প্রেমাতাল - পর্ব ২০+21+22+23 । মৌরি মরিয়ম

প্রেমাতাল

(মৌরি মরিয়ম)

Prematal
This Photo is from Pexels

তিতির মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরার পর মুগ্ধও তিতিরকে ধরলো কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তারপর ছেড়ে দিয়ে বলল,

-"এইযে তিতিরপাখি! এবার ফোন নাম্বারটা বলো।"

-"01*********"

-"আচ্ছা এবার বাসায় গিয়ে ভেজা কাপড় ছাড়ো। আমি বাসায় গিয়ে কল দিচ্ছি।"

-"আচ্ছা, কিন্তু একবার শুনেই নাম্বারটা মনে রাখতে পারবেন?"

মুগ্ধ নাম্বারটা বলল। তিতির দেখলো মুগ্ধ ঠিক নাম্বারই বলেছে। একবার শুনেই কি করে মনে রাখতে পারলো! ভালই হয়েছে তিতির এই টাইপের জিনিসগুলো মনে রাখতে পারেনা। এখন থেকে এগুলো মনে রাখার দায়িত্ব মুগ্ধকেই দিয়ে দিবে।

তিতির এক পা দুপা করে পিছিয়ে উলটো ঘুরে বাসায় ঢুকে গেল। সিঁড়িতে উঠতেই ওর খেয়াল হলো ও নিজের বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরেছিল! ভয়ে শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো। কেউ দেখে ফেলেনি তো? নিজের ফ্যামিলির কেউ না হোক আশেপাশের ফ্ল্যাটের কেউ দেখলেও বিপদ আছে কপালে।

তিতির বাসায় ঢুকে যেতেই মুগ্ধ নিজের বাসার দিকে রওনা হল। শত শত বৃষ্টির ফোটা রাস্তায় জমে যাওয়া বৃষ্টির পানিতে টুপ করে পড়েই ছোট একটা সার্কেল হচ্ছে তারপর সেই সার্কেল বড় হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে। এই সাধারণ দৃশ্যও আজ মুগ্ধর কাছে অসাধারণ লাগছে। মনে মনে তিতিরকে বলছিল, 'আমি জানতাম তুমি আমাকে ভালবাসো। তবু কেন আমার এতটা ভাল লাগছে তিতির?'

প্রেমাতাল - সকল পর্ব

বাসায় গিয়ে কোনরকমে ভেজা কাপড় পালটে ফোনটা পলিথিন থেকে বের করলো। বৃষ্টি নামায় ও চা ওয়ালার কাছ থেকে একটা পলিথিন নিয়ে ফোনটা পেঁচিয়ে রেখেছিল। তবু ফোনটা ভিজে গেছে খানিকটা। ভালমতো মুছে নাম্বারটা টাইপ করতেই দেখলো সাজেশন এসেছে! তিতিরের নাম্বার আগে ইউজড হয়েছে ওর ফোনে! কিভাবে! সাজেশনে ঢুকতেই দেখলো সকালে এই নাম্বার থেকেই কল এসেছিল যাকে ও অনেক ঝেড়ে দিয়েছিল। তার মানে ও ওর বাবার ফোন ঘেটে নাম্বারটা বের করেছিল কিন্তু সিওর ছিলনা। ঝাড়ি খেয়ে কেটে দিয়েছিল। মুগ্ধ নাম্বারটা ডায়াল করল। প্রায় সাথে সাথেই ওপাশ থেকে হার্টবিট বাড়ানো সেই কণ্ঠস্বর,

-"হ্যালো।"

-"হ্যালো। চেঞ্জ করেছো?"

তিতির ফোনটা হাতে নিয়েই বসেছিল। অধীর আগ্রহে বসে থাকার পর মুগ্ধর এইটুকু কথা যেন একগুচ্ছ সাদা কামিনী ফুলের মত বুকের মাঝে এসে লুটিয়ে পড়লো। তিতির মনে মনেই সেগুলোকে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে চাইলো,

-"হুম। আপনি?"

-"করেছি। মাথা মুছেছো ভাল করে?"

-"হুম।"

-"ঘোড়ার ডিম মুছেছো! তুমি তো মাথাই মুছতে পারোনা। টপটপ করে পানি পড়তে থাকে চুল থেকে।"

-"হ্যা তা ঠিক, এর চেয়ে ভাল মুছতে পারিনা।"

-"হ্যা সেজন্যই তো চিন্তায় পড়ে গেছি।"

-"কিসের চিন্তা?"

-"আমার বাচ্চাকাচ্চাদের তো সারাবছর ঠান্ডা লেগে থাকবে।"

-"মানে?"

-"মানে মা নিজেই যেখানে চুল মুছতে পারেনা সেখানে বাচ্চাদের চুল কি করে মুছবে?"

তিতির লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইলো। মুগ্ধও তা বুঝতে পারলো। এরপর বলল,

-"অনেস্টলি স্পিকিং তিতির, আমার যে তিনটা গার্লফ্রেন্ড ছিল তাদের কারো সাথেই আমি বাচ্চাকাচ্চা পর্যন্ত কথা বলিনি। কারও প্রতি এতটা মুগ্ধতা আমার ছিলই না। তোমার সাথে বললাম, ভবিষ্যতেও বলবো। তোমাকে আমার বাচ্চাদের মা হতেই হবে। চুল মুছতে না পারলেও প্রব্লেম নেই। আমি শিখিয়ে দেব। আর ছুটির দিনগুলোতে আমিই মুছে দেব। সকালে আর রাতে ওদেরকে আমিই খাইয়ে দেব। তুমি শুধু কষ্ট করে দুপুরে খাওয়াবে। বাইরে বেরোলে বাচ্চারা সব আমার কোলে থাকবে। একসাথে দুজন পর্যন্ত কোলে নিতে পারবো। অভ্যাস আছে, ছোট ভাইবোন দুটোকেই একসাথে কোলে নিতে হয়েছে। কিন্তু দুটোর পরের বাচ্চাগুলো অবশ্য তোমাকেই নিতে হবে।"

''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন

-"আপনি প্লিজ থামবেন? এগুলো কোনো কথা হলো?"

মুখে এসব বললেও তিতির মনে মনে উড়ছিল। মুগ্ধ বলল,

-"থামবো কেন? কেবল তো শুরু।"

-"আপাতত অন্য কথা বলুন। আমার খুব লজ্জা করছে।"

-"এটাই তো মুশকিল। আমি তোমাকে কোনো কথাই আর লজ্জা দেয়া ছাড়া বলতে পারবো বলে মনে হয়না।"

-"ইশ! ওনার ওসব কথা শুনতে আমি যেন বসে আছি। আচ্ছা বলুন তো আপনার আমার জন্য এই ফিলিং টা কবে হয়েছে?"

-"স্পেসিফিক করে বলতে পারবো না। একটু একটু করে হয়েছে। তবে তোমার ঘুমন্ত মুখটার উপরই প্রথম ক্রাশ খেয়েছিলাম। তারপর সেকেন্ড ক্রাশটা থানচি গেস্ট হাউজে গোসলের পর যখন তোমার চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছিল তখন। কিন্তু এসব শুধুই ক্রাশ! ভালবাসা হয়েছে একসাথে পথ চলতে চলতে যখন দেখেছি তুমি ঠিক আমার মনেরই মতন, তখন। আর শুরুতে একদম এরকম ভাবিনি। আমি সাধারণত বাচ্চা মেয়েদের দিকে নজর দিই না।"

তিতির অবাক হয়ে বলল,

-"আমি বাচ্চা?"

-"অবশ্যই তুমি বাচ্চা। ৮ বছরের ছোট তুমি। আমার তোমার বয়সের কোনো মেয়ের সাথে প্রেমের কথা চিন্তা করতেও খারাপ লাগতো। বড়জোর আমার চেয়ে ২/৩ বছর ছোট যারা তাদের সাথে প্রেমটা প্রেফার করতাম। কিন্তু এখন বুঝলাম বাচ্চাদের সাথেই প্রেমে সবচেয়ে মজা।"

-"কিরকম?"

-"সেটা ঠিক বলে বোঝানো সম্ভব না।"

-"ও। কিন্তু আমি তো আর এরকম বাচ্চা থাকবো না, বড় হবো একসময়... তখন?"

-"হুম অবশ্যই তুমি বড় হবে। আমিও কিন্তু এই বয়সেই থেমে থাকবো না। তুমি আজীবনই আমার থেকে ৮ বছর কম ম্যাচিওর থাকবে। তাই অলওয়েজ তুমি আমার কাছে বাচ্চাই থাকবে। বুঝেছো তিতিরপাখি?"

তিতির হাসলো কোনো কথা বলল না। মুগ্ধও উত্তরের অপেক্ষায় রইলো না। বলল,

-"এবার তুমি বলোতো তোমার এসব ফিলিং আসলো কবে, কিভাবে?"

-"আমিও জানিনা। আমারও একটু একটু করেই হয়েছে। কিন্তু আপনি যেরকম ক্রাশের কথা বললেন ওরকম বলতে গেলে বলতে হবে আমি প্রথম আপনার পায়ের উপর ক্রাশ খেয়েছিলাম।"

-"হুম খেয়াল করেছি তো। কি লোভাতুর চোখে তাকিয়ে ছিলে আমার পায়ের দিকে!"

-"ইশ! ছিঃ কখনোই লোভাতুর চোখে তাকাইনি। নরমালি তাকিয়েছি। আপনি যেরকম আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন ওরকমই।"

-"হুম আমি যেন বুঝিনা!"

-"বোঝেনই না।"

-"ভাল কথা মনে পড়েছে শোনো.. তুমি রেমাক্রি গেস্ট হাউজের বারান্দায় স্যাভলন লাগাতে দিয়েছিলে না আমাকে?"

-"হ্যা।"

-"ওভাবে ভেজা চুল সরিয়ে অত সুন্দর ঘাড় কোনো পুরুষের সামনে ধরলে কি হয় জানো?"

-"কি হয়?"

-"সেই পুরুষের চরিত্র নষ্ট হয়।"

-"মানে?"

-"তখন যদি ঘাড়ে একটা চুমু দিতাম কি হত? আমি চরিত্রহীনই তো প্রমানিত হতাম।"

তিতির লজ্জায় আর কোনো কথাই বলতে পারলো না। কিন্তু মনে মনে বলল,'দিলেও খুশিই হতাম যেমনটা রাতে হয়েছিলাম।'

মুগ্ধ বলল,

-"আরে বাবা বার বার সাইলেন্ট মুডে চলে গেলে তো হবেনা। এটলিস্ট ভাইব্রেশনে আসো।"

-"শুনছি।"

-"নেক্সট টাইম ভুলেও একাজ করোনা। তাহলে কিন্তু আর ছাড়বো না।"

-"নেক্সট টাইম আপনিও খালি গায়ে আর হাফ কিংবা থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে আমার সামনে আসবেন না।"

-"কেন? আসলে কি তুমিও চরিত্রহীনা হবে? তাহলে আমি বার বার ওভাবে তোমার সামনে আসতে চাই।"

-"না। কিন্তু মার লাগাতে পারি।"

-"মারকে কিভাবে আদরে পরিণত করতে হয় সেটা আমি ভাল করেই জানি সুন্দরী।"

-"উফফ অন্য কথা বলুন। খেয়েছেন দুপুরে?"

