আমি পদ্মজা - পর্ব ১৪-১৫-১৬ | Golpo Porun

আমি পদ্মজা

(ইলমা বেহরোজ)

poddoja
This photo is from Pexels

চারিদিক একেবারে নিস্তব্ধ। দূর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এলো। সঙ্গে হুইসেলের শব্দ। গভীর রাতের ট্রেন ছুটে চলেছে গন্তব্যের দিকে। আরেকটা আওয়াজও আসছে। কাছে কোথাও  নেড়ি কুকুরের দল ঘেউঘেউ করছে। পদ্মজা ইংরেজি বইয়ের দিকে চোখ রেখে মিনমিনে স্বরে বলল,'পরীক্ষা তো কালদিন পর।'

হেমলতা খোলা চুল মুঠোয় নিয়ে হাত খোঁপা করেন। এরপর বললেন,'কাল আর কালদিন পর একই হলো।'

পদ্মজা চুপ হয়ে গেল। এমন ভান ধরল যেন সে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। হেমলতা চোখ ছোট করে পদ্মজাকে দেখছেন। মেয়েটা পড়ায় মনোযোগ দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু সফল হতে পারছে না। বার বার নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে টিপছে। 

'পদ্ম, ছাদে যাবি?'

হেমলতার এহেন প্রস্তাবে পদ্মজা একটু অবাক হলো। নাকের পাটা হয়ে গেল লাল। এতে নাক লাল হওয়ার কী আছে জানা নেই। পদ্মজা কিঞ্চিৎ হা হয়ে তাকিয়ে রইল। হেমলতা আবার বলেন,'যাবি?'

পদ্মজা টেবিল থেকে প্রফুল্লচিত্তে ছুটে এলো। বলল,'যাব।'

আমি পদ্মজা - সকল পর্ব

আকবর হোসেনের বাড়িটির নাম সিংহাসনকুঞ্জ। বাড়ির নাম এমনটা হওয়ার কারণ ছাদে না গেলে জানা সম্ভব নয়। মা-মেয়ে  সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে উঠছে। তাদের পায়ের শব্দ মোহময় ছন্দ তুলে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। অথবা মিলে যাচ্ছে চাঁদের আলোর সাথে একাকার হয়ে। ছাদের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল সিংহাসন। তা দেখে পদ্মজার চক্ষু চড়কগাছ। বিষ্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল,'আম্মা! এত বড় সিংহাসন কার?'

হেমলতা পদ্মজার মুখের ভাব দেখে বেশ আনন্দ পাচ্ছেন। তিনি দুইদিন আগে এই সিংহাসন আবিষ্কার করেছেন। আকবর হোসেনের কাছে প্রশ্ন করেছেন, ঠিক পদ্মজার মতো করেই। আকবর হোসেনের উত্তর হেমলতা পুনরাবৃত্তি করলেন,' তোর আকবর কাকার আব্বু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের। উনার ইচ্ছে ছিল,নিজের বাড়ির ছাদে একটা সিংহাসন করার৷ শেষ বয়সে এসে ইচ্ছে পূরণ করেন। দিনরাত নাকি রাজকীয় ভঙ্গীতে সিংহাসনে বসে থাকতেন। মৃত্যুও হয় সিংহাসনে ঘুমানো অবস্থায়।'

পদ্মজা হা অবস্থায় স্থির হয়ে রইল। সে সিংহাসন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। ময়ূর সিংহাসন! সিংহাসন যেন পেখম মেলে দাঁড়িয়ে আছে। ইট-সিমেন্টের তৈরি সিংহাসন। অনেক বড় দেখতে। পাঁচ ফুট দৈর্ঘ্যের বা আরো বেশি হবে৷ হেমলতা বলেন,'মোঘল সম্রাট শাহজাহানের সিংহাসনের মতো সিংহাসনের স্বপ্ন বোধহয় তিনি দেখতেন। অর্থের জন্য পারেননি।'

হেমলতার কথা পদ্মজা শুনল নাকি বোঝা গেল না। পদ্মজা অনুরোধ করে অন্য কথা বলল, 'আম্মা, সিংহাসনে বসো তুমি।'

এক কথায় হেমলতা সিংহাসনে বসেন। এরপর পদ্মজাকে ডাকেন পাশে এসে বসতে। পদ্মজা আসল না। দূর থেকে বলল, 'মাঝে বসো আম্মা।'

''আমি পদ্মজা'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন

'কী শুরু করেছিস।'

'বসো না।'

হেমলতা কপাল কুঁচকে সিংহাসনের মাঝে বসেন। পদ্মজার ঠোঁটে হাসি ফুটে আবার হারিয়ে গেল। বলল,'আরেকটু বাকি।'

'কি বাকি?'

'বাম পায়ের উপর ডান পা তুলে রানিদের মতো বসো।'

হেমলতা বিরক্তি নিয়ে উঠে পড়েন। পদ্মজাকে বলেন,'পাগলের প্রলাপ শুরু করেছিস!'

পদ্মজা নাছোড়বান্দা হয়ে দৃঢ়ভাবে বলল,'আম্মা, বসো না। নইলে আমি কাঁদব।'

পদ্মজার এমন কথায় হেমলতা হাসবেন না রাগবেন ঠাওর করতে পারলেন না। রাতের সৌন্দর্য, রাতের মায়াবী রূপ প্রতিটি মানুষের ভেতরের আহ্লাদ, ইচ্ছে, কষ্ট, ঠেলেঠুলে বের করে আনার ক্ষমতা বোধহয় নিজে আল্লাহ সাক্ষাৎ করে দিয়েছেন। তাই হেমলতা তার নিজের শক্ত খোলসে ফিরতে পারলেন না। পদ্মজার পাগলামোর সুরে সুর মিলিয়ে তিনি সিংহাসনে রাজকীয় ভঙ্গীতে বসেন। পদ্মজার কেমন কেমন অনুভূতি হয়। বুকের ভেতর ঝিরিঝিরি কাঁপন। এইতো তার কল্পনার রাজ্যের রাজরানি হেমলতা। এবং তার কন্যা সে পদ্মজা। চোখের মণিকোঠায় ভেসে উঠল একটি অসাধারণ দৃশ্য। হেমলতার সর্বাঙ্গে হীরামণি-মুক্তার অলংকার। অসম্ভব সুন্দর শ্যামবর্ণের এই সাহসী নারীকে দেখতে কতশত দেশ থেকে মানুষ ভীড় জমিয়েছে। আর সে হেমলতার পাশে বসে আছে। চারিদিকে ঢাকঢোল পিটানো হচ্ছে। হাতিশাল থেকে হাতির হুংকার আসছে। তারাও যেন খুশি এমন রানি পেয়ে। 

'তোর পাগলামি শেষ হয়েছে?'

পদ্মজা জবাব দিল না। হেমলতার পাশে এসে বসল। কোলে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। এরপর আক্ষেপের স্বরে বলল,'আম্মা, তুমি রানি আর আমি রাজকন্যা কেন হলাম না। সবাই আমাদের ভালোবাসত। সম্মান করতো। মুগ্ধ হয়ে দেখতো।'

হেমলতার বুক চিঁরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। সমাজ কেন তার প্রতিকূলে থাকল? কেন পদ্মজা ছোট থেকে সমাজের কারোর মেয়ের সাথে মেশার অধিকার পেল না? তিনি বললেন,'জন্ম যেভাবেই হউক। জীবনে সফলতা না এনে মৃত্যুতে ঢলে পড়া ব্যক্তির ব্যর্থতা। তুই এমন জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা কর যাতে মানুষ সম্মান করে। সম্মান করতে বাধ্য হয়। চোখ তুলে তাকাতেও যেন ভয় করে। যারা দূরছাই করেছে তাদের যেন বিবেকে বাঁধে।'

'পারব আমি?'

