প্রেমাতাল - পর্ব 54-55-56। Golpo Porun
প্রেমাতাল
(মৌরি মরিয়ম)
This Photo is from Pexels |
প্রেমাতাল - পর্ব ৫৪
মৌরি মরিয়ম
ঘুম ভাঙার পরও শুয়ে রইলো মুগ্ধ তিতির যদি আসে! যদি আগের মত এসে ওর ঘুম ভাঙায়! আজকের দিনটা কি ও না এসে পারবে? অবশ্য নাও আসতে পারে, এখন তো ওর এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গিয়েছে। এখন তো চাইলেও এত সহজে আসতে পারবে না। যদি তিতির আসে সেই চিন্তা করে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে মুগ্ধ। আসলে ছুটি টা কাজে লাগবে আর না আসলেও রেস্ট নেয়া যাবে একটা দিন। কিন্তু মনে হচ্ছে আসবে। রাতে তিতির উইশ করেনি। যেহেতু উইশ করেনি, নিশ্চই কোন সারপ্রাইজ আছে। আবার নিজের মনকে সামলে নিল মুগ্ধ, এত বেশি ভাবলে পরে যদি না আসে তো খুব খারাপ লাগবে।
ওদিকে তিতির মুগ্ধর অফিসের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। মুগ্ধ আসছে না। মুগ্ধ কি তাহলে আজ ছুটি নিয়েছে! মুগ্ধর বাসায় কি যাবে ও? না না যাওয়াটা ঠিক হবে না। মুগ্ধর মা ব্যাপারটা ভাল চোখে নাও দেখতে পারে। কি করবে! অফিস টাইম ১০ টা কিন্তু মুগ্ধ সাধারণত ৯:৩০-৯:৪৫ এর মধ্যে অফিসে আসে। ৯ টা থেকে অপেক্ষা করছে তিতির, যখন ১০:৩০ বেজে গেল তখন তিতির ফোন করলো মুগ্ধকে।
তিতিরের কল পেয়ে মুগ্ধর বুকের ভেতরটা নেচে উঠলো। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সেই মিষ্টি কন্ঠ ভেসে এল,
-"হ্যালো.."
-"হ্যালো, গুড মর্নিং।"
-"ব্যাড মর্নিং, তুমি আজ অফিসে যাওনি?"
-"না।"
-"কেন?"
-"ছুটি নিয়েছি।"
-"কেন? কোন কাজ আছে?"
-"নাহ তো। অফিস করতে করতে টায়ার্ড হয়ে গিয়েছি।"
-"ওহ। তুমি কি ফ্রি আছো?"
-"হ্যাঁ, দেখা করবে?"
-"হ্যাঁ, চাচ্ছিলাম।"
-"কোথায় আসব বলো? আর কখন?"
-"এখনি এসো.. বনানী ব্রিজ।"
-"ওয়েট ওয়েট, বাই এনি চান্স তুমি কি বনানীতে? অফিসে গিয়েছিলে?"
-"অফিসে না, অফিসের সামনে।"
-"শিট! সরি।"
-"তুমি কেন সরি বলছো? আমি তো তোমাকে জানিয়ে আসিনি। তোমার তো দোষ নেই।"
-"আচ্ছা, শোনো আমি ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে আসছি। তুমি ওদিকে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে বসো।"
-"আমি ব্রিজের দিকে যাচ্ছি। তুমি ওখানে এসে ফোন দিও। আমি কোথায় থাকি ঠিক নেই।"
-"আচ্ছা।"
''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন
মুগ্ধ লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ৫ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে আলমারি খুলে একটা শার্ট হাতে নিতেই খেয়াল হলো তিতির অফিসের সামনে গিয়েছিল তার মানে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল, নিশ্চই শাড়ি পড়েছে! পাঞ্জাবি পড়াটা আজ ফরজ। সামনেই তিনটা পাঞ্জাবি ইস্ত্রি করা আছে। সাদা, লেমন, নীল। কোনটা পড়বে? আচ্ছা তিতির কি রঙের শাড়ি পড়েছে? কে জানে। যাই হোক, তিতিরের পছন্দের রঙ নীল। নীল পাঞ্জাবিই পড়া উচিৎ, আর এই নীল পাঞ্জাবিটা অনেক সুন্দরও। হাতের কাছে যে জিন্স পেল সেটাই পড়লো। পাঞ্জাবিটাও পড়লো, তারপর সাদা একটা কোটি পড়ে বোতাম লাগাতে লাগাতেই ঘর থেকে বের হলো। মা জিজ্ঞেস করলো,
-"কিরে মুগ্ধ, কোথায় যাচ্ছিস?"