-"না টেনশনে কি খাওয়া হজম হতো?"

-"যান গিয়ে খেয়ে নেন। পরে কথা বলছি।"

-"তুমি খেয়েছো?"

-"হুম। খেতে ইচ্ছে করছিলনা। জোড় করে খেয়েছি। আমার বাসায় না খেয়ে থাকা অসম্ভব। আর আমি ফিরেছি বলে বাবা দুপুরে বাসায় খেয়েছে আমাকে সাথে করে।"

-"ভাল করেছো। আমার মাও এরকম। কিন্তু অনেকদিন মায়ের সাথে বসে খাওয়া হয়না।"

-"যেতে পারেন না?"

-"যাই তো। প্রতি মাসে একবার যাই। তাছাড়া ছোট ভাইবোন দের পরীক্ষা হয়ে গেলেই বাবা ছাড়া ফুল ফ্যামিলি ঢাকায় চলে আসবে। তখন শুধু শান্তি আর শান্তি।"

-"ওদের কি পরিক্ষা? কিসে পড়ে?"

-"স্নিগ্ধর জেএসসি পরীক্ষা আর পিউ এর এইচএসসি পরীক্ষা।"

-"বাহ নামগুলো সুন্দর তো। আগে বলেননি কেন?"

-"আগে তো তুমি জিজ্ঞেস করোনি। আর এখন তো ওদের কথা অনেক বলতে হবে। বার বার ছোট ভাই ছোট বোন বলতে কেমন লাগে না? তাই নাম বলে দিলাম।"

-"ভাল করেছেন। এখন খেয়ে আসুন না প্লিজ। আমি তো আছিই.. কথাও হবে।"

-"পরে খাব।"

-"না এক্ষুনি খেতে হবে নাহলে আর একটা কথাও বলবো না।"

-"উফ কি ব্ল্যাকমেইল রে বাবা।"

-"যান না প্লিজ প্লিজ প্লিজ।"

-"ওকে। ১০ মিনিটে খেয়ে আসছি।"

-"হুম আপনি যান। আমি অপেক্ষা করছি।"

এরপর মুগ্ধ খেতে গেল। তিতির ফোন হাতে বসে ছিল। ড্রেসিং টেবিলের দিকে চোখ পড়তেই ওদের কাজের মেয়েজে ডাকলো,

-"চম্পা, এই চম্পা..."

চম্পা এসে বলল,

-"জ্বী আফা.."

-"ভেতরে আয়।"

-"গেট লাগাইন্যা দি।"

-"ওহ দাঁড়া খুলছি।"

তিতির দরজা খুলে দিতেই চম্পা ঘরে এল। তিতির ওর ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে সব লিপস্টিক গুলো তুলে চম্পার হাতে দিয়ে হেসে বলল,

-"এগুলো এখন থেকে তোর।"

চম্পা অবাক,

-"আফা আমনের মাতার গন্ডগোল হইসে নাকি? এত দামি জিনিসগুলা আমারে দিয়া দিতাসেন যে!"

-"ওড়নার আঁচলটা মেলে ধর তো।"

চম্পা হতভম্ব হয়ে তিতিরের কথামত আঁচল মেলে ধরল। তিতির এবার মেকাপ বক্স আর নেইপলিশ গুলো তুলে ওর আঁচলে দিয়ে বলল,

-"এগুলোও তোর।"

-"আফা সব দিয়া দিতাসেন ক্যা?"

-"এগুলো তুই আমাকে রেগুলার ইউজ করতে দেখেছিস কখনো? চাচী, ফুপি আর আপুদের কাছ থেকে গিফট পেতে পেতে এত জমে গেছে।"

-"হ কিন্তু মাঝেমইধ্যে তো এগুলান লাগান দেহি।"

-"হুম। আগে মাঝেমধ্যে লাগতো। কিন্তু এখন থেকে আর মাঝেমধ্যেও লাগবে না। তাই তোকে দিয়ে দিলাম। এখন তুই যা।"

চম্পার বিস্ময় কাটছিল না। বিস্ময় নিয়েই চম্পা ঘর থেকে বের হলো, তিতির আবার দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর তিতির আবার বিছানায় শুয়ে মুগ্ধর ফোনকলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই কল এল। তিতির মহানন্দে ফোন ধরলো,

-"হ্যালো।"

-"হুম, খেয়েছি। এবার খুশি?"

তিতির হেসে বলল,

-"হুম খুশি।"

মুগ্ধ বলল,

-"আচ্ছা একটা ইম্পরট্যান্ট কথা জানার ছিল।"

-"কি বলুন?"

-"নিজের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ওভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরার সাহস তুমি পেলে কোথায় বলোতো? আমার কিন্তু খুব ভয় করছিল।"

-"আমি নিজেও জানিনা। বাসায় আসার পর ভয় লেগেছে কিন্তু তখন আমার হুশ ছিলনা। সারাদিন কত খোঁজার পর পেয়েছি জানেন?"

-"হুম জানি।"

-"কি করে জানেন?"

-"তুমি বিকাল ৩ টার দিকে আমার বাসায় এসে দারোয়ানের কাছে আমার খোঁজ করেছিলে।"

-"হ্যা, কিন্তু সে বলেছে মুগ্ধ নামের কেউ ওই বাড়িতে থাকেই না। আসল ঘটনা কি? আপনি কি আসলেই ওই বাসাতে থাকেন?"

-"হ্যা।"

-"তাহলে উনি মিথ্যে বলল কেন?"

-"মিথ্যে বলেনি। আসলে আমার ফরমাল নেম হলো মেহবুব চৌধুরী। নিক নেম মুগ্ধ। তো স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি, অফিস সব যায়গাতে সবাই আমাকে মেহবুবই ডাকে। বাসায় যে ফ্রেন্ডদের সাথে থাকি ওদের মধ্যে দুজন ভার্সিটি ফ্রেন্ড আর একজন স্কুলফ্রেন্ড। ওরাও মেহবুব ডাকে, ভাড়াটিয়ার লিস্টেও মেহবুব চৌধুরী। তো দারোয়ান কিভাবে জানবে বলো?"

-"ও, তাহলে সে আপনাকে বলল কিভাবে আমি খুঁজতে গিয়েছিলাম? আমি তো মুগ্ধকেই খুঁজেছি।"

-"আমি বের হবার সময় ওকে বললাম আমার খোঁজে একটা মেয়ে আসতে পারে। যে মুগ্ধকে খুঁজবে। আমার ডাক নাম মুগ্ধ। যদি কেউ আসে আমার নাম্বারটা যেন দিয়ে দেয়। তখন ও বলল অলরেডি একজন এসেছিল, ও বলেছে এই নামে কেউ থাকেনা, এইতো।"

-"ওহ।"

-"জানি আরো খুঁজেছিলে। তোমার বাবার মোবাইল ঘেঁটে আমাকে কল করেছিলে কিন্তু আমার ঝাড়ি খেয়ে আর কথা বলোনি। কথা বললে কিন্তু সকালেই পেতাম। তুমি আমার কণ্ঠস্বর না চিনলেও তোমারটা আমি চিনতাম।"

-"তার মানে আমি ঠিক নাম্বারই বের করেছিলাম? ওই কর্কশ কণ্ঠী লোকটা আপনি ছিলেন?"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"তখন তোমাকে খুঁজছিলাম তো পাচ্ছিলাম না তাই মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে ছিল। তার উপর তুমি ফোন দিয়ে কথা বলছিলে না। তাই ঝেড়ে দিয়েছি। আই এম সরি ফর দ্যাট মাই তিতিরপাখি।"

আহ কি মিষ্টি কি মিষ্টি! তিতির বলল,

-"আমি যখন বুড়ী হয়ে যাব তখনও আপনি আমাকে এভাবেই তিতিরপাখি ডাকবেন?"

-"হুম সারাজীবন।"

-"দেখা যাবে।"

-"মানে?"

-"সবাইকে তো বলতে শুনি বয়ফ্রেন্ডরা প্রেম হওয়ার সময় অনেক কিছু বলে পরে সেগুলো ভুলে যায়।"

মুগ্ধ হেসে দিল। তিতির বলল,

-"হাসছেন কেন?"

-"এমনি।"

-"হাসলে হবে না উত্তর দিন।"

-"যখন বলা বন্ধ করে দেব তখন নাহয় শাস্তি দিও।"

-"ওকে! শুনুন না আমি আপনাকে আরো খুঁজেছি। সাফি ভাইয়াকে সারাদিন কল করেছি। উনি ধরেনি, কিন্তু নিশ্চই দেখেছে কারন কল করতে করতেই ওনার ফোন অনেকবার বিজি পেয়েছি।"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"ও তুমিও কল করছিলে? এবার বুঝেছি। আসলে আমিও ওকে কল করছিলাম। তাই তুমি যখন কল করেছো তখন আমি বিজি পেয়েছি আর আমি যখন কল করেছি তখন তুমি বিজি পেয়েছো। দেখেছো আমাদের দুজনের কি অবস্থা হয়েছিল? সেটা কি শুধু শুধুই? তুমি আমার বাচ্চাদের মা হবে বলেই তো।"

-"ধ্যাত! বলুন না সত্যি আপনিও কল করছিলেন?"

-"হুম। কারো সাথে কথা বললে ওয়েটিং দেখাতো। ওর ওয়েটিং সার্ভিস চালু করা আছে।"

-"ওহ!"

কিচ্ছুক্ষণ থেমে তিতির বলল,

-"কিন্তু এখন আরেকটা কথা বলার ছিল।"

-"বলো.. তোমার সব কথা শোনার জন্যই বসে আছি।"

-"আমি যে সেই কখন থেকে আপনি আপনি করে যাচ্ছি সেদিকে তো কারো খেয়াল নেই। একবারও তো বলল না তুমি করে বলতে।"

মুগ্ধ মজা করে বলল,

-"কে বলোতো? কার এতবড় সাহস?