'কেনো পারবি না? পুরো জীবন তো দুঃখে,অবহেলায় যায় না।'

'তোমার জীবন থেকে এতোগুলো বছর দুঃখে আর অবহেলায় তো গেছে আম্মা।'

হেমলতা কিছু বলতে পারলেন না। তিনি জীবনে কী পেয়েছেন? উত্তরটা চট করে পেয়ে গেলেন। পদ্মজাকে বলেন,'আমার মেয়ে তিনটা আমার সফলতা। আমার অহংকার। প্রেমা তো ছোট। তোরা দুইজন নিজেদের মতো থাকিস, পড়িস, কোনো দুর্নাম নাই। এজন্য মানুষ বলে, এইযে এরা হচ্ছে হেমলতার মেয়ে। তখন আমার অনেক কিছু পাওয়া হয়ে যায়।'

পদ্মজা আশ্বস্ত করে বলল,'কখনো ভুল কাজ করব না আম্মা। তোমাদের সম্মান আমাদের জন্য আংশিকও নষ্ট হতে দেব না।'

হেমলতা পদ্মজার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেঙে মাঝে মাঝে পাতার ফাঁকে ফাঁকে পাখ-পাখালির ডানা নাড়ার শব্দ ভেসে আসছে। পদ্মজা চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে একটা চাঁদ, অগণিত তারা। আকাশকে তারায় পরিপূর্ণ একটি কালো গালিচার মত লাগছে। হেমলতা বিভ্রম নিয়ে বললেন,'সমাজের সাথে আমার সখ্যতা কখনো হয়ে উঠেনি। কালো রংয়ের দোষে। প্রকৃতির মতিগতি অবস্থা দেখে দেখে আমার সময় কাটে। আব্বা শিক্ষক ছিলেন বলে, কালো হয়েও পড়ার সুযোগ পাই। অবশ্য আব্বার সামর্থ্যও ছিল। আমাদের সব ভাই-বোনকে পড়িয়েছেন। আম্মা আমাকে পড়ানোতে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। রং কালো। কেউ বিয়ে করবে না। একটু পড়ালেখা থাকলে হয়তো করবে,সেই আশায়। যখন আমি তোর বয়সে ছিলাম বড় আপার মেয়ে হয়। মেয়েটার গায়ের রং কালো। শ্বশুর বাড়িতে তুলকালাম কান্ড। বংশের সবাই ফর্সা। বাচ্চা কেন কালো হলো। আপাকে বের করে দিল। আপা বাপের বাড়ি ফিরল। সমাজের কতো কটুক্তি কথা হজম করেছে আপা। তখন আমি নামাযের দোয়ায় আকুতি করে চাইতাম একটা সুন্দর মেয়ের। আমার বিয়ে হলে,মেয়েটা যেন পরীর মতো সুন্দর হয়। আমার মতো অবহেলার পাত্রী যেন না হয়৷ বড় আপার মতো কালো মেয়ে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হতে যেন না হয়। তুই যখন পেটে,এবাদত বাড়িয়ে দেই। পাঁচ ওয়াক্ত নামায বাদে সময় পেলেই সেজদায় লুটিয়ে আল্লাহকে একই কথা বলতাম। আমার পরীর মতো মেয়ে চাই। দোয়া কবুল হলো। তোর যেদিন জন্ম হয়, সবাই অবাক হয়ে শুধু তাকিয়েই ছিল। আমি তো খুশিতে কেঁদেই দিয়েছিলাম। এতো সুন্দর বাচ্চা এই গ্রামে কেন, পুরো দেশেও বোধহয় ছিল না। চোখের পাপড়ি যেন ভ্রুতে এসে ঠেকছিল। ঠোঁট এতো লাল ছিল। যেন ঠোঁট বেয়ে রক্ত ঝরছে। সদ্য জন্মানো শিশুর মাথা ভর্তি ঘন কালো রেশমি চুল।অলন্দপুরের সবার কাছে ছড়িয়ে পরে এই কথা। দল বেঁধে দেখতে আসে। এক সপ্তাহ বেশ তোড়জোড় চলে। কী খুশি ছিলাম আমি। সারাক্ষণ তোকে চুমোতাম। রাতেও ঘুমাতে ইচ্ছে করত না। মনে হতো এই বুঝি আমার পরীর মতো মেয়ে চুরি হয়ে গেল। তোর আব্বা সারাক্ষণ খুশিতে বাকবাকম করতো। বাইরে থেকে এসে গোসল ছাড়া কোলে নিত না। যখন কোলে নিত বার বার আমাকে বলতো, 'ও লতা। ছেড়িডা মানুষ না শিমুল তুলা।'

হেমলতা থামেন। চোখ তার ছলছল। পদ্মজা বলল,'তারপর?'

'কেউ বা কারা ছড়িয়ে দিল তুই তোর বাপের মেয়ে না। যুক্তি দাঁড় করাল। বাপ,মা কালো মেয়ে এতো সুন্দর কেন হবে? গ্রামের প্রায় সব মানুষ অশিক্ষিত। তাই বিবেচনা ছাড়াই বিশ্বাস করে নিল। '

হেমলতা চুপ হয়ে যান। পদ্মজা টের পেল হেমলতা কিছু একটা  লুকিয়েছেন। শুধু গ্রামের মানুষ বললেই এতো বড় দাগ লেগে যায় না কপালে। অন্য কোনো কারণ আছে। যা যুক্তি হিসেবে শক্ত ছিল। হেমলতা দম নিয়ে বলেন,'একা হয়ে যাই। তোর বাপ সরে গেল। সমাজ সরে গেল। আঁতুড়ঘরে একা সময় কাটাতে থাকি। তোকে দেখলেই মনে হতো, আল্লাহ নিজের কোনো মূল্যবান সম্পদ আমাকে দেখে রাখতে দিয়েছেন। আমি অন্য আমি হয়ে যাই। খোলসটা পাল্টে যেতে থাকে। রাত জেগে স্বপ্ন সাজাই। তোর সাথে ফুল কুড়নোর স্বপ্ন দেখি। ফুল গাছ লাগাই। যখন তোর চার বছর হয় বাড়ি ভরে যায় ফুলগাছে। ছোট শাড়ি পরিয়ে প্রতিদিন মা-মেয়ে মিলে ফুল তুলে মালা গেঁথেছি। নিশুতি রাতে পাকা ছাদে জোছনা পোহানোর স্বপ্ন ছিল। আজ পূরণ হলো। আর দুইটা ইচ্ছে বাকি, সাগর জলে মা-মেয়ে পা ডুবিয়ে পুরো একটা বিকেল কাটাব। আর, শেষ বয়সে নাতি-নাতনীদের নিয়ে তাদের মায়ের জীবনি বলব।'

পদ্মজা দু'হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হেমলতার কোমর। তিনি টের পান পদ্মজা ফোপাঁচ্ছে। উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,'পদ্ম, কাঁদছিস কেন?'