-"ফ্রেন্ডরা এসেছে মা।"
-"ওহ, নাস্তাটাও করে যাবিনা?"
-"না, মা আমি খেয়ে নেব। ওদেরকে তো ট্রিট দিতেই হবে। তখন তো খাবই। তুমি খেয়েছো?"
-"হ্যা, স্নিগ্ধ ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় নাস্তা করে গিয়েছে, ওর সাথে আমিও খেয়ে নিয়েছি।"
-"আচ্ছা মা, আসছি তাহলে।"
-"দাড়া। এত তাড়া কিসের?"
একথা বলে মা এগিয়ে গেল। মুগ্ধকে টেনে নিচু করে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
-"আমার সোনার ছেলের জীবনে এই দিনটা বারবার আসুক, হ্যাপি বার্থডে।"
মুগ্ধ মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-"লাভ ইউ মা।"
-"হয়েছে এবার যা।"
-"হুম, শোনো রাত্রে মজা করে কিছু রান্না করো কিন্তু। পিউকেও আসতে বলো। একা জামাইয়ের হাত ধরে যেন চলে না আসে আবার, শশুরবাড়ির সবাইকে নিয়ে আসতে বলবে।"
-"আচ্ছা।"
-"আর প্লিজ অন্য কাউকেই বলবে না। আমি বার্থডে পার্টি করছিনা যে আত্মীয়স্বজন দিয়ে ঘর ভরে ফেলবে। আমার ভাল লাগে না।"
-"তোর ফুপীকেও বলবো না? পাশাপাশি বাড়িতে থেকে না বলে পারে কেউ?"
-"ফুপীকে বললে ইকরা আসবে।"
-"হ্যা, তাতে সমস্যা কি? ইকরাকে তুই সবসময় এত ভুল বুঝিস কেন বলতো?"
-"মা মা প্লিজ ওর কথা বলোনা, আমি গেলাম। সন্ধ্যার পর ফিরবো, এসে যদি ইকরাকে দেখি বাসা থেকে বের হয়ে যাব বলে দিলাম, টাটা।"
মা আর কথা বলল না। মুগ্ধ যেতে যেতে বলল,
-"পারলে ছানার মিষ্টি বানিও।"
১৫ মিনিটের একটু বেশি সময়ই লাগলো মুগ্ধর। ব্রিজের সামনে গাড়ি থামিয়ে নামলো। তিতিরকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। ফোন দিচ্ছে কিন্তু তিতির ধরছে না। আবার ডায়াল করলো। হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে(টোকাই) এসে মুগ্ধর সামনে ২/৩ টা গোলাপ ধরলো। বলল,
-"হেপি বাড্ডে।"
মুগ্ধ হাসলো, তিতিরের কাজ। কিন্তু গেলটা কোথায় মেয়েটা। এরপর আরেকটা বাচ্চা ফুলহাতে এল। একই ভাবে ওকে গোলাপ দিল। সেটা নিতে না নিতেই আরেকটা বাচ্চা এল, ফুল দিল। সেই ফুল নিতে না নিতেই আরো দুটো বাচ্চা এসে ফুল দিল। সবাই ফুল দিয়ে দিয়ে বলছে, "হেপি বাড্ডে।" মুগ্ধ হাসতে হাসতে সেই ফুল নিচ্ছে। দূরে দাঁড়িয়ে সেই মনোমুগ্ধকর হাসি দেখছে তিতির। মুগ্ধ আশেপাশে তাকিয়ে তিতিরকে খুঁজছে। কিন্তু বাচ্চাগুলোর হইচইয়ের কারনে অন্য কোন দিকে তাকাবার জো নেই। এরা একে একে আসছে আর ফুল দিয়ে উইশ করছে।
সবার ফুল দেয়া শেষ হতেই তিতির মিষ্টি একটা হাসি মুখে নিয়ে মুগ্ধর সামনে গেল। তিতিরকে দেখে মুগ্ধ হা হয়ে গেল। মনে হচ্ছে কোন স্বর্গচূড়া থেকে দেবী নেমে এসেছে। তিতিরও নীল পড়েছে, কিভাবে মিলে গেল! ফুল দিয়ে সব বাচ্চারা হইহই করতে করতে চলে গেল। ওরা যখন যাচ্ছিল তখন মুগ্ধ খেয়াল করলো সবার হাতে একটা করে বিরিয়ানির প্যাকেট। তিতির মুগ্ধকে একটা গোলাপ দিয়ে বলল,
-"হ্যাপি বার্থডে, এটা ৩৪ তম ফুল।"
মুগ্ধ হেসে ফুলটা নিল। বলল,
-"ওহ, বাচ্চাগুলো সবাই মিলে কি আমাকে ৩৩ টা ফুল দিয়েছে?"