-"আপনি! বুঝেও আবার ঢঙ করছে।"

মুগ্ধ হা হা করে হাসলো। তারপর বলল,

-"সিরিয়াসলি সবসময় তুমিতেই যে রোমান্টিকতা আসে তা কিন্তু না। তোমার মুখে ওই আপনিটাই আমার বেশ লাগে। তোমার ওই আপনি, শুনছেন, শুনুন এগুলো কত যে রোমান্টিক আর কত যে মিষ্টি লাগে তা তুমি বুঝবে না।"

-"তাহলে কি আমি আজীবন আপনাকে আপনি করেই বলবো?"

-"তোমার ইচ্ছে।"

-"অবশ্য হুট করে আপনি থেকে তুমি বলাটাও মুশকিল।"

-"তোমার যখন যা ইচ্ছে তুমি ডাকতে পারো। কিন্তু শুধু তুমি করে বললে, কোলে উঠলে আর জড়িয়ে ধরলেই তো হবে না। বৃষ্টিতে ভিজে যে কথাটা বলেছিলাম তার উত্তর চাই।"

-"এতকিছুর পর আবার উত্তরের কিছু বাকী থাকে নাকি?"

-"থাকে কারন, আমি উত্তরটা তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।"

তিতির লাজুক স্বরে বলল,

-"আমি বলতে পারবো না।"

-"সিরিয়াসলি, এই প্রথম শুনলাম কোন মেয়ে ঢাকা শহরের খোলা রাস্তায় নিজের বাড়ির সামনে একটা ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে লজ্জা পায়না কিন্তু ঘরের মধ্যে ফোনে "আই লাভ ইউ" জাস্ট তিনটা শব্দ বলতে লজ্জা পায়।"

-"হুম কারন, সবাই তিতির না।"

মুগ্ধ হেসে হেসে বলল,

-"দ্যাটস হোয়াই মুগ্ধ মার্ডারড বাই তিতির।"

তিতিরিও হেসে দিল। মুগ্ধ বলল,

-"আচ্ছা ফোর্স করবোনা। কিন্তু অপেক্ষা করবো।"

এভাবেই শুরু হয়েছিল এই দুই প্রেমাতালের একসাথে পথচলা। পাঁচ বছর কেটে গেলেও তিতিরের মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। সব স্পষ্ট কানে বাজে আজও। রাস্তায় ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল তিতির।

আজ ওরা দুজন দুজনের থেকে আলাদা। কোন যোগাযোগ নেই, দুজনের ফোন নাম্বার দুজনের কাছে থাকলেও কথা হয়না। দেখা হয়না প্রায় ৭ মাস হতে চললো। খুব কষ্টে সামলে নিয়েছে তিতির। মেনে নিয়েছে মানুষের জীবনের সব চাওয়া পূরণ হয়না। প্রতি রাতে কাঁদে সকালে উঠে সেই কান্নার সৎকার করে প্লাস্টিক একটা হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হয় সারাদিন। এই রুটিনে বেশ মানিয়ে গেছে তিতির। মানিয়ে গেছে মুগ্ধও কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ মুগ্ধ ফোন করে, মাসে হয়তো একবার। যখন মুগ্ধ আর কোনভাবেই নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে পারেনা তখনই ফোন করে কিন্তু ওর ওই একটা ফোনকল তিতিরের সব ওলট পালট করে দেয়। পাগলের মত হয়ে যায়। না পারে মুগ্ধর কাছে যেতে না পারে ওকে ছাড়া থাকতে আর না পারে মরে যেতে। যেন হাজার হাজার বিষলতা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে ওকে। আর সেই বিষলতা গুলো থেকে গুটি গুটি পায়ে বের হয়ে আসা হাজার হাজার বিষপোকা তাদের সূঁচালো ঠোঁট দিয়ে খুবলে খুবলে রক্তাক্ত করে ফেলে ওর ভেতরটা। কাল রাতে মুগ্ধ ফোন করার পর তিতিরের আবার সেই অবস্থাই হয়েছে। আরো বেশি পাগল পাগল লাগছে গানটা শুনে.. "ভাল আছি ভাল থেকো।"

হঠাৎ তিতিরের মাথাটা ঘুরে উঠলো। সামনের সবকিছু অন্ধকার আর আবছা হয়ে আসলো। তরতর করে ঘামতে লাগলো। বড্ড রোদ উঠেছে নাকি? কত হবে তাপমাত্রা? কাল যেন কত ছিল? ৪০ ডিগ্রি ছিলনা? নাকি ৪২? মনে করতে পারছিলনা তিতির। পা ভেঙে আসছিল। গায়ের সব শক্তিগুলো কোথায় গেল? দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না কেন? ও প্রানপণে আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল কোন রাস্তায় আছে? কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফুটপাতে লুটিয়ে পড়লো।

to be continued...

প্রেমাতাল - পর্ব ২১

মৌরি মরিয়ম

মুগ্ধ চোখ খুলে রাখতে পারছেন। ঘুমের জন্য না। চোখদুটো প্রচন্ড জ্বলছে তাই। গতকাল তিতিরের সাথে কথা হওয়ার পর সারারাত আর ঘুমাতে পারেনি। ফোন না দিয়েই বা কোথায় যাবে? মন তো আর সবসময় এত বাধা মানতে চায়না। নিঃশ্বাসটা আটকে যায় মাঝে মাঝে। স্নিগ্ধ, পিউ আর মায়ের দায়িত্ব ওর উপর না থাকলে আল্লাহ কে বলতো নিঃশ্বাসটা যেন সারাজীবনের জন্য বন্ধ করে দেয়। এখন তাও পারেনা। কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে সাময়িকভাবে সবকিছু থেকে একটু দূরে থাকা যায়। কিন্তু দুদিন ধরে অফিসে কাজের চাপ কম। তাই এখন ব্যস্থতাও নেই তিতিরের স্মৃতির হাত থেকে রেহাইও নেই।

লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে। পিয়ন এসে লাঞ্চের জন্য ডেকে গেছে অনেকক্ষণ আগে। মুগ্ধ উঠলো। ফোন ওয়ালেট পকেটে ঢুকালো। প্রায় সাথেই সাথেই ফোনটা বেজে উঠলো। তিতির! তিতির ফোন করেছে! কিন্তু এটা প্রায় অসম্ভব।গত ৭ মাসে তিতির একটাবারও ফোন করেনি ওকে। ফোন রিসিভ করলো। না তিতির নয় একাটা পুরুষ কন্ঠ ভেসে এল ওপাশ থেকে,

-"হ্যালো।"

-"হ্যালো।"

-"মুগ্ধ বলছেন?"

-"ইয়েস। আপনি কে? এটা তো তিতিরের নাম্বার।"

-"দেখুন ভাইয়া, আমি ওনার নাম জানিনা। উনি রাস্তায় সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে। তাই ওনার ব্যাগ ঘেটে ফোনটা বের করতে বাধ্য হয়েছি। ফোন লক করা আর ইমারজেন্সি কল লিস্টে কেবল আপনার নাম্বারটাই পেলাম তাই আপনাকে কল করলাম।"

তিতির রাস্তায় সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে এই সেনটেন্সটাই যথেষ্ট ছিল মুগ্ধর ভেঙে পড়ার জন্য। কিন্তু মুগ্ধ ভেঙে পড়েনি। কঠিন সময়ে স্টেবল থাকার ক্ষমতা আল্লাহ ওকে দিয়েছে। স্বাভাবিক স্বরে

-"ওহ ওকে ওকে! কোথায় আছেন?"

-"বনানী, চেয়ারম্যান বাড়ি।"

-"ভাই, আমার ১০-১৫ মিনিট লাগবে। আপনি কি ততক্ষণ একটু থাকবেন ওর পাশে?"

-"শিওর। আপনি আসুন।"

অফিস থেকে বের হতে হতেই মুগ্ধ চিন্তা করছিল, তিতির এখানে কি করছে? ওর বাসা, ইউনিভার্সিটি সবই তো ধানমন্ডিতে। তবে কি মুগ্ধর কাছেই এসেছিল?

১৫ মিনিট লাগলো মুগ্ধর অফিস থেকে আসতে। দূর থেকেই দেখতে পেল তিতিরকে। দেখামাত্রই এক দৌড়ে চলে গেল ওর কাছে। একটা মেয়ের কোলে ওর মাথাটা রাখা। আশেপাশে কয়েকটা ছেলে আর একজন বুড়ো লোক দাঁড়িয়ে আছে। নার্ভাস লাগছে, তিতিরকে কখনো এভাবে দেখেনি ও। ওদের কাছে গিয়ে বলল,

-"স্কিউজমি, আমিই মুগ্ধ।"

একটা ছেলে বলল,

-"আমি শ্রাবন। আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম। এইযে ওনার ফোন।"

মুগ্ধ ফোনটা নিয়ে তিতিরের পাশে বসতেই ছেলেটি বলল,

-"ভাইয়া উনি পুরোপুরি সেন্সলেস হননি। অন্য কোনো প্রব্লেম হয়েছে তাকাতে পারছিলনা আর কথাও বলতে পারছিলনা। ওনার চোখেমুখে পানি দেয়া হয়েছে। পানি খাওয়ানোও হয়েছে। কিছু বলার চেষ্টা করেছিল। আমরা বুঝতে পারিনি। তারপর আর চোখ খোলেনি।"

-"ওকে আমি ওকে আশেপাশে কোনো হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি। আপনাদেরকে অনেক ধন্যবাদ।"

-"ইটস ওকে ব্রাদার! চোখের সামনে এরকম দেখে এটুকু না করে পারা যায়না। আপনার গার্লফ্রেন্ড?"

-"হ্যা।"

মুগ্ধ একটা সিএনজি ডেকে তিতিরকে নিয়ে উঠলো। শ্রাবন ছেলেটা বলল,

-"ভাইয়া আমরা ওনার খবর পাবো কিভাবে?"

মুগ্ধ ওয়ালেট থেকে একটা কার্ড বের করে দিয়ে বলল,

-"থ্যাংকস এগেইন।"

-"ইটস ওকে! টেক কেয়ার অফ হার।"

সিএনজি ছাড়তেই মুগ্ধ তিতিরকে নিজের বুকের সাথে হেলান দিয়ে শোয়ালো। তিতিরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি বিদ্ধস্ত হয়েছে চেহারা। মুখটা শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচটা কিছুটা কালো হয়েছে। ওর ফ্যামিলির মানুষগুলোর কি এগুলো চোখে পড়েনা? তিতির একটু তাকানোর চেষ্টা করলো। দুইতিন সেকেন্ড তাকিয়েই ওর চোখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল আবার। মুগ্ধ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। ১০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল কাছের একটা ক্লিনিকে।

ডাঃ তিতিরকে দেখে বলল,

-"ওনার প্রেশার লো হয়ে এরকম হয়েছে। আর উনি বোধহয় রাতে ঘুমায়না একদমই, খাওয়াদাওয়াও ঠিকমত করেনা। শরীর খুব দুর্বল। তবে চিন্তা করবেন না, ওনার জ্ঞান আছে। কে হন আপনি ওনার?"

