প্রেমাতাল - পর্ব ১৫-১৬-১৭-১৮-১৯ । Golpo Porun
প্রেমাতাল
(মৌরি মরিয়ম)
![]() |
This Photo is from Pexels |
আবার এলোযে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে।
চলোনা ঘুরে আসি অজানাতে
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে..."
গানটা শেষ হতেই তিতির বলল,
-"উফফ সত্যি খুব ভাল গান আপনি। আর গানটাও এত জোস। একদম পারফেক্ট এখানে এই পরিবেশে।"
মুগ্ধ হাসলো আর খেয়াল করলো তিতিরের ভয়েসটা একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। একদম ঘুমে জড়ানো। তিতির সেই ঘুমু ঘুমু ভয়েসে বলল,
-"সত্যি আমার আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করছেনা এখান থেকে। আচ্ছা, এই গেস্ট হাউজটা সারাজীবনের জন্য ভাড়া দিবেনা?"
মুগ্ধ আবার হেসে ফেলল। বলল,
-"তোমার মাথাটা দেখছি পুরোটাই গেছে। আচ্ছা ভাল কথা.. শোনো, কাল সকাল ৮ টা নাগাদ আমরা নাফাখুমের উদ্দেশ্যে হাটা ধরবো।"
-"সাফি ভাইয়াদের জন্য ওয়েট করবো না?"
-"হুম ৮ টা পর্যন্ত তো ওয়েট করবো। তার বেশি সম্ভব না। বেলা বেড়ে গেলে হাটতে কষ্ট হবে। আর ওদের জন্য এত ভাবতে হবেনা। ওরা ২৬ জন আছে। আমরা দুজন যেসব বিপদে পড়েছি ওরা সেসব বিপদে পড়বে না।"
-"ও।"
-"আচ্ছা, যাও যাও ঘুমাতে যাও এখন।"
তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-"আরেকটা গান শোনান না প্লিজ! তারপর ঘুমাতে যাব।"
কটেজের বারান্দা থেকেই দেখা যাচ্ছে রেমাক্রি গ্রামের ঘরগুলোতে হারিকেন আর কুপির আলোগুলো মিটিমিটি তারার মত জ্বলছে। কটেজের সামনেই জ্বলছে জোনাক পোকা। আর জ্বলছে তিতিরের জন্য মুগ্ধর বুক!
হঠাৎ মুগ্ধর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। আর সাথে সাথে একটা দুষ্টু গান ধরলো,
"এত কাছে দুজনে প্রেম ভরা যৌবনে
হঠাৎ ভুলে ভুল না হয়ে যায়!
মায়াবী রাত মাতাল নেশাতে
আজ মনে মোরে চায় যে মেশাতে
দ্বীপ নিভিয়ে ঝড় যে বয়ে যায়..
এত কাছে দুজনে প্রেম ভরা যৌবনে
হঠাৎ ভুলে ভুল না হয়ে যায়!
আখিতে জ্বলে কামনারই বহ্নি
অঙ্গ যে চায় সঙ্গ যে তন্বীর
মনের কথা মনেই রয়ে যায়..
এত কাছে দুজনে প্রেম ভরা যৌবনে
হঠাৎ ভুলে ভুল না হয়ে যায়!
আলেয়াকে মিছে ভালবেসোনা
দূরে থাকো কেন? কাছে আসোনা
কোরো না ভুল কে যে কয়ে যায়?"
এত কাছে দুজনে প্রেম ভরা যৌবনে
হঠাৎ ভুলে ভুল না হয়ে যায়!"
গান গাওয়ার সময় মুগ্ধ ইচ্ছে করেই তিতিরের দিকে তাকালো না। শেষ করে তাকাতেই মুগ্ধ দেখতে পেল তিতির বারান্দার ফ্লোরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। হায় খোদা! কখন ঘুমিয়ে পড়লো মেয়েটা! বাচ্চা কাকে বলে! লাভ কি হলো ডুষ্টু গানটা গেয়ে? ওর লজ্জা পাওয়াটাই দেখা হলো না। মুগ্ধ ডাকলো,
-"তিতির? এই তিতির?"
তিতিরের কোনো সাড়াশব্দ নেই। মুগ্ধর আর ডাকতে ইচ্ছে করছিল না। কি ইনোসেন্ট যে লাগছিল! মুগ্ধ তিতিরকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর পাশে বসে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। চাঁদের আলোয় ওকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। উফ এত কেন ভাল লাগে তিতিরের আনকোরা মুখটা! চুলগুলো এলোমেলো। নিচের ঠোঁটটা সামান্য ভেতরের দিকে ঢুকে রয়েছে। কি মিষ্টি! কি মায়াবী! মুগ্ধর খুব ইচ্ছে করছে তিতিরের কপালে একটা চুমু দিতে! কিন্তু ব্যাপারটা কি ঠিক হবে? তারপর আবার ভাবলো কপালেই তো, ক্ষতি কি! কিন্তু তিতির যদি জেগে যায় আর মাইন্ড করে! করলে করবে। তখন বরং বোঝা যাবে তিতির ওকে ভালবাসেনা। আর যদি জেগে যায় কিন্তু রাগ না করে তাহলেও বোঝা যাবে যে তিতির ওকে ভালবাসে। পরক্ষণেই ভাবলো, ধুর কিসব ভাবছে ও। তার চেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঘুম দিক। উঠে দাঁড়িয়ে হাটা শুরু করলো মুগ্ধ। দরজার কাছ পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এল। আবার ওর পাশে বসলো। তারপর নিচু হয়ে তিতিরের কপালে একটা চুমু দিল। নাহ তিতিরের ঘুম ভাঙলো না। ইশ! ঘুম ভাঙা উচিৎ ছিল। নেগেটিভ হোক পজেটিভ হোক ওর এক্সপ্রেশন টা থেকে তো অনেক কিছু বোঝা যেত। কয়েক সেকেন্ড বসে উঠে চলে গেল নিজের ঘরে।
''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন
মুগ্ধ চলে যাওয়ার পর তিতির পাশ ফিরে বালিশটা জড়িয়ে ধরলো। হাত পা রীতিমত কাঁপছিল, ঠোঁটে ছিল বিশ্ব জয় করার হাসি! ও ঘুমের ভান করেছিল এতক্ষণ। কারন, মুগ্ধ যেই গান গাইতে শুরু করেছিল তাতে লজ্জায় মরে যেত পরে চোখে চোখ পড়লে। তাছাড়া মুগ্ধর কোলে ওঠার জন্যও এর চেয়ে ভাল উপায় আর নেই। কিন্তু তার সাথে যে ওর ঠোঁটের ছোঁয়াটাও পাবে তা ভাবেনি। এবার ও শিওর যে মুগ্ধ ওকে ভালবাসে। লোভে পড়ে করলে ঠোঁটে করত, অন্য কোথাও করতো। ভালবাসা থেকে করেছে বলেই কপালে করেছে। উফফ, তিতিরের কি যে আনন্দ হচ্ছে!
বিছানায় শুতেই মুগ্ধর খেয়াল হলো তিতির তো ঘুমে, দরজা লাগাতে পারবে না। দরজাটা সারারাত ভেজানো থাকবে? তিতিরকে এতটা আনসেফ রেখে ও ঘুমাতে পারবে না। নিজের খুঁটিনাটি যেসব জিনিসপত্র যা ও বের করেছিল তা আবার ব্যাগপ্যাকে ভরে নিয়ে তিতিরের ঘরে চলে গেল। তিতির টের পেলেও কিছু বলল না। মুগ্ধ ভেতর দরজায় খিল দিয়ে ব্যাগপ্যাকটা ফ্লোরে রেখে ঘরের অন্য বিছানাটায় শুয়ে পড়লো। তিতিরের দিকে আর এক বারের জন্যও তাকালো না। ও মেয়ে না ও একটা মায়াজাল!
খুব ভোরে ঠিকমতো আলো ফোটেনি তখন তিতিরকে ডাকলো মুগ্ধ,
-"এই তিতির, ওঠো ওঠো।"
তিতির একটু কান্নার ভাব করে পাশ ফিরে শুলো। মুগ্ধ তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে ঝাকি দিয়ে দিয়ে ডাকছিল,
-"এই মেয়ে, ওঠো না প্লিজ। নাহলে খুব মিস করবা। ওঠো ওঠো।"
-"আয়ায়া, আমি ঘুমাচ্ছি তো.. উফফো।"
তিতিরের এই আহ্লাদী কথার সাথে ছিল সেই ঘুমু ঘুমু মাতাল করা ভয়েস! শুনে মুগ্ধর বুকের ভেতরটায় কিছু একটা চুরচুর করে পড়ছিল। ইচ্ছে করছিল ওকে কোলের মধ্যে নিয়ে অনেক অনেক আদর করতে! আবার ডাকলো,
-"ওঠো না। একটু পর নাহয় আবার ঘুমিয়ো।"
তিতিরের কোনো হেলদোল নেই। বাবারে বাবা কি ঘুম! মুগ্ধ তিতিরকে ধরে উঠালো। তারপর বিছানা থেকে নামিয়ে দাঁড় করাতেই লুটিয়ে পড়লো মুগ্ধর বুকে। কাল থেকে বুকের ভেতরটা যে খরায় খা খা করছিল তাতে যেন ঝুমবৃষ্টি নামলো। তিতির ঘুমে পুরো কাদা! মুগ্ধ তিতিরকে বুকে জড়িয়ে ধরেই টেনে টেনে বারান্দায় নিয়ে গেল। মুগ্ধ পারতো ওকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে যেতে কিন্তু তাতে তো এতক্ষণ তিতির ওর বুকের মধ্যে থাকতো না! বারান্দায় নিয়ে মুগ্ধ তিতিরের গালে হাত দিয়ে বলল,
-"একবার চোখটা খোলো না.. তিতিরপাখি.. ও তিতিরপাখি.. তাকাওনা একবার।"
তিতির একটু সজাগ হলো। ঘুমে জড়ানো চোখদুটো খুলতেই হালকা আলোয় যেন এক কল্পলোক দেখতে পেল। চারদিকে মেঘ আর নীল, সবুজ পাহাড়ের এক অপূর্ব সমন্বয়। প্রকৃতি যেন এখানে উজার করে রেখেছে এর রূপের ঝাঁপি। ছোট ছোট মেঘের ভেলায় চড়ে কোন এক অপরূপা রাজকন্যা যেন নেমে এসেছে পাহাড় রাজার দেশে। নীল আকাশ হতে সূর্যের আলো যেন সেই রাজকন্যাকে সোনার মুকুট পড়িয়ে পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে উষ্ণ পরশে সকলের ঘুম ভাঙাবে বলে।
তিতির তখনও মুগ্ধর বুকে মাথা রেখে শুয়ে ছিল। এসব দেখতেই সোজা হয়ে দাড়ালো। কটেজের সিড়ি বেয়ে নেমে গেল সামনে। এখান থেকেই একপাশে ঘুমিয়ে থাকা রেমাক্রি বাজার দেখা যাচ্ছে। ছোট-খাট একটি বাজার। দোকান প্রায় ৩০ টির মত। বাজারের চারপাশে দোকান আর মাঝখানটা ফাঁকা। আসলে এগুলো প্রত্যেকটি এক একটি বাড়ি। সামনের অংশটুকু দোকান আর পিছনের অংশে তারা বসবাস করে। অন্যপাশে দেখা যাচ্ছে সেই সাঙ্গু নদী। তার ওপাশে গহীন জঙ্গল। আরেকপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। খুব দূরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না, হালকা কুয়াশা ছিল। তিতির এসব দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। মেঘগুলো সামান্য উপড়ে। উড়ে গিয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। মুগ্ধ পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তিতির একটা উঁচু পাহাড় দেখিয়ে বলল,
-"আমাকে ওই পাহাড়চূড়াতে নিয়ে যাবেন একবার?"
-"এত ঘুমালে কিভাবে নিয়ে যাব ঘুমকুমারী?"
তিতির এবার আর রাগ করলো না। চোখ বড় বড় করে তাকালো না। মুগ্ধর একটা হাত ধরে বলল,
-"নিয়ে চলুন না ওখানে? যদি সম্ভব হয় আরকি।"
মুগ্ধও ফাজলামো থেকে বেড়িয়ে এসে বলল,
-"আমি তোমাকে ওখানে নিয়ে যাব বলেই ডাকছিলাম। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। জাস্ট ৫ মিনিটে। নাহলে বিশাল মিস হয়ে যাবে।"
তিতির ৩ মিনিটে ফ্রেশ হয়ে জাস্ট একটা শাল জড়িয়ে চুলগুলোকে হাতখোঁপা করতে করতে বেড়িয়ে এল,
-"চলুন।"
তিতিরের ওই হাতখোঁপা করার দৃশ্যটা মুগ্ধর চোখে আটকে রইলো। এই ছোট ছোট অতি সাধারণ ব্যাপারগুলো কেন যে মুগ্ধর এত ভাল লাগে! আর তিতিরের মধ্যেই বিধাতা যেন সব দিয়ে রেখেছেন যা মুগ্ধ সারাজীবন চেয়ে এসেছে।
মুগ্ধর কাধে ছোট একটা ব্যাগ দেখে তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-"ব্যাগ নিচ্ছেন যে? আমারও নিতে হবে?"
