আমি পদ্মজা - পর্ব ১৭-১৮-১৯-২০ | Golpo Porun

আমি পদ্মজা

(ইলমা বেহরোজ)

poddoja
This photo is from Pexels

নৌকা ছাড়ার পূর্বে আকাশের কালো মেঘের ঘনঘটা চোখে পড়ল। তার কিছুক্ষণ পর হঠাৎই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে এলো। খোলা নৌকা হওয়াতে চোখের পলকে যাত্রী পাঁচজন কাকভেজা হয়ে গেল। ভিজলেন না হেমলতা। মোর্শেদ ছাতা ধরে রেখেছেন। বজ্রপাতের সাথে সাথে হেমলতার আত্মা দুলে উঠছে। মনটা খচখচ করছে। তিনি জলের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। জলে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার সঙ্গেই বলের মতো একদলা পানি লাফিয়ে উঠছে। তারপর ছোট্ট ছাতার মতো আকৃতি নিয়ে চারপাশে প্রসারিত হয়ে হাওরে মিলিয়ে যাচ্ছে। দেখতে সুন্দর! কিন্তু সেই সৌন্দর্য মনে ধরছে না। অজানা আশঙ্কায় তিক্ত অনুভূতি হচ্ছে। মোর্শেদ গলা খাকারি দিয়ে হেমলতার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। এরপর বলেন,'কিছু খাইবা?'

হেমলতা নিরুত্তর। মোর্শেদ শুষ্ক হাসি হেসে বলল,

'আর কিছুক্ষণ। আইয়াই পড়ছি।'

হেমলতা কিচ্ছুটি বললেন না। নিরুত্তরেই বসে রইলেন। বৃষ্টির স্পর্শ নিয়ে আসা হাওরের হিমেল বাতাসের ছোঁয়া লাগছে চোখেমুখে। হাওরের ঘোর লাগা বৃষ্টি দেখতে দেখতে তন্দ্রা এসে ভর করে। হেমলতা নিকাব খুলে চোখেমুখে পানি দিয়ে তন্দ্রা কাটান। এরপর ক্লান্ত চোখ দু'টি মেলে তাকান মোর্শেদের দিকে। মোর্শেদের হাতে হাত রেখে বলেন,'আমার এতো খারাপ লাগছে কেন? বুক পোড়া কষ্ট হচ্ছে।'

মোর্শেদ হেমলতার কণ্ঠ শুনে সহসা উত্তর দিতে পারলেন না। চিত্ত ব্যাথায় ভরে উঠল। কিছুসময় অতিবাহিত হওয়ার পর আশ্বস্ত করে বললেন,'আইয়া পড়ছি তো। ওইযে বাজারের ঘাট দেহা যাইতাছে।'

হেমলতা মোর্শেদের হাত ছেড়ে দূরে তাকান। অলন্দপুরের বাজারটা ছোট পিঁপড়ার মতো দেখাচ্ছে। নৌকাটা বার বার দুলছে। চারিদিকে ঝড় বইছে। মনেও তো বইছে। তিনি নিজেকে শান্ত করতে চোখ বুজে বার কয়েক প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেন। ব্যাথাতুর মন আর্তনাদ করে শুধু জানতে চাইল,আমার মেয়েগুলো কেমন আছে?

আমি পদ্মজা - সকল পর্ব

রীনা চুল এতো শক্ত করে ধরেছে যে পদ্মজার সারা শরীর ব্যথায় বিষিয়ে উঠছে। পদ্মজা আকুতি করেও ছাড়া পাচ্ছে না। পূর্ণা,প্রেমা খামচে ধরে রেখেছে পদ্মজাকে। কিছুতেই তারা বোনকে ছাড়বে না। 

আমির ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হয়ে চিৎকার করে উঠল, 'কামরুল চাচা এটা ঠিক হচ্ছে না! মেয়েগুলোর অভিশাপে পুড়ে যাবেন।'

আমিরের উৎকট উত্তেজনায় ক্ষণকালের জন্য কামরুল হতবুদ্ধি হয়ে গেল। রমিজ আলী কামরুলের নরম, নিঃশ্বব্দ, ভয়ার্ত মুখের দিকে চেয়ে ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল,'বেশ্যাদের শাপে কেউ পুড়ে না।'

জলিল প্রেমাকে সরিয়ে নিয়েছে। প্রেমার কান্না শোনা যাচ্ছে। বড় আপা,বড় আপা করে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। ছইদ অনেক টেনেও পূর্ণাকে সরাতে পারল না, তাই অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে পূর্ণার বুকে নোংরা হাতের দাগ বসিয়ে দিল। পূর্ণা এমন ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কোনো মেয়েই এমন নীচু ঘটনার সাক্ষী হতে চায় না। অকস্মাৎ এই ঘটনা কাটিয়ে উঠার পূর্বেই একটা শক্ত হাত পায়জামার ফিতা টেনে ধরল। পূর্ণার পায়ের তলার মাটি সরে গেল। ভয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল,'আপা...আপা।'

পূর্ণার আর্তনাদ পদ্মজার মস্তিষ্ক প্রখর করে তুলল। পদ্মজা মুখ তুলে পূর্ণার দিকে তাকাল। তার চেয়ে কয়েক ইঞ্চি দূরে পূর্ণা। পদ্মজার এক হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে সে। কাছে আসতে পারছে না ছইদের জন্য। পূর্ণার কান্না দেখে পদ্মজা আতঙ্কে নীল হয়ে গেল। চারিদিকে কোলাহল। গালি দিচ্ছে মা বাপ তুলে। কেউ বলছে না, মেয়েটা ভালো। এরকম করতেই পারে না। পূর্ণা চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কেঁদে মাকে ডাকছে। পদ্মজা এক দৃষ্টে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষ এরকম কেন হয়? 

''আমি পদ্মজা'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন

পূর্ণার হাত ছইদ আলগা করতেই সে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল পদ্মজাকে। তার পুরো শরীর কাঁপছে। হৃৎপিণ্ড এতো জোরে চলছে যে অনুভব করা যাচ্ছে। পূর্ণা কাঁদতে কাঁদতে বলল,'আপা...আপা...কেন মেয়ে হলাম  আপা? এত কষ্ট হচ্ছে আপা। আপা..."

পদ্মজার দু'চোখ বেয়ে টুপ করে দু'ফোটা জল পড়ে। এক হাতে শক্ত করে পূর্ণাকে বুকের সাথে চেপে ধরল। রমিজের উস্কানিতে কামরুল গলা উঁচিয়ে বলল,'নটিরে বাঁন ছইদ।'

পূর্ণার কানে কথাটা আসতেই সে আরো জোরে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরল। পদ্মজা ঠান্ডা স্বরে বলল,'পূর্ণা ছেড়ে দে আমায়।'

রীনা পদ্মজাকে চুলে ধরে টেনে নিয়ে যেতে চাইলেও পদ্মজা জায়গা থেকে এক চুলও নড়ল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। পূর্ণাকে ফিসফিসিয়ে বলল,'বেঁচে থাকলে সব উসুল হবে। ছেড়ে দে।'

পদ্মজার কণ্ঠে কী যেন ছিল। পূর্ণা সাথে সাথে শান্ত হয়ে গেল। চোখ তুলে পদ্মজার দিকে তাকাল। পদ্মজার গাল বেয়ে রক্ত ঝরছে।ছইদ পূর্ণাকে নিতে আসলে পদ্মজা একটি দুঃসাহসিক কাজ করে বসল। ছইদের অণ্ডকোষ বরাবর লাথি বসিয়ে দিল। ছইদ মাগো বলে কুঁকিয়ে উঠল। জলিলসহ উপস্থিত  তিন জন তেড়ে আসল পদ্মজার দিকে। পূর্ণাকে ধাক্কা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল দূরে। অশ্রাব্য গালি দিতে দিতে কেউ পদ্মজাকে থাপ্পড় দিল, কেউ বা দিল লাথি। দু'তিনজন গ্রামবাসীর মনে মায়া উদয় হলো। ছুটে আসল পদ্মজাকে বাঁচাতে। প্রান্ত ভয়ে চুপসে গিয়েছিল। পদ্মজাকে  কাঁদায় ফেলে মারতে দেখে দৌড়ে আসে, জলিলের হাতে শরীরের সব শক্তি দিয়ে কামড় দিল। জলিল প্রান্তের কান বরাবর থাপ্পড় বসাতেই প্রান্তের মাথা ভনভন করে উঠল। পরিস্থিতি বিগড়ে যেতে দেখে কামরুল হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। মনে মনে বেশ ভয় পান। কেশে গলা পরিষ্কার করে, দুই হাত তুলে চেঁচিয়ে বললেন,'তোমরা থামো,এইডা কি করতাছো? থামো, কইতাছি। সবাই সইরা আসো। থামো...!"