-"বয়ফ্রেন্ড।"

-"ঝগড়া হয়েছিল নাকি?"

-"না।"

-"তাহলে ওনার ডিপ্রেশন টা কিসের?"

-"একচুয়েলি ওর ফ্যামিলি আমাদের সম্পর্কটা মানেনি। তাই নিয়েই বোধহয় ও আপসেট।"

-"বোধহয় মানে? আপনি ঠিকমতো জানেনও না? ফ্যামিলি বয়ফ্রেন্ড সবাই মিলে কেয়ারলেস হলে তো এমন হবেই।"

-"ডক্টর, আমাদের ৭/৮ মাস ধরে কোনো যোগাযোগ নেই। রাস্তায় সেন্সলেস হয়ে পড়েছিল, রাস্তার লোকজন ওর মোবাইলের ইমারজেন্সি কল লিস্টে আমার নাম্বার পেয়ে আমাকে ফোন করে তখন আমি গিয়ে ওকে নিয়ে আসি। যোগাযোগ না রাখলে কি করে কেয়ার করবো বলুন?"

ডাঃ কতক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। সে কি ভাবছে বোঝা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর বলল,

-"আমি ওনাকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে দিচ্ছি, দুএক ঘন্টা ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে। আর কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি, ভিটামিন। রেগুলার খেতে বলবেন।"

ইনজেকশন দেয়ার সময় ও একটু ব্যাথা পেয়ে কুঁকড়ে গেল। একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। কোনো কথা বলতে পারল না। তিতিরের এমন নিথর দেহ আর নিস্তেজ মুখটা সহ্য করতে পারছিল না মুগ্ধ। বলল,

-"ডক্টর আমি ওকে নিয়ে যেতে চাচ্ছি।"

-"ওনার তো ঘুম দরকার।"

-"হুম বাসায় গিয়ে ঘুমাবে।"

-"আচ্ছা নিয়ে যান।"

পিউ দরজা খুলেই অবাক। বলল,

-"ভাবী! ভাইয়া, ভাবীকে কোথায় পেলি? কি হয়েছে ওর?"

মুগ্ধ তিতিরের ঘুমন্ত মাথাটা নিজের বুকে ঠেকিয়ে ওকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। ওর হাতগুলো ঝুলছিল। এই দৃশ্যটা পিউ নিতে পারছিল না। মুগ্ধ ভেতরে ঢুকতেই পিউ আবার জিজ্ঞেস করলো,

-"বলনা ভাবীর কি হয়েছে? অজ্ঞান হয়ে গেছে?"

-"প্রেশার লো হয়ে রাস্তায় পড়ে গেছিল।"

-"তারপর? তুই পেলি কিভাবে?"

মুগ্ধ পুরো ঘটনাটা সংক্ষেপে বলল পিউকে। তারপর বলল,

-"ওকে ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। তাই ঘুমাচ্ছে।"

মুগ্ধ তিতিরকে নিজের রুমে নিয়ে গেল। শুইয়ে দিল বিছানায়। পিউ গেল পিছন পিছন। মুগ্ধ পিউকে জিজ্ঞেস করলো,

-"মা বাসায় নেই?"

-"না।"

-"কোথায় গেছে?"

-"ইকরাপুদের বাসায় গেছে। চলে আসবে।"

-"স্নিগ্ধ?"

-"কলেজে।"

-"কলেজ ছুটি হয়েছে ২ টায়। এখন সাড়ে ৩ টা বাজে। এখনো কলেজে কি?"

-"ভাইয়া, ওদের কলেজে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছে তো তাই।"

-"ও। তুই কোথাও যাচ্ছিস নাকি?"

-"হ্যা ভাইয়া, ক্লাস আছে।"

-"যা তাহলে।"

-"ভাবীকে কি একটু পরেই বাসায় দিয়ে আসবি?"

-"ঘুম থেকে উঠলে দিয়ে আসব।"

-"ইশ! আমার ফিরতে ফিরতে রাত হবে। ওর সাথে একটু কথাও বলতে পারলাম না।"

-"কথা বলে আর কি হবে? যে সারাজীবন দূরে থাকবে সে দূরেই থাক।"

পিউ কি বলবে! শান্তনা দেয়ার কোনো ভাষা ওর নেই। তিতিরের অবস্থা দেখে ওর নিজেরই বুকটা ফেটে যাচ্ছে। পরীর মত মেয়েটা কেমন হয়েছে দেখতে! তার উপর বড় ভাই। চুপ করেই থাকলো। মুগ্ধ বলল,

-"ক্লাসে যা। দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। আমি আছি, আজ আর অফিসে যাবনা।"

-"আচ্ছা। ভাইয়া তুই কি লাঞ্চ করেছিলি? নাহলে ভাত দেই তোকে?"

-"করেছি।"

-"আচ্ছা, যাচ্ছি। দরজাটা লাগিয়ে দে।"

পিউ চলে গেল। মুগ্ধ আবার এসে বসলো তিতিরের পাশে। তাকিয়ে রইলো তিতিরের দিকে। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। ঘুমের জন্য যাকে আদর করে ঘুমকুমারী ডাকতো আজ সে নাকি প্রয়োজনীয় ঘুমটুকুও ঘুমায় না। মুগ্ধর ইচ্ছে করছে তিতিরকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখতে। আচ্ছা এমন কোনো মন্ত্র যদি থাকতো বুকে জাপ্টে ধরে মন্ত্রটা পড়লেই প্রিয়জনের সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে।তাহলে ও আজ সারাদিন সেই মন্ত্রটা পড়তো।

কত সুন্দর করে কেটে গিয়েছিল ওদের ৪টা বছর। যেন স্বপ্ন! হঠাৎ করেই প্রপোজ করেছিল.. আর তিতির ইন্সট্যান্ট রিপ্লাই দিয়েছিল জড়িয়ে ধরে। তারপর থেকেই শুরু হয়েছিল এই স্বপ্নটা। সকালে যখন মুগ্ধ অফিসে যেত তিতির তখনো ঘুমে। যেদিন ওদের সম্পর্কটা হয়েছিল তার পরের দিন সকালের ঘটনা,

তিতির ঘুমিয়ে আছে। ফোনটা বেজেই চলেছে। চোখ না খুলেই ফোন হাতরে কোনোরকমে কানের কাছে ধরে হ্যালো বলল। সেই হ্যালো টা মুগ্ধর বুকে একটা ফুলের টোকা দিয়েছিল। মুগ্ধ বলল,

-"আমার ঘুমকুমারী এখনো ঘুমাচ্ছে?"

-"হুম আমার স্কুল কলেজ সব সকালে ছিল। ঘুমাতে পারিনি। প্লিজ ঘুমাতে দাওনা।"

আবার সেই ঘুম মাখানো কণ্ঠস্বর। সবগুলো শব্দ যেন একটার সাথে আরেকটা ধাক্কা খেয়ে লুটিয়ে পড়ছে। বেশ লাগছে শুনতে। বান্দরবানে যখন ওকে রেমাক্রিতে সূর্যোদয় দেখাতে নিয়ে যাবে বলে ঘুম থেকে ওঠাচ্ছিল তখনও এভাবেই কথা বলেছিল তিতির। কিন্তু এখন একটু অন্যরকম লাগছে কেন? বয়ফ্রেন্ড হয়ে গেছে বলে বেশি আহ্লাদ করছে নাকি? তারপর আচমকাই মুগ্ধর খেয়াল হলো তিতির ওকে তুমি করে বলেছে। এটাই ডিফারেন্স। বাহ! ওর মুখে আপনি তুমি সবই কেন এত ভাল লাগে! মুগ্ধ বলল,

-"এত সিডাক্টিভলি কথা বললে কিন্তু তোমার ঘরে চলে আসব।"

-"আচ্ছা আসো।"

মুগ্ধর হাসি পেল। ও কি ঘুমের ঘোরে থেকেই কথা বলছে এখনো! তা নাহলে তো এধরণের রিপ্লাই না দিয়ে উলটো লজ্জা পেত। মুগ্ধ বলল,

-"আসলে কিন্তু...."

মুগ্ধ কিছু বলার আগেই তিতির বলল,

-"আদর দিতে হবে কপালে বান্দরবানের মত করে। কিন্তু আমি উঠবো না।"

-"ওরে দুষ্টুটা! তুমি জেগে ছিলে?"

-"হ্যা তো। আমি তোমার কোলে চড়ার জন্য ঘুমের ভান করেছিলাম।"

-"ফাজিল মেয়ে, যাও তোমাকে আর কোলেই নিব না।"

তিতির নগদ কান্না করে দিল।

-"অ্যাআআআআ... আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে সারাজীবন কোলে নিবা। আমার ফ্রেন্ডরা ঠিকই বলেছিল। ছেলেরা বয়ফ্রেন্ড হওয়ার পর বদলে যায়।"

কান্না শুনে মুগ্ধ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বলল,

-"আরে না পাগলী। নিব নিব।"

-"না নিবানা। আমি বুঝে গেছি। প্রমাণ তো পেয়েই গেছি। কাল সন্ধ্যায় কোলে চড়ার লোভেই তো আমি তোমাকে রাস্তার মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে কোলে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে হেঁটে আমাদের নিউ বর্ন রিলেশনশিপ সেলিব্রেট করবে। কিন্তু তুমি করোনি। ফোন নাম্বার নিয়ে ভেগে গেছো। এখন আমার কি হবে! অ্যাআআআআআ।"

মুগ্ধ হাসতে হাসতে কুটিকুটি হলো। তিতির বলল,

-"আমি কাঁদছি আর তুমি হাসছো! তুমি পচা।"

-"সরি বাবা। তুমি কান্না করোনা প্লিজ। সত্যি আমার এমনটাই ইচ্ছে করছিল। আই সয়ার, যদি এটা তোমার বাসার সামনে না হয়ে অন্য যেকোনো যায়গা হতো আমি এটাই করতাম। দেখোনি বান্দরবানে আমি তোমাকে কারনে অকারনে কতবার কোলে নিয়েছি? কোলে নিতে তো আমার ভাল লাগে। কিন্তু কাল আমার ভয় করছিল যদি তোমার বাসার কেউ দেখে ফেলে!"

তিতির কাঁদতে কাঁদতেই বলল,

-"না না না। এসব কথায় আমি ভুলবো ন।"

-"আচ্ছা যাও। আমাদের বিয়ের পর যখন তোমাকে বাসায় নিয়ে আসব। তখন গাড়ি থেকে নামিয়ে আর এক পা হাঁটাবো না তোমাকে। যত উপরেই হোক না কেন তোমাকে কোলে করে সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে যাব।"

-"প্রমিস?"