-"নাহ, এত কথা বলার সময় এখন নেই। চলোতো।"
-"সময় নেই কেন? আর এত তাড়াহুড়োই বা কেন করছেন?"
-"বলবো, আগে তো চলো।"
মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরে ধরে ওকে পাহাড়ের উপড়ে ওঠাচ্ছিল। অনেক খাঁড়া একটা পাহাড়। এটা কোন ট্রেইলের মধ্যে পড়েনা তাই রাস্তাও নেই। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পা বাঝিয়ে বাঝিয়ে উঠতে হচ্ছে।
প্রায় ২০ মিনিট ওঠার পর ওরা সেই পাহাড়ের চূড়ায় উঠলো। তিতির উঠেই বসে পড়লো, হাপাচ্ছিল। মুগ্ধ সেই ছোট ব্যাগটা থেকে পানির বোতল বের করে দিল তিতিরের দিকে। তিতির পানি খেয়ে বোতলটা মুগ্ধকে দিয়ে দিল। মুগ্ধ সেটা ব্যাগে রাখতেই তিতির বলল,
-"আপনি পানি খেলেন না যে? তৃষ্ণা পায়নি?"
-"নাহ, এটুকুতেই যদি হাপিয়ে যেতাম তাহলে কি উঁচু উঁচু পাহাড়ে ক্লাইম্বিং করে উঠতে পারতাম?"
-"তার মানে কি আমি কখনো ওসব পাহাড়ে উঠতে পারবো না?"
-"অবশ্যই পারবে। প্রথমেই তো আর কেউ পারেনা। ট্রেনিং নিতে হয়।"
-"ওহ।"
মুগ্ধ হাত বাড়িয়ে বলল,
-"হয়েছে, এবার ওঠো।"
তিতির মুগ্ধর হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। মুগ্ধ তিতিরকে ঘুড়িয়ে দাঁড় করালো। তারপর ওর পাশে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে একটা পাহাড় দেখিয়ে বলল,
-"শোনো, ওই দিকে তাকিয়ে থাকো।"
হঠাৎ কিছু মেঘ এসে তিতিরের গায়ে লাগলো। আর তিতিরের গায়ের সেই অংশটা ভিজে গেল। তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-"এই মেঘ মেঘ! ইশ কি সুন্দর! আমার গায়ে এসে লাগলো।"
-"হুম নোড়োনা। এখনি তোমার গালে লাগবে।"
মুগ্ধর কথা শেষ না হতেই আবার মেঘ এসে লাগালো ওর গালে, মুখে, কানে। তিতির চোখ বন্ধ করে তা উপভোগ করলো। পরেরবার মেঘ আসতেই তিতির ধরতে গেল। আর মেঘ ওর হাতের উষ্ণতা পেয়ে গলে পানি হয়ে গেল। তিতির তা মুগ্ধকে দেখালো। মুগ্ধ হাসলো। মুগ্ধর মেঘের দিকে কোন মনোযোগ নেই। ওর সব মনোযোগ এখন তিতিরের দিকে। মেঘ ও জীবনে অনেক দেখেছে। এখন তিতিরকে দেখার পালা। তিতির বাচ্চাদের মত খালি মেঘ ধরার চেষ্টা করছে। হঠাৎ মুগ্ধ বলল,
-"এই তোমাকে না বললাম ওই পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে থাকো।"
-"কেন ওদিকে কি?"
একথা বলে পাহাড়টার দিকে তাকালো। কিছুই দেখতে পেলনা। তারপর মুগ্ধর দিকে ফিরে বলল,
-"পাহাড় তো সব যায়গা থেকে দেখা যায়। কিন্তু এত কাছে মেঘ কোথাও পাইনি। আমি মেঘই ধরবো।"
মুগ্ধ তিতিরের মাথাটা ঘুড়িয়ে ধরলো সেই পাহাড়টার দিকে। বলল,
-"জাস্ট আর কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকো।"
কয়েক সেকেন্ড পর তিতির দেখতে পেল বিশাল এক সূর্য থালার মত একটা মাথা জাগিয়েছে পাহাড়ের ওপাশ থেকে। তিতির কোনো কথা বলতে পারলো না। কি অসাধারণ! আস্তে আস্তে সূর্যের এক প্রান্ত পুরো পৃথিবীকে তাতিয়ে উপরে উঠছে। আরো একটু উপরে.. তারপর আরো একটু উপরে। এভাবে একটু একটু করে পুরো সূর্যটাই যখন উপরে উঠে গেল তখন তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-"সূর্যটা অনেক বড়। একেবারে অন্যরকম! পাহাড়ের সূর্য বুঝি এমন ভয়ঙ্কর সুন্দর হয়?"
-"শুধু পাহাড়ে নয় সূর্যোদয়ের সময় সূর্য সব যায়গাতেই এমন থাকে। কিন্তু শহরের মানুষ সূর্য ওঠার অনেক পরে ওঠে বলে সূর্যের এই রূপের কথা জানতে পারেনা। তাছাড়া ইট পাথরের দেয়ালের ভেতর থেকে এই সূর্যকে দেখার সুযোগ কোথায় বলো? এই রূপটা পাহাড় আর সমুদ্র থেকে সবচেয়ে ভাল উপভোগ করা যায়।"
-"আপনি কি করে আগে থেকে বুঝেছিলেন ওই পাহাড়ের আড়াল থেকেই সূর্যটা উঠবে?"
-"আমি আগেও এখানে এসেছিলাম, কটেজ থেকে দেখে মনে হয়েছিল এখানে এলে মেঘ ধরতে পারবো, তাই এসেছিলাম। এসে হঠাৎই এইরকম সূর্যোদয় দেখে সারপ্রাইজড হয়েছিলাম। সূর্যোদয় আমি আগেও বহু দেখেছি সমুদ্রের পাড় থেকে, এর চেয়েও অনেক উঁচু পাহাড় থেকে। কিন্তু তবু এই যায়গা থেকে কেন জানি সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছিল।"
-"আপনার সেই ভাললাগাটা আজ আমাকে দেয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"না না, ধন্যবাদ নেবনা।"
-"তাহলে?"
-"তোমাকে ঋণী করে রাখবো।"
To be continued...
প্রেমাতাল - পর্ব ১৬
মৌরি মরিয়ম
পাহাড়ে ওঠাটা যতটা কঠিন ছিল নামাটা আরো বেশি কঠিন মনে হলো তিতিরের। নিচে তাকাতেই ভয় করছে। এত খাড়া পাহাড়! মুগ্ধ বলল,
-"আরে এভাবে পা ফেলছো কেন? এত ভয়ের কিছু নেই।"
-"ভয়ের কিছু নেই মানে? কোথায় পা ফেলবো সেটাই তো বুঝতে পারছি না।"
মুগ্ধ হেসে তিতিরের হাত ধরে ধরে পাহাড় থেকে নামালো। তারপর কটেজের সামনে এসে তিতির নৌকা ঘাটের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
-"দেখুন দেখুন, সাফি ভাইয়ারা আসছে।"
মুগ্ধ তাকিয়ে দেখলো চারটা নৌকা এসে ঘাটে ভিড়েছে। সাফি এবং অন্যরা নৌকা থেকে নামছে। কাঠের ব্রিজটাতে উঠেই সাফি ওদেরকে দেখতে পেল। সেখান থেকেই হেসে হেসে বলল,
-"ভাই শুধু তোর পক্ষেই এটা সম্ভব! হারিয়ে গিয়েও আমাদের আগে এসে বসে আছিস!"
মুগ্ধও হাসি মুখে বলল,
-"আর তুই যেটা করেছিস সেটাও শুধু তোকে দিয়েই সম্ভব।"
ততক্ষণে সাফি ওদের কাছে চলে এসেছে। দুই ভাই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলো। সাফি বলল,
-"আমি তোকে না দেখে ভেবেছিলাম তুই প্রথম গাড়ীতে চলে গেছিস। নিলগিরি গিয়ে দেখি তুই নেই। আর তিতিরও নেই। কি যে ভয় পেয়েছিলাম। পরে দোলা বলল যে ও নাকি শিওর তিতির তোর সাথেই আছে।"
মুগ্ধ সাফিকে ছেড়ে বলল,
-"তুই নিলগিরি গিয়ে টের পেয়েছিস যে আমি নেই! তাহলে বোঝ তুই কোন জাতের ছাগল।"
-"সরি সরি ভাই।"
-"কাল রাতে কোথায় ছিলি? থানচি থেকে না ভোরে রওনা দিয়েছিলি?"
-"হ্যা, ভাই কি আর বলবো ভুল রাস্তায় গিয়ে দুনিয়ার ঘুরলাম।"
-"কেন মাঝিরা রাস্তা চিনে না? আর গাইড নেস নাই?"
-"মাঝিদের কথা কি আর বলবো। একজন বলল কোন রাস্তা দিয়ে জানি শর্টকাট মারবে আর অন্যরাও লাফাতে লাফাতে সেদিকে চললো। গাইডরা নিষেধ করেছিল। ওরা শোনেনি।"
-"বললে আবার শুনবে না কেন?"
-"গাইডও যে কি জুটসে কপালে! তোমার মংখাইরে খালি পায়ে ধরা বাকী রাখছি। সে বলে সে মাত্র নাফাখুম থেকে গেছে সে কোনক্রমেই আসতে পারবেনা।"
মুগ্ধ হেসে দিল। তিতির এতক্ষণ চুপ করে ছিল। তারপর মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-"উনি কোন মংখাইয়ের কথা বলছে?"
তিতিরের কথা শেষ হতে না হতেই মংখাইকে দেখা গেল নদী থেকে ব্রাশ হাতে উঠে আসছে। সাফি বলল,
-"ওই মিয়া তুমি না কইলা আসবা না?"
মংখাই দাঁত কেলিয়ে বলল,
-"মুগ্ধ দাদা বললে তো না আসি পারিনা।"
মুগ্ধ মংখাইয়ের কাধ জড়িয়ে বলল,
-"আমার ভাই লাগেনা? না এসে পারবে কি করে?"
মংখাই লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে রইল। তিতিরের ভাল লাগছিল। মংখাই মুগ্ধর কত ভক্ত। আর সেটা শুধুমাত্র ওর ব্যবহারের জন্যই। ওদের মত মানুষদের এত আপন করে নিতে সবাই পারেনা।
মুগ্ধ বলল,
-"তারপর রাতে কোথায় থাকলি তোরা?" -"সন্ধ্যা নাগাদ কোনক্রমে তিন্দু আসতেই ডুবো পাথরে ধাক্কা লেগে আমাদের নৌকাটা গেল উল্টে। বাকী তিনটা সেফলি ছিল, সামনেই। ভাগ্য ভাল ওই নৌকার সবাই সাঁতার জানতাম আর ওখানটায় পানিও কম ছিল। তাও পাথরে লেগে সবাই কমবেশি ব্যাথা পেয়েছি। তারপর সন্ধ্যা হয়ে গেছে নৌকা চালানোও নিষেধ তাই আমাদের এক গাইড বলল বড়পাথর এলাকায় নদীর একটা অংশে নাকি চর পরেছে। ওখানে থাকা যাবে। তো আমরা সেখানে গিয়েই তাঁবু গাড়লাম। খুব ভয়ে রাতটা পার করেছি ভাই। কতরকম রিস্ক ছিল চিন্তা কর।"
-"তা তো ছিলই। ভালয় ভালয় আসতে পেরেছিস সেজন্য শুকরিয়া কর।"
''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন
-"হুম। আল্লাহ বাঁচাইছে।"
-"যাই হোক, জীপ ছাড়ার কথা ছিল বান্দরবান বাস স্ট্যান্ড থেকে ৯ টায়। ছাড়ালি হোটেলের সামনে থেকে ৮ টায়। আমরা তো ৯ টার আগেই বাসস্ট্যান্ড গিয়ে দেখি জীপ নেই। হোটেলে গিয়ে শুনি ১ ঘন্টা আগে চলে গেছিস। আজব ব্যাপার!"