পদ্মজা বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,'আমাকে কখনো একা থাকতে দিও না আম্মা। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। তোমার মতো কেউ হয় না।'

'এজন্য কাঁদতে হয়?আমি সবসময় তোর সাথে আছি। কান্না থামা। কী মেয়ে হয়েছে দেখ! কেমন করে কাঁদছে। পদ্ম, চুপ...আর না...মারব এবার...পদ্ম।'

পদ্মজা থামে। কিন্তু ছটফটানি হচ্ছে ভেতরে। কেন এমন হচ্ছে জানে না। কিন্তু হচ্ছে। কান্না পাচ্ছে। আকাশ ভরা রাতের দিকে তাকিয়ে ভয় হচ্ছে। একটু আগেই সুন্দর লাগছিল এই আকাশ। আচমকা ভয়ংকর মনে হচ্ছে। মায়ের কোল ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, চারিদিকে অশরীরীদের ভীর। তাদের কোলাহলে মস্তিষ্ক ফেটে যাচ্ছে। পদ্মজা মায়ের কোলে মুখ লুকালো। 

'পদ্ম,ঘুমিয়ে পড়েছিস?' 

'না আম্মা।'

'সেদিন মাঝ রাত্রিরে ছুরি নিয়ে বের হয়েছিলাম। হানিফের ঘরটা আব্বা,আম্মার ঘর থেকে দূরে হওয়াতে সুবিধা ছিল। হানিফের ঘরের পাশে গিয়ে দেখি মদনও ঘরে। দুজনকে সামলানো সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তাই অপেক্ষা করতে থাকি মদন কখন যাবে। এরপর আরেকজন লোক আসে। একটু দূরে সরে যাই। গোয়ালঘরের পিছনে। মিনিট কয়েক পর উঁকি দিয়ে দেখি দরজা লাগানো। সাড়াশব্দ নেই। সাবধানে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখি হানিফ নেই। তখন হয়তো আম্মা দেখছে। তাই ভাবছে আমি খুন করেছি।'

'নানু কেন এমন ভাবল? হানিফ মামা তো তোমারই ভাই।'

হেমলতা তাৎক্ষণিক জবাব দিলেন না। সময় নিয়ে একটা গোপন সত্যি বললেন,'আমি তোর নানুর ভাইকে খুন করেছি। তাই তিনি আমাকে ঘৃণা করেন। ভয় পান। সন্দেহ করেন।'

হেমলতার কণ্ঠ স্বাভাবিক। পদ্মজা চমকে উঠে বসল। মুখখানা হা অবস্থায় স্থির হয়ে গেল হেমলতার দিকে। দৃষ্টি গেল থমকে। হেমলতা পদ্মজাকে সামলে নিতে সময় দেন। দূরের রাতের আকাশে চোখ রাখেন। পদ্মজা নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বলল,'তিনি কী হানিফ মামার মতো ছিলেন?'

হেমলতা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ান। সিঁড়িতে কারো পায়ের আওয়াজ। হেমলতা সাবধান হয়ে যান। পদ্মজাকে আড়াল করে দাঁড়ান। সেকেন্ড কয়েক পর একটা ছেলের দেখা মিলল। অচেনা মুখ। হেমলতা আগে কখনো দেখেননি। ছেলেটিও তাদের দেখে ভড়কে গেল।

চলবে...

আমি পদ্মজা - ১৫

ভোর বেলার সূর্য উদয়ের সময় পরিবেশে মৃদু সূর্যালোক ছড়িয়ে পড়ল। ট্রেনের জানালা দিয়ে সূর্যের আগুনরঙা আলো পদ্মজার মুখশ্রী ছুঁয়ে দিল। ফজরের নামায পড়ে ট্রেনে উঠেছে তারা। গন্তব্য অলন্দপুর। পদ্মজার মেট্রিক শেষ হলো আজ তিন দিন। হেমলতার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজল পদ্মজা৷ পুরো দেড় মাস পর পূর্ণা,প্রেমা,প্রান্তর দেখা পাবে। খুশিতে আত্মহারা সে। 

মাঝে একটু জিরিয়ে ফের চলছে ট্রেন। হেমলতা জানালার বাইরে তাকিয়ে আকাশ দেখছেন। কারণে, অকারণে তিনি এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। শুষ্ক চক্ষুদ্বয় যখন তখন সজল হয়ে উঠে। কিছুতেই বারণ মানে না। নীল আকাশের বুকে যেন সেদিন রাতের স্মৃতি আকার নিয়ে ভেসে উঠল। ছেলেটার বয়স তেইশ-চব্বিশ বছর হবে। অবাক চোখে তাকিয়েছিল। দেখতে বেশ ভাল। হেমলতা পদ্মজাকে আড়াল করে কঠিন স্বরে প্রশ্ন করেন, 'কে তুমি?'

ছেলেটি  হেমলতার কথার ধরনে বিব্রতবোধ করল।ইতস্তত করে বলল,'মুহিব, মুহিব হোসেন।'

হেমলতার টনক নড়ল। তিনি  সাবধানে জিজ্ঞাসা করলেন,'বারেক হোসেন তোমার বাবা?'

মুহিব ভদ্রতা সহিত বলল,'জ্বি।'

হেমলতা কী যেন বলতে চেয়েছিলেন,বলতে পারলেন না। তার আগে মুহিব বলল,'বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আমি আসছি।' এরপরই হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল। সেদিন আর রাত জাগা হলো না। ছাদ থেকে নেমে গেল তারা। গোপন বৈঠকে একবার বাঁধা পড়লে আর মন সায় দেয় না আলোচনা চালিয়ে যেতে। অনুভূতি গুলো ভোতা হয়ে যায়।

এরপরদিন জানা গেল, মুহিব তার পিতার সাথে রাগ করে ঢাকা ছেড়ে চাচার বাড়ি উঠেছে। এখনকার ছেলে-মেয়েদের ক্ষমতা খুব। তারা খুব সহজ কারণে মা-বাবার সাথে রাগ করে দূরে সরে যেতে পারে। হেমলতা অবজ্ঞায় কপাল কুঞ্চিত করতে সঙ্কোচবোধ করলেন না। পরে অবশ্য বুঝেছেন, মুহিব খুবই ভাল ছেলে। নম্র,ভদ্র,জ্ঞানী। মেধাবী ছাত্র। বিএ পড়ছে। সবচেয়ে ভাল গুণ হলো, মুহিবের নজর সৎ। হেমলতা চোখের দৃষ্টি চিনতে ভুল করেন না। ঠিক সতেরো দিন পর বারেক হোসেন ছেলেকে নিতে আসেন। যেদিন আসেন এরপরদিন রাতে হেমলতাকে প্রস্তাব দেন। মুহিবের বউ হিসেবে পদ্মজাকে নিতে চান। হেমলতা অবাক হোন। মুহিব মনে মনে পদ্মজার উপর দূর্বল অথচ বোঝা গেল না। নিঃসন্দেহে মুহিব পাত্র হিসেবে উপযুক্ত। মুহিবের বড় দুই ভাই মুমিন, রাজীব। দুজনই চাকরিজীবী। মুমিন বিয়ে করে বউকে ডাক্তারি পড়াচ্ছে। সমর্থনে আছে পুরো পরিবার। অতএব বোঝা গেল, পরিবারের প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্ক, ভাবনা উচ্চ মানের। বারেক হোসেন বিয়ের প্রস্তাবের সাথে এটিও বলেছেন,'আমার মেয়ে নেই। ছেলের বউরাই আমার মেয়ে। আপনার মেয়ের যতটুকু ইচ্ছে পড়বে। কোনো বাঁধা নেই।'

হেমলতা প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন না। তিনি আনন্দ সহিতে জবাব দিলেন,'পদ্মজা আইএ শেষ করুক। এরপরই না হয়।'

বারেক হোসেন হেসে বলেন,'তাহলে এটাই কথা রইল।'

স্মৃতির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন হেমলতা। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। গলাটা কাঁপছে। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে পানি পান করলেন। 