-"প্রমিস!"

-"যদি আমি মোটা হয়ে যাই তবু নিবে?"

-"হ্যা নিব। আমার তিতিরপাখিকে নিবনা কাকে নিব বলো?"

-"কেন তোমার বেবিদের নিবে না? কালকেই না বললে বেবিদের তুমিই কোলে কোলে রাখবে। আমাকে নিতে হবে না। দুইজনকে নাকি একসাথেই কোলে নিতে পারবে?"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"হ্যা.. ওদেরকেও নিব। কিন্তু ২ টার পরের গুলোকে তোমার নিতে হবে সেটা কিন্তু ভুলে যেওনা।"

-"আচ্ছা, কিন্তু ওদের যখন নিবে তখন কি আবার আমাকে কোলে নেয়া বন্ধ করে দিবে?"

-"না তো। আমার তিতিরপাখিকে তো আমি সারাজীবন কোলে নিব। কিন্তু বেবিরা যখন ছোট থাকবে হাটতে পারবে না যতদিন ততদিন তো কোলেই রাখতে হবে তাই না? তো তখন হয়তো তোমাকে একটু কম নিতে পারবো।"

-"তাহলে তখন আমিই ওদের কোলে নিব। আর তুমি আমাকে কোলে নিও?"

মুগ্ধ বলল,

-"আচ্ছা আচ্ছা। তাহলে তুমি খুশি থাকবে তো?"

-"হ্যা.. খুউউউব।"

-"আচ্ছা, এখন বলোতো আমার ঘুমকুমারীর ঘুমটা কেন এত তাড়াতাড়ি ভাঙালাম?"

-"কেন?"

-"অফিসে যাওয়ার আগে মুখটা না দেখে যাই কি করে বলোতো?"

-"কিন্তু আমি তো এখন বের হতে পারবো না। কি বলে বের হব?"

-"বের হতে হবে না। তুমি শুধু বারান্দায় আসো। আমি তোমার বাসার সামনেই আছি। পুরোপুরি সামনে না, একটু লেফট সাইডে।"

তিতির লাফ দিয়ে উঠে পড়লো। দৌড়ে গেল বারান্দায়। মুগ্ধ দাঁড়িয়ে আছে অপজিটের ফুটপাতে। ফুল ফরমাল, গ্রে কালারের শার্ট ব্ল্যাক প্যান্টের সাথে ইন করা, ব্ল্যাক টাই, সানগ্লাস, কানে ফোন। এই প্রথম ওকে ফরমাল দেখছে। উফফফ এত মারাত্নক লাগছে মুগ্ধকে। ওকে দেখেই সানগ্লাসটা খুলে হাসলো।

মুগ্ধও তিতিরকে দেখছিল মুগ্ধ চোখে। হোয়াইট স্লিভলেস টি-শার্ট পড়ে আছে। চুলগুলো মারাত্মকভাবে এলোমেলো। চোখে ঘুম। কানে ফোন। মুগ্ধকে দেখেই হাসলো।

মুগ্ধ বলল,

-"ম্যাম আপনি এলোচুলে আমার সামনে দয়া করে আসবেন না। আমার প্রব্লেম হয়।"

-"কি প্রব্লেম?"

-"ওহ.. ভুলেই গিয়েছিলাম তোমাকে তো আবার সব ডিরেক্টলি বলতে হয়। আচ্ছা পরে বলবো। আজ বেশি সময় নেই।"

-"আচ্ছা।"

-"থাক এখনি শোনো, এলোচুলে তোমাকে অনেক আবেদনময়ী লাগে।"

-"আবেদনময়ী মানে যেন কি? আমি বাংলায় একটু উইক আছি।"

-"হায়রে! তোমাকে সেক্সি লাগে। যতই চাইলাম সেক্সি ওয়ার্ডটা স্কিপ করতে তুমি বলিয়েই ছাড়লে।"

কি লজ্জাটাই যে তিতির পেয়েছিল! আর কোনো কথা বলতে পারেনি। তারপর দুপুর ১২ টায় ফোন করে বলল,

-"এই আপনি কি সকালে আমার বাসার সামনে এসেছিলেন? নাকি আমি স্বপ্নে দেখেছি? কল লিস্টে দেখলাম ২০ মিনিটের মত কথা বলেছি কিন্তু কিছুই মনে করতে পারছি না।"

-"স্বপ্ন না, গিয়েছিলাম।অফিসে আসার আগে বউয়ের মুখটা একবার দেখে না আসলে হয়? আজ তো ক্লাসও আছে, ফিরতে ফিরতে রাত!"

-"ও। আমি কি খুব উল্টোপাল্টা কিছু বলেছি? আসলে ঘুমের ঘোরে আমি অনেক হাবিজাবি বকি।"

মুগ্ধ হাসলো। তারপর বলল,

-"না উল্টোপাল্টা কিছু বলোনি। যা বলেছো ভালই বলেছ। মনে না থাকলে আমি রাতে ফিরে তোমাকে বলব।"

-"আচ্ছা। অফিসে থাকতে ফোন করা যাবেনা?"

-"হুম যাবে। বাট অনেকক্ষণ কথা বলা যাবে না। আমি তোমাকে লাঞ্চ টাইমে ফোন করবো। এখন রাখি?"

-"আচ্ছা।"

রাতে বাসায় ফিরে সব বলতেই তিতির খুব লজ্জা পাচ্ছিল আর অস্বীকার করেছিল যে ও এসব বলেনি। মুগ্ধ তাতেও মজা পেয়েছিল। তিতিরের সব খুঁটিনাটি বিষয়কে ঘিরেই ছিল মুগ্ধর আনন্দ।

To be continued...

প্রেমাতাল - পর্ব ২২

মৌরি মরিয়ম

ওদের সম্পর্ক তখন ৪ মাস চলছিল। তিতির পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে চান্স পায়নি। প্রাইভেটেই ভর্তি হয়েছে। ওদিকে মুগ্ধর মাস্টার্স কম্পলিট হয়ে গেছে। তখনই মুগ্ধ আগের চাকরিটা ছেড়ে এখনকার চাকরিটায় জয়েন করেছিল। আগের অফিস ধানমন্ডিতেই ছিল। এখনকারটা বনানী। ধানমন্ডি থেকে বনানী অফিস করাটা ডিফিকাল্ট লাগলেও মুগ্ধ বাসা চেঞ্জ করেনি কারন এখানে তিতির আছে। এখান থেকে চলে গেলে যখন তখন তিতিরের সাথে দেখা করাটা এতটাও ইজি হবে না।

তখনকারই একটা দিন মুগ্ধ কেবল অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়েছে। এমন সময় তিতিরের ফোন,

-"হ্যালো।"

-"হ্যা তিতিরপাখি বলো।"

-"বাসায় ফিরেছো?"

-"হ্যা, একটু আগেই। তুমি কোথায়?"

-"ভার্সিটিতে।"

-"এখনো? সন্ধ্যা হয়ে গেল তো। আবার বৃষ্টিও তো নামলো।"

-"হ্যা, একটা ফ্রেন্ডের বার্থডে ছিল। সবাই মিলে একটু সেলিব্রেট করছিলাম।"

-"ও।"

-"এই শোনোনা, তুমি কি অনেক টায়ার্ড?"

-"না তো। কেন তুমি জানোনা তোমার বাচ্চাদের বাবা একটুতেই টায়ার্ড হয়না?"

-"উফ আবার শুরু হয়ে গেছে!"

-"রেগে যাচ্ছো কেন? বাচ্চাদের বাবা অন্য কাউকে বানানোর ইচ্ছে আছে নাকি?"

তিতির হেসে বলল,

-"কামড় দিব কিন্তু।"

-"দাওনা প্লিজ। তোমার কামড়ে অন্তত তোমার ঠোঁটের ছোঁয়াটা পাওয়া যায়। চুমু তো আর দাওনা।"

-"এই রাখলাম। কি বলতে ফোন করেছি তা শোনার নাম নেই যত হাংকিপাংকি কথা বলে চলেছে।"

-"আচ্ছা সরি সরি। বলোনা কি বলবে।"

-"বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে।"

-"ভেজো। তবে বাসায় এসে। রাস্তা দিয়ে একা একা ভিজতে ভিজতে এসোনা।"

-"উঁহু। তোমার সাথে ভিজতে ইচ্ছে করছে।"

-"ও। তুমি তাহলে ভার্সিটিতেই থাকো। আমি আসছি।"

মুগ্ধ একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়লো। মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে এখন। ১০ মিনিটে রিক্সা তিতিরের ভার্সিটির সামনে গিয়ে থামতেই তিতির দৌড়ে এল। মুগ্ধ সরে বসলো। তিতির রিক্সায় উঠতেই মুগ্ধ রিক্সাওয়ালাকে বলল,

-"মামা চালাও। ১১ নাম্বার রোডে খালি যাইয়ো না। আর যেদিকে তোমার মন চায় যাও।"

রিক্সা চলতে শুরু করলো। সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত নেমে এসেছে। ভিজে দুজনে চুপচুপে হয়ে গেছে। মুগ্ধ তিতিরের কোমড় জড়িয়ে ধরলো। তিতির লাফিয়ে উঠলো। পড়েই যাচ্ছিল, মুগ্ধ ধরে ফেলল,

-"এত লাফালাফির কি আছে?"

-"সুড়সুড়ি লাগে। ধুরো ছাড়ো না।"

-"সিরিয়াসলি? ছাড়লে খুশি হবে? সত্যি তো?"

তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,

-"না, কিন্তু ওভাবেও জড়িয়ে ধরোনা প্লিজ। নরমালি ধরে রাখো।"

মুগ্ধ ওর কথামত আলগাভাবে ধরলো। তারপর তিতিরের কানের কাছে মুখ এনে বলল,

-"আই লাভ ইউ।"

-"হুম, জানি।"

-"আমি আজও উত্তরটা পেলাম না।"

-"সময় হলেই পাবে।"

মুগ্ধ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

-"আল্লাহ সেই দিনটা আমি জীবিত থাকতেই দেখিও।"

তিতির মুগ্ধর হাতটা নিয়ে একটা কামড় দিল। মুগ্ধ ফিসফিস করে বলল,

-"একদিন তো একটা চুমু দিলেও পারো। সবসময় কামড়ই দিতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই।"

তিতির সেকথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,

-"তোমাকে না আমি একদিন নিষেধ করেছি থ্রি-কোয়ার্টার পড়ে আমার সামনে আসবেনা।"

-"পড়ে দেখেছি। কিছুই হয়না তাই আবার পড়েছি। আর তুমিই বলো বৃষ্টিতে ভিজে একটা ফুল প্যান্ট নষ্ট করা কি ঠিক?"