-"আরে আর বলিস না। জীপ ড্রাইভার এসে বলে জীপ রেডি চাইলে আমরা আগেও যেতে পারি। তো আমি দেখলাম সবাই ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে রেডি। তাই ভাবলাম যত তাড়াতাড়ি যেতে পারবো ততই ভাল, রওনা দিয়ে দিলাম। তোরা কিভাবে কিভাবে এলি?"
-"অনেক কাহিনী! সব বলবো আগে ফ্রেশ হয়ে নে তোরা।"
এতক্ষণে দোলাও চলে এসেছে। তিতিরকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বলল,
-"আহারে, বোনটা আমার! অনেক কষ্ট হয়েছে না?"
তিতির অযথাই অস্বস্তিবোধ করলো। বলল,
-"না না ঠিক আছি একদম।"
দোলা এবার ওকে ছেড়ে বলল,
-"এই তোমার কাপড় ভেজা কেন?"
তিতির হেসে বলল,
-"আমরা মেঘ ধরতে গিয়েছিলাম। মেঘ আমাদের ভিজিয়ে দিয়েছে।"
দোলা বলল,
-"কোথায়?"
তিতির অাঙুল দিয়ে দেখালো,
-"ওই যে উঁচু পাহাড়টা দেখতে পাচ্ছো ওর চূড়ায় গিয়েছিলাম। সূর্যোদয়ও দেখে এসেছি।"
সাফি বলল,
-"ভাইয়া তুই আবার ওই রিস্কি পাহাড়টাতে গিয়েছিলি? তাও তিতিরকে নিয়ে? তোর কি মাথা খারাপ?"
মুগ্ধ বলল,
-"নো রিস্ক নো গেইন।"
তিতির বলল,
-"আসলেই। রিস্ক নিয়ে গিয়েছিলাম বলেই তো আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যের লিস্টে আরো একটা যোগ হলো।"
-"হ্যা কিন্তু জানের রিস্ক নিয়ে এসব করা উচিৎ না। তোমার কিছু হয়ে গেলে তোমার ফ্যামিলির কাছে কে জবাব দেবে বল?"
মুগ্ধ বলল,
-"আমি জবাব দেব।"
-"ভাইয়া তোর সাহস অতিরিক্ত বেশি।"
-"হুম। কারন আমি জানি আমি ওকে ওখানে সেফলি নিয়ে যেতে পারবো এবং সেফলি নিয়ে আসতে পারবো তাই নিয়ে গেছি। আর ও তোর মত ভীতু না যে অর্ধেকটা গিয়ে ফিরে আসবে। সি ইজ আ পিওর ট্রাভেলার। গত ২/৩ দিন ধরে আমাদের উপর দিয়ে যা গেছে অন্য কোনো মেয়ে হলে ভেঙে পড়তো, কান্নাকাটি করতো, বিরক্ত করতো। হার্ট অ্যাটাকও করতে পারতো। ও বলেই হাসি মুখে স্টেবল ছিল। বিপদকে বলেছে এডভেঞ্চার। ওকে নিয়ে পৃথিবীর যেকোনো দুর্গম যায়গায় চলে যাওয়া যাবে। কোনো প্রব্লেম হবেনা।"
মুগ্ধর মুখে এসব কথা শুনে লজ্জায় কুকড়ে গেল তিতির। সাফি, দোলা মিটিমিটি হাসছিল। মুগ্ধ যে এরেস্ট হয়ে গেছে তা বুঝতে কারোরই বাকী রইল না।
তিতির যে ঘরে ছিল সে ঘরে ঢুকেই দোলা বলল,
-"ভাইয়ার ব্যাগ এখানে? তোমরা একসাথে ছিলে? এত ফাস্ট?"
তিতির কি বলবে ভেবে পেলনা। মুগ্ধ পেছন থেকে দোলার মাথায় একটা গাড্ডা মেরে বলল,
-"চিন্তাটাকে বিশুদ্ধ কর। আর মনটাকে ড্রাই ক্লিনার্সে দে। ওটা নোংরা হয়ে গেছে। সবাই তোর আর সাফির মত না। বাসের মধ্যেই কিসব করছিলি! ছিঃ"
তারপর নিজের ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। দোলা চিৎকার করে উঠল,
-"ভাইয়া!! তুমি সবসময় কেন আমার পিছনে লেগে থাকো?"
-"আমি কোথায় পিছনে লাগলাম? তোমরা তো এক ঘরেই ছিলে! যা দেখেছি তাই বললাম।"
-"হুম। এই ঘুমকুমারী ঘুমিয়ে পড়েছিল দরজা না লাগিয়ে তাই আমি ওনার সেফটির জন্য এঘরে এসে শুয়েছি। অবশ্যই আলাদা বিছানায়।"
বলেই মুগ্ধ বেড়িয়ে গেল। দোলা তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-"এই তুমি অস্বস্তি ফিল করছো কেন? আমরা ভাই বোনরা এমনই। সবসময় দুষ্টুমি করতে থাকি। কিছু মনে করোনা।"
-"না না আমি কি মনে করবো? আমি বুঝেছি।"
ওদের সবার মনই মোটামুটি খারাপ হয়ে গেল কারন আর্মি ক্যাম্প হতে শুধু মাফাখুম যাওয়ার পারমিশন মিলেছে। নাইক্ষ্যাং, সাতভাইখুম, ভেলাখুম কোনটারই পারমিশন পায়নি। ওদিকে কোনো জনবসতি নেই, পাহাড়ীরা শুধু মাছ ধরতেই ওদিকে যায় কিন্তু পুরো বর্ষাকাল বৃষ্টির কারনে ওদিকে কেউ যেতে পারেনি। আপাতত কোনো রাস্তা নেই, সব জঙ্গল! মুগ্ধ, সাফি অনেক রিকোয়েস্ট করেছিল জঙ্গল কেটে রাস্তা বানিয়ে যাবে যেহেতু ৫ জন মাঝি ৫ জন গাইড আছে তার উপর ওরাও আছে কোনো প্রব্লেম হবেনা। কিন্তু কোনো কাজ হলোনা। আর্মিরা শুধু নাফাখুম পর্যন্তই পারমিশন দিল।
রেমাক্রি বাজার থেকে নাস্তা করে ৮ টার মধ্যে ওরা রওনা হয়ে গেল নাফাখুম জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে। রেমাক্রি হতে গাড়ি তো দূরের কথা নৌকা ও চলাচল করতে পারে না বলে নাফাখুম পর্যন্ত পুরো রাস্তাটা পায়ে হেটেই যেতে হয়। নাফাখুম যাওয়ার রাস্তাটা বড্ড সুন্দর, ঘন সবুজ পাহাড়ি জঙ্গল, তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে অসম্ভব সুন্দর একটি ঝিরি। ঝিরিপথ ধরে হাটছে সবাই। তিতিরের খারাপ লাগছে। এই কদিন মুগ্ধ আর ও একসাথে ছিল। সারাক্ষণ টুকটাক গল্প করেছে আর আজ দূরে দূরে থাকতে হচ্ছে। দোলা আপু সারাক্ষণ ওর পাশাপাশি হাটছে। মুগ্ধ কাছাকাছিই আছে, কথাও বলছে কিন্তু স্পেশালি ওকে কিছুই বলছেনা। শুধু দৃষ্টি বিনিময় হচ্ছে। ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। সবার সামনে তো আর মুগ্ধ সারাক্ষণ ওর সাথে বকবক করতে পারবেনা। কিন্তু তবু মন মানতে চাইছেনা।
হঠাৎ মুগ্ধ তিতিরকে থামালো,
-"এই দাঁড়াও দাঁড়াও।"
তিতির দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর বলল,
-"কি হয়েছে?"
মুগ্ধ নিচু হয়ে তিতিরের একটা পা ধরে বলল,
-"নড়ো না। জোঁকে ধরেছে।"
তিতির কোন কথা বলল না। কারন ও টের পাচ্ছিল না জোঁকটা ধরলো কোথায়! ব্যাথা তো পাচ্ছেনা। উল্টো দোলা চেঁচিয়ে উঠলো,
-"মাগো এটুকু যেতে না যেতেই জোঁক?"
একটা ছেলে লবন নিয়ে দৌড়ে এল। মুগ্ধ চেনেনা তাকে। মুগ্ধ বলল,
-"না না লবন দিয়েন না। আমি এমনি ছাড়িয়ে দিচ্ছি।"
মুগ্ধ জোঁকটা ধরে টেনে ছুটিয়ে আনলো। এতক্ষণে তিতিরের ব্যাথা লাগলো কারন জোঁকটা কামড়ে ধরেছিল আর মুগ্ধ তা টেনে ছুটাবার চেষ্টা করছিল। সাফি বলল,
-"ভাইয়া, লবন দিলে জোঁকটা একা একাই পড়ে যেত তো।"
মুগ্ধ কোনো কথা বলল না। জোঁকটা ছুটিয়ে ফেলার সাথে সাথে রক্ত পড়তে লাগলো। মুগ্ধ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পকেট থেকে রুমাল বের করে পায়ের ক্ষতস্থানটায় বেধে দিয়ে বলল,
-"লবন দিলে জোঁক পড়ে যেত ঠিকই। কিন্তু ইনফেকশন হয়ে যেত। মাসখানেক ভুগতে হতো। এখন তা হবে না। রক্ত এমনি এমনি থেমে যাবে।"
তিতির কিছু বলল না। দাঁতে দাত চেপে রইলো। ওর কিছুই বলার নেই ও জানে ওর সবচেয়ে ভাল হবে যাতে মুগ্ধ তাই করবে।
কিছুদূর যেতেই দেখা গেল ঝিরির পানি অনেকটাই বেশি। মুগ্ধর হাটুর উপর পর্যন্ত যা তিতিরের কোমড় সমান হবে। তিতির বলল,
-"ইশ! পুরো ভিজে যাব। ভেজা কাপড়ে সারাটা দিন থাকতে হবে। আচ্ছা আর কোনো রাস্তা নাই এটুকু পার হওয়ার?"
সাফি বলল,
-"না, এটাই একমাত্র রাস্তা। পাশে তো পাহাড় দেখছোই। আর পাহাড় এবং আটকা যায়গা বলেই তো এখানে পানি জমে রয়েছে।"
মুগ্ধ তিতিরের কাছে গিয়ে নিচু স্বরে বলল,
-"অলরেডি অনেকবার কোলে চড়ে ফেলেছো! আরেকবার কি চড়বে?"
তিতির চমকে তাকালো। মুগ্ধ বলল,
-"আই মিন টু সে তোমার কোন আপত্তি না থাকলে আমি তোমাকে কোলে করে এটুকু পার করে দিতে পারি।"
তিতির লজ্জা পেয়ে গেল। মনে মনে তো নাচছে কিন্তু একথার রিপ্লাই ও কিকরে দেবে? "হ্যা কোলে চড়বো" একথা কি বলা যায়? মুগ্ধ বোধহয় বুঝে নিল। আচমকাই তিতিরকে কোলে তুলে পানির ভেতর দিয়ে হাটা শুরু করলো। তিতির মুগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরে তাকিয়ে রইলো মুগ্ধর দিকে। এতগুলো মানুষের সামনে মুগ্ধ যদি এতখানি পানির মধ্যে দিয়ে ওকে কোলে করে হাটতে পারে ও কেন পারবে না মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে থাকতে? মুগ্ধও কম না ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল তিতিরের চেয়ে থাকা চোখে। কি যে আনন্দ হচ্ছিল তিতিরের! খানিকটা অহংকারও! অহংকার তো খারাপ, তবু আজ তিতির অহংকার করবে। কেনই বা করবে না? গ্রুপে যে কয়েকটা মেয়ে তাদের সবার সাথে তাদের বয়ফ্রেন্ড আর শুধু একজনের সাথে ফ্রেন্ডরা আছে, তবু সবগুলো মেয়ে কোমড় সমান পানিতে হাটছে। ছেলেগুলো বড়জোড় ওদের হাত ধরে আছে। আর ও একজনের কোলে করে যাচ্ছে! হা করে তাকিয়ে তা সবাই দেখছে। নিজেকে তখন প্রিন্সেস মনে হচ্ছিল!
To be continued....
প্রেমাতাল - পর্ব ১৭
মৌরি মরিয়ম
পুরাদস্তুর জঙ্গল যাকে বলে! কখনো বাঁশঝাড়, কখনো বিশাল বিশাল নাম না জানা গাছ, কখনো বিভিন্ন রকমের লতা, ছোট বড় পাহাড়! তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে ঝিরিপথটি। হাটতে হাটতে তিতির খেয়াল করছিল দোলা সাফির সাথে ঝগড়া করছে। ঝগড়ার টপিক কোমড় সমান পানি সাফি ওকে হাটিয়ে পার করিয়েছে। আর মুগ্ধ তিতিরকে কোলে নিয়ে পার করলো! দোলা চাপা স্বরে বললেও শুনতে পাচ্ছিল তিতির। দোলা বলছিল,
-"বড় ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু শেখ!"