সবকিছু থেমে গেল। পদ্মজা কাচুমাচু হয়ে পড়ে রইল কাঁদায়। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নাভির নিচে একটা লাথি পড়েছে বেশ জোরে। চোখ বুজে রেখেছে। দু'হাত বুকের উপর। লম্বা চুল কাঁদায় মেখে ছড়িয়ে আছে আশেপাশে।  যন্ত্রনায় যেন পাঁজরগুলো মড়মড় করে ভেঙ্গে যাচ্ছে। পূর্ণা জ্বরের তোপে জ্ঞান হারিয়েছে। হেমলতার মা মনজুরা বাড়িতে ঢুকে পদ্মজাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে আঁতকে উঠলেন। দৌড়ে এসে পদ্মজাকে তুলতে চাইলে কামরুল হুংকার ছাড়েন,'এই ছেড়িরে ধরন যাইব না। যান এন থাইকা।'

মনজুরা পদ্মজার কামিজ ঠিক করে দিলেন। এরপর দুজন লোককে নিয়ে পূর্ণাকে তুলে ঘরে নিয়ে গেলেন। মনজুরার বুক কাঁপছে হেমলতার ভয়ে। হেমলতা বার বার বলেছিল, দুই দিন তার মেয়েদের চোখের আড়াল না করতে! আর তিনি একা বাড়িতেই ছেড়ে দিয়েছেন! ইচ্ছে হচ্ছে এক ছুটে কোথাও পালিয়ে যেতে। হিমেল নাক টেনে টেনে কাঁদছে। জপ করছে হেমলতার নাম। মনজুরা রেগে ধমক দেন,'আহ! থাম তো।'

বাপের বাড়িতে কাউকে না পেয়ে হেমলতা চিন্তায় পড়েন। মোর্শেদ  বললেন,'আমরার বাড়িত গিয়া বইয়া রইছে মনে হয়। আও বাড়িত যাই।' 

হেমলতা মিনমিনে গলায় বলেন, 'তাই হবে।'

দুজন হেঁটে বাড়ির রাস্তায় উঠে। তখন পাশ কেটে একজন মহিলা হেঁটে যায়। কিছুটা হাঁটার পর মোর্শেদের খটকা লাগল। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান। মহিলাটি অনেক দূর অবধি চলে গিয়েছে। মহিলার অবয়ব দেখে মোর্শেদের বাসন্তীর কথা মনে হলো। মনে মনে আওড়ান,'বাসন্তী আইছে?'

পরপরই নিজের মনকে বুঝ দেন,'না,না হে আইব কেমনে। আর আইলেও যাইব গা ক্যান?'

তিনি আর মাথা ঘামালেন না। হেমলতার বুক দুরুদুরু করছে। ঠান্ডা বাতাস বইছে। তবুও তিনি ঘামছেন অজানা আশঙ্কায়। বাড়ির কাছাকাছি এসে তিনি দেখতে পেলেন,মাতব্বরকে। মাতব্বরের সাথে আরো দুজন ব্যক্তি। এছাড়া বাড়ির সামনে মানুষের ভীরও দেখা যাচ্ছে। হেমলতার হৃৎপিণ্ড যেন থমকে গেল। মেরুদণ্ড বেয়ে বরফের ন্যায় ঠান্ডা কিছু একটা ছুটে গেল। তিনি নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে ছুটতে থাকেন। পিছলা খেয়ে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেন। হেমলতার দৌড় দেখে মোর্শেদ অবাক হোন। প্রশ্ন করেন,'তুমি দৌড়তাছো ক্যান?'

হেমলতা প্রশ্নটি শুনলেন না। নিকাব বাতাসের দমকে উড়ে পড়ল দূরে। তিনি ভীর ঠেলে বাড়িতে ঢুকেন। কোলাহল বেড়ে গেল। এতো ভীরের মাঝে একটা মেয়েকে পড়ে থাকতে দেখে তিনি অবাক হোন। অন্ধকারে মেয়েটিকে চিনতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। তিনি আঙ্গুল তুলে বিড়বিড় করেন,'মেয়েটা কে?'

হেমলতার প্রশ্ন কারো কান অবধি গেল না। কোথা থেকে একটি আলো এসে পড়ে পদ্মজার উপর। সাথে সাথে হেমলতার চক্ষুদ্বয়ের সামনে পদ্মজার কাঁদারক্তে মাখা মুখ ভেসে উঠল। হেমলতা গগণ কাঁপিয়ে আর্ত চিৎকার করে উঠলেন,'পদ্মজারে...."

পদ্মজার বুক ধড়াস করে উঠল! অস্তিত্ব কেঁপে উঠল। আম্মা এসেছে! তার পৃথিবী! তার শক্তি! পদ্মজা দূর্বল দুই হাতে ভর রেখে উঠে বসার চেষ্টা করল। পারল না। ভাঙ্গা গলার জোর দিয়ে শুধু ডাকল,'আম্মা...আম্মা।"

হেমলতার পৃথিবী থমকে গিয়েছে। বিধ্বস্ত, পর্দাহীন,কাঁদা,রক্তমাখা পদ্মজাকে দেখে বিশ্বাস হচ্ছে না, এটা তার মেয়ে। তিনি দ্রুত নিজের বোরখা খুলে পদ্মজাকে ঢেকে, বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেন। অসহনীয় যন্ত্রনায় যেন কলিজা বেরিয়ে আসছে তার। তার সোনার কন্যার এ কী রূপ! কে করলো?  কাঁপা কণ্ঠে বললেন,'পদ্ম...আমার পদ্ম।"

হেমলতার বুকে মাথা রেখে পদ্মজা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বলল,'আম্মা...আম্মা।'

হেমলতা পদ্মজাকে আরো জোরে চেপে ধরেন বুকের সাথে। দৃষ্টি অস্থির। বুক হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে। 

মোর্শেদ বাড়িতে ঢুকে উঁচু গলায় বলেন,'এইহানে এতো মানুষ ক্যান? মাতব্বর মিয়া আপনে এইনে ক্যান? কী অইছে?'

প্রান্ত,প্রেমা দৌড়ে এসে মোর্শেদকে জড়িয়ে ধরল। দুজন ভয়ে কাঁদছে,কিন্তু কান্নার শব্দ হচ্ছে না। মোর্শেদ বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মাতব্বর মজিদ গম্ভীর কণ্ঠে কামরুলকে প্রশ্ন করেন,' মেয়েটার এই অবস্থা কারা করেছে? এটা কী নিয়মের মধ্যে পড়ে?'

কামরুল মাথা নিচু করে রেখেছেন। মিনমিনে গলায় বলেন,'আমি ছেড়িডারে মারতে কই নাই। জলিল,ছইদ, আর মজনুর ছেড়ায় নিজ ইচ্ছায় মারছে।'

'আপনি আটকালেন না?'

'আটকাইছি বইললাই মাইয়াডা বাঁইচা আছে। আর এমন নটিদের বাঁচার অধিকার নাই।'

'থামেন মিয়া! কার কী শাস্তি হবে সেটা আমার দায়িত্ব। আপনার না। ছইদ,জলিল আর মজনুর ছেলেকে তো দেখা যাচ্ছে না। আগামীকাল তাদের আমি মাঠে দেখতে চাই।'

কামরুল মাথা নিচু করে রাখলেন। মজিদ হাওলাদার ভারি সৎ এবং নিষ্ঠাবান মানুষ। গ্রামের মানুষদের দুই হাতে আগলে রেখেছেন। পুরো অলন্দপুরের মানুষ মজিদকে ফেরেশতা সমতূল্য ভাবে। পঁচিশ বছর ধরে অলন্দপুর সামলাচ্ছেন তিনি। 

গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। হেমলতা কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারছেন না। অনেক বছর আগের ঘটনা আর এই ঘটনা হুবুহু একরকম কী করে হলো? তিনি নিজের ভেতর একটা হিংস্র পশুর উপস্থিতি অনুভব করছেন। কামরুলের মুখ থেকে শোনা তিনটা নাম মস্তিষ্কে নাড়া দিচ্ছে প্রচন্ডভাবে! ছইদ,জলিল আর মজনুর ছেলে!

মজিদ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,'আগামীকাল সবাই স্কুল মাঠে চলে আসবেন। মিয়া মোর্শেদ মেয়ে নিয়ে আলো ফুটতেই চলে আসবেন। এই বাড়ি পাহারায় থাকবে মদন আর আলী। আমার ছেলেকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। ঠিক সময়ে সেও উপস্থিত থাকবে।'

চলবে....

আমি পদ্মজা - ১৮

ভীর কমতেই কানে তালা লাগা প্রচন্ড শব্দে বজ্রপাত হয়। হেমলতা একা পদ্মজাকে তুলতে গিয়ে হিমশিম খান। মোর্শেদ এগিয়ে আসেন। দুই হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নেন পদ্মজাকে। বিজলি চমকাল। বিজলির আলোয় পদ্মজার মুখটা দেখে মোর্শেদের বুক কেমন করে উঠল! কষ্টে বুক চুরমার হয়ে গেল। জন্মের দিন পদ্মজাকে কোলে নেয়ার পর যে অনুভূতিটুকু হয়েছিল ঠিক সেরকম একটা অনুভূতি হয়। অনুভূতিটুকুর নাম বোধহয়  পিতৃত্ব! প্রচণ্ড ঝোড়ো বাতাস বইছে। তারা ঘরে ঢুকতেই ভারী বর্ষণ শুরু হলো। মুহূর্তে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব দেখা দিল! তবে সেই তাণ্ডব ছুঁতে পারল না মোড়ল বাড়ির মানুষদের মন। ঝড়ের তান্ডবের চেয়েও বড় তান্ডবের সাথে যুদ্ধ করে চলেছে তারা। হেমলতা গরম পানি করে পদ্মজাকে গোসল করালেন। জামাকাপড় পাল্টে দিলেন।  পদ্মজা ঠোঁট কামড়ে নীরবে কেঁদে গেল। চোখের জল আটকে রাখতে পারছে না কিছুতেই। ইচ্ছে হচ্ছে বাড়ির পিছনের সবচেয়ে বড় আম গাছটার সাথে ফাঁস লেগে মরে যেতে। মন দূর্বলতার শূন্য ছুঁই ছুঁই। হেমলতা পদ্মজার চুল মুছে কপালে চুমু দিলেন। পদ্মজার নাকে এক ফোঁটা জল পড়ল। পদ্মজা চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকাল। 

'আম্মা আসছে? আমার আম্মা কই? আম্মা আসে নাই?'