____________

প্রেমা,প্রান্ত বাড়ির বাইরে সড়কে পায়চারি করছে। পূর্ণা গেইটের আড়াল থেকে বার বার উঁকি দিয়ে দূর রাস্তা দেখছে। মোর্শেদ হেমলতা আর পদ্মজাকে আনতে গঞ্জে সেই কখন গেল, এখনো আসছে না। পুরো দেড় মাস পর মা-বোনের সাক্ষাৎ পাবে তারা। হৃদপিণ্ড দ্রুতগতিতে চলছে। মিনিট পাঁচেক পর কাঁচা সড়কের মোড়ে মোর্শেদের পাশে কালো বোরখা পরা দুজন মানুষকে দেখতে পেল তারা। পূর্ণা লাজলজ্জা ভুলে আগে আগে ছুটে গেল। পিছনে প্রান্ত এবং প্রেমা। ছুটে এসে মা-বোনকে একসাথে জড়িয়ে ধরে প্রবল কণ্ঠে কেঁদে উঠল পূর্ণা। হেমলতা পূর্ণাকে ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। মাঝে মাঝে একটু বাড়াবাড়ি করা দোষের নয়। পদ্মজার চোখ বেয়েও টপটপ করে জল পড়ছে। প্রায় প্রতিটা রাত সে ভাই বোনদের মনে করেছে। বিশেষ করে পূর্ণাকে বেশি মনে পড়েছে। মনে হচ্ছে কত শত বছর পর দেখা হলো। আর পূর্ণা বাড়ির আনাচে কানাচে পদ্মজার শূন্যতা অনুভব করেছে। সে অশ্রুসিক্ত চোখ মেলে তাকাল পদ্মজার দিকে। এরপর আবার জড়িয়ে ধরে বলল,'আপা, আমার এতো আনন্দ হচ্ছে। এতো আনন্দ কখনো হয় নাই।'

পদ্মজার কোমল হৃদয় পূর্ণার ভালবাসা দেখে বিমোহিত হয়ে উঠল। সে স্নেহার্ধ কণ্ঠে বলল,'আমার সোনা বোন। আর কাঁদিস না।'

পূর্ণা চোখের জল দ্রুত মুছল। প্রফুল্লচিত্তে বলল,' আপা, আমি তোমার পছন্দের চিংড়ি মাছ দিয়ে লতা রেঁধেছি।'

পদ্মজা অবাক চোখে তাকাল। হেমলতা প্রশান্তিদায়ক সুখ অনুভব করলেন। এক বোনের প্রতি আরেক বোনের নিঃস্বার্থ ভালবাসা দেখে। পদ্মজা বাকহারা হয়ে পূর্ণার দুই গালে চুমো দিল। মোর্শেদ দৃশ্যটি মুগ্ধ হয়ে দেখেন। এরপর তাড়া দেন, 'দেহো মাইয়াডির কারবার। মানুষ আইতাছে। আর হেরা রাস্তায় কান্দাকাটি লাগাইছে। হাঁট সবাই,হাঁট।'

খাওয়া দাওয়া শেষ করে চার ভাই বোন ঘাটে গিয়ে বসল। দেড় মাসে কী কী হলো, না হলো সব পূর্ণা বলছে। প্রেমা পূর্ণার নামে বিচার দিল। প্রান্ত প্রেমার নামে বিচার দিল। প্রান্ত কেন বিচার দিল, তা নিয়ে প্রেমা বাকবিতন্ডা লাগিয়ে দিল। সে কী কান্ড! দুজন তুমুল ঝগড়া লেগে গেল। এরপর দুজনই বিচার নিয়ে গেল হেমলতার কাছে। তখন পদ্মজা শুষ্ককন্ঠে পূর্ণাকে বলল,'জানিস পূর্ণা, আম্মা আমার বিয়ে ঠিক করছে।'

পূর্ণা ভীষণ চমকাল। চমকিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,'কবে? কার সাথে?'

'যে বাড়িতে ছিলাম ওই বাড়ির ছেলের সাথে। বিএ পড়ছে। আমার আইএ শেষ হলে বিয়ের তারিখ পড়বে।'

'আপা, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আম্মার না ইচ্ছে তোমাকে অনেক পড়াবে। তোমার চাকরি হবে।'

পদ্মজা চুপ থাকল ক্ষণকাল। এরপর বলল,'আম্মার কী যেন হয়েছে। পাল্টে গেছেন।'

'কী রকম?'

'আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বেশিরভাগ কথা এড়িয়ে যান। আমার ভবিষ্যত নিয়ে আগের মতো আগ্রহ দেখান না। আমি কথা তুললে এড়িয়ে যান। গল্প করেন না। মানে,আগের মতো নেই।' কথাগুলো বলতে গিয়ে পদ্মজার গলা কিঞ্চিৎ কাঁপল।

'সেকী!'

'সত্যি।'

'কিছু হয়েছে ওখানে?'

'না। আমি যতটুকু জানি তেমন কিছুই হয়নি।'

পূর্ণা সীমাহীন আশ্চর্য হয়ে চিন্তায় ডুবল। পদ্মজা শূন্যে তাকিয়ে রইল। লিখন শাহ নামে মানুষটার কথা মনে পড়ছে। তিনি যখন শুনবেন এই খবর, সহ্য করতে পারবেন? সত্যি ভালবেসে থাকলে সহ্য করতে কষ্ট হবে নিশ্চয়ই। পূর্ণা দ্বিধাভরে প্রশ্ন করল, 'আপা, লিখন ভাইয়ের কী হবে?'

পদ্মজা ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাকাল। বলল, 'আমি তাকে বলেই দিয়েছি, আম্মা যা বলবেন তাই হবে।'

পূর্ণার বড্ড মন খারাপ হয়ে গেল। তার আপার মতো সুন্দরীকে শুধুমাত্র লিখন শাহর পাশেই মানায়। কত স্বপ্ন দেখল সে, লিখন শাহ এবং পদ্মজাকে নিয়ে। সব স্বপ্নে গুড়ো বালি। সে কাতর কণ্ঠে বলল, 'লিখন ভাইয়ের সাথে তোর বিয়ে না হলে আমি কষ্ট পাব খুব।'

'আমিতো আম্মার কথার বাইরে যেতে পারব না।'

পূর্ণা গলার স্বর খাদে এনে বলল,'যদি লিখন ভাই রাজি করাতে পারে?'

পদ্মজা অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। সেই দৃষ্টি যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে, এ হওয়ার নয়! পূর্ণা কপাল কুঁচকে ফেলল। বিরক্তিতে বলে উঠল,'ধ্যাত!'

____________

বাতাসটা গরম গরম ঠেকছে। ক্রমশ মাথা ব্যাথা বেড়ে চলেছে। এতো এতো গাছগাছালি চারিদিকে তবুও এতটুকুও শীতলতা নেই পরিবেশে। হেমলতা আলমারির কাপড় গুছিয়ে বিছানার দিকে তাকালেন। মোর্শেদ এই রোদ ফাটা দুপুরে কখন থেকে ঝিম মেরে বিছানায় বসে আছে। মুখখানা বিমর্ষ, চিন্তিত। হেমলতা প্রশ্ন ছুঁড়লেন, 'কোনো সমস্যা?'