সাফি বিরক্ত মুখে বলল,
-"প্রেমটা ওর সাথেই করতা।"
-"কি বললা তুমি?"
-"কি বলবো? তোমরা মেয়েরা এমন কেন? একজনকে একটা কিছু পেতে দেখলেই সেটা তোমাদেরও লাগবে! কিন্তু কেন?"
-"তুমি জানো আমি কত কষ্টে পানিটা পার হয়েছি?"
-"জানি। ইভেন তুমিও জানতা এরকম হতে পারে। জেনেই তো এসেছো। দোলা এখানে আমরা ঘুরতে এসেছি প্রেম করতে না। প্রেম ঘরের দরজা বন্ধ করেই করা যায়। তার জন্য জঙ্গলে আসতে হয়না।"
-"আবার প্রেম শুধু ঘরের দরজা বন্ধ করে না। জঙ্গলে এসেও করা যায়।"
-"উফ তুমি একটু চুপ করবা?"
-"কেন চুপ করবো? আমাকে কোলে নিলা না কেন তুমি?"
-"অদ্ভুত তো!"
-"অদ্ভুত না। বলো বলো?"
-"আমি কি ভাইয়ার মত স্ট্রং নাকি যে তোমাকে কোলে নিব? তোমাকে কোলে নিয়ে আমি হাটতে পারবো? প্রেম করার সময় দেখে নাও নাই কেন?"
-"কিহ? তুমি আমাকে মোটা বললা?"
-"কখন বললাম? আমি তো বললাম আমার কথা। তোমার ওজন ৫০ আমার ৬৩। কিভাবে কোলে করে হাটবো? তিতিরের বড়জোড় ৪৫/৪৬ হবে। সেখানে ভাইয়ার ৮০। ওর পক্ষে এটা ইজি ছিল। তোমার বেশি শখ লাগলে ওর কোলেই চড়ো গিয়ে।"
-"তুমি.. তুমি আমার সাথে কথাই বলবা না।"
-"আচ্ছা বলবোনা, যাও যাও.. হুহ।"
মুগ্ধ তিতিরের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
-"এইযে, তিতিরপাখি.. অন্যের ঝগড়া হা করে দেখতে হয়না।"
তিতির চমকে উঠে বলল,
-"না না, কই আমিতো অন্যের ঝগড়া দেখছিনা।"
-"আমি তো দেখলাম দোলা সাফি আবার লেগেছে। ওরা সারাদিন ঝগড়া করতে থাকে। এবার কি নিয়ে লাগলো?"
-"আমি অন্যের পারসোনাল কথা শুনিনা।"
মুগ্ধ হাসছিল। তিতির বলল,
-"হাসছেন যে?"
-"এমনি।"
একথা বলেই আবার হাসলো। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টালো,
-"কেমন লাগছে এই বুনো সৌন্দর্য?"
-"ভালই। কিন্তু এত মানুষ না থাকলে একটু গা ছমছমে অনুভূতি হত।"
পথে আরো পাঁচবার জোকে ধরলো তিতিরকে। পঞ্চমবার মুগ্ধ তিতিরের ঘাড় থেকে জোক ছাড়াচ্ছে এমন সময় ও বলল,
-"আচ্ছা আপনি কি জোকেদের সাথেও ভাব করে গেছেন? আমাকে পাঁচবার ধরলো আর আপনাকে একবারও না। কি আজব!"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"তোমার ব্লাডগ্রুপ কি বি+?"
-"হ্যা, আপনি কি করে জানলেন?"
-"যাদের ব্লাডগ্রুপ বি+ তাদের জোকে ধরে বেশি। মশা কামড়ায় বেশি।"
-"ও। হ্যা আপনি ঠিকই বলেছেন যেখানে কাউকে মশা কামডায় না আমাকে সেখানেও মশা কামড়ায়।"
-"হুম।"
-"আপনার ব্লাডগ্রুপ কি? যে জোকে ধরে না?"
-"ও+... এত বনে বাদারে ঘুরে বেড়াই। কোথাও জোকে ধরেনা। একমাত্র হাম হাম ঝড়নায় যাওয়ার সময় ধরেছিল একবার। ওখানে যাওয়ার রাস্তায় একটা যায়গা পড়ে। পুরো জোকের আখড়া।"
-"ওখানে আমি গেলে তো বোধহয় আমি শেষ।"
''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন
-"আমিও সেটাই ভাবছি।"
হঠাৎ মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরে থামালো,
-"এই দাড়াও দাড়াও...।"
-"কি?"
তারপর মুগ্ধ ওর হাতের লাঠি দিয়ে গাছের ভেতর কিছু একটা দেখালো,
-"ওই দেখ।"
তিতির প্রায় লাফিয়ে উঠলো,
-"ওয়াও.. সাপ! বাট লাইট গ্রিন কালার! হাও কিউট। এত্ত সুন্দর সাপ আমি জীবনেও দেখিনি।"
-"ভয় লাগছে না?"
-"ভয় কিসের? আমি কি ওর কাছে যাচ্ছি না ও আমার কাছে আসছে? অযথা ভয় পাবো কেন?"
-"এক্সাক্টলি। এটাই অনেকে বোঝেনা। সাপ দেখলেই লাফালাফি শুরু করে দেয় ভয়ে।"
-"কিন্তু সাপের ক্ষতি না করলে
সাপ মানুষের ক্ষতি কক্ষনো করেনা।"
-"হুম, সেটাই।"
কিছুদূর যেতে না যেতেই সামনে দিয়ে একটা কুকুর আসছিল। একটু দ্রুতই হাটছিল কুকুরটা। কাছাকাছি আসতেই তিতির পেছনে দৌড়ে এসে ধাক্কা খেল মুগ্ধর সাথে। ওকে দৌড় দিতে দেখে কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসছিল। মুগ্ধ কুকুরটাকে তাড়িয়ে দিল। তারপর বলল,
-"জোকে নয়, সাপে নয়, ডাকাতে নয়, এমনকি পুরুষ মানুষেও নয়। বাঘিনী কিনা কাবু হলো কুকুরে?"
-"উফ আপনি মারাত্মক খারাপ লোক! সব মানুষেরই তো কোনো না কোনো ফোবিয়া থাকে। আমার আছে কুকুর ফোবিয়া। এটা নিয়ে এত মজা নেয়ার কিছু নেই।"
মুগ্ধ হাসছিল। তিতির বলল,
-"এত হাসছেন যে! নিজে মনে হয় কিছুকেই ভয় পান না?"
-"হুম পাইতো।"
-"কি ভয় পান?"
তিতিরের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-"মেয়েমানুষ!"
বলেই হেসে দিল মুগ্ধ।
ঝিরিপথ ধরে প্রায় আড়াই ঘন্টা হাটার পর দূর থেকেই জলপ্রপাতের জলকেলির শব্দ শুনতে পেল ওরা। কিন্তু তখনও জলপ্রপাতটা দেখা যাচ্ছিল না। তিতির আনন্দে লাফিয়ে উঠলো,
-"এসে গেছি!"
মুগ্ধ জানালো,
-"না মাত্র তো পানির শব্দ এল। আসলে ওখানে এত জোড়ে জোড়ে পানি পড়ে যে দূর থেকেও শব্দ শোনা যায়।"
-"ও।"
তারপর আরো ১৫/২০ মিনিট হাটার পর দেখা মিলল নাফাখুম জলপ্রপাতের। তিতির দূর থেকে দেখতে পেয়েই দৌড়ে গেল জলপ্রপাতের কাছে। চোখে না দেখলে ভাবা যায় না কী ভয়ঙ্কর এর সৌন্দর্য! ৪০ ফিট প্রশস্ত এই জলপ্রপাত। যেমন এর রূপ তেমনই তার গর্জন। ভয়ঙ্কর স্রোতে পানি আছড়ে পড়ছে রেমাক্রি খালে। তবে খালটা এখানে তুলনামূলক সরু যার দুপাশে পাথরের পাহাড়। সেই পাহাড়ের উপরেই ওরা দাড়িয়ে আছে। বিশাল জায়গা জুড়ে কি বিচিত্র সেই পানি পড়ার আওয়াজ। কোথাও ঝরঝর, কোথাও গমগম, কোথাও কলকল। সামনে, পাশে, একটু দূরে, আরও দূরে শুধু উন্মত্ত স্রোতধারা। অজস্র স্রোতধারাগুলো মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা লেগেছে কে কত জোরে, সবেগে আছড়ে পড়তে পারে। জলপ্রপাতটায় দুটো স্টেপের মত আছে। প্রথম স্টেপ থেকে ভয়ঙ্কর সেই স্রোতধারা গুলো সেকেন্ড স্টেপে গিয়েই ছড়িয়ে পড়ছে খালে। খালের পানিগুলোর রঙ সবুজ। কিনারে দাঁড়িয়েই পানির ছাট লাগছিল তিতিরের গায়ে। তিতির একটা কথাও বলছিল না। অবাক চোখে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছিল। মুগ্ধ এসে ওর পাশে দাঁড়ালো। অন্যরা দুএকজন ওদের মতই কোনো এক কিনারে দাড়িয়ে জলপ্রপাতের তেজস্বী সৌন্দর্য দেখছে। আর ম্যক্সিমামই ছবি তোলায় ব্যস্ত।
কিন্তু আধুনিকতার কোন ছোঁয়াই এখানে এখনো পৌঁছায়নি বলে নাফাখুমের ভার্জিনিটি পুরোপুরি অনুভব করা যায়। স্রষ্টার তুলির স্পর্শে যেন সবকিছুই এখানে বর্ণময়। ফুল, পাখি, প্রজাপতি প্রকৃতির সমস্ত রং যেন এরা উজাড় করে পেয়েছে। নাম না জানা মিষ্টি পাখির ডাক পাহাড় থেকে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
মুগ্ধ বলল,
-"এখানে কিছুক্ষন থাকলে এক অদ্ভুত মোহময় ও প্রাচীন অনুভূতির গন্ধ পাওয়া যায়। তুমি কি পাচ্ছো?"
-"হুম পাচ্ছি বোধহয়। আর আমি এতক্ষণ এটাই ভাবছিলাম কিন্তু ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কি অসাধারণ!"
-"হুম। বান্দরবানের প্রাকৃতিক রূপ উপভোগ করতে হলে অবশ্যই নাফাখুমে একবার আসা উচিৎ।"
-"সত্যি। আচ্চা এর নাম নাফাখুম কেন হল?"
-"এটা নিয়ে স্থানীয়দের বেশ কয়েকটি মিথ আছে। তার মধ্যে যেটা বহুল প্রচলিত সেটা বলি, ম্রোং ভাষায় খুম মানে জলপ্রপাত। আর নাফা হলো নথ! আই মিন নোসপিন। তো আগে এখানে অনেক বড় বড় মাছ পাওয়া যেত তাদের নাকে নথ পড়িয়ে রাখা হত। তাই এর নাম নাফাখুম।"
-"মাছ পাওয়া যেত মানে? এই খালে মাছ পাওয়া যেত?"
-"হ্যা তবে বেশি পাওয়া যেত গর্তে।"
-"গর্ত আবার কোথায়?"
-"এইযে বিশাল উন্মত্ত জলরাশি দেখতে পাচ্ছো এর নিচে ছোট ছোট গর্ত আছে যার মুখগুলো ম্যানহোলের সমান। কিন্তু অনেক গভীর, ৩০/৪০ ফিট পর্যন্ত। ওখানেই মাছ বেশি থাকতো।"
-"সেকী! তাহলে তো এখানে নামাটা খুবই রিস্কি। কখন কে ওইসব গর্তের মধ্যে ঢুকে যাবে কেউ কিছু করতেও পারবে না।"
-"ওই স্রোতের ওখানে গেলে গর্তে ঢোকার সময় পাবেনা। স্রোতই ভাসিয়ে খালে ফেলে কোথায় নিয়ে যাবে টেরও পাবেনা।"
-"ওহ।"
হঠাৎ সাফির গলা পাওয়া গেল,
-"ভাইয়া, এদিকে আয়। ওরা অনেকেই নামতে চাচ্ছে। আমার সাহস হচ্ছে না ওদের নামতে দিতে। তুই আগে নেমে দেখা কিভাবে নামতে হবে। তারপর যদি কেউ সাহস করে তো নামবে।"
মুগ্ধ সাফিকে বলল,
-"ওয়েট আসছি।"
তারপরর তিতিরকে বলল,
-"আপনি নামবেন নাকি?"