পাশের ঘর থেকে পূর্ণার চিৎকার ভেসে আসল। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে পূর্ণা ছুটে এলো। হেমলতাকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ল হেমলতার বুকে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। পূর্ণার শরীর আগ্নেয়গিরি মনে হচ্ছে। এতো গরম! জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। পূর্ণার কান্না দেখে পদ্মজাও ডুকরে কেঁদে উঠল। হেমলতা স্তব্ধ হয়ে দুই মেয়ের কান্না শুনলেন। সামলানোর চেষ্টা করলেন না। মনজুরা দরজার সামনে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। টিনের চালে ভারী বর্ষণের শব্দ। জগৎসংসার সেই শব্দে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

মাঝরাত। বাতাসের বেগ প্রচন্ড। হেমলতা কালো রংয়ের শাড়ি পরে, একটা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ির বাইরে পা বাড়ান। মনজুরা বারান্দার ঘর থেকে উঁচু কণ্ঠে বলেন,'রাম দা ব্যাগে ক্যান ঢুকাইছস? আর কোন কেলাঙ্কারি বাকি?'

হেমলতা বিদ্যুদ্বেগে ফিরে দাঁড়ালেন। পলকমাত্র মনজুরার মুখের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে,নিঃশব্দে ধীরে ধীরে বর্ষণ মাথায় নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে মনজুরা শুষ্ক হয়ে উঠলেন।  ছুটে পদ্মজার ঘরে গেলেন। পদ্মজা চুপচাপ শুয়ে আছে। মৃদু ফোঁপানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। পূর্ণা ঘুমাচ্ছে। তিনি এ ঘর ছেড়ে দ্রুত বারান্দার ঘরে আসলেন। বড্ড অস্থির লাগছে। জীবনে প্রথম হেমলতার জীবন ভিক্ষা চেয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন!

আমি পদ্মজা - সকল পর্ব

ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। সবকিছু শান্ত। পদ্মজা ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসল। গেইটে শব্দ পেয়ে চমকে তাকাল। উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল। হেমলতা ঢুকেন। বিধ্বস্ত অবস্থা। মনজুরা পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, পদ্মজা টের পেল না। হেমলতা বাড়িতে ঢুকে কাঁধের ব্যাগটা মুরগির খুপীর সামনে ছুঁড়ে ফেলেন। অন্ধকারের জন্য মুখ স্পষ্ট নয়। হেমলতা বাড়ির পিছনের দিকে চলে গেলেন। পদ্মজার বুক দুরুদুরু করছে। সে ধীর পায়ে উঠানে এসে দাঁড়াল। পিছনে মনজুরা। পায়ের শব্দে চমকে তাকাল পদ্মজা, দেখতে পেল মনজুরাকে। ফিসফিসিয়ে বলল,'নানু,আম্মা কোথায় গিয়েছিল?'

মনজুরা ক্ষণকাল নীরব থেকে এরপর বললেন,'জানি না।'

মনজুরার কণ্ঠে ভয়। পদ্মজা দূর্বল শরীর ঠেলে নিয়ে আসল বাড়ির পিছন। দেখতে পেল,হেমলতা নদীতে নেমে গোসল করছেন। এক নিঃশ্বাসে কয়েকটা ডুব দিলেন। পদ্মজা ব্যস্ত পায়ে ঘাটের কাছে এলো। ক্ষীণ স্বরে ডাকল,'আম্মা।'

হেমলতা ঘুরে তাকালেন। ঝড় শেষে আকাশ ধবধবে সাদা । অন্ধকার কাটার পথে। পদ্মজা বলল,'ঠান্ডা লাগবে।'

হেমলতা কিচ্ছুটি বললেন না। গোসল শেষ করে উঠে আসেন উপরে। পদ্মজা আর কিছু বলল না। হেমলতা উঠানে এসে মনজুরাকে বললেন,'পূর্ণারে নিয়ে আসো আম্মা।'

পদ্মজা অবাক হয়ে শুধু দেখছে। পূর্ণা আসে ধীর পায়ে হেঁটে। তার জ্বর অনেকটা কমে এসেছে। মনজুরা দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। হেমলতা মৃদু হেসে পূর্ণাকে বললেন,'পদ্মজা পাশে এসে দাঁড়া।'

পূর্ণা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। সে বাধ্যের মতো পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়াল। হেমলতা মুরগির খুপীর পাশ থেকে কালো ব্যাগটা হাতে তুলে নিলেন। ব্যাগ থেকে একটা রাম দা আর একটা কৌটা বের করলেন। পূর্ণা রাম দা দেখে চমকে উঠল। দু'বোন চাওয়াচাওয়ি করল একবার। হেমলতা রক্তেমাখা রাম দা দুই মেয়ের পায়ের সামনে রাখলেন। শীতল কিন্তু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন,'মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আর পৃথিবীতে সেরা মানুষগুলোরই বাঁচার অধিকার আছে। মানুষরূপী পশুদের না। যখন যেখানে কোনো মেয়েকে অসম্মান হতে দেখবি এক কোপ দিয়ে অমানুষটার আত্মা দেহ থেকে আলাদা করে দিবি। যে তোকে অসম্মান করেছে সে দোষী, তুই না। তার শাস্তি পাওয়া উচিৎ, তোর না। তাই আত্মহত্যার কথা কখনো ভাববি না। দোষীর আত্মা হত্যা করা উচিৎ। আর আমি মনে করি, এতে পাপ নেই। বরং পাপীকে বিনাশ না করা পাপ। আর আমার মেয়েরা যেন সেই পাপ কখনো না করে। সেই...."

'মেয়েদের এসব কি শিক্ষা দিতাছস তুই? মাথা খারাপ হইয়া গেছে তোর?'

মনজুরা হইহই করে উঠলেন। হেমলতা ঢোক গিলে মনজুরার কথা হজম করে নিলেন। এরপর আবার মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন,' আমি কখনো ছেলে চাইনি। মেয়ে চেয়েছি। প্রতিবাদী, দুঃসাহসীক মেয়ে চেয়েছি। আল্লাহ আমাকে তিনটা মেয়ে দিয়েছেন।  

এখন সেই মেয়েরা যদি এইটুকুতে দূর্বল হয়ে পড়ে কীভাবে হবে? ঠিক আগের মতোই মাথা উঁচু করে বাঁচবি। যতদিন আমি আছি কেউ তোদের অসম্মান করে  টিকতে পারবে না। আমি না হয় যতদিন বেঁচে থাকি তাদের শাস্তি দেব। পৃথিবী থেকে মুছে দেব। কিন্তু যখন থাকব না? তখন,তখন কী তারা বেঁচে থাকবে? বেঁচে থাকতে দেয়া ঠিক হবে? অন্য কোনো মেয়ের সাথে নোংরামো করবে না তার নিশ্চয়তা আছে? নেই। এখন থেকে নিজেদের শক্ত কর। মেয়েদের সাহস মেয়েদরই হতে হয়। নিজেকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিজের। রাতের স্মৃতি দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেতে বলব না। মনে রাখ। প্রতিটি মানুষের ভেতর লুকানো হিংস্র শক্তি আছে। সবাই প্রকাশ করতে জানে না। চিনতে পারে না নিজেকে। গত রাতের ঘটনাটা মনে রেখে নিজের ভেতর লুকানো হিংস্র শক্তিটাকে জাগিয়ে হাতের মুঠোয় রাখ। যাতে সঠিক সময়ে হাতের মুঠো খুলে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারিস। আঘাতে, আঘাতে চুরমার করে দিতে পারিস পাপের জগত।"

এইটুকু বলে হেমলতা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। দপ করে বসে পড়েন। পদ্মজা 'আম্মা' বলে হেমলতাকে ধরতে চাইলে, হেমলতা হাত উঠিয়ে বলেন,'দাঁড়িয়ে থাক।'

হেমলতা সময় নিয়ে দম নেন। এরপর কৌটাটা খুলে ঠান্ডা তরল কিছু ঢেলে দেন দুই মেয়ের পায়ে। পূর্ণা কেঁপে উঠে দূরে সরে গেল। পদ্মজা আতঙ্ক নিয়ে প্রশ্ন করল,'আম্মা, কার রক্ত?'