মোর্শেদ তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। হেমলতা তাকিয়ে রইলেন জবাবের আশায়। ক্ষণকাল সময় নিয়ে মোর্শেদ বললেন,'বাসন্তী এই বাড়িত আইতে চায় থাকবার জন্যে।'

হেমলতার চোখ দু'টি ক্রোধে জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল। নির্বিকার কণ্ঠে বলেন,'তোমার ইচ্ছে হলে নিয়ে এসো। বাড়ি তো তোমার।'

মোর্শেদ চকিত চোখে তাকান। তিনি ভেবেছিলেন হেমলতা রাগারাগি করবে। মোর্শেদের চোখ দু'টির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ রূপ নিল। কিড়মিড় করে হেমলতাকে বলেন, 'আমি তারে চাই না।'

হেমলতা ঠাট্টা করে হাসলেন। বললেন,'বিশ বছর সংসার করে এখন তাকে চাও না! আমি হলে মামলা ঠুকতাম।'

মোর্শেদ আহত মন নিয়ে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। চোখ দুটিতে অসহায়ত্ব স্পষ্ট। হেমলতা নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে সরে পড়েন। মোর্শেদ তখন কপট রাগ নিয়ে নিজে নিজে আওড়ান,'আমারে ডর দেহায়। মা*ডারে খুন করতে পারলে জীবনে শান্তি পাইতাম।'

হেমলতা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান। মোর্শেদকে পরখ করে নেন। রাগে ছটফট করছে মোর্শেদ৷ বাসন্তীর প্রতি তার এতো রাগ কেন? তিনি দু পা এগিয়ে আসেন। বললেন,'ভালোবাসার মানুষকে এভাবে গালি দিয়ে ভালোবাসা শব্দটির সম্মান খুইয়ে দিও না। '

'আমি তারে কোনকালেও ভালোবাসি নাই। বাসলে তোমারে বাসছি।'

হেমলতা ভীষণ অবাক হয়ে, চোখ তুলে তাকান। ভোতা অনুভূতি গুলো মুহূর্তে নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। মোর্শেদ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। দৃষ্টি অস্থির। বিছানা থেকে নেমে, গটগট পায়ে বেরিয়ে যান। হেমলতা মোর্শেদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকেন,ঝাপসা চোখ মেলে। এই মানুষটার থেকে এই একটি শব্দ শোনার জন্য একসময় কত পাগলামি করেছেন তিনি। কত কেঁদেছেন। আকুতি, মিনতি করেছেন। সত্য হোক কিংবা মিথ্যে হেমলতার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। বয়সটা কম হলে আজ তিনি অনেক পাগলামি করতেন,অনেক!

____________

পূর্ণার ভীষণ জ্বর। তাই পূর্ণাকে নানাবাড়ি রেখেই পদ্মজা বাড়ি ফিরল। সাথে এলো হিমেল, প্রান্ত,প্রেমা। বাড়িজুড়ে ছোটাছুটি করে লাউ,শিম,লতা,পুঁইশাক বন্দোবস্ত করল। হিমেল বাজার থেকে মাছ এনে দিল। বাড়িতে শুটকি ছিল। আজ হেমলতা আর মোর্শেদ ফিরবে। তাই এতো আয়োজন। দুই দিন আগে ঢাকা গেলেন তারা। হেমলতার বড় বোন হানির মেজো মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। হানি বলেছেন,হেমলতা না গেলে তিনি বিয়ের তারিখ ফেলবেন না। তাই বাধ্য হয়ে হেমলতা গিয়েছেন। তবে,পদ্মজার খটকা লাগছে শুরু থেকে। তার মা তাকে রেখে পাশের এলাকায় যেতেও আপত্তি করেন। আর আজ দু'দিন ধরে তিনি মাইলের পর মাইল দূরে পদ্মজাকে ছাড়া রয়েছেন। এসব এখন ভাবার সময় নয়। পদ্মজা যত্ন করে কয়েক পদের রান্নার প্রস্তুতি নিল। সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই। পরিবেশ ঠান্ডা,স্তব্ধ। এ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। প্রান্ত-প্রেমা উঠান জুড়ে মারবেল খেলছে। হিমেল শুধু দেখছে। মাঝে মাঝে প্রবল কণ্ঠে হাসছে। হাত তালি দিচ্ছে। রান্না শেষ হলো বিকেলে। প্রেমা,প্রান্ত,হিমেলকে খাবার বেড়ে দিল পদ্মজা। খাওয়া শেষ হলে বলল,'হিমেল মামা, প্রান্ত আর তুমি পূর্ণারে নিয়ে আসো৷ সন্ধ্যা হয়ে যাবে একটু পর। আম্মা,আব্বাও চলে আসবে।'

হিমেল, প্রান্ত বের হতেই পিছন পিছন ছুটে গেল প্রেমা। পদ্মজা একা হয়ে গেল। রান্নাঘর গুছিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বাতাস বইছে প্রবলবেগে। বাতাসের দাপটে চুল, ওড়না উড়ছে। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। পরিবেশ অন্ধকার হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। মনটা কু গাইতে লাগল। পদ্মজা এক হাত দিয়ে অন্য হাতের তালু চুলকাতে চুলকাতে গেইটের দিকে বারংবার তাকাচ্ছে৷ যতক্ষণ কেউ না আসবে শান্তি মিলবে না৷ বিকট শব্দ তুলে কাছে কোথাও  বজ্রপাত পড়ল। ভয়ে পদ্মজার আত্মা শুকিয়ে গেল। চারিদিক কেমন অন্ধকার হয়ে  এসেছে! ঘোমটা টেনে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। বিকট বজ্রপাত, দমকা হাওয়া, বড় বড় ফোটার বৃষ্টি।  সব মিলিয়ে প্রলয়ঙ্কারী ঝড় বইছে যেন। লাহাড়ি ঘরের মাথার উপরে থাকা তাল গাছ অবাধ্য বাতাসের তেজে একবার ডানে আরেকবার বামে ঝুঁকে পড়ছে। পদ্মজার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল ভয়ে। ছুটে গেল নিজের রুমে। বিছানার উপর কাচুমাচু হয়ে বসল। টিনের চালে ধুমধাম শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টির বেগ বেড়ে চলেছে। এতসব শব্দ ভেদ করে আরেকটি শব্দ কানে এলো। সদর ঘরে কিছু একটা পড়েছে। পদ্মজা ভয় পেয়ে গেল। পরপরই খুশিতে আওড়াল,'আম্মা আসছে।'

বিছানা থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে সদর ঘরে আসল। সদর ঘর অন্ধকারে তলিয়ে আছে। জানালা দিয়ে আসা ইষৎ আলোয় পদ্মজা টের পেল একজন পুরুষের অবয়ব। সাথে সাথে সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে পড়ল। পা'দুটি  স্তব্ধ হয়ে গেল। পদ্মজা কাঁপা কণ্ঠে বলল,'কে আপনি? খালি বাড়িতে কেন ঢুকেছেন?'

কোনো জবাব আসল না। পদ্মজা অনুরোধ করে ভেজা কণ্ঠে বলল,' বলুন না কে আপনি?'

একটি ম্যাচের কাঠি জ্বলে উঠল। সেই আলোয় দু'টি গভীর কালো চোখ বিভ্রম নিয়ে তাকিয়ে রইল পদ্মজার দিকে। শীতল, স্পষ্ট কণ্ঠে চোখের মালিক বলল,'আমির হাওলাদার।'

পদ্মজা পুরুষালী কণ্ঠটি শুনে আরো ভড়কে গেল। রগে,রগে বরফের ন্যায় ঠান্ডা সুক্ষ্ম কিছু একটা দৌড়ে গেল। এক হাত দরজায় রেখে, পদ্মজা আকুতি করে  বলল,'আপনি চলে যান। কেন এসেছেন?'