-"তোমার সাথে কথা বলাটাই বৃথা।"

মুগ্ধ আর এই অহেতুক বিষয়ে কথা বাড়ালো না। বলল,

-"তোমাকে কি এখন কিছুতেই বিয়ে দেবে না?"

-"না। স্টাডি শেষ হওয়ার আগে তো অসম্ভব।"

-"মা আজও বিয়ে কর বিয়ে কর বলছিল। আমার এক কাজিন আমাকে অনেক পছন্দ করে। ও এমনভাবে মায়ের মাথা খেয়েছে যে মা ওকেই বিয়ে করতে বলছে।"

তিতির আতঙ্কিত স্বরে বলল,

-"মানে?"

মুগ্ধ দেখল তিতিরের চোখে পানি এসে পড়েছে। সেকেন্ডের মধ্যে মুখটা লাল হয়ে গেল। মুগ্ধ ওকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,

-"এই পাগলী! কাঁদছ কেন? বললেই কি আমি বিয়ে করছি নাকি? আমার উপর বিশ্বাস নেই?"

তিতির একটা কথাও বলল না। মুগ্ধ বলল,

-"আমি এমনিতেই ওকে পছন্দ করিনা। ইভেন হেট করি। তুমি না থাকলেও আমি আর যাই হোক ওকে বিয়ে করতাম না।"

-"ওর নাম কি?"

-"ইকরা।"

-"কেমন কাজিন তোমার?"

-"ফুপাতো বোন।"

-"ওর নাম্বার কি তোমার মোবাইলে 'প্যারা' লিখে সেভ করা?"

-"হ্যা। তুমি কি করে জানলে?"

-"সরি আমি তোমার পারমিশন ছাড়া তোমার মোবাইল ধরেছিলাম আর মেসেজ পড়েছিলাম।"

-"আরে ধুর পাগলী। কিসের সরি? যা আমার তা তোমারও। আমার কোনো জিনিস ধরার জন্য তোমার পারমিশন নিতে হবে না। তাছাড়া, আমার জীবনে সিক্রেট বলে কিছু নেই যা তোমার কাছে লুকাতে হবে।"

তিতির চুপ করে রইল। মুগ্ধ বলল,

-"যাই হোক, বাদ দাও ওর কথা। আসল কথা বলি। মা যখন ওকে বিয়ে করার কথা বলছিল তখন আমি মাকে তোমার কথা বলে দিয়েছি।"

তিতির অবাক হয়ে তাকালো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলো,

-"বলার পর মা বলল, 'তাহলে তো হলোই। চল বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে যাই।' আমি বললাম, 'মা তিতির খুব বাবু একটা মেয়ে। ওর ফ্যামিলি এখনই ওকে বিয়ে দেবে না।' তারপর মা কতক্ষণ আফসোস করলো এতদিন পর মেয়ে একটা পছন্দ করেছি তাও এত ছোট! আরো কত কি! তারপর বুচ্ছো পিউকে ফেসবুকে তোমার ছবি পাঠিয়ে বলেছি মাকে দেখাতে। তোমার ছবি দেখে মা পুরো পাল্টি খেল।"

তিতির মন খারাপ করে বলল,

-"পছন্দ করেনি না? তুমি যে কেন ছবি পাঠাতে গেলে? ছবিতে আমাকে আরো ছোট ছোট লাগে। কোন ছবিটা পাঠিয়েছো?"

যেই ছবিই পাঠাই না কেন মা ছবি দেখে বলেছে, 'মুগ্ধ তুই এতদিনে একটা কাজের কাজ করেছিস বাপ। ছোট হয়েছে তো কি হয়েছে? ওর বিয়ের বয়স হতে হতে হয়তো তোর ৩০/৩২ বছর হয়ে যাবে তাতে কি! পুরুষ মানুষের বয়সে কি আসে যায়?"

কথা শেষ হতেই মুগ্ধ হো হো করে হেসে দিল। তিতিরের আতঙ্ক কমেছে, ও তাকিয়ে আছে। মুগ্ধ বলল,

-"আমার মা বুচ্ছো পুরা একটা সিনেমার ক্যারেকটার। তার ব্যাবহারে তোমার মনে হবে যে সে তোমারই বয়সী। একদম বাচ্চাদের মত করে। মা আরো কি বলেছে জানো? বলেছে, 'আগে তোর পছন্দ করা একটা মেয়েকেও আমার ভাল লাগেনি। এই মেয়েটা একদম হিরার টুকরা। কোথায় পেলি?' হা হা হা মা পারেও।"

-"সত্যি আন্টি আমাকে পছন্দ করেছে?"

-"কি বললে?"

-"কি বলেছি?"

-"আমার মা তোমার আন্টি হয়? এক থাপ্পড় মারবো, মা বলো।"

তিতির মুগ্ধর আরো কাছে এসে ওর একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল,

-"এই বলোনা, মা আমাকে পছন্দ করেছে?"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"হুম, খুব।"

তিতির হাসলো। মুগ্ধ বলল,

-"এত পছন্দ করেছে যে তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে। সামনাসামনি দেখতে চায়।"

-"মা যেন কবে ঢাকায় আসবে?"

-"সামনের মাসেই তো পিউ এর পরীক্ষা। পরীক্ষা হয়ে গেলে পিউকে নিয়ে সবাই আসবে। আমাকে আর পিউকে নতুন বাসায় তুলে দিয়ে মা-বাবা স্নিগ্ধকে নিয়ে চলে যাবে। স্নিগ্ধর পরীক্ষা পর্যন্ত বাবা-মা ওখানেই থাকবে। পরীক্ষা শেষ হতেই মা স্নিগ্ধকে নিয়ে পার্মানেন্টলি চলে আসবে। বাবা ট্রান্সফার পেলে আসবে নাহলে ওখানেই থাকবে।"

-"ও। তখন তুমি ধানমন্ডি ছেড়ে চলে যাবে না?"

-"তো কি? যখন বলবে তখনই বান্দা হাজির হয়ে যাবে।"

তিতির হেসে বলল,

-"আমি জানি।"

-"তিতির জানো মা বলছিল তোমাকে চিটাগাং নিয়ে যেতে। যদি সম্ভব হতো সত্যি তোমাকে নিয়ে যেতাম। ইশ! নাভাল রোডের কাঁকড়া ফ্রাই! পতেঙ্গা রোডের বাইকরাইড সবকিছু যেন তোমার জন্য অপেক্ষা করছে!"

-"সম্ভব না কেন?"

-"মানে? সম্ভব না কেন তুমি জানো না?"

-"কেন?"

-"বাসায় কি বলে যাবে তুমি?"

-"বলবো ট্যুরে যাচ্ছি।"

-"সিরিয়াসলি?"

-"হ্যা! কিন্তু এভাবে বিয়ের আগেই তোমাদের বাসায় চলে গেলে কেউ আমাকে খারাপ ভাববে না তো?"

-"কে খারাপ ভাববে? আমার মা? বললাম না আমার মা কেমন? একটু বোকাসোকা। কিন্তু পাগল একটা। তোমাকে ভাল লাগলে তোমার জন্য জান দিয়ে দেবে।"

-"আর বাবা?"

-"বাবার সময় কোথায় কিছু ভাবার? আর আমি বাবার সাথেও ফ্রি। নো প্রব্লেম তিতিরপাখি। তাছাড়া তুমি তো আর আমার সাথে থাকবে না। পিউ এর সাথে থাকবে। কিন্তু তুমি কি সত্যি যেতে পারবে?"

-"পারবো।"

-"তাহলে পরশুই চলো। আমিতো এমনিতেই পরশু যাব বলেছিলাম না তোমাকে?"

-"ও হ্যা। আচ্ছা, আমি আজ রাতেই তোমাকে কনফার্ম করছি।"

-"ওকে। ওই মামা রিক্সা এইখানেই থামাও।"

তিতির বলল,

-"এটা তো ১০ নাম্বার।"

মুগ্ধ ভাড়া দিতে দিতে বলল,

-"এত পাক্নামি করো কেন? নামো রিক্সা থেকে।"

তিতির নামলো। মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরে ১০ নাম্বার রোডে ঢুকলো। তিতির পানিতে হাটবে বলে স্যান্ডেল খুলে ফেলল। তারপর স্যান্ডেলের ফিতাটা আঙুলের সাথে ঝুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

-"দেখেছো বৃষ্টি আরো বেড়েছে। আজ বাসায় ফিরতেই ইচ্ছে করছে না।"

-"রাস্তাঘাটে মানুষজন এত কম কেন জানো? বৃষ্টির জন্য! আর তুমি কিনা বৃষ্টির জন্য বাসায় যেতে চাচ্ছো না?"

তিতির মুগ্ধর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,

-"হুম আমার তো বৃষ্টি আর মুগ্ধকে একসাথে খুব ভাল লাগে।"

-"রিয়েলি? আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের নাম কিন্তু বৃষ্টি ছিল।"

তিতির অবাক চোখে তাকালো মুগ্ধর দিকে। বলল,

-"তোমাকে বলেছিনা তুমি তোমার এক্স হিস্ট্রি আমাকে শোনাতে আসবে না?"

-"আমি কোথায় বললাম? তুমিই তো বললে!"

তিতিরের এক হাতে স্যান্ডেল আরেক হাতে ব্যাগ থাকায় মারতে পারলো না। কিন্তু ঠিকই তেড়ে এসে কামড়ে দিল মুগ্ধর হাতে। মুগ্ধ তাড়াতাড়ি তিতিরকে কোলে নিয়ে হাঁটা ধরলো। কয়েক পা হেঁটেই মুগ্ধ বলল,

-"আমি তোমাকে কোলে নিব বলেই রিক্সা ছেড়ে দিয়েছি। বুঝেছ তিতিরপাখি?"

তিতির কিছু না বলে শুধু হাসলো। কিছুদূর যেতেই একটা পুলিশের গাড়ি দেখা গেল। ভেতর থেকে একটা পুলিশ ডাক দিল,

-"এইযে হিরো? এটা কি সিনেমা করার যায়গা? দিস ইজ পাবলিক প্লেস!"

তিতির আস্তে আস্তে বলল,

-"এই আমাকে নামিয়ে দাও।"

মুগ্ধ বলল,

-"চুপ করে খালি দেখে যাও। প্রয়োজনে আমার কথায় তাল মেলাবে।"

মুগ্ধ গাড়িটার কাছে গিয়ে বলল,

-"সরি স্যার। ও বৃষ্টিতে পা পিছলে পড়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছে, হাটতে পারছে না। তাই কোলে করে নিয়ে যাচ্ছি। সামনেই আমাদের বাসা।"

পুলিশ বলল,

-"ও, আচ্ছা যান তাহলে।"

-"থ্যাংকস।"

মুগ্ধ তিতিরকে কোলে নিয়েই আবার ব্যাক করলো। গাড়িটা স্পীডে চালিয়ে চলে যেতেই ওরা দুজনে হেসে দিল। তিতির বলল,

-"ইউ আর জিনিয়াস!"