-"হুম।"
-"প্লিজ নামবেন না। এটা ভয়ঙ্কর রিস্কি যায়গা।"
-"আমার কিছু হবে না। আমি ওই খালে সাঁতারও কেটে আসতে পারবো। তাছাড়া আমার কাছে প্রটেকশন আছে। চলো চলো।"
তিতিরের বুক দুরুদুরু করছিল। কি করছে মুগ্ধ এটা। কেন করছে? সাফি থামাচ্ছে না কেন? এত রিস্ক নেয়ার কি দরকার? যায়গাটা তো সত্যিই অনেক ভয়ঙ্কর। মুগ্ধ ব্যাগ থেকে একটা বেল্টের মত কি বের করলো তার দুপাশে দড়ি বাধা। সেটাকে কোমরে আটকে নিল। জলপ্রপাতের দুপাশে কয়েকজন করে সেই দড়ি ধরে রাখলো। আর মুগ্ধ জলপ্রপাতের উপরের দিকটায় নামলো। সেখানে শুধু ছোট বড় পাথর আর জলপ্রপাতের স্রোতের পানির শুরু। তিতিরের মন চাইছে গিয়ে ওদের সাথে দড়িটা ধরতে। ওর মনে হচ্ছিল ও যদি দড়িটা না ধরে তাহলে মুগ্ধ সেফ থাকবে না। কিন্তু তিতিরের সব ভয় দূর হয়ে গেল যখন দেখলো মুগ্ধ তড়তড় করে এক পাথর থেকে আরেক পাথরে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামতে লাগলো। নিচের দিকে স্রোতের তেজও বেশি পানিও বেশি। আস্তে আস্তে মুগ্ধ সেকেন্ড স্টেপটায় চলে গেল। পুরো জলপ্রপাতের পানি ওখানটায় গিয়েই পড়ছে। তিতিরের এবার নিঃশ্বাস টাই আটকে গেল। মুগ্ধ দাঁড়িয়ে আছে আর স্রোতের ধাক্কায় বাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস যারা দড়ি ধরে ছিল তারা খুব শক্ত করে ধরে ছিল, আর মুগ্ধও পায়ের উপর সব জোড় দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণ পর দড়িওয়ালাদের উদ্দেশ্য করে মুগ্ধ কিছু বলল। কিন্তু পানির শব্দে তিতির তা বুঝলো না। হঠাৎ দেখলো মুগ্ধ পায়ের ভয় ছেড়ে দিয়েছে। দড়িওয়ালা রা আরো শক্ত করে দড়ি ধরে আছে। মুগ্ধ তখন পানিতে ভাসছিল। আর কান্নায় ভাসছিল তিতিরের চোখদুটো। কেউ দেখলো না অবশ্য। সবার নজর তখন মুগ্ধর দিকে। একসময় এই দৃশ্যটাও তিতিরের চোখে সয়ে গেল। কান্না থামিয়ে চোখ মুছলো। এবার আর ভয় করছেনা। অনেকক্ষণ ওভাবে থাকার পর মুগ্ধ আবার পা ফেলল পাথরে। তারপর আস্তে আস্তে উঠে এল। উপড়ে উঠেই ব্যাগ থেকে পানি বের করলো এবং হাফ লিটারের পানির বোতল একটানে শেষ করলো। তারপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে হাপাতে লাগলো। একটা পা সোজা আরেকটা পা ভাজ করা ছিল। হাফ প্যান্ট পড়া মুগ্ধর ভেজা পায়ের হাটু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। লোমগুলো ভিজে কেমন হালকা সবুজ একটা ভাব এনেছে। ওগুলো যেন ডাকছে তিতিরকে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল পা গুলো ধরতে। কিন্তু মেয়েদের সব ইচ্ছে পূরণ হয়না। এমনকি বলাও যায়না।
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থেকে উঠে বসলো মুগ্ধ। একজন এসে বলল,
-"ভাই বেশি খারাপ লাগছে?"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"আরে নাহ! ইট ওয়াজ স্পিচলেস! আমি জাস্ট একটু রেস্ট নিয়ে নিলাম। এটা আমার লাইফের সেকেন্ড টাইম। প্রথমবার যখন এসেছিলাম তখনও এরকমই করেছিলাম। তবে হ্যা পানির স্রোত অনেক শক্তিশালী।"
সাফি বলল,
-"নামার ইচ্ছে ছিল। বাট তুইই বাকা হয়ে যাচ্ছিলি। আমি তো দাঁড়িয়েই থাকতে পারবো না বোধহয়।"
দোলা সাফিকে বলল,
-"এই না তুমি নেমোনা। অতিরক্ত ভয়ঙ্কর ছিল ব্যাপারটা।"
দেখা গেল কেউই সেভাবে নামলো না। উপরের দিকে নেমে হাত ধরাধরি করে পা ভিজিয়ে হেটে চলে আসলো। মুগ্ধ একা হতেই তিতির ওর কাছে গিয়ে বলল,
-"আমাকে ওখানে নিয়ে যাবেন?"
-"তুমি যাবে?"
-"হ্যা। একা তো আর যেতে পারবো না। আপনি যদি নিয়ে যান তো যাব।"
-"সিওর?"
-"১০০% কিন্তু আপনি আবার নামলে আবার কষ্ট হবে।"
-"কিসের কষ্ট? আবার নামলে আবার ফিল করতে পারবো। খালি কনফার্ম করো সত্যিই যাবা কিনা।"
-"সত্যিই যাব।"
আবার একই ভাবে সব ব্যবস্থা হলো। এবার একই বেল্টের মধ্যে দুজন। সবাই তিতিরের সাহস দেখে রীতিমত অবাক। যদিও একই বেল্টের মধ্যে দুজন বাধা ছিল তবু তিতির জোকের মত আঁকড়ে ধরেছিল মুগ্ধকে। আস্তে আস্তে উপর থেকে নিচে নামার সময়েই তিতিরের পা ফেলতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ভাল লাগছিল খুব বেশি। সেকেন্ড স্টেপে যেতেই তিতিরের পা ভেঙে আসছিল। স্রোতের এত জোড়! মুগ্ধ বলল,
-"ভরসা আছে তো আমার উপর?"
-"১০০% আছে।"
মুগ্ধ তিতিরের কোমড় জড়িয়ে ধরে তিতিরকে উঁচু করলো। এবার আর মুগ্ধ পাথর থেকে পা সরালো না। তিতির চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। দু'পাশ থেকে উপর থেকে সব দিক থেকে স্রোতের পানি এসে পড়ছিল ওর গায়ে। তখন ও ভাসছিল জলপ্রপাতের উত্তল স্রোতধারায়। ভাসছিল প্রেমের জোয়ারেও। এখন আর কষ্ট হচ্ছে না। স্রোত তিতিরের পা এমনভাবে ভাসিয়ে নিয়েছে যে তিতিরের মনে হচ্ছিল ও সেই স্রোতের উপর শুয়ে আছে। বালিশটা ছিল মুগ্ধর শক্ত বুক! তখন পর্যন্ত ওটাই ছিল ওর জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্ত! হঠাৎ তিতির উপরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল মুগ্ধ তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মুগ্ধর চোখে চোখ পড়তেই তিতির হাসলো, হাসলো মুগ্ধও।
To be continued...
প্রেমাতাল - পর্ব ১৮
মৌরি মরিয়ম
জলপ্রপাতের পানিতে ভাসতে ভাসতে আর স্রোতের ধাক্কা খেতে খেতে তিতিরের সারা শরীর যেন অসাড় হয়ে পড়ছিল। তিতির পানি থেকে ওঠার কথা মুগ্ধকে বলতে গিয়ে দেখলো কোনো কথাই বলতে পারছেনা। কথা বলার জন্য যে মিনিমাম শক্তিটুকু দরকার তা ওর ওই মুহূর্তে ছিলনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুগ্ধ বলল,
-"এইযে তিতিরপাখি, চলো এবার ওঠা যাক। এর বেশি থাকলে পরে তোমার কষ্ট হবে।"
তিতির কিছু বলতে পারলো না। মুগ্ধ ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই উপরে উঠলো। সাথে সাথে দোলা এসে ওদের বেল্ট আর দড়ি খুলে দিল। তিতির নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়েছে। মুগ্ধর ব্যাগে আরো দুই বোতল পানি ছিল। একটা বের করে তিতিরকে খাওয়ালো। তিতির অর্ধেকটা পানি খেয়ে আবার শুয়ে পড়লো। মুগ্ধ বাকি পানিটুকু খেয়ে শুয়ে রেস্ট নিচ্ছিল। হঠাৎ তিতিরের দিকে তাকাতেই দেখলো তিতির উঠে বসেছে। জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর হাসছে, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তাকিয়ে আছে জলপ্রপাতের সেই স্রোতধারা গুলোর দিকে। কিছুক্ষণ পর তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-"আপনি জানেন না আপনি আমাকে আজ কি দিয়েছেন! এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। যতক্ষণ আমি ওখানে ছিলাম আমার মনে হচ্ছিল আমি অন্য কোনো এক জগতে আছি। যদিও আমার একফোঁটা শক্তি ছিলনা কিন্তু আমার খুব ভাল লাগছিল। খুব খুব খুব!"
মুগ্ধ হাসলো শুধু কিছু বললনা। দোলা বলল,
-"এত ভাল লাগছে তাহলে কাঁদছ কেন?" তিতির হাসতে হাসতে বলল,
-"আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না আপু। আমার এই কান্নাটা অবশ্যই খুশির কান্না! আমার জীবনে এত সুখের মুহূর্ত আগে কখনো আসেনি। কিন্তু কেন জানিনা কান্নাটা আমি থামাতে পারছিনা।"
মুগ্ধ বলল,
-"আমি তো দেখছি তুমি হাসিটাও থামাতে পারছ না!"
তিতির আবার হাসলো। মুগ্ধ ব্যাগ থেকে টাওয়াল বের করে দিল। বলল,
-"নাও মাথাটা ভাল করে মুছে নাও।"
তিতির টাওয়াল নিল। মুগ্ধ ব্যাগ নিয়ে উঠে কোথায় চলে গেল। একটু পর ভেজা থ্রি-কোয়ার্টার পালটে শুকনো একটা পড়ে ফিরে এল। তিতির এখনো সেই যায়গায় একা একা বসে আছে। আর গ্রুপেরই একটা ছেলে ওর দিকে তিতিরের দিকে তাকিয়ে আছে। নজরটা যে কোনদিকে তা বুঝতে মুগ্ধর অসুবিধা হলো না। ট্রিপে এসে ছেলেটাকে কিছু বলাও তো যাবে না। তিতিরের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-"তিতির ব্যাগ তো আনোনি না?"
-"না।"
-"এক্সট্রা কাপড় যখন আনোনি ভেজাটা উচিৎ হয়নি।"
তিতির বলল,
-"প্রব্লেম নেই।"
-"প্রব্লেম আছে। দোলা ছোট একটা ব্যাগ এনেছে, ওকে জিজ্ঞেস করো তো ওর কাছে এক্সট্রা কাপড় আছে কিনা।"
তিতির উঠে গিয়ে দোলার সাথে কথা বলে ফিরে এল। বলল,
-"আপু ব্যাগে কাপড়চোপড় আনেনি। শুকনো খাবার এনেছে।"
-"ও।"
তারপর মুগ্ধ নিজের ব্যাগ থেকে একটা টি-শার্ট বের করে তিতিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-"নাও এটা পড়ো।"
তিতির অবাক চোখে,
-"এটা আপনার?"
-"হ্যা।"
এবার তিতির হো হো করে হেসে উঠলো,
-"ওর মধ্যে দুটো আমি ঢুকতে পারবো।"
-"সেটা আমি জানি। লাগলে তিনটা তুমি ঢোকো গিয়ে। যাও, আর একটা কথাও না বলে চেঞ্জ করে এসো। ওই ঝোপের আড়ালে গিয়ে চেঞ্জ করো।"
-"থ্যাংকস বাট সত্যি কোনো দরকার নেই। আমার ঠাণ্ডা লাগবে বলে বলছেন তো? আমার এটুকুতেই ঠান্ডা লাগেনা, কোনো প্রব্লেম হবেনা। এটা আপনিই পড়ুন।"
-"তিতির বাম পাশের চেক শার্ট পড়া ছেলেটা তোমার ভেজা শরীরের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি দেখেছি, দেখে খুব রাগ লেগেছে। মন চাইছিল চোখদুটো গেলে দিই। ট্রিপে কোনো ঝামেলা করতে চাচ্ছিনা। তাই বলছি চেঞ্জ করো।"
তিতিরের চোখগুলো রসগোল্লা হয়ে গেল। নিজের কানকে বিঃশ্বাস করতে পারছিল না। মুগ্ধ বলল,
-"একদম ডিরেক্টলি না বললে কিছুই বোঝোনা কেন? আজব!"