রক্তের কথা শুনে ঘৃণা আর ভয়ে পূর্ণার সর্বাঙ্গ রি রি করে উঠল। মনে হচ্ছে,পায়ে পোকা কিলবিল করছে। টাটকা তাজা লাল রক্ত! বমি গলায় এসে আটকে গেছে। হেমলতা পদ্মজাকে জবাব দিলেন না। শুধু মৃদু হাসলেন। পূর্ণা এই ভয়ংকর দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারাল। পদ্মজা দু'হাতে জাপটে ধরল পূর্ণাকে। কী আশ্চর্য, এই ভয়ংকর ঘটনা তাকে একটুও বিচলিত করল না! হেমলতার গায়ে ভেজা শাড়ি। তাই পূর্ণাকে ধরলেন না। মনজুরাকে বললেন,'পূর্ণারে ঘরে নিয়ে যাও, আম্মা।'

মনজুরা কঠোর চোখে তাকান হেমলতার দিকে। হেমলতা আবারো হাসেন। ভেজা কণ্ঠে বলেন,'কালো বলে অবহেলা না করে বুকে আগলে রাখলে আমার জীবনটা, আমার মেয়েদের জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো আম্মা।"

হেমলতার কথায় মনজুরার সারামুখ বিষণ্নতা ছেয়ে গেল। তিনি হেমলতার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। অপরাধবোধে মাথা নুইয়ে ফেললেন। পূর্ণাকে ধরে নিয়ে গেলেন ঘরে। হেমলতা সেখানেই পড়ে রইলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন। আলো ফুটেছে পুরোপুরি। পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। পানি দিয়ে উঠানের রক্ত মুছে দিলেন চিরতরে। রাম দা ধুয়ে লুকিয়ে রাখলেন লাহাড়ি ঘরে। শাড়ি পাল্টে উঠানে পা রাখেন। তখন মগা আসল। এসে খবর দিল, বিচার বসবে দুপুরে। রাতের ঘূর্ণিঝড়ে গ্রামের বেশিরভাগ ঘরবাড়ি উড়ে গেছে। পশুপাখি সহ বিভিন্ন ক্ষতি হয়েছে। অনেক মানুষ আহত হয়েছে! এই খবর শুনে হেমলতার চোখ সজল হয়ে উঠল। প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। প্রকৃতি কখনো কাউকে ছাড়ে না! গ্রামবাসী অন্যায় দেখেও নিস্তব্ধ থেকেছিল। এ বুঝি তারই শাস্তি!

______________

মাথার উপর সূর্য। প্রচন্ড তাপদাহ । পূর্ণা,পদ্মজা, হেমলতা কালো বোরখার আবরণে নিজেদের ঢেকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে অলন্দপুরের মাধ্যমিক স্কুলের উদ্দেশ্যে। খাঁ খাঁ রোদ্দুর, তপ্ত বাতাসের আগুনের হলকা । সবুজ পাতা নেতিয়ে পড়ার দৃশ্য পড়ছে চোখে। মোর্শেদ বাকিদের নিয়ে আসছে। রীনাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে করুণ কান্নার স্বর ভেসে আসে। পদ্মজা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল,রীনার বাড়ির ছাদ উড়ে গেছে। গাছপালা ভেঙ্গে উঠানে পড়ে আছে। হেমলতা পদ্মজাকে টেনে নিয়ে এগিয়ে যান। 

বটের ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছিল এক রাখাল ছেলে। সে হেমলতার মুখ দেখে বুঝল, পিছনের দুটি মেয়ে পদ্মজা আর পূর্ণা। ছুটে আসল। পদ্মজাকে উদ্দেশ্য করে বলল,'পদ্ম আপা তুমি ডরাইও না। তোমার কিচ্ছু হইব না।'

চারদিকে নিঝুম , নিস্তব্ধ,ঝিমধরা প্রকৃতি । ঘামে দরদর তৃ্ষ্ণার্ত রাখাল। হাঁপিয়ে কথা বলছে। স্কুলে যাওয়ার পথে, মাঝে মাঝেই এই পনেরো বছর রাখালের সাথে দেখা হতো পদ্মজার। পদ্মজার জন্য পাগল সে। বড় বোনের মতো মান্য করে। পদ্মজা মৃদু করে হাসল। পদ্মজার মুখের উপর পাতলা পর্দা বলে, রাখালের চোখে তা পড়ল না। রাখালকে পিছনে ফেলে তিন মা মেয়ে এগিয়ে চলল। 

স্কুল মাঠে অনেক মানুষ জমেছে। রাতের ঘূর্ণিঝড়ের জন্য অলন্দপুরের বেশি অর্ধেক মানুষ আসেনি। তবুও  প্রায়  পাঁচ'শ মানুষ তো এসেছেই! ঘটনা ঘটেছে আটপাড়ায় আর তা ছড়িয়ে পড়েছে সব পাড়ায়! যথাসময়ে বিচার কার্য শুরু হলো। পদ্মজা এবং আমির দুজন দু'দিকে দাঁড়ানো। মাতব্বর ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন,'এদের একসাথে কারা দেখেছেন?'

রমিজ আলী,কামরুল, মালেক হাত তুলল। মজিদ মাতব্বর বললেন,'কী দেখেছেন? ব্যাখ্যা করুন।'

রমিজ আগে আগে উঁচু কণ্ঠে বলল,'আমি দেখছি ঝড়ের সন্ধ্যায় আপনের পোলারে পদ্মজার ঘর থেকে বাইর হইতে। বাড়িত আর কেউ আছিলো না।'

আমির রেগে গিয়ে কিছু বলতে চাইল, মজিদ মাতব্বর হাতের ইশারায় আটকে দিলেন। আমির বাপের বাধ্য সন্তান তাই  থেমে গেল। মজিদ মাতব্বর বললেন,'আপনি আমিরকে পদ্মজার ঘর থেকেই বের হতে দেখেছেন?'

রমিজ আলী দৃষ্টি অস্থির রেখে আমতা আমতা শুরু করলেন। দম নিয়ে বললেন,'তারে বারান্দা থাইকা বাইর হইতে দেখছি।'

মজিদ মাতব্বর নীরব থেকে এরপর বললেন,'তাহলে কোন আন্দাজে আপনি বলছেন,তারা নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত ছিল?'

পদ্মজার সর্বাঙ্গ রি রি করে উঠল। সে চোখ বুজে ফেলল। রমিজ আলী থমকে গিয়ে পরপরই হুংকার দিয়ে উঠেন,'একটা অচেনা ছেড়া খালি বাড়িত কোনো ছেড়ির কাছে কেন যাইব? আপনার নিজের ছেড়া বলে,তার দোষ ঢাকতে পারেন না। আমার ছেড়ির বেলা কিন্তু ছাড়েন নাই।'

'যুক্তি দিয়ে কথা বলুন। আপনার মেয়েকে হাতেনাতে ধরা হয়েছিল। তার গায়ে কাপড় ছিল না। তারা একসাথে একই ঘরের একই বিছানায় ধরা পড়েছে। আমির আর পদ্মজার বেলা সেটা হয়নি।'

মজিদ মাতব্বরের ক্ষমতা এবং কথার দাপটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে রমিজ আলীর। কামরুল চুপসে গিয়েছেন। সামনে নির্বাচন। মজিদ মাতব্বরকে ক্ষেপানো মানে নিজের কপালে দুঃখ বয়ে আনা। ভীরের মাঝ থেকে কেউ একজন বলল,'তাহলে আপনার ছেলে একটা মেয়ের কাছে খালি বাড়িতে গেল কেন?'

মজিদ মাতব্বর উঁকি দিয়ে প্রশ্নদাতাকে খুঁজে বের করলেন। তারই প্রতিপক্ষ হারুন রশীদ! মজিদ মাতব্বর আমিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,'তুমি কেন গিয়েছিলে পদ্মজার বাড়িতে?'

আমির সহজ গলায় বলল,'বাড়ি ফিরছিলাম হঠাৎ ঝড় শুরু হলো। সামনে মোর্শেদ কাকার বাড়ি ছিল। মোর্শেদ কাকা বাড়ি নাই জানতাম না। জানলে,বৃষ্টিতে ভিজতাম। তবুও ওই বাড়ি যেতাম না। এই গ্রামের অনেকেই জানে আমার শ্বাসকষ্ট আছে। বাড়ির সবাই জানে,বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লাগে। শ্বাসকষ্ট হয়।'

হারুন রশীদ বললেন,'যখন দেখলা ছেড়িডা বাড়িত একলা তখন বাইর হইয়া গেলা না ক্যান?'

আমির সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল,'আমার মাথায় আসেনি এমন কিছু হতে পারে। আর... "

আমির পদ্মজার দিকে একবার তাকাল। পদ্মজা সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিল। আমির বলল,'আর...পদ্মজা কতটা সুন্দর যারা দেখেছে সবাই জানে। আমি প্রথম দেখে অভিভূত হয়ে পড়ি। তাই মস্তিষ্কে একবারো কোনো বিপদের আশঙ্কা আসেনি।'

মজিদ মাতব্বর ছেলের শেষ কথা শুনে অসন্তুষ্ট হলেন। তবুও স্বাভাবিক থেকেই বললেন,'গ্রামবাসী কোনো প্রমাণ ছাড়াই লাফিয়েছে। মেয়েটাকে অপদস্থ করেছে। প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে  নোংরামো অপবাদ দেয়া অপরাধ।' 

মজিদ মাতব্বর কামরুলের দিকে তাকিয়ে তাকে লক্ষ্য করে বললেন,'ছইদ,মজনুর ছেলে আরেকটা কে জানি? কোথায় তারা?'