-"হ্যা।"
-"হায়রে! বুড়া হয়ে গেলাম। কেন তুমি আমাকে মনে করিয়ে দিলে যে এটা আমার ৩৪ তম বার্থডে?"
-"চিন্তা করোনা তুমি স্টিল অনেক ইয়াং আর হ্যান্ডসাম আছো।"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"বাই দ্যা ওয়ে, ওদের হাতে বিরিয়ানির প্যাকেট দেখলাম। তুমি কিনে দিয়েছো?"
-"হ্যা।"
-"আমি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে! আমি খাওয়াতাম।"
-"তোমার ইচ্ছে হলে তুমি খাওয়াও গিয়ে, আমি ধরে রেখেছি নাকি? পথশিশুদের তো অভাব নেই। আমি অনেক কষ্টে ওদের জোগাড় করেছি, আমি প্ল্যান করেছি, আমি খাইয়েছি, তাতে তোমার কি?"
-"তাও ঠিক।"
-"থ্যাংকস ফর দ্যা সারপ্রাইজ।"
-"আমার সারপ্রাইজ তুমি নষ্ট করেছো আজ অফিসে না গিয়ে।"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"আচ্ছা, সরি।"
-"কিন্তু তোমাকে নীল পাঞ্জাবিতে দেখে আমিও সারপ্রাইজড হয়েছি।"
-"ওটা তো আমিও হয়েছি। তুমি নীল পড়ে আসেছো ভাবিওনি।"
তিতির হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-"কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? চলো কোথাও যাওয়া যাক।"
গাড়িতে উঠেই মুগ্ধ বলল,
-"কোথায় যাবে?"
-"তুমি কতক্ষণ টাইম দিতে পারবে? আফটার অল টুডে ইউ আর দ্যা বার্থডে বয়। আজ সবাইকে টাইম দিতে হবে তোমার।"
-"রাতে বাসায় টাইম দিতে হবে। সারাদিন, সারা সন্ধ্যা ফ্রি।"
-"তাহলে পদ্মার পাড়ে যাব। নৌকায় চড়বো, পদ্মার ইলিশ আর শুকনো মরিচ ভাজা দিয়ে ভাত খাব।"
-"ইটস আ গ্রেট আইডিয়া কিন্তু নৌকায় চড়বে? ওদিকের নদীতে অনেক গ্যাঞ্জাম। ভাল লাগবে কি?"
-"যেদিকে গ্যাঞ্জাম নেই সেদিকে নিয়ে যাবে।"
-"আচ্ছা। কিন্তু তার আগে পেটে কিছু দিতে হবে। কিচ্ছু খাইনি। ঘুম থেকে উঠেই আসলাম। তুমি ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়েছো তো?"
-"হ্যা।"
একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামিয়ে মুগ্ধ বলল,
-"ভাল করেছো। কিন্তু আমার সাথে আবার খেতে হবে চলো।"
-"না না। আমি খাব না, আর তুমি খাবার নিয়ে গাড়িতে চলে আসো। রেস্টুরেন্টে যেতে ইচ্ছে করছে না।"
-"আহ, আচ্ছা ঠিকাছে।"
মুগ্ধ দুজনের জন্যই খাবার পার্সেল করে নিল। তারপর গাড়িতে উঠেই আরেকটা সারপ্রাইজ পেল। ওর প্রিয় রেড ভেলভেট চিজ কেক নিয়ে বসে আছে তিতির। মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-"রেড ভেলভেট চিজ কেক! ওহ মাই গড। কোথায় পেয়েছো? বানিয়েছো নাকি?"
-"হ্যা।"
-"মানে কি কিভাবে বানিয়েছো?"
-"যেভাবে বানায় সেভাবেই বানিয়েছি।"
-"সেটা তো বুঝলাম কিন্তু বাসায় কেউ দেখেনি? কি বলেছো?"
-"অনেক ভোরে সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগে বানিয়েছি।"
-"সত্যি তিতির, এরকম সিচুয়েশনে আমার খুব বেশি আফসোস লাগে তোমাকে সারাজীবনের জন্য পাবনা বলে। তুমি সবার থেকে আলাদা তিতির। তুমি অনেক লক্ষী, অনেক পাগলী। এই শীতের মধ্যে ভোর রাতে উঠে কয়টা মেয়ে পারে এসব করতে? পাগল না হলে পারা যায় না।"
খুশি মুগ্ধর চোখমুখে ঝিলিক দিচ্ছিল। তিতির বলল,
-"ভালবাসলেই পারা যায়। এখন কি একটু খেয়ে দেখবে কেমন হয়েছে?"