-"তো কি? ওদের ভয়ে আমি তোমাকে কোল থেকে নামাবো নাকি? ধুর ওদের পাত্তা দেয় কে?"

-"বাহ রে! এখন পার্ট নেয়া হচ্ছে? খুব তো স্যার স্যার করছিলে!"

-"স্যার স্যার করিনি। স্যার বলে সম্বোধন করেছি। ওটা ভদ্রলোকেরা করে।"

১০ নাম্বার রোড শেষ হতেই মুগ্ধ তিতিরকে নামিয়ে বলল,

-"কিন্তু এবার নামাতেই হবে। বাকিটা আমাদের আলাদা যাওয়া উচিৎ।"

তিতির কোল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলল,

-"ধরা পড়লে খবর আছে। অনেক বেশি সাহস দেখাই আমরা। আসলে আমাদের ধানমন্ডির মধ্যেই দেখা করা উচিৎ না।"

-"হুম, বাসায় যাও এখন তাহলে। এত বেশি বৃষ্টিতে ভিজলে আবার ঠান্ডা লাগবে।"

তিতির মুগ্ধকে বিদায় জানিয়ে হাটতে শুরু করলো। মুগ্ধ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তিতির ৭/৮ পা গিয়েই দৌড়ে ফিরে আসলো। মুগ্ধ বলল,

-"কি?"

তিতির মুখে কিছু বলল না, আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো লোকজন নেই। স্যান্ডেল আর ব্যাগ হাত থেকে ফেলে দিল। তারপর আচমকা মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধ প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও পরে সামলে নিল। তারপর নিজেও জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ পর তিতির ওকে ছেড়ে নিচু হয়ে ব্যাগ আর স্যান্ডেল তুলে হাঁটা শুরু করলো। একবারও আর মুগ্ধর দিকে তাকালো না। মুগ্ধ পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছিল তিতির ব্যাগটা কাধের উপর ফেলে পেনসিল হিলের চিকন ফিতাগুলো আঙুলে ঝুলিয়ে হেলেদুলে হাঁটতে লাগলো। যেন ওর মত সুখী মানুষ এই পৃথিবীতে আর একজনও নেই।


প্রেমাতাল - পর্ব ২৩

মৌরি মরিয়ম

মুগ্ধ কলাবাগান বাস কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে। ১০:৩০ এ বাস ছাড়বে। সামনেই সাফি আর দোলা বসে আছে। ওরা এসেছে হেল্প করার জন্য। কারন তিতিরকে পৌঁছে দিতে আসবে ওর বাবা এবং ভাইয়া। তিতির বাসায় বলেছে এবারও টিওবি থেকেই যাচ্ছে খাগড়াছড়ি ট্রিপে। যেহেতু তিতিরের বাবা, ভাইয়া সাফি-দোলাদের চেনে তাই ওদেরকে নিয়ে এসেছে মুগ্ধ। ১০:২৫ বাজে, এখনো তিতির আসছে না দেখে মুগ্ধ দোলাকে দিয়ে ফোন করালো। তিতির জানালো ও প্রায় এসে গেছে।

মুগ্ধ আগে থেকেই বাসে উঠে থাকলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিতির এসে পড়লো ওর বাবার সাথে। বাবা তিতিরকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বাস না ছাড়া পর্যন্ত। অগত্যা দোলা সাফিকেও বাসে উঠতে হলো। বাস ছেড়ে দেয়ার পরও তিতিরের বাবা দাঁড়িয়ে ছিল। তিতির জানালা দিয়ে মুখ বের করে বলল,

-"বাবা, তুমি রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে যাও।"

-"হ্যা যাচ্ছি।"

তারপর হাত নেড়ে টা টা বলল তিতির। বাবা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সাটায় উঠলো। বাস ততক্ষণে অনেক দূরে চলে এসেছে। বাস যেদিকে যাচ্ছে রিক্সা যাচ্ছে তার উলটো দিকে তাই বাবাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না তবে রিক্সাটা দেখা যাচ্ছে। তবু তিতির তাকিয়েই আছে। মুগ্ধ বলল,

-"বাস তো ছেড়ে দিয়েছে, এবার মুখটা ভেতরে আনো। হুট করে আরেকটা বাস চলে আসতে পারে।"

তিতির শুনলো না। মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে আসলো। তিতিরের চোখভর্তি পানি। মুগ্ধ অবাক,

-"সেকি! কাঁদছ কেন?"

এতক্ষণ চোখে জমে থাকা পানিটা একফোঁটা পড়লো গাল বেয়ে। বলল,

-"আমি কখনো বাবাকে মিথ্যে বলে কোথাও যাইনি। খুব ভালবাসি বাবাকে। সব থেকে বেশি। আর আজ সেই আমি বাবাকে মিথ্যে বলে এতদূর যাচ্ছি। আমার খুব খারাপ লাগছে।"

মুগ্ধ কি বলবে বুঝতে পারলো না। নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে। তিতিরের চোখ মুছে দিয়ে হাত ধরে বলল,

-"চলো আমরা নেমে যাই। যাওয়া লাগবে না। আমি তোমাকে দিয়ে আসছি।"

-"না আমি যাব।"

-"আরে পাগলী! আমি রাগ করে বলছি না। সত্যি বলছি এরকম খারাপ লাগা নিয়ে গেলে কি তোমারও ভাল লাগবে বলো?"

-"আমি জানি তুমি রাগ করে বলোনি। কিন্তু আমি যাব।"

-"কেন জেদ করছো?"

তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,

-"কারন, আমার লাইফে বাবা যতটা ইম্পরট্যান্ট তুমিও ঠিক সমান ইম্পরট্যান্ট!"

মুগ্ধ কিছু বললনা শুধু মনে মনে ভাবলো, হুমায়ুন আহমেদ স্যার বলে গেছেন "কিশোরী মন বড়ই রহস্যময়।"

বাস শাহবাগ পৌঁছতেই দোলা আর সাফি বিদায় নিয়ে নেমে গেল। যাত্রাবাড়ী থেকে প্যাসেঞ্জার উঠানোর পর বাসের লাইট অফ করে দিল। আবছা আলোয় মুগ্ধ দেখলো তিতির সিটে হেলান দিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরে চুপ! মুগ্ধ ওকে ঘাঁটালো না। থাকুক কিছুক্ষণ নিজের মত। বাস যখন কাঁচপুর ব্রিজে উঠলো তিতির তখন বাসের জানালা দিয়ে মুখ বের করে রাখলো। মুগ্ধ আবার ওকে টেনে ভেতরে নিয়ে এসে বলল,

-"এটা করো না। রিস্কি খুব।"

তিতির হেসে বলল,

-"সবসময় তো করছি না। এখন একটু নদীর গন্ধ নিলাম। আবার যখন নদী পড়নে তখন একটু নেব। নিতে দেবে না?"

তিতিরের মুখে হাসি দেখে মুগ্ধ একটু স্বস্তি পেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুগ্ধর ফোন এল। পিউ ফোন করেছে,

-"হ্যালো, ভাইয়া?"

-"হুম বল।"

-"তোরা রওনা হয়েছিস?"

-"হ্যা, মাত্রই কাঁচপুর ব্রিজ পার হলাম।"

-"ওহ! তিতির আপু তোর পাশেই না?"

-"না পিছনে।"

-"পিছনে মানে? তোরা পাশাপাশি সিট পাসনি?"

-"যেমন প্রশ্ন ছিল তেমনই উত্তর ছিল।"

-"উফফ! বাদ দে। আপুকে দে না একটু কথা বলি?"

-"কাল সকালেই তো জলজ্যান্ত পেয়ে যাবি। এখন আবার কথা বলে কি করবি?"

-"দে না। শুধু আমি না, আম্মুও কথা বলবে।"

মুগ্ধ ফোনটা কানের কাছ থেকে সরিয়ে বলল,

-"একটু কথা বলবে? পিউ খুব চাইছে।"

তিতির বলল,

-"দাও, আবার জিজ্ঞেস করা লাগে?"

তিতির ফোনে ধরে বলল,

-"হ্যালো.."

পিউ ওপাশ থেকে বলল,

-"ওমা কি মিষ্টি ভয়েস গো তোমার! আমার ভাইটার আবার ডায়াবেটিস না হয়ে যায়।"

তিতির হাসলো। পিউ বলল,

-"হাসিটাও সুন্দর। উফ কখন যে তোমাকে দেখবো আমার আর তর সইছে না।"

তিতির বলল,

-"তোমাদের সবাইকে দেখার জন্যও আমার মনটা অস্থির হয়ে আছে। তোমার ভাইয়া তো সবসময় তোমাদের গল্প করে।"

-"তাই?"

-"হুম।"

-"এই শোনো আপু... মা তোমার সাথে কথা বলবে, নাও।"

তারপর হুট করেই পিউ ফোনটা মায়ের হাতে দিয়ে দিল। মা ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই তিতির সালাম দিল। তারপর জিজ্ঞেস করলো,

-"কেমন আছেন আন্টি?"

মা বলল,

-"এইতো আম্মু ভাল আছি। কিন্তু বড্ড অস্থির লাগছে। তোমরা সেফলি আসবে তারপর আমি শান্তি পাব।"

আহা কী অবলীলায় কথা বলছে! যেন হাজার বছরের চেনা। খুব ভাল লাগছিল তিতিরের। কথা শেষ হতেই মুগ্ধ বলল,

-"আমার মা তোমাকে দেখার আগেই মানে শুধু ছবি দেখেই পটে গেছে। শুধু তোমার সাথে কথা বলেই ফোন রেখে দিল। আমার সাথে কথাই বলতে চাইলো না।"

তিতির হেসে বলল,

-"জেলাস?"

-"নাহ! মা যত তোমাকে পছন্দ করবে আমার তো ততই ভাল লাগবে তাই না?"

তিতির আচমকা মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধও ধরলো। পুরো বাস অন্ধকার। তিতির মুগ্ধর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,

-"আমি খুউউউব হ্যাপি।"

মুগ্ধও তিতিরের মত ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,

-"কেন?"