উত্তরের আশায় না থেকে পদ্মজা দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল। রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিল। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়েছে। কাজ করছে না। লোকটা যদি সম্মানে আঘাত করে বা গ্রামের মানুষ যদি দেখে ফেলে খালি বাড়িতে অচেনা পুরুষের সাথে, কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সে আর ভাবতে পারছে না। দরজায় করাঘাত শুনে পদ্মজা রুমের সব আসবাবপত্র ঠেলেঠুলে দরজার কাছে নিয়ে আসল। এরপর মাটিতে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। দু'হাত মাথায় রেখে আর্তনাদ করে ডাকল,'আম্মা, কই তুমি? আমি খুব একা আম্মা। আম্মা...।'

চলবে....


আমি পদ্মজা - ১৬

টিনের চালে ঝুম ঝুম শব্দ। বৃষ্টির এই ছন্দ অন্যবেলা বেশ লাগলেও এই মুহূর্তে ভয়ংকর লাগছে পদ্মজার। একেকটা বজ্রপাত আরো বেশি ভয়ানক করে তুলেছে পরিবেশ। সে কাচুমাচু হয়ে ফোঁপাচ্ছে। বৃষ্টির শব্দ একটু কমলে কিছু কথা ভেসে আসে বাতাসে,'আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? আমাকে ভয় পাবেন না। বিপদে পড়ে এই বাড়িতে উঠেছি৷ বিশ্বাস করুন।'

পদ্মজা কান্না থামাল। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল। দরজার ওপাশ থেকে আমির নামের মানুষটা বলছে,'দরজা খুলুন। বিশ্বাস করুন আমাকে। আমি আপনার সাথে কোনো সুযোগ নিতে আসেনি। ভয় পাবেন না।'

পদ্মজা একটু নড়েচড়ে বসল। আমির আবার বলল,'শুনছেন?'

পদ্মজা ঢোক গিলে কথা বলার চেষ্টা করল। কথা আসছে না। এরপর খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করল। বলল,'আ...আমি দরজা খুলব না।'

ক্ষণকাল উত্তর আসল না। এরপর আমির বলল,'আচ্ছা, খুলতে হবে না। আপনি ভয় পাবেন না প্লীজ।'

'আপনি চলে যান।'

'বৃষ্টি থামতে দিন। হঠাৎ বৃষ্টির জন্যই তো আপনার বাড়িতে উঠা। আমার বৃষ্টিতে সমস্যা হয়।'

আমিরের মুখে স্পষ্ট শুদ্ধ ভাষা শুনে পদ্মজা বুঝল, লোকটা শিক্ষিত। কথাবার্তা শুনে ভালো মানুষ মনে হচ্ছে। তবুও সাবধানের মার নেই। সে দরজা খুলল না। বিছানায় গিয়ে বসল। ভয়টা কমেছে। 

'শুনছেন?'

পদ্মজা জবাব দিল,'বলুন।'

'আপনার নাম কী? ডাকনাম বলুন।'

'পদ্মজা।'

' সুন্দর নাম। আমার নাম জিজ্ঞাসা করবেন না?'

'জানি।'

আমির অবাক হওয়ার ভান ধরে প্রশ্ন করল,'কীভাবে? আমাকে চিনেন?"

'না, কিছুক্ষণ আগেই  নাম বললেন।'

'তখন তো ভয়ে কাঁপছিলেন, নাম শুনেছেন! বাব্বাহ!' 

আমিরের কণ্ঠে রসিকতা। পদ্মজা মৃদু হাসল। কেন হাসল জানে না। আমির বলল,'শুনছেন?'

'শুনছি।'

'আপনি কী এরকমই ভীতু?'

'আমার সাহসিকতা প্রমাণ করানোর জন্য এখন বের হতে বলবেন তাই তো?'

ওপাশ থেকে গগন কাঁপানো হাসির শব্দ আসল। আমির হাসতে হাসতে বলল,'বেশ কথা জানেন তো।'

এই বিষয়ের কথাবার্তা এড়িয়ে গেল পদ্মজা। বলল,'বৃষ্টি কমলেই চলে যাবেন কিন্তু।'.

'এতো তাড়াতে হবে না। বৃষ্টি কমলেই চলে যাবো।'

'কষ্ট নিবেন না। খালি বাড়ি তো।'

'বাকিরা কোথায়? এটা মোর্শেদ কাকার বাড়ি না?'

'জি।'

'উনার ধানের মিল তো এখন আমার আব্বার দখলে। ছুটিয়ে নিবেন কবে?'

পদ্মজা অবাক হয়ে দরজার দিকে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে বলল,'আপনি মাতব্বর কাকার ছেলে?'

'অবাক হলেন মনে হচ্ছে।'

'মাতব্বর কাকার ছেলের নাম তো বাবু।'

আমির হেসে বলল,'আমার ডাকনাম বাবু। আম্মা আর আব্বা ডাকে। ভাল নাম, আমির।'

পদ্মজা আর কথা বাড়াল না। বজ্রপাত থেমেছে। বৃষ্টি রয়েছে। আমির জিজ্ঞাসা করল,'বাকিরা কোথায় বললেন না?'

'আম্মা,আব্বা ঢাকা। আজ ফেরার কথা ছিল। আর আমার দুই বোন আর ভাই নানাবাড়ি। বোধহয় বৃষ্টির জন্য আসতে পারছে না।'

'এখনো আমাকে ভয় পাচ্ছেন?'

'একটু,একটু।'

'এটা ভালো। অচেনা মানুষকে একেবারেই বিশ্বাস করতে নেই।'

__________

বাসন্তী ভ্যান থেকে নেমে সামনে এগোলেন। মোর্শেদের বাড়িটা তিনি চিনেন না। তাই কোনদিকে যাবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। এদিকে আকাশের অবস্থা ভাল না। রাস্তাঘাটেও  মানুষ নেই। ঝড়ো হাওয়া বইছে৷ আরো কিছুটা পথ হাঁটার পর আচমকা ঝড় শুরু হলো। তিনি দৌড়ে একটা বাড়িতে উঠলেন। রমিজ আলি বারান্দায় বসে হুঁকা টানছিল। সিল্কের শাড়ি পরনে,পেট উন্মুক্ত,লম্বা চুলের বেণুনীতে ধবধবে সাদা বাসন্তীকে দেখে তিনি অবাক হয়ে এগিয়ে আসেন। বিস্ময়ে প্রশ্ন করেন,'কেডা আপনে? কারে চান?'

বাসন্তী কেঁপে উঠলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে রমিজকে দেখে, লম্বা করে হাসেন। বলেন,'হুট কইরা মেঘখান আইয়া পড়ল তো।'

'তে আপনে কার বাড়িত যাইতেন?'

'মোর্ছেদের বাড়ি।' 

রমিজ আলি বিরক্তিকর ভাব নিয়ে সরে যান। ঘরের ভেতর থেকে চেয়ার এনে দেন। বলেন,'মোর্শেইদদার কী লাগেন আপনে?'

বাসন্তী চিন্তায় পড়েন। গ্রামের মানুষ তো জানে না তার আর মোর্শেদের সম্পর্ক। এখন জানানোটা কতটা যুক্তিসংগত? সেকেন্ড কয়েক ভাবার পর যুক্তি মিলে গেল। গ্রামবাসীকে বলা উচিত। নয়তো সে তার অধিকার কখনো পাবে না। একমাত্র গ্রামবাসীই পারে তার জায়গাটা শক্ত করে দিতে। বাসন্তী রমিজ আলির চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,'আমি তার বউ লাগি। পরথম বউ। তার লগে আমার বিছ বছরের ছম্পর্ক।'

রমিজ আলির চক্ষুদ্বয় যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পাওয়ার মতো আনন্দ অনুভব করেন। তিনি প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলেন,'হের পরের বউয়ে জানে?'