কামরুল ধীরভাবে বলল,'পাই নাই খোঁজে। মনে হয়, ভয়ে কোনহানো লুকাইছে।'

রমিজ আলী হঠাৎ গমগম করে উঠলেন,'এইডা আমি মানি না। তারারে আপনে ছাইড়া দিতে পারেন না। আপনের ক্ষমতা বেশি দেইখা আপনে এমনে নিজের ছেড়ারে ঢাইকা রাখতে পারেন না। ধূর্তবাজ লোক।'

আমির রেগেমেগে রমিজ আলীকে ধরতে এলে, মজিদ গর্জন করে উঠলেন,'আমির!' 

আমির কিড়মিড় করে রাগ হজম করার চেষ্টা করল। হারুন অতিশয় ধূর্ত লোক। তিনি রসিকতা করে বললেন,'সত্য হউক আর মিথ্যাই। বদনাম তো বদনামই।'

মজিদ সবার প্রশ্ন কথা উপেক্ষা করে উপস্থিত গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে বললেন,'আপনাদের আমার বিচারের প্রতি বিশ্বাস আছে?'

সবাই আওয়াজ করে বলল,'আছে।'

মজিদ মাতব্বর তৃপ্তির সাথে হাসলেন। ক্ষণকাল নীরব থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কণ্ঠ উঁচু করে বললেন,'মোর্শেদের মেয়েদের সাথে খারাপ হয়েছে। পদ্মজার নামে অনেক প্রশংসা শুনেছি। সে খুবই ভাল মেয়ে। আর আমার ছেলেকেও সবাই চিনেন, সে কেমন। যারা যারা দোষ করেছে তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়া হবে। পদ্মজা আর আমির নামে যে পাপের অভিযোগ  করা হয়েছে তার যুক্তিগত প্রমাণ নেই। আর প্রমাণ ছাড়া আমি কখনো কাউকে শাস্তি দেইনি। আজও দেব না। তবে আমি আজ সবার সামনে মোর্শেদ আর তার স্ত্রীর কাছে একটা প্রস্তাব রাখব।'

হেমলতা, মোর্শেদ সহ উপস্থিত সবাই কৌতূহল নিয়ে তাকাল। মজিদ  মাতব্বর বললেন,'পদ্মজাকে আমিরের বউ করে নিয়ে যেতে চাই।'

চারিদিকে কোলাহল বেড়ে গেল। সব কোলাহল সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে স্বপ্নাবিষ্টের মত শুধু মজিদ মাতব্বরের প্রস্তাবটি পদ্মজার কানে বাজতে থাকল। জীবনের কোন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে সে?

চলবে....

আমি পদ্মজা - ১৯

সূর্যের প্রখর তাপে সমস্ত প্রকৃতি যেন নির্জীব হয়ে ওঠেছে। উপস্থিত সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। রমিজ আলি,হারুন রশীদ নামক ধূর্ত মানুষগুলোর চোখ ছানাবড়া। মজিদ মাতব্বর ধীর শান্ত কণ্ঠে বললেন,'আপনারা চাইলে সময় নিতে পারেন। আজ এখানে...'

হেমলতা কথার মাঝে আটকে দিয়ে বললেন,'আপনি বিয়ের তারিখ ঠিক করুন।'

মজিদ মাতব্বরের প্রস্তাবের চেয়ে এই প্রস্তাবে হেমলতার রাজি হওয়াটা যেন কোলাহল মুহূর্তে  দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল। পদ্মজা হতবাক, বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! মোর্শেদ চোখ বড় করে হেমলতার দিকে দৃষ্টিপাত করেন। আশপাশ থেকে ফিসফিসানি ভেসে আসছে। মজিদ মাতব্বর মৃদু হাসলেন। এরপর আনন্দসহিত সবাইকে নিমন্ত্রণ করলেন,'আগামী শুক্রবার আমার ছেলের সাথে মোর্শেদের বড় মেয়ের বিবাহ। আপনাদের সবার নিমন্ত্রণ রইল।'

কথা শেষ করে হেমলতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,'দিন তারিখ ঠিক আছে?'

হেমলতা সম্মতি জানালেন। মোর্শেদ অবাকের চরম পর্যায়ে। কোনো কথা আসছে না মুখে। পদ্মজা ঢোক গিলে ব্যাপারটা হজম করে নিল। মুহিবের সাথে যখন তার বিয়ের আলোচনা হলো তখন সে ভারি অবাক হয়েছিল। লিখন শাহ নামে একটা মানুষকে মনে পড়েছিল। এখন তেমন কিছুই হচ্ছে না। অনুভূতিগুলো ভোঁতা। যা হওয়ার হবে। সেসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। বিচার সভা ভেঙ্গে গেল। মজিদ মাতব্বর আলাদা করে মোর্শেদের সাথে কথা বলেন। তিনি আগামীকাল নিজ স্ত্রী এবং বাড়ির অন্যান্য বউদের নিয়ে পদ্মজাকে দেখতে আসবেন। মোর্শেদ, হেমলতা সমস্বরে অনুমতি দিলেন। বাড়ি ফেরার পথে অনেকের কটু কথা কানে আসে। পদ্মজা, আমির দুজনেরই চরিত্র খারাপ। এজন্যই বিয়ে হচ্ছে। মাতব্বর ক্ষমতাবান বলে,পুরো ব্যাপারটা ঘুরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু,তলে তলে তো নিজেরা জানে তাদের ছেলেমেয়ে কেমন। তাই তাড়াতাড়ি করে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন খুব বিশ্রীভাবে পদ্মজাকে উদ্দেশ্য করে বলল,' কে জানে, মনে কয়তো ছেড়ি পেট বাঁধাইছে। রাইতে বাপ মারে দিয়া পায়ে ধরাইয়া বিয়া ঠিক করছে।'

পদ্মজার মন তিক্ত হয়ে উঠে। হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এতো নোংরা মন্তব্য সহ্য করা খুব কঠিন। মিথ্যে অপবাদ চারিদিকে। বোরখার আড়ালে পদ্মজার চোখ দু'টি ছলছল করে উঠল। খুব কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। হেমলতা পদ্মজার একহাত শক্ত করে চেপে ধরেন। মানুষদের ছায়া ছেড়ে ক্ষেতের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে তিনি বললেন,'জীবন খুব ছোট। এই ছোট জীবনে ঘটে অনেক ঘটনা। যে ভাল তার সাথে যে শুধুই ভালই হবে তা কিন্তু ঠিক না, উচিতও না। ভাল খারাপে মিলিয়েই জীবন। তাই বলে,সেই খারাপকে পাত্তা দিয়ে সময় নষ্ট করতে হবে তার কোনো মানে নেই। খারাপটাকে পাশে রেখে ভাল মুহূর্ত তৈরি করার চেষ্টা করবি। ভালটা ভাববি। শুধুমাত্র কয়জনের কথায় কী আসে যায়? পুরো গ্রামবাসী জানে,তুই কেমন। পুরো অলন্দপুরের যত মানুষ আজ এসেছে তাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই মনে মনে তোর গুণগান গেয়েছে। তারা মনে মনে বিশ্বাস করে তুই নির্দোষ। কিন্তু চুপ ছিল। যারা খারাপের দলে তারা সংখ্যায় কম বলে কোলাহল করে নিজেদের দাপট দেখাতে চেয়েছিল। সবার অগোচরে বোঝাতে চেয়েছিল,আমরা অনেকজন। কিন্তু পারেনি। কোলাহল কোনো কিছুর সমাধান নয়। এখন যারা নিন্দা করলো তারা নিজেদের নীচু মনের পরিচয় দিয়েছে, সেই সাথে আমলনামায় পাপের সংখ্যা বাড়িয়ে দিল। তাদের শাস্তি পৃথিবী এবং আখিরাত দুটোতেই হবে। একদিন এদের শাস্তি হবেই,এই কথাটা ভেবে খুশি হ। সব ভুলে যা। বাকি জীবন পড়ে রয়েছে। সেসব নিয়ে ভাব। চোখের জল অতি আপনজন এবং আল্লাহর জন্য ফেলা উচিত। এদের মতো কু-মানুষের জন্য না।'

পদ্মজা হুহু করে কেঁদে উঠল। আচমকা হেমলতাকে মাঝপথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে,কান্নামাখা কণ্ঠে বলল,'তুমি জাদুকর আম্মা। তুমি জাদু জানো।'

হেমলতা পদ্মজার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। মোর্শেদ পদ্মজাকে কান্না থামাতে বলতে চাইলে,হেমলতা ইশারায় চুপ করিয়ে দেন।  পাশেই বিস্তীর্ন ক্ষেত। গ্রীষ্মের দুপুরের রূপ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।  মোর্শেদের কপাল বেয়ে ঝরঝর করে ঘাম ঝরছে। তার দৃষ্টি থমকে আছে হেমলতার দিকে। একটা অপ্রিয় সত্য সম্ভাবনার কথা মনে হতেই চোখ দুটি ছলছল করে উঠল। তিনি দ্রুত চোখ সরিয়ে, বড় করে নিঃশ্বাস ফেলেন। জীবনের লীলাখেলায় তিনি নিঃস্ব। পদ্মজার কান্না থামার লক্ষণ নেই। হেমলতা ছদ্ম গাম্ভীর্যের সহিত বললেন,'এতো কাঁদলে কিন্তু মারব।'

__________

আকাশ জুড়ে তারার মেলা। জানালা গলে চাঁদের আলো পদ্মজার মুখশ্রী ছুঁয়ে দিচ্ছে। সে বারান্দার ঘরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। বুকটা কেমন করছে। অনবরত কাঁপছে। হেমলতার উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত উঠে বসল। হেমলতা পদ্মজার দিকে মুহূর্ত কাল তাকিয়ে রইলেন। পদ্মজা নখ খুঁটছে। হেমলতা বললেন,'ঘুম আসছে না?' 