তিতির আর একটা কথাও না বলে টি-শার্ট টা নিয়ে ঝোপের মধ্যে চলে গেল। তারপর টি-শার্ট টা বুকে জড়িয়ে ধরলো, স্মেল নিল। ইশ, মুগ্ধ কত খেয়াল রাখে ওর যতটা ও নিজেও রাখতে পারেনা। উড়তে ইচ্ছে করছে, উড়তে! মুগ্ধর স্মেলটাও এত মারাত্মক কেন?
মুগ্ধর টি-শার্ট টা তিতিরের হাটু সমান লম্বা হয়েছে, আর এত ঢোলা যে আরো দুএকজন ঢুকতে পারবে। তাতে কিছু যায় আসেনা। মুগ্ধর টি-শার্ট পড়া মানে অনেক কিছু যা কেউ বুঝবে না। আরেকবার টি-শার্ট টা নাকের কাছে এনে স্মেল নিয়ে বেড়িয়ে এল ঝোপের বাইরে। ওকে দেখে দোলা হেসে দিল। আরো অনেকেই হাসলো বোধহয় কিন্তু ও একটুও অস্বস্তিবোধ করছিল না। খুব পার্ট নিয়ে ছিল।
এবার ফেরার পালা। প্রায় ৪-৫ ঘন্টা নাফাখুমে কাটিয়ে ওরা ফেরার পথে হাটা ধরলো। পথে তিতিরকে ৯ বার জোকে ধরলো, মুগ্ধ একইভাবে জোক ছাড়িয়ে দিল। সবারই কেমন যেন কথাবার্তা ফুরিয়ে গেছিল, জলপ্রপাতের ঘোর কারোরই কাটেনি। সেই কোমড় সমান পানির যায়গায় এসে মুগ্ধ বিনাবাক্যে তিতিরকে কোলে নিয়ে হাটা শুরু করলো। কোলে নিতেই তিতির ওর গলা জড়িয়ে ধরলো। একটা অদৃশ্য অধিকারবোধ দুজনের মধ্যেই কাজ করছিল। মুগ্ধর টি-শার্ট তিতিরকে দেয়ার কারনে মুগ্ধ ছিল খালি গায়ে। এটাও একটা দেখার মত দৃশ্য ছিল। তিতিরের কেমন যেন লাগছিল! মুগ্ধ ছিল খালি গায়ে আর লজ্জা লাগছিল ওর। হাতগুলো মুগ্ধর খালি গায়ে লাগছিল। আর যখনি সে হাতের কুনুই ওর বুকের লোমগুলোর সাথে লাগছিল তখন সুড়সুড়ি লাগছিল তিতিরের। যেদিন এসেছিল সেদিন মুগ্ধর মুখে খুব ছোট ছোট দাঁড়ি ছিল। এখন সেগুলো অনেক বড় হয়ে গেছে। তিতির সেদিকে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধকে এখন আরো বড় বড় লাগছে। তিতির মুগ্ধর গলার পিছনে দুহাত বেধে রেখেছিল। হঠাৎ একটা হাত দিয়ে মুগ্ধর গলা জড়িয়ে আরেকটা হাত নামিয়ে মুগ্ধর দাড়িতে রাখলো। মুগ্ধ চমকে তাকালো তিতিরের দিকে। তিতির লজ্জা পেয়ে ওর দাড়ি ছেড়ে দিয়ে আবার গলার পিছনে হাত বাধলো।
রেমাক্রি ফিরতে ফিরতে বিকাল ৫ টা বাজল। সবাই ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করে নিল। তারপর যে যার মত রেস্ট নিচ্ছিল। তিতির বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েছিল। খুব ক্লান্ত লাগছিল। পা গুলো যেন ভেঙে আসছিল। জানালা গুলো নিচু হওয়ার কারনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নদী, পাহাড় সবই দেখতে পাচ্ছিল তিতির। হঠাৎ বারান্দায় মুগ্ধকে দেখা গেল। মুগ্ধ ওকে দেখতে পেয়েই জিজ্ঞেস করল,
-"কি ব্যাপার? ঘুমকুমারী না ঘুনিয়ে তাকিয়ে আছে যে!"
''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন
-"আমার এত ক্লান্ত লাগছে যে ঘুমাতেও পারছিনা।"
-"আরে ঘুরতে আসলে ওরকম একটুআধটু হয়। রাতে একবারে ঘুমিও। এখন চলো তো।"
-"কোথায়?"
-"রেমাক্রি বাজারে যাব। চলো মজা হবে।"
-"কি মজা?"
-"বাজারে কতরকম ফল, সবজি ওঠে। সব তুমি চিনবেও না।"
-"না প্লিজ আমি যাব না, আপনি যান। আমি এখন আরো হাটলে মরেই যাব।"
-"এহ! তুমি হাটলা কখন? কোলে কোলেই তো গেলে আসলে। আর জলপ্রপাতের পানিতে? সেখানেও তো কোলেই ছিলে।"
তিতির অবাক হয়ে বলল,
-"মানুষের উপকার করে আবার খোঁটা দিচ্ছেন? কি খারাপ আপনি।"
-"সেটাতো অবশ্যই।"
-"আপনি যান। আমি যাবনা।"
-"কোলে করে নিলে যাবে?"
তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। মুগ্ধও হেসে দিল। তারপর বলল,
-"আচ্ছা তুমি রেস্ট নাও। আমি যাই।"
তিতির কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল তা ওর মনে নেই। ঘুম ভাঙলো দোলার ডাকে। উঠতেই দোলা বলল,
-"আহা ঘুমিয়ে ছিলে, ওদিকে তোমার আশিক তো তোমাকে ছাড়া মরেই যাচ্ছিল। মনের দুঃখে শেষে রান্নাই করতে চলে গেল।"
তিতির লজ্জা পেয়ে হাসলো। দোলা বলল,
-"আরে এত লজ্জার কি আছে? আমিই তো।"
-"নাহ আসলে তেমন কিছু না।"
-"ইশ আর লজ্জা পেয়ে মিথ্যে বলতে হবেনা। আমরা এতক্ষণ তোমাদের এডভেঞ্চারের গল্প শুনছিলাম।"
-"কোন গল্প?"
-"ডাকাতের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচার গল্প।"
-"ওহ।"
-"তাইতো বলি দুজনের মধ্যে এত ভাব হলো কখন?"
তিতির কি বলবে লজ্জায় তো শেষ হয়ে যাচ্ছিল। দোলা বলল,
-"তুমি খুব লাকি বুঝলে? তোমার আগে কোনো মেয়েকে ভাইয়া এতটা প্রায়োরিটি দেয়নি। ওদের একটা কাজিন আছে 'ইকরা'। ভাইয়াকে পাগলের মত লাভ করে আর ভাইয়া পাত্তাই দেয়না।"
হঠাৎ তিতিরের মনে পড়লো সেইযে মেসেজ দেয় 'পেরা' সেই ইকরা নয়তো? কিন্তু সে তো ভার্সিটির, কাজিন তো না। নাকি কাজিনই বাট একই ভার্সিটিতে পড়ে। দোলা বলল,
-"এই বলোনা, কিভাবে প্রোপোজ করল?"
তিতির বলল,
-"প্রোপোজ! তুমি ভুল ভাবছো.. সত্যি প্রোপোজ করেনি। আমাদের মধ্যে তেমন কিছুই হয়নি।"
দোলা অবাক হয়ে বলল,
-"ভাইয়াও তাই বলল। কিন্তু বিশ্বাস করিনি। আই মিন তোমাদের মধ্যে রিলেশনশিপ চলছে সে ব্যাপারে আমি সিওর ছিলাম তা নাহলে কোলে নেয়া। একই দড়িতে পানিতে নামা। দুজনের কথাবার্তা, দুজনের দুজনের দিকে তাকানো! এসব কিভাবে সম্ভব!"
তিতির এবার বলল,
-"আসলে আমি ওনাকে পছন্দ করি। উনিও হয়তো করে কিন্তু কিছু বলেনি তো কখোনো। তাই সিওর না।"
-"ওয়াও, দ্যাটস গ্রেট। তুমি তাহলে ওকে বলে দাও তোমার ফিলিংসের কথা।"
-"না না আমি বলতে পারবো না।"
-"কেন?"
-"উনি যদি পছন্দ না করে আর রিজেক্ট করে তাহলে মানতে পারবো না। তার চেয়ে অপেক্ষা করি।"
-"সেকী! রিজেক্ট কেন করবে?"
-"হতেও তো পারে ওনার আমাকে পছন্দ না। আফটারঅল মাত্র ৩/৪ দিন ধরে চিনি আমরা একে অপরকে।"
-"আরে আমরা তো চিনি ভাইয়াকে। ও ভাল না বাসলে এরকম করতোই না।"
-"তবু আমি অপেক্ষা করবো আপু।"
-"কতদিন অপেক্ষা করবে? এর মধ্যে যদি অন্য কেউ ঢুকে পড়ে? আর ভাইয়া তার হয়ে যায়?"
-"উনি আমার হলে কখনোই অন্য কেউ ঢুকে পড়তে পারবে না। আর ঢুকলেও উনি তার হবে না। হলে বুঝতে হবে আমি ভুল ভেবেছি। উনি আসলে আমাকে ফিল করেনি।"
-"হায় আল্লাহ! কোন দুনিয়ায় আছি।"
তিতির দোলার হাত ধরে বলল,
-"প্লিজ আপু আমাকে ছুঁয়ে বলো যে তুমি ওনাকে আমার ফিলিংসের কথা কিছু বলবে না। আমি চাই উনি নিজ থেকে আমাকে বুঝুক আর প্রোপোজ করুক।"
দোলা তিতিরের হাত ধরে হেসে বলল,
-"আচ্ছা বলবোনা। দোয়া করি খুব তাড়াতাড়ি আমার বড় জা হয়ে যাও।"
তিতির লজ্জা পেয়ে গেল। দোলা হাসতে হাসতে বাইরে বেড়িয়ে গেল।
রাতে সবাই খেতে বসেছে। তিতির বারান্দায় দড়িয়ে ভাবছিল মুগ্ধরই কথা। এমন সময় পিছন থেকে মুগ্ধ বলল,
-"এইযে সুন্দরী, আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি।"
-"মোটেই খোঁজেননি। আমি এখানেই ছিলাম।"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"আচ্ছা আচ্ছা, তোমার ক্লান্তি গেছে?"
তিতির হেসে বলল,
-"হুম, ঘুমিয়েছি না?"
-"পা ব্যাথা?"
