?"

একথা শোনামাত্রই তিতিরের চোখ ফেটে কান্না এল। একটা শব্দও করলো না। শুধু চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। এ যেন পানি না রক্ত!

ড. ইমা বলল,

-"আহা, মাথা ঠান্ডা কর। কি সব বলছিস। তুই বাইরে যা তো। আমি দেখছি।"

মা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাইরে চলে গেল। তিতির কাঁদতে কাঁদতেই উঠে এসে ড. ইমার পা জড়িয়ে ধরে বলল,

-"আন্টি, প্লিজ আমাকে বাঁচান।"

-"আরে আরে করছো কি? পা ছাড়ো। এই পাগলী মেয়ে কি হয়েছে?"

-"আন্টি, আমার ফ্যামিলি আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে বিয়ে দিতে রাজী হচ্ছেনা। ৬ বছরের সম্পর্ক আমাদের। অনেকদিন ধরে অনেকভাবে চেষ্টা করছি, কোনো লাভ হচ্ছে না। তাই আমি এবার প্রেগনেন্সির কথা বলেছি। আসলে আমি প্রেগন্যান্ট নই, আমার বয়ফ্রেন্ড এসব করার মত ছেলেই না। কিন্তু প্লিজ আন্টি আপনি মাকে সত্যি কথাটা বলবেন না।"

-"সেকী!"

-"হ্যা।"

-"কিন্তু আমি কি করতে পারি?"

-"আপনি শুধু বলবেন সব ঠিকাছে, কোন প্রব্লেম নেই। আমি যে প্রেগন্যান্ট না সেটা প্লিজ বলবেন না।"

-"আরে আগে পা তো ছাড়ো।"

ড. ইমা তিতিরকে টেনে উঠিয়ে পাশের চেয়ারটাতে বসালো। বলল,

-"তিতির, আমি এটা কি করে লুকাবো বলো, তোমার মা তোমাকে এখানে এবরশন করাতে নিয়ে এসেছে।"

তিতিরের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। উনি আরো বলল,

-"তোমাকে একথা বললে কি তুমি আসতে? তাই চেকাপের কথা বলে এনেছে।"

তিতিরের কান্না আরো বাড়লো। ড. বলল,

-"বাচ্চাদের মত কান্না করো না। এসব না করে বাবা-মাকে বোঝাও যে তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডকেই বিয়ে করতে চাও।"

-"অনেক বুঝিয়েছি আন্টি। কোনটাতে কাজ হয়নি বলে আজ এই পথ বেছে নিয়েছি।"

-"তিতির, যেভাবে তুমি এসে আমার পা জড়িয়ে ধরেছো! আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা। বড্ড মায়া লাগছে, কিন্তু আমি কি করবো মা? আমার যে কিছুই করার নেই। তাও ভাগ্য ভাল যে তুমি সত্যি সত্যি প্রেগন্যান্ট হওনি। হলে একটা জীবন পৃথিবীতে আসার আগেই মেরে ফেলা হতো। আমি মায়ায় পড়ে না করলেও তোমার মা তোমাকে অন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত।"

তিতির কেঁদেই চলেছে। ড. আন্টি আবার বলল,

-"শুধু তোমার মা বলে কথা না। আমার এই ক্লিনিকে কয়েকদিন পরপর এরকম মায়েরা আসে তাদের মেয়েদের নিয়ে এবরশন করাতে। আজকাল অহরহ ঘটছে এসব। কাউকে তো দেখলাম না মেনে নিয়ে মেয়ের পছন্দমত বিয়ে দিয়েছে। আমি একজন মা বলেই বুঝি কোনো মায়েরাই এসব মানতে পারেনা। নিজে যখন মা হবে তখন বুঝতে পারবে। আসলে মায়েরা চিন্তা করে, যে ছেলে বিয়ের আগে এসব করতে পারে তারা আর যাই হোক ভাল ছেলে না তাই বিয়ে দিতে রাজী হয়না। প্রত্যেকটা মা ই তো চায় তার মেয়ের ভাল একটা ছেলের সাথে বিয়ে হোক। টাকা পয়সা, লেখাপড়া, চাকরী, যোগ্যতা সবকিছুর আগে দেখে চরিত্র। তার মেয়েরই ভাল জীবনযাপনের আশায়। তাই বলছি এভাবে বাবা-মা কে বিয়েতে রাজী করানো যায়না।"