পদ্মজা মাথা দুই পাশে নাড়াল। হেমলতা আর কিছু বললেন না। পদ্মজা পিনপতন নীরবতা কাটিয়ে বলল,'মেজো আপার বিয়ের তারিখ পড়ছে?'

হেমলতা পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। বিছানার উপর বসে পদ্মজাকে টেনে কোলে শুতে ইশারা করেন। পদ্মজা শুয়ে পড়ল। মায়ের কোলটা  তার এখন ভীষণ দরকার ছিল। হেমলতা পদ্মজার প্রশ্ন এড়িয়ে অন্য কথা তুললেন। বললেন,'আমি জানি না কোনো মা তার মেয়ের কাছে নিজের বিয়ে সম্পর্কিত আলোচনা করেছে নাকি। কিন্তু আমি আমার বিয়ের গল্প তোকে বলতে চাই। শুনবি?'

পদ্মজা সায় দিল। হেমলতা পদ্মজাকে বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলার জন্য অতীতে নিয়ে যান,'সেদিন রাতে আব্বা এসে বলল, তিনদিন পর আমার বিয়ে। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। কষ্ট হয়েছিল। আমি আরো পড়তে চেয়েছিলাম। এরপর শুনলাম, যার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে তার পড়াশোনা নেই। জ্ঞানও যথেষ্ট কম। রাগচটা লোক। এসব তথ্য জেনে রাগ,মন খারাপ কিছুই হয়নি। ভয় হয়। না জানি কেমন যাবে সংসার! বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। তোর আব্বাকে তখনো আমি দেখিনি। বিয়ের দিন আয়নায় প্রথম দেখি। কালো একটা মুখ। চোখ দু'টি গভীর। কখনো না দেখা মানুষটাকে, প্রথম দেখেই মনে হয় আমার সবচেয়ে আপন একজন মানুষ। সব ভয় কেটে গেল। বিদায়ের সময় সবাই বলছিল,দুজনকে খুব মানিয়েছে। রাজযোটক। একজন হিন্দু দিদি বলেছিলেন,সাক্ষাৎ রাম সীতা। আটপাড়ায় যদি একজন ছয় ফুট লম্বার মানুষ থাকে তবে সেটা তোদের আব্বা ছিল। বিয়ের পর জানতে পারি,তোর আব্বাকে বিয়ে করার জন্য অনেক মেয়েই পাগল ছিল। নিজেকে খুব সৌভাগ্যবতী মনে হতো। অশিক্ষিত ভেবে নাক কুঁচকেছিলাম। সেই আমি তোর আব্বার জন্য দিনকে রাত, রাতকে দিন মানতে রাজি ছিলাম। এতোটাই ভালবাসা হয়ে গেছিল যে, তোর আব্বা ছুরি নিয়ে রক্তের আবদার করলে আমি আমার বুক পেতে দিতাম...।"

পদ্মজা মাঝপথে আটকে দিয়ে বলল,'তাও তো আব্বা তোমাকে ভালোবাসেনি আম্মা।'

হেমলতার হাসি উজ্জ্বল মুখটা নিভে গেল। অপ্রতিভ হয়ে উঠলেন। তিনি দৃষ্টি এলোমেলো রেখে বললেন,'তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছিল।'

পদ্মজা চুপ করে রইল। হেমলতাও নিশ্চুপ। দরজার পাশে মোর্শেদ বসেছিলেন। বিড়ি ফুঁকছিলেন। হেমলতার প্রতিটি কথা বুড়ো হয়ে যাওয়া মনটাকে দুমড়ে, মুচড়ে দিল। তিনি বিড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান চৌরাস্তার উদ্দেশ্যে। চৌরাস্তার পাশে একটা বড় ব্রিজ আছে। ব্রিজে দখিনা হাওয়ার তীব্রতা খুব বেশি। সেখানেই এসে দাঁড়ান। ফেলে আসা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ চোখ বুজে মনে করার চেষ্টা করেন।

বেশ কিছুক্ষণ পর পদ্মজা বলল,'আম্মা, প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর প্রশ্ন করব না। তবুও...'

'বলব একদিন।'

পদ্মজা আর জিজ্ঞাসা করল না,কোনদিন বলবে। নিশ্চুপতার অবস্থানে ফিরে গেল। মুহূর্ত কাল স্থির থেকে হেমলতা বললেন,'পূর্ণা খুব কান্নাকাটি করে দেখলাম। মেয়েটা এতো দূর্বল কী করে হলো?'

পদ্মজা হেমলতার এক হাত মুঠোয় নিয়ে আশ্বস্ত করল,'আমি আছি আম্মা। সামলে নেবো।'

'ঘরে যা। রাত হয়েছে অনেক।'

পদ্মজা উঠে বসল। ওড়নাটা ভাল করে টেনে নিয়ে,জুতা পরল। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। হেমলতা বিছানার শেষ অংশ থেকে বালিশ টেনে নেন। বালিশের নিচে দুটি কাগজ ভাঁজ করা ছিল। হেমলতা হাত বাড়িয়ে নেন। পদ্মজার উদ্দেশ্যে বলেন,'পদ্মজা,এগুলো কী?'

হেমলতা ভাঁজ খুলেন। পদ্মজা ফিরে তাকায়। হেমলতার হাতে লিখনের চিঠি দুটি দেখে সর্বাঙ্গে বৈদ্যুতিক কিছু একটা ছড়িয়ে পড়ে,শরীর কাঁপিয়ে দিল। মাটি যেন দুই পা টেনে ধরল। হেমলতা প্রথম লাইন পড়ে বেশ অবাক হোন। পদ্মজার দিকে একবার চকিতে তাকান। এরপর এক নিঃশ্বাসে দুটো চিঠি পড়ে শেষ করেন। পড়া শেষে থম মেরে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। ভয়ে পদ্মজার দুই চোখ বেয়ে জল পড়ছে। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হেমলতা ধীর পায়ে হেঁটে আসেন পদ্মজার কাছে। দু ভ্র প্রসারিত করে, শান্ত অথচ  তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলেন,' এসব কবে হয়েছে? আমাকে জানাসনি কেন?'

পদ্মজা প্যাচপ্যাচ করে কেঁদে বলল,'যখন উনারা শুটিং করতে আসেন।' পদ্মজার মনে হচ্ছে এখুনি সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুতেই হচ্ছে না। মনে মনে প্রার্থনা করছে,যেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে পারে সে। তাহলে এই লজ্জা থেকে বাঁচা যাবে। হেমলতা পদ্মজাকে পরখ করে নেন। পদ্মজা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। বার বার নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরছে। পদ্মজা হেমলতাকে চুপ থাকতে দেখে বলল,'তুমি যা বলবা তাই হবে আম্মা। আমার উপর রেগে যেও না।'

চলবে....

আমি পদ্মজা - ২০

আজ যেন শুধু মোড়ল বাড়ির মাথার উপরেই সূর্যটা উঠেছে। সকাল থেকে আত্মীয় আপ্যায়নের প্রস্তুতির তোড়জোড় চলছে। সবাই ঘেমে একাকার। বাড়ির প্রতিটি মানুষ ব্যস্ত। মোর্শেদ হিমেল ও প্রান্তকে নিয়ে বাজার করে ফিরেছেন সূর্য উঠার মাথায়। লাহাড়ি ঘরের পাশে বড় উনুন করা হয়েছে। সাধারণ চালের পরিবর্তে সুগন্ধি (কাটারিভোগ)সিদ্ধ চালের ভাত রান্না করা হয়েছে। ফিরনি, রাজ হাঁসের মাংস রান্না হচ্ছে। বাড়িজুড়ে রমরমা ব্যাপার। একদিন আগের ঘটনা ধামাচাপা পড়েছে ৯৫ ভাগ। ছোট ছোট দরিদ্র ছেলেমেয়েরা খাবারের ঘ্রাণ পেয়ে ছুটে এসেছে মোড়ল বাড়ি। সবার মধ্যেই নতুন উত্তেজনা,নতুন অনুভূতি। শুধু পূর্ণা এখনো সেদিনের ঘটনা থেকে বেরোতে পারছে না। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ঘরে। পদ্মজা মনজুরা আর শিউলির মাকে কাজে সাহায্য করছিল। হেমলতা ধমকে ঘরে পাঠিয়ে দেন। পদ্মজা ঘামে ভেজা কপাল মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করে। পূর্ণার দুচোখ জলে নদী! পদ্মজা বিছানার উপর পা তুলে বসল। পূর্ণা পদ্মজার উপস্থিতি টের পেয়ে, হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছল। পদ্মজা কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলল,'চোখের জল কী শেষ হয় না?'