'না।'

'থাহেন কই আপনে?'

'রাধাপুর।'

'লুকাইয়া রাখছিল বিয়া কইরা?'

'হ। এখন মোর্ছেদ আমারে তালাক দিতে চায়। আমার সাথে ছংছার করতে চায় না। তাই আমি আমার অধিকার নেয়ার জন্যে আইছি। আমি তার বাড়িতে থাকবার চাই। আপনেরা আমারে ছাহায্য কইরেন। গ্রামবাছী ছাড়া মোর্ছেদ আমারে জায়গা দিব না।'

রমিজ আলি প্রবল বৃষ্টি, আর বজ্রপাতকে হটিয়ে উঁচু স্বরে বলেন,'আপনের জায়গা করে দেওন আমরার কাম। আপনি চিন্তা কইরেন না।মেঘডা কমতে দেন। এরপর খালি দেহেন কী হয়।'

বাসন্তী চোখমুখ জ্বলজ্বল করে উঠল। ভরসা পাওয়া গেল। রমিজ আলির প্রতিশোধের নেশা পেয়েছে। মোর্শেদ তাকে কতো কটু কথা বলেছে,অবজ্ঞা করেছে,অপমান করেছে। এইবার তার পালা। প্রতিটি অপমান ফিরিয়ে দিবেন বলে শপথ করেন। তিনি বাসন্তীকে ভরসা দিয়ে বলেন,'আপনি বইয়া থাহেন। আমি আরো কয়জনরে লইয়া আইতাছি।"

রমিজ আলি খুশিতে গদগদ হয়ে বেরিয়ে যান। ছইদ, রজব, মালেক,  কামরুলকে নিয়ে ফিরেন। সবার হাতে হাতে ছাতা। কামরুল আটপাড়া এলাকার মেম্বার। গ্রামে কোনো অনাচার হলে তা দেখার দায়িত্ব তার। তাই তিনি মাথার উপর বজ্রপাত, ঝড় নিয়েই ছুটে আসেন। 

____________

পদ্মজা উসখুস করছে। টয়লেটে যাওয়া প্রয়োজন। প্রস্রাবের বেগ বাড়ছে। এভাবে আর কতক্ষণ থাকা যায়। সাহসও পাচ্ছে না বের হওয়ার। রুমে পায়চারি করল কিছুক্ষণ। চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিল। এরপর কাঁচি কোমরে গুঁজে নিল। আয়তুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিল। তারপর দরজা খুলল। আচমকা দরজা খোলার আওয়াজ শুনে আমির চমকে তাকাল। আকাশ থেকে কালো মেঘের ভাব কেটে গেছে অনেকটা। সন্ধ্যার আযান পড়ছে। সালোয়ার,কামিজ পরা পদ্মজাকে দেখে মুহূর্তে হৃদস্পন্দন থমকে গেল তার। পদ্মজা ওড়না টেনে নিল নাক অবধি। এরপর কাঁপা পায়ে আমিরের পাশ কাটাল। আমিরের চোখ স্থির। নিঃশ্বাস এলোমেলো। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। পদ্মজা যখন ফিরছিল রুমে তখন আমির ডাকল,'পদ্মজা?'

পদ্মজা দাঁড়াল। মানুষটা খারাপ হলে এতক্ষণে আক্রমণ করতো। যেহেতু করেনি, মানুষটার উদ্দেশ্য খারাপ না। তাই দাঁড়াল। তবে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল না। আমিরের গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি পরা। শার্ট ভিজে গেছে। তাই বারান্দার দড়িতে রেখেছে,বাতাসে শুকাতে। আমির বলল, 'অলন্দপুরে এমন রূপবতী আছে জানতাম না।'

পদ্মজা লজ্জা পেল। বিব্রতবোধও করল। বৃষ্টি প্রায় কমে এসেছে। পদ্মজা বলল,'আপনি এবার আসুন। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।'

'যেতে তো ইচ্ছে করছে না।'

লোকটা বলে কী! এতক্ষণ বলল,বৃষ্টি কমলেই চলে যাবে। এখন বলছে, যাবে না৷ পদ্মজা ঘুরে তাকাল। চোখের দৃষ্টিতে আকুতি নিয়ে বলল,'চলে যান।'

আমির কিঞ্চিৎ হা হয়ে তাকিয়ে রইল। না চাইতেও পদ্মজা আমিরকে খেয়াল করল। শ্যামবর্ণের একজন পুরুষ। থুতনির মাঝে কাটা দাগ। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিল পদ্মজা। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,'বৃষ্টি কমে গেছে। আম্মা,আব্বা চলে আসবে। চলে যান।'

আমিরের নিস্তব্ধতা পদ্মজাকে বিরক্ত করে তুলল। এতো ঘাড়ত্যাড়া, দুই কথার মানুষ কীভাবে হয়? উঠানে পায়ের শব্দ! কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ। বারান্দা থেকে তাকাল আমির এবং পদ্মজা। গ্রামের এতোজনকে দেখে পদ্মজার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। দৌড়ে রুমে ঢুকে পড়ল। রমিজ আলি চেঁচিয়ে ডাকেন,'কইরে মোর্শেইদদা। আকাম কইরা এখন লুকায়া আছস ক্যান? বাইর হ। তোর আকাম ধইরা লইয়া আইছি।'

আমির বারান্দা পেরিয়ে বেরিয়ে আসে। গম্ভীরমুখে বলল,'উনারা বাড়িতে নেই।'

উৎসুক জনতা আমিরকে দেখে অবাক হলো। কামরুল বললেন,' আরে আমির। শহর থেকে আইলা কবে?'

'এইতো চার দিন হলো। আছেন কেমন?'

'এইতো আছি। তা এইহানে কি করো?'

আমির উত্তর দেয়ার আগে রমিজ আলি প্রশ্ন করেন,'বাড়িত কী কেউ নাই?'

আমির বেশ সহজ,সরল গলায় বলল,'আছে। পদ্মজা আছে।'

উপস্থিতি পাঁচ-ছয়জন তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। সবার দৃষ্টি দেখে আমির বুঝল,সে কত বড় ভুল করে ফেলল। তাহলে পদ্মজা এটারই ভয় পাচ্ছিল? আমির দড়ি থেকে শার্ট নিয়ে দ্রুত পরল। এরপর কৈফিয়ত স্বরে বলল,'আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। বাড়ি ফিরছিলাম। বৃষ্টি নামে তাই এই বাড়িতে উঠে পড়ি। বাড়িতে কেউ নাই জানলে..."

আমির কথা শেষ করতে পারল না। রমিজ আলি চেঁচিয়ে আশেপাশে বাড়ির সব মানুষদের ডাকা শুরু করল। মাতব্বর তাকে কম অপদস্ত করেনি। কোণঠাসা করেছে। মোর্শেদ পথেঘাটে কটু কথা শুনিয়েছে। আজ সেই যন্ত্রণা কমানোর দিন। আমির ভড়কে গেল। কামরুল আঙ্গুল শাসিয়ে কঠিন স্বরে বললেন,'তোমার কাছে এইডা আশা করি নাই। তোমার আব্বারে ডাকাইতাছি। উনি যা করার করবেন।'

আমির বিরক্তি নিয়ে বলল,'আরে আজব! কী শুরু করেছেন আপনারা?'

ছইদ আমিরের বয়সের কাছাকাছি। ব্যক্তিগত ভেজাল আছে তাদের মধ্যে। ছইদ হুংকার ছেড়ে বলল,'চুপ থাক তুই! তোর বাপে মাতব্বর বইলা তোরে ডরাই আমরা? আকাম করবি আর ছাইড়া দিমু?'