-"কি করবো আন্টি? কোনোভাবেই বোঝাতে পারছিলাম না। আমি তো পারতাম ইচ্ছে করলেই পালিয়ে গিয়ে ওকে বিয়ে করতে। ওদের বাসার সবাই রাজী। আমাদের কোন প্রব্লেমই হতো না। কিন্তু বাবা-মায়ের কথা ভেবেই তো পারিনি। যাদের কথা ভেবে নিজে কষ্ট পাচ্ছি আরেকজনকেও দিচ্ছি তারা কি পারেনা একটু আমার কথাটা ভাবতে?"

-"হ্যা, সেটাই ভাবছিলাম আমি। কিন্তু তুমিও মা খুব বাজে একটা ওয়েতে গিয়েছো। এভাবে হবে না, অন্যভাবে বোঝাও।"

ড. আন্টি মাকে ডেকে বলল,

-"তোর মেয়ে প্রেগন্যান্ট না। শুধুমাত্র তোদেরকে বিয়েতে রাজী করানোর জন্য একথা বলেছে। ও ছেলেটাকে প্রচন্ড ভালবাসে। বুঝতে পারছিস একটা মেয়ে কখন ভয়ডর, লজ্জাশরম বিসর্জন দিয়ে একথা বলতে পারে? কতটা ভালবাসলে? তাছাড়া ও তো পারতো পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে। তা না করে তোদেরকে রাজী করানোর চেষ্টা করছে। এবার মেনে নে বোন।"

তিতিরের মা তখনই তিতিরকে শরীরের সব শক্তি দিয়ে একটা চড় দিল। তারপর ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে রিক্সায় উঠিয়ে সোজা বাসায়। পুরো রাস্তা একটা কথাও বলল না হাতটা শক্ত করে ধরে রইলো শুধু। বাসায় ঢুকেই এক সেকেন্ড দেরী না করে নিজের ঘরে চলে গেল। তিতিরও গেল নিজের ঘরে কিন্তু দরজা আটকালো না। এমন সময় ফোন এল মুগ্ধর। এখন ধরতে সাহস পেল না। মা যদি আসে? ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে দিল।

মা নিজের ঘরে গিয়ে আলমারী খুলে সেই ৩ ফিটের কাঠের স্কেল টা নিয়ে এল যে স্কেল টা ছোটবেলায় বানানো হয়েছিল তিতিরের ছবি আঁকার জন্য। একপাশে একটু ভেঙে যাওয়ায় ওটা আর তিনি ব্যাবহার করতে দেয়নি তিতিরকে। আজ সেই বহু বছরের অব্যহৃত স্কেলটি দিয়ে ইচ্ছেমত মারলো তিতিরকে। তিতির বরাবরই সবার খুব আদরের ছিল। কেউ কখনো ওর গায়ে হাত তোলেনি। মুগ্ধর কথা জানার পর কয়েকটা চড় থাপ্পড় খেয়েছে বটে কিন্তু এমন মারের সাথে পরিচিত ছিল না তিতির। মা এতই পাগলের মত মারছিল যে, কখন তিতির ফ্লোরে পড়ে গেছে সেদিকে খেয়ালই করেনি। তিতির একটা কথাও বলল না। নীরবে কাঁদতে লাগলো শুধু। এত জোড়ে মারার পরও চিৎকার করছেনা বলে মা আরো জোরে মারছিল। প্রথমে ভাবী আর চম্পা ছাড়া কেউ বাসায় ছিল না থামাবার মত। ভাবী থামাতে আসায় মা ভাবীকে এমন ধাক্কা দিল ভাবী গিয়ে পড়লো দরজার উপর। মাথায় ব্যাথা পেল। আর আগাতে সাহস পেলনা। কাঁদতে লাগলো শুধু। চম্পা তো এগোলোই না, দূরে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। মায়ের শরীরের সব শক্তি একসময় শেষ হয়ে গেল। এবার সেও কাঁদতে লাগলো। একসময় বাবা এল। চম্পা দরজা খুলেই বলল,

-"খালুজি আফারে বাঁচান।"

বাবা অস্থির হয়ে বললেন,

-"কি হয়েছে তিতিরের?"