পূর্ণা নিরুত্তর। পদ্মজা অভিজ্ঞ স্বরে বলল,'দেখ পূর্ণা, এসব মনে রাখলে তোরই ক্ষতি। দেখছিস না,আমি একদিনের ব্যবধানে সব ভুলে হবু শ্বশুরবাড়ির মানুষদের জন্য রান্নাবান্না করছি। তুইও ভুলে যা। তোর বন্ধুরা আসছে। তুই নাকি তাদের ধমকে দিয়েছিস? এটা কিন্তু ঠিক না।'

আমি পদ্মজা - সকল পর্ব

পূর্ণা পদ্মজার দিকে তাকাল। দৃষ্টি ভীষণ শীতল। পদ্মজাকে বলল,'সত্যি ভুলতে পেরেছো আপা?'

পদ্মজা সঙ্গে,সঙ্গে উত্তর দিল,'ভুলিনি। কিন্তু সহ্য করতে পেরেছি। তোর মতো চোখের জল অপাত্রে ঢালছি না।'

পূর্ণা উঠে বসে,একটা বালিশ বুকে জড়িয়ে ধরে দায়সারাভাবে বলল,'তুমি অনেক শক্ত আপা। আমি খুব দূর্বল। আমি ভুলতে পারছি না।'

পদ্মজা আর এই বিষয়ে কথা বাড়াল না। পূর্ণার গাঁ ঘেঁষে বসে,ফিসফিসিয়ে বলল,'গতকাল রাতে কী হয়েছে জানিস?'

'কি হয়েছে?'

পদ্মজা চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলে,'তোর নায়ক ভাইয়ের চিঠি আম্মার হাতে পড়েছে।'

পূর্ণা আঁতকে উঠে বলল,'সেকী! কখন? কীভাবে?'

'আর বলিস না! সেদিন তুই নানাবাড়ি ছিলি। তখন চিঠি দুইটা বের করেছিলাম। বারান্দার ঘরে বালিশের নিচে রেখে দেই। আর মনে নেই। এরপরেই অঘটন ঘটে। এরপরদিন বিচার বসল। চিঠির কথা ভুলেই গেলাম। বারান্দার ঘরে ছিলাম রাতে,তবুও মনে পড়েনি। আর আম্মা পেয়ে গেল।'

উত্তেজনা, ভয়ে পূর্ণার গলা শুকিয়ে গেছে। প্রশ্ন করল,'আম্মা কী বলছে?'

পদ্মজা ঠোঁট দুটি উল্টিয়ে কী যেন ভাবে। এরপর ব্যথিত স্বরে বলল,'তেমন কিছুই না। এজন্যই আরো ভয় হচ্ছে।'

'কিছুই না?'

'কখন হলো এসব জিজ্ঞাসা করেছে। আমি বললাম,তুমি যা বলবে তাই হবে। এরপর আম্মা অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।'

'তারপর?'

'বলল, ঘুমা গিয়ে। শেষ।'

দুই বোন একসাথে চিন্তায় পড়ে গেল। কপাল ভাঁজ করে কিছু ভাবতে শুরু করে। পূর্ণা বলল,'আম্মা তোমার মুখ দেখে বুঝে গেছে তুমি লিখন ভাইকে ভালোবাসো না।'

পদ্মজা অন্যমনস্ক হয়ে বলল,'মনে হয়।'

পূর্ণা খুব বিরক্তি নিয়ে বলল,'লিখন ভাই এতো সুন্দর, তোমাকে এতো ভালোবাসে তবুও কেন ভালবাসোনি আপা? লিখন ভাইয়ের চিঠি তো ঠিকই সময় করে করে পড়তে। বিয়ে করতে কী সমস্যা?'

'আম্মা দিলে তো করবই। সমস্যা নেই।'

'তোমার এই ন্যাকার কথা আমার ভাল লাগে না আপা।'

পদ্মজা হেসে ফেলল। পূর্ণার রেগে কথা বলা দেখে। পদ্মজা পূর্ণার এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল,'গতকাল রাতে আম্মা আব্বার প্রতি ভালোবাসাটা আমাকে বলছে। প্রথম দেখেই নাকি আপন,আপন লেগেছিল। আব্বার জন্য আম্মা দিনকে রাত,রাতকে দিন মানতেও রাজি ছিলেন। এতোটা ভালোবাসতেন। আমার তেমন কোনো অনুভূতি হয়নি তোর নায়ক ভাইয়ের জন্য। প্রথম প্রথম কোনো পুরুষের চিঠি পেয়েছিলাম, সবকিছু নতুন ছিল। তাই একটা ঘোরে গিয়ে নতুন অনুভূতির সাক্ষাৎ পাচ্ছিলাম। আম্মার ভালবাসার কথা শোনার পর থেকে মনে হচ্ছে আমি উনাকে ভালোবাসিনি। সবটা মোহ ছিল। দূরে যেতেই উবে গেছে। তবে, উনি খুব অসাধারণ একজন মানুষ। আম্মা উনার হাতে তুলে দিলে আমাকে, কোনো ভুল হবে না। কিন্তু এটা এখন কল্পনাতীত। পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।'

পদ্মজার এতো কথা উপেক্ষা করে পূর্ণা কটমট করে বলল,'তোমার কী কালাচাঁদরে দেখলে আপন আপন লাগে?'

পদ্মজা চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞাসা করল,'কালাচাঁদ কে?'

পূর্ণা মিনমিনিয়ে বলল,'তোমার হবু জামাই।'

তারপরই গলা উঁচিয়ে বলল,'আমিও কালা জানি। কিন্তু আপা,তোমার জন্য লিখন ভাইয়ের মতো সুন্দর জামাই দরকার।'

পদ্মজা এক হাতে কপাল চাপড়ে বলল,'এখনও লিখন ভাই! যা তোর সাথে তোর নায়কের বিয়ে দিয়ে দেব। এখন আয়,ঘর থেকে বের হ। মুক্তা,সোনামণি,রোজিনা আসছে। তোর সাথে কথা বলবে। আয় বলছি...আয়।'

পূর্ণাকে টেনে নিয়ে বের হলো পদ্মজা। 

____________

সূর্য মামার রাগ কমেছে। মোড়ল বাড়ির মাথার উপর থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সদর ঘর ভর্তি মানুষ। হাওলাদার বাড়ির বউদের গ্রামবাসী শেষবার তাদের বিয়েতেই দেখেছে। আবার দেখার সুযোগ হওয়াতে দল বেঁধে মানুষ এসেছে। লোকমুখে শোনা যায়, হাওলাদার বাড়ির মেয়ে-বউদের সারা অঙ্গে সোনার অলংকার ঝলমল করে। মগা-মদন সহ আরো দুজন ভৃত্য মোড়ল বাড়ির গেইটে দাঁড়িয়ে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। পদ্মজাকে শাড়ি পরাচ্ছেন হেমলতা। পদ্মজা এর আগে কখনো শাড়ি পরেনি। পূর্ণা, প্রেমা ছোট হয়েও পরেছে। পদ্মজার কখনো ইচ্ছে করেনি।তাই সে হেমলতাকে বলল, 'প্রথম শাড়ি তুমি পরাবে আম্মা।'

শাড়ি পরানো শেষে, চোখে কাজল এঁকে দেন। ঠোঁটে লিপিস্টিক দিতে গিয়েও,দিলেন না। মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি করে চুল খোঁপা করতেই,পূর্ণা ছুটে আসে। হাতে শিউলি ফুলের মালা। হেমলতা মৃদু ধমকের স্বরে বলেন,'এতক্ষণ লাগল!' 

হেমলতার কথা বোধহয় পূর্ণার কানে গেল না। পূর্ণা চাপা উত্তেজনা নিয়ে বলল,'আল্লাহ! আপারে কী সুন্দর লাগছে!'

পদ্মজা লজ্জায় মিইয়ে গেল। চোখে মুখে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে। হেমলতা পদ্মজার খোঁপায় ফুলের মালা লাগিয়ে দিয়ে বললেন,'শুধু রূপে চারিদিক আলোকিত করলে হবে না,গুণেও তেমন হতে হবে।'

পদ্মজা বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। তখন হুড়মুড়িয়ে সেখানে উপস্থিত হলো লাবণ্য। দৌড়ে এসে পদ্মজাকে  জাপটে ধরে। এক নিঃশ্বাসে বলেও ফেলল,'আল্লাহ, পদ্ম তুই আমার ভাবি হবি। আমার বিশ্বাসই হইতাছে না। মনে হইতাছে স্বপ্ন দেখতাছি। ইয়া...মাবূদ। শাড়িতে তোরে পরী লাগতাছে। বাড়ির সবাই ফিট খাইয়া যাইব। দেহিস।'

পদ্মজা কি বলবে ভেবে পেল না। শুধু হাসল। হেমলতা পদ্মজার মাথার ঘোমটা টেনে দেন। লাবণ্যকে বলেন,'তোমার সইকে নিয়ে যাও।'

পদ্মজা হেমলতার হাতে হাত রেখে অনুরোধ করে বলল,'আম্মা,তুমি আসো।'

হেমলতা হাসেন। পদ্মজার মাথায় এক হাত রেখে বলেন,'কয়দিন পর থেকে এরাই তোর আপন। মা পাশে থাকবে না।'

পদ্মজার চোখ দুটি ছলছল করে উঠে। ছলছল চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। পদ্মজাকে নতুন বউ রূপে দেখে হেমলতার বুকে ঝড় বইছে। মেয়েটা কয়দিন পর আলাদা হয়ে যাবে। দুই মাস আগে হলে তিনি সাত রাজার ধনের বিনিময়েও মেয়ের বিয়ে দিতেন না। 