-"তোমাকে পেয়ে।"

মুগ্ধ তিতিরের কপালে চুমু দিয়ে বলল,

-"আমিও খুব হ্যাপি! লাকি অলসো.. তোমাকে পেয়ে।"

তারপর তিতির আর কোনো কথা বলল না। কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ আবিস্কার করলো তিতির ঘুমিয়ে পড়েছে। নিজের মনেই হাসলো মুগ্ধ। প্রায় এক ঘন্টা পর একটা স্পিড ব্রেকার পার হওয়ার সময় বাসটা নড়ে উঠতেই তিতিরের ঘুমটা ভাঙলো। ঘুম ভাঙতেই হেসে দিল তিতির। তারপর মুগ্ধকে ছেড়ে দুই পা উঠিয়ে গুটিসুটি হয়ে নিজের সিটে মাথা রেখে মুগ্ধর দিকে ফিরে বসলো। তারপর মুগ্ধর হাত ধরে বলল,

-"একটা কথা বলবে?"

ইশ! তিতিরের ঘুমু ঘুমু ভেজা ভেজা ভয়েসটা কাছ থেকে কি যে সুন্দর লাগছে। ভয়েস যদি খাওয়া যেত মুগ্ধ এক্ষুনি খেয়ে ফেলতো। তিতির আবার হাতে নাড়া দিয়ে বলল,

-"বলোনা, বলবে?"

মুগ্ধ বলল,

-"হুম, বলো কি?"

-"ইকরা কিসে পড়ে?"

-"ভার্সিটিতে।"

-"আমার সমান?"

-"না তোমার চেয়ে অনেক বড়। ও আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ে। এখন বোধহয় সেকেন্ড ইয়ার।"

-"ও। আচ্ছা ও কক্সবাজারে কি করেছিল? যার জন্য তোমার কাছে মাফ চাইছিল?"

-"অনেক খারাপ একটা কাজ করেছিল।"

-"সেটা তো তোমাদের মেসেজ দেখে আমি বুঝেছি। কিন্তু কি করেছে বলোনা? তুমি তো বলেছ বলবে।"

-"আমি তো বলতেই পারি কিন্তু তুমি তো সহ্য করতে পারবে না। আর লজ্জাও পাবে।"

-"সহ্য করতে না পারার কি হলো? পারব, বলোতো।"

-"আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুমের মধ্যেই ও আমাকে কিস করেছে।"

-"কোথায়?"

-"ঠোঁটে।"

-"মানে?"

-"বোঝোনি?"

-"তুমি করতে দিলে কেন?"

-"আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম রে বাবা। যখন টের পেয়েছি তখন তো উঠে চড় মেরেছি একটা।"

-"কিন্তু ততক্ষণে তো ও যা করার করেই ফেলেছে।"

-"নাহ, এর পরেও করেছে।"

-"কি করেছে?"

তিতিরের চোখেমুখে আতঙ্ক। মুগ্ধ বলল,

-"ও শার্ট পড়া ছিল। হঠাৎ শার্টের বাটনগুলো সব খুলে ফেলেছিল।"

-"কিহ?"

আবছা আলোয় মুগ্ধর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তিতিরের মুখটা লাল হয়ে গেছে। চোখে পানিও এসে গেছে, পড়ার অপেক্ষা শুধু। মুগ্ধ বলল,

-"কাঁদলে কিন্তু একটা থাপ্পড় মারবো। আমি কি তাকিয়েছিলাম নাকি ওর দিকে? আমি তো ওকে চড় মেরে ঘর থেকে বের করেই দিয়েছিলাম।"

-"কক্সবাজারে এটা কি করে সম্ভব? আর কেউ ছিলনা?"

-"সবাই মহেশখালী গিয়েছিল। আমার পা কেটে যাওয়ার আমি যাইনি। আর ও যে যায়নি কিকরে বলবো বলো? আমি তো ঘুমিয়েই ছিলাম।"

তিতির আর কিছু বলল না। মন খারাপ করে বসে রইলো। মুগ্ধ বলল,

-"তোমার কি মনে হয় তোমার মুগ্ধ বিলিয়ে দেয়া অর্ডিনারি জিনিস হাত পেতে নেয়?"

-"না।"

-"তাহলে মন খারাপ করছো কেন?"

-"জানিনা।"

মুগ্ধ তিতিরের কোমড় জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে আনলো। তারপর বলল,

-"তোমার মুগ্ধর তো শুধু তার তিতিরপাখির উপর লোভ! অনেক লোভ জানো?"

তিতির মিটিমিটি হাসলো। কোনো উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ পর বলল,

-"তোমাকে আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। অনেক দিন আগে থেকেই ভেবেছি কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়নি।"

-"কি বলো?"

-"বান্ধরবানে একটা কথা বলেছিলে মনে আছে?"

-"বান্দরবানে তো কত কথাই বলেছি। কোনটার কথা বলছ এখন?"

-"ওইযে.. ইউ নেভার কিসড ইউর এক্স বিকজ অফ হার লিপস্টিক।"

মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। বলল,

-"হ্যা বলেছি তো। আর এটা ট্রু!"

-"তারমানে কি যেহেতু তোমার টোটাল ৩ জনের সাথে সম্পর্ক ছিল। তাই ওকে ছাড়া তুমি বাকি দুইজনের সাথে কিস করেছো?"

মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল,

-"হ্যা করেছি। এটা তো একটা নরমাল ব্যাপার। তোমাকেও তো কতবার করতে চেয়েছি তুমি তো পারমিশন দাওনি।"

-"ওরা কি চাইতেই পারমিশন দিয়ে দিল?"

-"হ্যা। পারমিশন লাগেনি ওরাও উদ্যোগী ছিল।"

-"আমার অবাক লাগে তুমি কি টাইপের মেয়েদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলে!"

-"সবাই তো আর তোমার মত লাজুকলতা না।"

-"তোমার ওরকমই পছন্দ না? আমার টাইপ মেয়ে তেমন পছন্দ না?"

এবার মুগ্ধ একটু সিরিয়াস হয়ে বলল,

-"তিতির, তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা যে প্ল্যান করে হয়নি তা তো তুমি জানোই। সম্পর্কটা না করে বাঁচতাম না, তাই করেছি। ৫ দিনে বুঝে গিয়েছিলাম তোমাকে ছাড়া ভাল থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। তোমার সাথে ওদের তুলনা করা চলে না। আর তুমি যেমন তেমনভাবেই আমি তোমাকে ভালবেসেছি, তেমবভাবেই ভালবাসতে চাই বাকীটা জীবন। আমার কি ধরনের মেয়ে পছন্দ অপছন্দ তা তুমি ভাবতেও যেও না। শুধু জেনে রেখো তোমাকে আমার পছন্দ!"

আহ! তিতিরের আবার উড়তে মন চাইছে। কিছু বলল না, মনে মনে উড়তে লাগলো। মুগ্ধ বলল,

-"এই অনেক সিরিয়াস সিরিয়াস কথা হয়েছে। এবার একটু তাকাও না আমার দিকে।"

তিতির তাকালো। মুগ্ধ তিতিরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তিতির মুগ্ধর গালে হাত রেখে বলল,

-"তোমার দাড়িটা এখন একদম পারফেক্ট সাইজ। বেশি বড়ও না, আবার বেশি ছোটও না। কেন যে ক্লিনসেভ করো!"

-"অফিসের জন্য।"

-"ধুর! অফিসকে বলবা এটা ফরমাল হওয়ার নতুন স্টাইল।"

-"তাই অনেক সুন্দর লাগছে?"

-"অন্নেক!"

-"তাহলে একটা চুমু দাও।"

তিতিরের জন্য ভালই হলো। এতক্ষণ দাড়ির দিকে তাকিয়ে তিতিরের একটা চুমু দিতেই ইচ্ছে করছিল। কিন্তু লজ্জায় বলতে পারেনি। মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে কিন্তু ওইযে লজ্জা! লজ্জায় পারেনা।

মুগ্ধ গাল বাড়িয়ে আছে। যদিও অন্ধকার আর এত রাতে সবাই ঘুমাচ্ছে তবু তিতির আশেপাশে তাকিয়ে একবার দেখে নিল। তারপর মুগ্ধর বাড়িয়ে রাখা গালটাতে একটা চুমু দিল। তিতির যখন সরে যাচ্ছিল তখন মুগ্ধ তিতিরের মুখটা ধরে ইচ্ছেমত ওর গালে গাল ঘষে দিল। তিতির ব্যাথায় উঁহ করে উঠলো। মুগ্ধ তাড়াতাড়ি ওর মুখ চেপে ধরে বলল,

-"আস্তে। কি সব সাউন্ড করছো! কেউ শুনলে কি ভাববে জানো? বোকা মেয়ে কোথাকার!"

তিতির মুগ্ধর দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে ঠোঁট উলটে বলল,

-"দাড়ি না যেন তাঁরকাটা।"

একথা শুনে মুগ্ধ হেসে গড়িয়ে পড়লো। তারপর বলল,

-"তোমার না দাড়ি ভাল লাগে?"

তিতির মুগ্ধর আরো কাছে এসে বলল,

-"ভাল লাগে তো। এখনো লাগে। দাড়ি দিয়ে আরো যত খোঁচাই দাও না কেন তবু ভাল লাগবে। আই জাস্ট লাভ ইট।"

-"তাই? তাহলে আরেকবার দিই?"

-"দাও।"

মুগ্ধ এবার তিতিরের গালে নয় ঘাড়ে দাড়ি ঘষে দিল। তিতির ছিটকে সরে গেল। ওপাশে মুগ্ধর একটা হাত না থাকলে তিতির জানালার উপর পড়ে ব্যাথা পেত। তিতির ঘাড়ের সেখানে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো। ওর হার্টবিট ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলছে। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,

-"ব্যাথা পেয়েছ?"

তিতির আবার সেই ভেজা স্বরে বলল,

-"না।"

কিন্তু মুখ তুলে তাকালো না তিতির। একইভাবে বসে রইলো। মুগ্ধ ওকে বুকে টেনে নিল। তারপর তিতিরের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,

-"পাগলী! শান্ত হও। এখনি এত অস্থির হলে ভবিষ্যতে কি করবে?"

তিতির কিছু বলল না। মুগ্ধ বলল,

-"আচ্ছা, তোমার কি খুব ভাল লেগেছিল?"

তিতির চুপ। মুগ্ধ বলল,

-"জাস্ট সে ইয়েস অর নো।"

তিতির এবারেও চুপ করে রইলো। মুগ্ধ বলল,

-"আচ্ছা যাও সহজ করে দিচ্ছি। ভাল না লাগলে তুমি আমার বুক থেকে উঠে তোমার সিটে গিয়ে বসো। আর যদি ভাল লাগে তাহলে এভাবেই থাকো আমার বুকে।"

তিতির আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো ন। দুই হাত দিয়ে আরো শক্ত করে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধ হেসে বলল,

-"জানতাম তো!"

To be continued...

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url