চম্পা বাবাকে নিয়ে এল তিতিরের ঘরে। মেয়েকে ফ্লোরে মরার মত পড়ে কাঁদতে দেখে বাবা ছুটে এলেন,

-"কি হয়েছে মা? কি হয়েছে?"

তিতিরের গায়ে স্কেলের দাগ বসে গেছে। তিতির কিছুই বলতে পারলো না শুধু হিচকি দিয়ে কাঁদতে লাগলো। ভাবী বলল,

-"বাবা, তিতির আর মা বাইরে গিয়েছিল। ফিরে এসে হঠাৎই মা তিতিরকে মারতে লাগলো কেন তা জানিনা।"

এমন সময় তান্নাও রুমে ঢুকলো। মা যখন তিতিরকে মারতে শুরু করে ভাবী তখনই তান্নাকে ফোন করেছিল। ফোন পেয়ে তান্না দৌড়ে এসেছে। তান্না তিতিরকে ধরে উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। বাবা এবার মাকে ঝাড়ি দিয়ে বললেন,

-"তুমি আমার মেয়েকে এভাবে মারার সাহস কোথা থেকে পেলে? কি করেছে ও? মুগ্ধর সাথে বিয়ের কথা বলেছে তো? এ আর নতুন কি? তাই বলে এভাবে মারবে তুমি?"

মাকে চুপ থাকতে দেখে তান্না বলল,

-"কি হলো মা? বলছো না যে? এভাবে মারলে কেন ওকে? ইশ দাগ বসে গেছে।"

তান্নাও কেঁদে ফেললো। বাবা আবার জিজ্ঞেস করলো,

-"বের করে দিব বাসা থেকে। আমার মেয়েকে জানোয়ারের মত মেরে এখন চুপ করে বসে কাঁদছে।"

মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে পুরো ঘটনাটা বললো। সবাই কয়েক সেকেন্ড চুপ। সবার আগে কথা বলল তান্না। চোখ মুছে কান্না থামিয়ে বলল,

-"শোন তুই যদি ভাবিস যে এসব করলে আমরা তোকে ওই হারামজাদার সাথে বিয়ে দেব তাহলে ভুল ভাবছিস। কোন কিছু করে লাভ হবে না। এটা অসম্ভব। তোর মায়ের প্রতি সম্মান না থাকতে পারে আমার আছে, আমাদের আছে।"

বাবা চুপচাপ ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।

মা বলল,

-"ওকে যদি বিয়ে করতেই চাস তো চলে যা ওর কাছে, আমরা তো তোকে আটকে রাখিনি। ভাববি তোর বাপ-মা, ভাই কেউ নেই। আমরাও ভাববো আমাদের কোন মেয়ে নেই।"

তিতির কথা বলতে পারছিল না। সারাশরীর ব্যাথায় বিষের মত হয়ে আছে। অনেক কষ্টে বলল,

-"আমি গেলে তো অনেক আগেই যেতাম। তোমাদের পারমিশন ছাড়া বিয়ে করবো না বলেই তো মানাতে চাইছি। প্লিজ মা মেনে নাও না।"

তান্না ঘর থেকে বের হওয়ার আগে বলল,

-"ও সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মেরে ফেলো, আমার আর কিছু বলার নেই।"

মা তিতিরকে বলল,

-"তোকে পেটে ধরেই বড় পাপ করেছি আমি।"

To be continued...

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url