'আমি আসছি। লাবণ্য যাও তো নিয়ে যাও। পূর্ণা তুইও যা।'

লাবণ্য পদ্মজাকে নিয়ে যায়। পদ্মজার বুক ধড়ফড় করছে। মায়ের যেন কী হয়েছে! সে পিছন ফিরে তাকায়। সাথে সাথে হেমলতা অন্য দিকে ঘুরে তাকান। চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। তিনি দ্রুত তা মুছেন। 

সদর ঘর কোলাহলময় ছিল। পদ্মজা ঢুকতেই সব চুপ হয়ে গেল। লাবণ্য পদ্মজাকে ছেড়ে ভারী আনন্দ নিয়ে বলল,'আম্মা,কাকিম্মা,ভাবি,আপারা এইযে পদ্মজা। আমার নতুন ভাবি।'

পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল। অলংকারে জ্বলজ্বল করা পাঁচ জন নারীকে দেখে যেন চোখ ঝলসে গেল তার। সবাই তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা চোখ নামিয়ে ফেলল। তখন কোথা থেকে আবির্ভাব হলো আমিরের। সদর দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল পদ্মজা। পদ্মজাকে দেখে থমকে গেল সে। পদ্মজার পরনে খয়েরি রংয়ের জামদানি শাড়ি। শাড়িতে কোনো মেয়েকে এতো সুন্দর মনে হতে পারে এর আগে অনুভব করেনি আমির। আমিরের লজ্জা খুব কম। সে উপস্থিত গুরুজনদের উপেক্ষা করে পদ্মজাকে বলল,'মাশাআল্লাহ। দিনের বেলা চাঁদ উঠে গেছে।'

লজ্জায় পদ্মজার রগে রগে কাঁপন ধরে। এতো লজ্জাহীন মানুষ কী করে হয়! আমিরের মা ফরিনা ধমকের স্বরে বলেন,'বাবু,এইনে বয় আইসসা।'

আমির পদ্মজাতে দৃষ্টি স্থির রেখে মায়ের পাশে গিয়ে বসল। হেমলতা সদর ঘরে প্রবেশ করতেই আমির ধড়ফড়িয়ে উঠল। ছুটে এসে হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করল। হবু শ্বাশুড়ির প্রতি আমিরের এতো দরদ দেখে ফরিনা খুব বিরক্ত হলেন। পাশ থেকে ফরিনার জা আমিনা ফিসফিসিয়ে বললেন,'মেয়ের রূপ আগুনের হুল্কা। বাবু এইবার হাত ছাড়া হইলো বলে।'

আমিনার মন্ত্র ফরিনার মগজ ধোলাই করতে পারল না। পদ্মজার রূপে তিনি মুগ্ধ। আমির কালো বলে তিনি ছোট থেকেই আমিরকে বলতেন,'বাবু তোর জন্যি চান্দের লাকান বউ আনাম।' আর সেই কথা রক্ষার পথে। তিনি শুধু পছন্দ করছেন না শ্বাশুড়ির প্রতি আমিরের এতো দরদ! কী দরকার ঝাঁপিয়ে পড়ে পায়ে ধরে সালাম করার। আমির হেমলতাকে ভক্তির সাথে প্রশ্ন করল,'ভালো আছেন?'

হেমলতা মিষ্টি করে হেসে বলেন,'ভালো আছি। যাও গিয়ে বসো।'

আমির বাধ্যের মতো মায়ের পাশে গিয়ে বসল। মজিদ মাতব্বর, মোর্শেদের সাথে বাইরে আলোচনা করছেন। আর কোনো পুরুষ আসেনি বাড়িতে। তারা বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত। মুহূর্তে পদ্মজার সারা অঙ্গ সোনার অলংকারে পূর্ণ হয়ে উঠল। রূপ বেড়ে গেল লক্ষ গুণ। যার কোনো সীমা নেই। যার সাথেই পদ্মজা কথা বলেছে, সেই এগিয়ে এসে বালা নয়তো হার পরিয়ে দিয়েছে। কি অবাক কান্ড!

সবাই আড্ডা দিচ্ছে। পদ্মজা চুপ করে বসে আছে। কেউ কিছু প্রশ্ন করলে উত্তর দিচ্ছে। লাবণ্য একজনকে উদ্দেশ্য করে বলল,'রানি আপা,বাড়ির পিছনে যাইবা?'

রানি খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,'যাব।'

তার খুশির কারণ লাবণ্য কিছুটা ধরতে পেরেছে। রানির একজন প্রেমিক আছে। তাই শুধু সুযোগ খুঁজে দেখা করার। যেখানেই দাওয়াত পড়ে সেখানেই তার প্রেমিক উপস্থিত হয়।  লাবণ্য সবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে পদ্মজা,পূর্ণা,রানিকে নিয়ে বাড়ির পিছনে আসে। রানি বাড়ির পিছনে এসেই ঘাটের দিকে ছুটে যায়। একটা নৌকা এসে ভীরে। নৌকায় কে ছিল দেখা যায় না। রানি নৌকায় উঠে পড়ে। কারো সাথে বিরতিহীন ভাবে কথা বলছে শোনা যায়। পূর্ণা লাবণ্যকে প্রশ্ন করল,'লাবণ্য আপা? রানি আপা কার সাথে কথা বলে?'

'আবদুল ভাইয়ের সাথে।'

'কোন আবদুল?'

'যার কথা ভাবছিস।'  কথা শেষ করে লাবণ্য চোখ টিপল। পূর্ণা অবাক হয়ে বলল,'মাস্টারের সাথে!'

লাবণ্য হাসে। রানি এগিয়ে আসে। লাবণ্য বলে,'কথা শেষ?'

'হ চইলা গেছে।'

রানি পদ্মজার দিকে তাকিয়ে বলল,'মাশাআল্লাহ, তুমি এতো সুন্দর। আমার কোলে নিয়া আদর করতে মন চাইতাছে।'

পদ্মজা মুচকি হেসে বলল,'আপনি খুব শুকনা। আমাকে কোলে নিতে পারবেন না।'

'শুকনা হইতে পারি। শক্তি আছে।'

রানির কথা বলার ঢংয়ে সবাই হেসে উঠল। পূর্ণা আমিরকে দেখে পদ্মজার কানে কানে বলল,'আপা তোমার কালাচাঁদ আসছে।'

পদ্মজা পূর্ণাকে চোখ রাঙিয়ে বলল,'কীসব কথা! উনার বোনরা আছে।'

'লাবণ্য,রানি যা এখান থেকে।' আমিরের আদেশ শুনে রানি,লাবণ্য খুব বিরক্ত হলো। রানি কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,'দাভাই,থাকি না।'

আমির চোখ রাঙিয়ে তাকাল। ধমকের স্বরে বলল,'যেতে বলছি যা।'

লাবণ্য বিরক্তিতে, ইশশ! বলে পদ্মজাকে বলল,'আয় অন্যখানো যাই।'

'পদ্মজা থাকুক। তোরা যা।' আমিরের কথা শুনে বেশি চমকাল পদ্মজা। লাবণ্য ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল,'কেন? কেন?'

পদ্মজা, পূর্ণা অন্যদিকে ফিরে আছে। আমির দৃষ্টি কঠোর করতেই লাবণ্য,রানি চলে গেল। পূর্ণা চলে যেতে চাইলে পদ্মজা পূর্ণার হাত চেপে ধরে। পূর্ণা পদ্মজার হাত ছাড়িয়ে, ধীরকণ্ঠে বলল,'একা থেকে তোমার কালাচাঁদের ভালোবাসা খাও।'

'ছিঃ।'

পূর্ণা ছুটে চলে গেল। আমির পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়াতেই পদ্মজা বলল,'বিয়ের আগে গুরুজনদের না জানিয়ে এভাবে একা কথা বলা ঠিক নয়।'

'কী হবে?'

পদ্মজা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,'কলঙ্ক লাগবে।'

'আর কী বাকি আছে?'

'পরিমাণ না বাড়ানোই ভাল।'

পদ্মজার কথা বলতে একটুও গলা কাঁপেনি। বাড়ির ভেতর চলে আসার জন্য পা বাড়াতে আমির পদ্মজার এক হাত থাবা দিয়ে ধরে,আবার ছেড়ে দিল। পদ্মজা ছিটকে দূরে সরে গেল। আমির  বলল,'তুমি সত্যি একটা পদ্ম ফুল পদ্মবতী। এজন্যই লিখন শাহর মতো সুদর্শন যুবক তোমার প্রেমে পড়েছে।'

দেখা হওয়ার পর এই প্রথম পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল। পরপরই চোখের দৃষ্টি সরিয়ে ছুটে বাড়ির ভেতর চলে গেল। আমির অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। এবার আত্মীয় বিদায়ের পালা। যাওয়ার পূর্বে লাবণ্য একটা কাগজ পদ্মজার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল,'দাভাই দিছে।' 

ঘুমাবার আগে পদ্মজা কাঁপা হাতে কাগজটির ভাঁজটি খুলল।  কাগজটিতে যত্ন করে লেখা-

                       সারা অঙ্গ কলঙ্কে ঝলসে যাক

                              তুই বন্ধু শুধু আমার থাক।

চলবে....

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url