-"পা ব্যাথা আছে। এত হাঁটিনিতো কখনো।"
-"ওহ। হুম ডিনার করে একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নিও। ব্যাথা কমে যাবে।"
-"আচ্ছা।"
-"তোমার জন্য বাঁশ রেঁধেছি। চলো খাবে।"
-"কি?"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"বান্দরবানে বলেছিলাম না বাঁশ কুরুইল খাওয়াবো সুযোগ পেলে? ওটাই রান্না করেছি। ওটা আনতেই বাজারে গিয়েছিলাম।"
বাঁশ কুরুইল টা সত্যি অসাধারণ ছিল। নরম নরম আর খুব টেস্টি। চিকেন দিয়ে ঝাল ঝাল করে রান্না করেছে মুগ্ধ। তিতিরের মনে হলো এত সুস্বাদু খাবার ও আর খায়নি। খেতে খেতে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলছিল,'আমি আপনার কাছ থেকে সব রান্না শিখবো। তারপর আর আপনাকে রাঁধতে দেবনা। আমি আপনাকে রেঁধে খাওয়াবো।'
খুব ভোরে ওরা রওনা দিয়েছিল যাতে রাতে থানচিতে থাকতে না হয়। কারন, থানচি যায়গাটা কারোরই তেমন পছন্দ হয়নি। সন্ধ্যার মধ্যেই ওরা বান্দরবান পৌঁছলো। তারপর রাতের বাসে ঢাকা। ঢাকার বাসেও তিতির মুগ্ধ পাশাপাশি বসলো। তিতিরের মন খারাপ লাগছিল। পথ তো শেষ হয়ে যাচ্ছে, মুগ্ধ এখনো কিছু বলল ন। মুগ্ধ আর ও টুকটাক কত গল্প করছে। ম্যক্সিমাম ট্রাভেলিং রিলেটেড। ১০ দিনের ট্যুর ৫ দিনে শেষ হয়ে গেল পারমিশন না পাওয়ার কারনে। ৪০% টাকা ফেরত পেল। এই টাকা দিয়ে তো অন্য কোথাও ঘুরে আসা যায়! তিতিরের ইচ্ছে করছে মুগ্ধর সাথে অন্য কোথাও চলে যেতে কিন্তু ও কখনোই তা বলতে পারবে না। এত চিন্তার মধ্যেও ও বেশ কয়েকবার ঘুমালো। উঠলো, গল্প করলো। কিন্তু মুগ্ধ কিছুই বলল না।
আস্তে আস্তে একসময় সকাল হল। বাস চলে এল ঢাকায়। মুগ্ধ আর তিতিরের গন্তব্য একই যায়গা, ধানমন্ডি ১১ নম্বর রোড। দুজনে একটা সিএনজি নিল। তিতিরের বাসার সামনে এসে মুগ্ধ সিএনজি ছেড়ে দিল। একটা বাসা পরেই ওর বাসা। হেটেই চলে যেতে পারবে।
দুজনেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিতিরের বাসার সামনে রাস্তার অপজিটে। দুজনেরই মন খারাপ। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারলো না। ভেবে পেলনা কি বলবে। একসময় মুগ্ধ ম্লান হেসে বলল,
-"ওকে বাসায় যাও তাহলে।"
-"হ্যা যাচ্ছি।"
-"ভাল থেকো। নিজের প্রতি খেয়াল রেখো। সাবধানে থেকো।"
-"আপনিও ভাল থাকবেন।"
তিতির আর দাঁড়ালো না, চলে গেল। গেটের সামনে গিয়ে তিতির একবার পিছন ফিরে তাকালো। মুগ্ধ পকেটে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে ফিরে তাকাতে দেখেই হাসলো। তিতিরও একবার হাসলো। তারপর গেটের ভেতর ঢুকে গেল।
তিতির ভেতরে যাওয়ার পর মুগ্ধ উলটো ঘুরে নিজের বাসার দিকে হাটতে লাগলো। বাসার গেটের ভেতর ঢুকতেই মনে পড়লো তিতিরের ফোন নাম্বারটাই তো আনা হয়নি! কোনরকমে গেটটা খুলে দৌড় দিল। এক দৌড়ে চলে এল তিতিরের বাসার সামনে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
অন্যদিকে এক সিঁড়ি উঠে দোতলার অর্ধেকে যেতেই তিতিরের খেয়াল হল মুগ্ধর ফোন নাম্বার নেয়া হয়নি। এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমতেই বাবার সাথে ধাক্কা লাগলো। বাবা ওকে দেখে খুশিতে বলে উঠলো,
-"ওরে বাবা! আমার আম্মা দেখি ১০ দিনের যায়গায় ৫ দিনে এসে গেছে। কিন্তু আম্মা দৌড়াচ্ছে কেন?"
-"বাবা সিএনজিতে আমার পার্স ফেলে এসেছি।"
এছাড়া আর বিশ্বাসযোগ্য কোন কথা খুঁজে পেলনা তিতির। বাবা বলল,
-"বাইরে তো কোন সিএনজি নেই।"
-"ওহ! বাবা আমি আরেকটু খুঁজে দেখি?"
-"নেই তো মা। বাদ দে। কি এমন ছিল পার্সে?"
-"টাকা।"
-"ওহ। তাতে কি হয়েছে? টাকা গেছে যাক। আমার মেয়ে তো সেফলি ফিরে এসেছে।"
-"বাবা ওতে পাঁচ হাজার টাকা ছিল। ট্যুরের টাকা বেচে যাওয়ার ফেরত পেয়েছি। আমি ভেবেছিলাম ওটা দিয়ে কিছু করবো। বাবা আমি যাই?"
-"আরে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা? চল আমি তোকে এক্ষুনি দিয়ে দিচ্ছি। এর জন্য নাকি আমার আম্মা এত সকালে বাইরে গিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবে।"
তিতির মন খারাপ করে বাবার সাথে সিঁড়িতে উঠলো,
-"এত সকালে তুমি কোথায় গিয়েছিলে বাবা?"
-"নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। এত সকালে আর কোথায় যাব? চল চল। উপড়ে চল। আজ আমি নিজে বাজারে গিয়ে বাজারের সবচেয়ে বড় ইলিশ মাছটা নিয়ে আসব আমার আম্মার জন্য।"
কিন্তু তিতিরের অস্থির লাগছিল। একেকটা সিঁড়ি যেন একেকটা উঁচু পাহাড়ের চেয়েও বেশি উঁচু মনে হচ্ছিল।
To be continued..
প্রেমাতাল - পর্ব ১৯
মৌরি মরিয়ম
মুগ্ধ তিতিরকে না পেয়ে নিজের বাসায় ফিরে এল। ভাল লাগছে না কিছু! সারারাত বাসের ঝাঁকুনি আর তিতিরকে নির্ভয়ে অপলক দেখার লোভ! এই দুটো কারনে ঘুমাতে পারেনি ও। ভেবেছিল বাসায় এসে ঘুমাবে। কিন্তু কিসের ঘুম কিসের খাওয়া। তিতিরকে কিভাবে পাবে সেই চিন্তায় ও অস্থির! যদিও বাসা চেনে কিন্তু কয় তলায় থাকে তা তো জানেনা। আর জানলেও বাসায় গেলে তিতিরের প্রব্লেম হতে পারে। কি করবে কি করবে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো সাফিকে কল করলে নিশ্চই তিতিরের নাম্বার পাওয়া যাবে। অবশ্যই পাওয়া যাবে সব গ্রুপ মেম্বারের ডিটেইল ওর কাছে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সাথে সাথে কল করলো সাফিকে। সাফি ফোন ধরছে না। উফ এত বিরক্তিকর কেন ছেলেটা। সাফিকে অনেকবার ট্রাই করার পর দোলাকে ফোন করলো। দোলা তো আরো এক ধাপ এগিয়ে, ফোনই বন্ধ। নিজের গালে নিজে দুইটা চড় মারতে মন চাইছে। ও নিজেকে বুদ্ধিমান বলেই জানতো। কখনো এমন কিছু করেনি যার জন্য পরে আফসোস করতে হয়েছে। সবসময় প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য রেডি থাকে। সব ব্যাপারে আগাম কনসার্ন থাকে। আর এখন তিতিরের ফোন নাম্বারটা আনতেই ভুলে গেল! এতটা বোকামি ও কিভাবে করলো! হ্যা চলে আসার সময় প্রচন্ড মন খারাপ হয়েছিল তাই তেমন কিছুই বলতে পারেনি। কিন্তু ফোন নাম্বারটা তো আগে নিয়ে রাখা উচিৎ ছিল। ওর জন্য নিলগিরি থেকে পেনহোল্ডার, রেমাক্রি বাজার থেকে ডুমুর আর পাকা পেঁপে কিনেছিল তাও দেয়া হয়নি। এত গাধা মুগ্ধ কবে হলো!
এবার সাফির মাকে কল করলো মুগ্ধ,
-"হ্যালো চাচী?"
-"হ্যা হ্যা মুগ্ধ বল বাবু।"
-"এই চাচী শোনোনা, সাফি কি ঘুমাচ্ছে? ওকে এতবার কল দিলাম ধরছেই না।"
-"মানে? ও তো তোর সাথেই ট্রিপে গেল। এখনো তো আসেইনি। তুই ওকে বাসায় খুঁজছিস! আমি তো কিছুই বুঝতে পারচ্ছিনা।"
মুগ্ধ বুঝতেই পারছে চাচী এখন চিন্তায় পড়ে যাবে তাই চাচীকে নিশ্চিন্ত করার জন্য বলল,
-"ওহ হো। আচ্ছা আচ্ছা আসলে আমি তো ওকে বান্দরবানে হারিয়ে ফেলেছিলাম বুঝলে? আমি এসে পড়েছি তাই ভেবেছি সাফিও বুঝি এসে পড়েছে। তুমি চিন্তা করোনা তো। ও এসে পড়বে।"
-"তুই যে বললি ফোন ধরছে না।"
-"তো কি হয়েছে? ফোনে তো কত প্রব্লেমই হতে পারে।"
-"ওহ, তাও ঠিক।"
-"আচ্ছা চাচী রাখি, তুমি অত চিন্তা করোনা।"
ফোন রেখেই মুগ্ধ আবার কল দিল সাফিকে। এবার ওর ফোন বিজি পাওয়া গেল। যাক পাওয়া যাবে তাহলে। কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করলো। কিন্তু বার বার ফোন বিজি আসছেন আজব তো ছেলেটার কি ওয়েটিং সার্ভিসও একটিভ করা নেই? না মনে পড়েছে। ওয়েটিং সার্ভিস তো চালুই আছে। কতই তো ওকে ওয়েটিং এ পেয়েছে। তাহলে? উফ আর কিছু ভাল লাগছিল না মুগ্ধর।
মুগ্ধ সাফির ফোন বিজি পাবেনা কেন? এদিকে তিতিরও তো সাফিকে অনবরত ফোন করছিল মুগ্ধর নাম্বারের জন্য। সাফি তো ফোনই ধরছে না। হঠাৎ তিতিরের মনে পড়লো বাবাকে না মুগ্ধর ফোন দিয়ে ফোন করেছিল? ইয়েস! এত সহজে নাম্বারটা পাবে ভাবেনি ও। দৌড়ে বাবার ঘরে চলে গেল। বাবা রেডি হচ্ছিল বাইরে যাওয়ার জন্য। তিতির বলল,
-"বাবা একটু ফোনটা নেই? জরুরী কল করার ছিল। আমার ফোনে না ব্যালেন্স নেই।"
-"হ্যা হ্যা, নিয়ে নে।"
তিতির ফোন নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। তারপর ভাবতে লাগলো কবে কখন ফোন করেছিল। হ্যা মনে পড়েছে সকালে ফোন করেছিল। গতকাল সকালে ছিল রাস্তায়, গত পরশু সকালে ছিল নাফাখুম। তার মানে পরশুর আগের দিন কল করেছিল। কললিস্ট চেক করতে গিয়ে মহাবিপদে পড়লো তিতির। কারন অনেক আননোন নাম্বার ছিল। এটা কোনো কথা! বাবা এত কথা কার সাথে বলে? যাই হোক বাবাকে ফোন ফেরত দিতে হবে তাই ফটাফট সেদিন সকাল থেকে ১২ টা পর্যন্ত যত কল এসেছে সব তুলে নিল একটা ডায়েরীতে। তারপর এক দৌড়ে গিয়ে ফোনটা বাবাকে ফেরত দিয়ে আরেক দৌড়ে ফিরে আসলো ঘরে। সব মিলিয়ে ৮ টা নাম্বার পাওয়া গেছে তার মধ্যে ৩ টা এয়ারটেল! হায় খোদা এগুলো কেন তুললো ও। ওর এয়ারটেলে নেটওয়ার্ক ছিলনা বলেই তো মুগ্ধর নাম্বার থেকে কল করেছিল। ওগুলো বাদ দিলে থাকে ৫ টা নাম্বার। প্রথমটাতে কল দিল,
-"হ্যালো.."
ওপাশ থেকে কর্কশ মহিলা কন্ঠে,
-"হ্যালো কেডা? কেডা আপনে?"
তিতির ফট করে লাইনটা কেটে দিল। এটাও বাদ। পরের নাম্বারটাতে কল দিল। ওপাশ থেকে বলল,
-"হ্যালো তিতির আফা?"
তিতির অবাক,
-"আপনি কে ভাই?"
-"আফা আমি শরীফ।"
শরীফ ওদের দারোয়ান। কি বলবে! বলল,
-"ও আচ্ছা। শরীফ ভাই, আমি না একজনকে ফোন করতে গিয়ে ভুলে আপনাকে কল দিয়ে ফেলেছি। আচ্ছা রাখি।"
-"আচ্ছা আফা।"
''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন
দুটো গেল। ৩য় নাম্বারটা টাইপ করতেই দেখলো এটা দেখলো এটা অলরেডি ওর ফোনবুকে আছে। ভাইয়ার এক্সট্রা ফোনের নাম্বার, নতুন নিয়েছে। তিনটা গেল। ৪র্থ নাম্বারটাতে কল করতেই একটা কর্কশ আর রাগী লোকের ভয়েস পাওয়া গেল। ঝাড়ি দিয়ে বলল,
-"হ্যালো কে?"