আমিরের চোখ লাল বর্ণ ধারণ করে। রেগে গেলে চোখের রং পাল্টে যায় তার। কালো মুখশ্রীর সাথে লাল চোখ ভয়ংকর লাগে। ছইদ ভেতরে ভেতরে ভয় পেল। আমিরের হাতে কম মার সে খায়নি। তবে, আজ সুযোগ আছে৷ পুরো গ্রামবাসী এক দলে। সে কিছুতেই ছাড়বে না। ঢোক গিলে বলে,'চোখ উলডাইয়া লাভ নাই। কুকামের উসুল না তুলে যাইতাছি না।'

আমির রাগে শক্ত হাতে ছইদের কানের কাছে থাপ্পড় দিল। মুহূর্তে ছইদের মাথা ভনভন করে উঠল। ততক্ষণে রমিজের উস্কানিতে মানুষ জমে গেছে। সবার হাতে হাতে টর্চ,হারিকেন। আঁধার নেমে এসেছে। আমির আবারো ছইদকে মারতে গেলে কয়জন এসে জাপটে ধরল। কামরুল একজন মহিলাকে আদেশ স্বরে বলেন,' শিউলির আম্মা কয়জনরে লইয়া মাইয়াডারে বার কইরা আনো। লুকাইছে নটি। গ্রামডা নটিদের ভীরে ধ্বংস হইয়া যাইতাছে'

পদ্মজা মাটিতে নতজানু হয়ে বসে কাঁপছে। দ্রুতগতিতে পা থেকে মাথার চুল অবধি কাঁপছে। বাইরের প্রতিটি কথা কানে এসেছে। চারপাশ যেন ভনভন করছে। শিউলির আম্মা পদ্মজার রুমে আসল। দরজা খোলা ছিল। টর্চ ধরে দেখল পদ্মজা মাটিতে বসে কাঁপছে। সে পদ্মজার মাথায় হাত রেখে বলল,'কেন এমন কাম করছস?'

পদ্মজা ঝাপসা চোখ মেলে তাকাল। শিউলির আম্মা পাশের বাড়ির। পদ্মজার সাথে ভাল সম্পর্ক। পদ্মজা শিউলির মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বলল,'ভাবী আমি কোনো খারাপ কাজ করি নাই। সবাই ভুল বুঝছে।'

রীনা নামে একজন মহিলা পদ্মজাকে জোর করে টেনে দাঁড় করাল। হেমলতার অনেক বাহাদুরি এই মেয়ে নিয়ে। অনেক অহংকার। সেই অহংকার আজ ভাল করে ভাঙ্গবে। সে মনে মনে পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠেছে। ঘৃণিত কণ্ঠে পদ্মজাকে বলল,'ধরা পড়লে সবাই এমনডাই কয়। আয় তুই।'

পদ্মজা আকুতি করে বলল,'বিশ্বাস করুন আমি খারাপ কিছু করিনি। আম্মা এসব শুনলে মরে যাবে। আপনারা এমন করবেন না।'

কারো কানে পৌছালো না পদ্মজার কান্না,আর্তনাদ, আকুতি। সবাই গ্রামের সবচেয়ে সুন্দর মনের, সুন্দর পরিবারের সদস্য গুলোকে ধ্বংস করায় মেতে উঠল। পদ্মজাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনে। কখনো ঘোমটা ছাড়া কোনো পুরুষের সামনে না যাওয়া মেয়েটার বুকের ওড়না পড়ে রইল ঘরে। তিন-চার জন মহিলা শক্ত করে চেপে ধরে রাখল। সবাইকে উপেক্ষা করে পদ্মজা ঘৃণা চোখে তাকাল আমিরের দিকে। আমির চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়ানোর, কিছুতেই পারছে না। পূর্ণা জ্বরের চোটে কাঁপছে। বাড়িতে ঢুকে দেখল কোলাহল। ভয় পেয়ে গেল। একটু এগিয়ে দেখল,পদ্মজার বিধ্বস্ত অবস্থা। জ্বর মুহূর্তে উবে গেল। দৌড়ে এসে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরল। চেঁচিয়ে উঠল,'আমার আপারে এমনে ধরছেন কেন? আপা..এই আপা? কাঁদছো কেন?'

পদ্মজা কেঁদে বলল,'পূর্ণা, আম্মা মরে যাবে এসব দেখলে। আমি কিছু করি নাই পূর্ণা।'

পূর্ণা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু অনুভব করছে,তার বুক কাঁপছে। ব্যথায় বিষে যাচ্ছে৷ সে রীনাকে বলল,'খালা আপনি আমার বোনরে এভাভে ধরেছেন কেন? ছাড়েন।'

রীনা কর্কশ কণ্ঠে বলল,'তোর বইনের রস বাইড়া গেছিল। এজন্যে খালি বাড়িত ব্যাঠা ছেড়া ডাইকা আইনা রস কমাইছে।'

পূর্ণার গা রিরি করে উঠল! তেজ নিয়ে বলল,'খারাপ কথা বলবেন না। আমার আপা এমন না।'

পাশ থেকে একজন মহিলা পূর্ণার উদ্দেশ্যে বলল,'তোর মা যেমন হের মাইডাও এমন অইছে। নিজেও এমন কিচ্ছা করল। মাইয়াও করল।'

পদ্মজা চমকে তাকাল। মহিলা বলে যাচ্ছে,'বুঝলা তোমরা সবাই, মায় এক বেশ্যা, মাইয়ারে বানাইছে আরেক বেশ্যা।'

পদ্মজা আচমকা রেগে গেল খুব। আক্রোশে শরীর কাঁপতে থাকল। রীনা সহ দুজন মহিলাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। এরপর রাগে চেঁচিয়ে বলল,'আমার মা নিয়ে কিছু বললে,আমি খুন করব। মেরে ফেলব একদম। জিভ ছিড়ে ফেলব ।'

পদ্মজার এহেন রূপে সবাই থতমত খেয়ে গেল। লম্বা চুলগুলো খোঁপা থেকে মুক্ত হয়ে পিঠময় ছড়িয়ে পড়ল। চোখের মণি অন্যরকম হওয়াতে মনে হচ্ছে, কোনো প্রেতাত্মা রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। গ্রামের কয়েক মহিলা আবার বিশ্বাস করে, পদ্মজা কোনো পরীর মেয়ে। তাই এতো সুন্দর। এই মুহূর্তে তারা ভাবছে,পদ্মজার ভেতর কেউ ঢুকেছে। তাই সামনে এগোল না। রীনা একাই এগিয়ে আসল। পদ্মজার চুলের মুঠি ধরে বিশ্রি গালিগালাজ করল। এরপর কামরুলকে বলল,'কামরুল ভাই, এই বান্দিরে বাঁন্ধা লাগব।'

পূর্ণা,প্রেমা পদ্মজাকে ছাড়াতে গেলে ছইদসহ আরো তিন চারজন এগিয়ে আসল। অন্ধকারের ভীরে পড়ে পদ্মজা, পূর্ণা, প্রেমা বাজেভাবে উত্ত্যক্ত হলো। কয়টা কালো হাত নিজেদের তৃপ্তি মিটিয়ে নিল। তিন বোনের কান্না,আর্তনাদ কারো হৃদয় ছুঁতে পারল না। হেমলতার অনুপস্থিতিতে তার আদরের তিন কন্যার জীবন্ত কবর হচ্ছিল,বাধা দেয়ার কেউ ছিল না।

চলবে....

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url