উফ এই মানুষগুলোর কি আর কোনো কাজ নেই? অলওয়েজ রামগরুড়ের ছানার মত মুখ করে বসে থাকে আর কাউকে পেলেই ঝাড়ি মারে। বাবার সাথে এদের এমন কি কাজ! যাই হোক, কি বলবে ও? যদি বাবার কেউ হয় তাই 'মুগ্ধ বলছেন?' একথা তো জিজ্ঞেস করা যায়না। আর জিজ্ঞেস করবেই বা কেন? ওর মুগ্ধ কখনো এভাবে কথা বলে না। মুগ্ধর ভয়েসটাও এমন কর্কশ না, কি মিষ্টি ভয়েস! খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। অযথা এই ব্যাটার সাথে কথা বলবে কেন ও? এমন সময় ওপাশ থেকে আবার বলল,
-"অই মিয়াঁ কে আপনে? কথা কন না ক্যান? কথা কন, নাইলে ফোন রাখেন। আজাইরা ফোন দিয়া ফোনটারে বিজি কইরা রাখসে! যত্তসব। ফোন রাখেন।"
তিতির ফট করে লাইনটা কেটে দিল। উফ এই গুন্ডা টাইপ ব্যাটার সাথে বাবার কি সম্পর্ক কে জানে! পরের নাম্বারটায় ডায়াল করলো অথচ জানলোই না যে এটাই ছিল মুগ্ধ। ও তিতিরকে খোঁজার জন্য সাফিকে কল করছিল তাই মাঝখানে অন্য কলে ডিস্টার্ব ফিল করায় ওরকম বিহেভ করেছে।
৫ম নাম্বারটা বন্ধ পেয়ে তিতির আবার সাফিকে কল করলো কিন্তু সাফির নাম্বার এখন বিজি। অদ্ভুত তো! এতক্ষণ ওর কল ধরেনি আর এখন অন্য কারো সাথে কথা বলছে? নিশ্চই দোলা আপুর সাথে কথা বলছে কিন্তু ওর কলগুলো দেখে একবার কি কল ব্যাক করা যেত না? কিন্তু তখন সাফির ফোন বিজি ছিল কারন, মুগ্ধ তখন পাগলের মত ফোন করে যাচ্ছিল সাফিকে। কিন্তু তিতির তা জানতেও পারলো না। ওদিকে মুগ্ধও জানলো না তিতির কতটা ব্যাকুল হয়ে আছে ওর জন্য।
সারাটা দিন এরকমই চলতে থাকলো। অবশেষে লাঞ্চের পর দুজনেই সাফিকে কল করে সাফির নাম্বার বন্ধ পেল। কারন, ওদের দুজনের কলের তাড়নায় সাফির ফোন চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। আর সাফি সকাল থেকেই দোলার বাসায় মরার মত ঘুমাচ্ছিল। তাই ও কারোরই কল ধরতে পারেনি।
মুগ্ধ কললিস্ট ঘেটে তিতিরের বাবার নাম্বার পেয়ে গেছিল। কিন্তু ওর বাবকে কল দিলে ওর যদি কোনো প্রব্লেম হয়? তাই দিলনা। মুগ্ধ ভাবলো সাফি বোধহয় ঘুমাচ্ছে তা নাহলে ফোন ধরতো। তাছড়া মুগ্ধ তো জানেই ট্যুর থেকে এসে সাফি সারাদিন ঘুমায়। আর হয়তো কথা বলার জন্য না চাচী ফোন করছিল বলে ওর ফোন বিজি ছিল। হ্যা তাই হবে কারন, চাচীকে ফোন দেয়ার আগে প্রত্যেকবার ফোন বেজে বেজে কেটে গেছে। চাচীকে ফোন দেয়ার পর থেকেই বিজি। চাচীও না এত টেনশন করতে পারে। সাফি বাসায় যায়নি আগে জানলে ও কখনোই চাচীকে কল দিত না। কোথায় গেল? দোলার বাসায় নয়তো! হতেও পারে। অপেক্ষা করতে লাগলো সাফি উঠে নিশ্চই কল করবে। তখন তিতিরের নাম্বারও পাওয়া যাবে। শুধু শুধু ওর বাবাকে কল দিয়ে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। ও জানে সবুরের ফল মিষ্টি হয়।
তিতির অপেক্ষা করতে করতে একসময় ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিল। এইচএসসি পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর তিতিরের বাইরে যাওয়ার একমাত্র উপায় হলো ভার্সিটি কোচিং। আজ ক্লাস নেই তবু বিকাল ৩ টার দিকে ক্লাসের কথা বলে বের হলো তিতির। একটা বাসা পরেই মুগ্ধর বাসা। বাসার সামনে যেতেই দারোয়ান জিজ্ঞেস করলো,
-"আপা কাউকে খুজতেছেন?"
-"হ্যা, ভাই আসলে আমি একজনকে হারিয়ে ফেলেছি। আমার কাছে ফোন নাম্বার নেই কিন্তু উনি এই বাসাতেই থকে।"
-"ও। নাম কি?"
-"ওনার নাম মুগ্ধ।"
-"এটা আবার কেমন নাম! যাই হোক, আপা এই বাসায় এই নামে তো লেউ থাকে না।"
-"একটু ভাল করে সিওর হয়ে বলেন না।"
লোকটা বলল,
-"আসলে আমার কাছে সব ভাড়াটিয়া এবং তাদের সব মেম্বারদের নামের লিস্ট আছে। আমি এ বাসায় ৫ বছর ধরে আছি। সত্যি বলছি আপা, এই নামে এখানে কেউ নাই।"
তিতির মন খারাপ করে চলে আসলো। মুগ্ধ ওকে মিথ্যে বলল! কিন্তু কেন মিথ্যে বলবে? প্রচন্ড মন খারাপ হলো। হেটে নিজের বাসা পর্যন্ত আসতে যেন পা ভেঙে আসছিল। বাসায় ঢুকলো না তিতির। ছাদে চলে গেল। কিছুই ভাল লাগছে না ওর।
বিকাল ৫ টার দিকে বাসা থেকে বের হলো মুগ্ধ। তিতিরের বাসার সামনে যাবে। কি করবে জানেনা কিন্তু যাবে। আর অপেক্ষা করতে পারছে না। গেট দিয়ে বের হয়ে আবার ফেরত আসলো দারোয়ানকে ডেকে বলল,
-"লিটন ভাই শোনো।"
-"জ্বী ভাই বলেন।"
-"আমাকে খুঁজতে একটা মেয়ে আসতে পারে। তুমি তাকে নাম জিজ্ঞেস করবে। যদি নাম বলে তিতির তাকে আমার ফোন নাম্বার টা দিয়ে দেবে।"
-"আচ্ছা।"
মুগ্ধ একথা বলে বের হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আবার ফিরে আসলো। বলল,
-"লিটন ভাই...।"
-"বলেন ভাই।"
-"নাম জিজ্ঞেস করা লাগবে না। আসলে একজনই আসবে নাম্বারটা দিয়ে দিও।"
লিটন হেসে বলল,
-"আচ্ছা ভাই।"
মুগ্ধ বলল,
-"আরেকটা ইম্পরট্যান্ট কথা। ও কিন্তু মেহবুবকে খুঁজবে না, মুগ্ধকে খুঁজবে। আমার ফ্যামিলি নেম মুগ্ধ বুঝলা? এখানে ভার্সিটির ফ্রেন্ডদের সাথে থাকি তো তাই এখানে সবাই ফরমাল নামটাই ডাকে।"
-"হায় হায় ভাই আগে বলবেন না?"
-"কেন আসছিল? আর তুমি বলে দিসো মুগ্ধ এখানে থাকে না?"
-"হ্যা ভাই ৩ টার দিকে আসছিল। খুব সুন্দরী একটা মেয়ে অল্পবয়সী। কিন্তু ভাই আপনের নাম যে মুগ্ধ তা তো আমি জানতাম না। সবাই তো দেখি আপনেরে মেহবুব বইলাই ডাকে।"
-"শিট! আমি যে কেন তোমাকে সকালে বললাম না। উফফফ!"
-"সরি ভাই।"
-"না না। ঠিক আছে। তুমি কেন সরি হবা? আমি তো তোমাকে আগে বলি নাই।"
মুগ্ধ সোজা চলে গেল তিতিরের বাসার সামনে। রাস্তার অপজিটে দাঁড়িয়ে বাসার সব বারান্দা আর জানালাগুলোতে চোখ বুলাতে লাগলো। এমনই একটা যায়গা একটা চায়ের দোকানও নেই, ধুর! শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকাটা খুবই অস্বস্তিকর। হঠাৎ দেখলো একটা চা ওয়ালা আসছে, যারা ফেরি করে চা বিক্রি করে। থামালো মুগ্ধ,
-"ওই মামা চা দাও তো।"
লোকটা রাস্তায় বসলো। বলল,
-"মামা কি চা দিমু?"
-"যা আছে সব দাও।"
চা ওয়ালা বোকা হয়ে গেল। বলল,
-"মানে?"
-"লেবু চা দাও।"
লোকটা একটা ওয়ান টাইম কাপে চা দিল। মানে এখন টাকা নিয়ে চলে যাবে। মুগ্ধ বলল,
-"মামা তুমি আমার সাথে এখানে বসে থাকবা এক ঘন্টা। কত টাকা নিবা?"
-"আমি এইখানে বইসা থাকমু কেন?"
-"আমি চা খাব তাই। আর ঘন্টায় কত টাকা নিবা বলো আমি দিব।"
-"এক ঘন্টা ৫০ টাকা।"
-"আমি তোমাকে এক ঘন্টায় ১০০ টাকা দিব। তুমি খুশি মনে বসে থাক আর আমাকে চা খাওয়াও।"
চা ওয়ালা এই অফার পেয়ে খুশি হলো।
এক ঘন্টা পার হয়ে গেছে। চা ওয়ালাকে আরো এক ঘন্টার জন্য কন্ট্যাক করা হয়েছে। মুগ্ধ এই এক ঘন্টায় কয় কাপ চা খেয়েছে তা ও নিজেই জানেনা। তাও ভাল এই রাস্তাগুলো অনেক বড় বড় আর ভিড়ও থাকে না তাই এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও তেমন কারো নজরে আসেনি। কোনো বারান্দা বা জানালায়ও তিতিরকে দেখতে পায়নি।
তিতির ছাদ থেকে নেমে এসেছে অনেকক্ষণ। ওর আর কিছুই ভাল লাগছে না। সাফিকে আবার কল দিল, নাম্বার বন্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধুম করে বৃষ্টি নামলো। কি যে দিন আসলো। পাহাড়ে পুরো শীত আসলেও ঢাকায় অল্প অল্প পড়তে শুরু করেছে। এই দিনে বৃষ্টি! অবশ্য ভালই লাগছে। তিতির বৃষ্টি দেখতে বারান্দায় গেল। বারান্দায় গিয়ে রাস্তার দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেল অ্যাশ কালারের শার্ট পড়া ছেলেটার দিকে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ওদের বাসার দিকে তাকিয়ে আছে, দৃষ্টি বারবার এদিক ওদিক করছে। এই ভরা সন্ধ্যার অন্ধকারেও মানুষ্টিকে চিনতে কষ্ট হলোনা তিতিরের। বুকের ভেতর থেকে একটা কান্না উঠে আসতে চাইলো। এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভূত হলো। কিন্তু মুগ্ধ যে ওদের বারান্দার দিকে একবারও তাকাচ্ছে না। তিতির কয়েকবার হাত নাড়লো মুগ্ধ দেখতে পেলনা। তিতির ভেতরে আসলো। কি ছুঁড়ে মারবে কিছুই খুঁজে পাচ্ছিল না। অবশেষে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে কয়েকটা লিপস্টিক নিয়ে একটা রুমালে বাঁধলো। এই লিপস্টিক গুলোর আর দরকার নেই। এগুলোই নষ্ট হোক। তারপর তা নিয়ে বারান্দা থেকে ছুঁড়ে মারলো মুগ্ধর গায়ে। মুগ্ধর গায়ে না লাগলেও মুগ্ধর সামনে এসেই পড়লো। তা দেখতে পেয়ে উপড়ে তাকাতেই তিতিরকে দেখতে পেল। মুগ্ধ ইশারা করলো তিতিরকে নিচে নামতে। তিতির ইশারায় বোঝালো আসছে। কিন্তু বাসায় কি বলে বের হবে এই ভর সন্ধ্যায়? তাও বৃষ্টির মধ্যে! আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ড্রইং রুমে কেউ নেই। কিছু না বলেই যাক তাহলে পরে যা হওয়ার হবে। তিতির চোরের মত দরজা খুলে বেড়িয়ে এল। এক দৌড়ে নিচে, সেসময় দারোয়ানও ছিলনা গেটে, বাহ! দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল। হেটে হেটে নয়। এক দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো মুগ্ধর সামনে। ততক্ষণে তিতিরও ভিজে সপসপে। আর এক সেকেন্ডের অপেক্ষাও না করে মুগ্ধ বলল,
-"আই লাভ ইউ তিতির।"
মুগ্ধর চুল, চোখের পাতা, ঠোঁট বেয়ে বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল। তিতির রিপ্লাই দিতে গিয়েও পারলো না। কথাটা যেন গলায় আটকে গেল। কেন এমন হলো! খুশিতে ও কথাই বলতে পারছে না। এক পা এগিয়ে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো তিতির। মুগ্ধ উত্তর পেয়ে গেল।
To be continued...