-"হ্যা অবশ্যই।"
হঠাৎ মনে পড়তেই তিতির বলে উঠলো,
-"হায় হায়। আমি তো ছুরি আনিনি। এখন কি হবে? কাটবে কিভাবে?"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"নো প্রব্লেম। তুমি আছো না?"
একথা বলেই মুগ্ধ তিতিরের হাতটা টেনে নিয়ে তিতিরের আঙুল দিয়ে কেকটা কাটলো। যদিও কেকটা ছড়িয়ে গেল। কাটার বদলে ভাঙা হলো। তবুও ব্যাপারটা তিতিরের এত ভাল লাগলো যা বলার মত না। তিতির মুগ্ধকে কেক খাইয়ে দিল। মুগ্ধও তিতিরকে খাইয়ে দিল। মুগ্ধ কেক খেতে খেতে বলল,
-"উম্মম্মম্মম্মম্ম... বেস্ট রেড ভেলভেট চিজ কেক এভার।"
একবারেই মুগ্ধ অর্ধেকটা কেক খেয়ে ফেলল। তিতিরের তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ও জানতো, মুগ্ধ এমনই করবে। এই কেকটা মুগ্ধর খুব প্রিয়। কোন রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে পেস্ট্রি থাকলেই ও খুঁজত রেড ভেলভেট চিজ কেক আছে কিনা। ভোর রাতে উঠে চোরের মত আতঙ্ক নিয়ে কেক বানানোটা সার্থক।
দুপুরবেলা মাওয়া ঘাটে গিয়ে একটা স্পিডবোট রিজার্ভ করলো মুগ্ধ। উঠতে উঠতে বলল,
-"তিতির, আমরা ওপাড়ে গিয়ে ভাত খাব। এপাড়ে গ্যাঞ্জাম বেশি।"
-"আচ্ছা।"
স্পীডবোট চলতে শুরু করলে তিতির অকারনেই বারবার হাসছিল। ভাল লাগছিল মুগ্ধর। ২০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল ওপাড়ে। ওপাড়ে গিয়েই ইলিশ মাছ ভাজা, শুকনো মরিচ ভাজা আর ভর্তা দিয়ে ভাত খেল ওরা। তারপর একটা ভ্যান ভাড়া করে গ্রামের ভেতর দিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরলো। তারপর কিছুক্ষণ নৌকায়ও ঘুরলো। অনেক অনেক গল্প করলো ওরা কিন্তু খুব স্বাভাবিক সব গল্প। যেন ওদের সম্পর্ক স্বাভাবিক। যেন অনেকদিন পর দেখা হয়নি ওদের, প্রায়ই দেখা হয়।
ওপাড় থেকে ফিরতে ফিরতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। এখন তো ৫ টার সময়ই সন্ধ্যা হয়ে যায়। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে কিছুদূর যেতেই জ্যামে পড়লো। মুগ্ধ বলল,
-"তোমার বাসায় ফিরতে হবে কখন?"
-"দেরী হলেও প্রব্লেম নেই। বাসায় বলেছি আজ অফিসের পিকনিক।"
-"আচ্ছা। কি দুষ্টু মেয়ে রে বাবা।
তিতির হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-"কিন্তু এই জ্যাম ছাড়তে তো মনে হচ্ছে অনেক দেরী লাগবে।"
আরো কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ গাড়ি ঘুড়িয়ে গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে যেতে লাগলো।
-"গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছো কেন?"
-"মেইনরোডের যে অবস্থা দেখলাম রাত ১০/১১ টায়ও পৌঁছতে পারবো না। ৮/৯ টার দিকে আবার পিউরা আসবে। আমি বাসায় না থাকলে কেমন দেখায় না?"
-"হ্যা তা তো ঠিকই। কিন্তু তুমি এসব রাস্তা চেন তো?"
-"হ্যা, আগে সাইক্লিং করতাম না? এখানে অসংখ্যবার এসেছি।"
-"ও।"
এরপর হঠাৎ মনে পড়ায় মুগ্ধ বলল,
-"ওহো ভাল কথা তিতির, খুব ভাল একটা খবর আছে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম তোমাকে বলতে।"
-"কি কথা?"
-"পিউয়ের বেবি হবে।"
-"ওয়াও। এই কথাটা তুমি আজ আমাকে বলছ?"
-"আরে আমাকে বলেনি তো এতদিন। পিউ অনেকদিন আসেনা তাই মাকে জিজ্ঞেস করলাম পিউ আসেনা কেন? তখন মা বলল পিউ অসুস্থ, চিন্তা করো তখনো বলছিল না। পরে আমি তো টেনশানে পড়ে গিয়েছিলাম যে কি হলো আবার। তখন মা আমার অস্থিরতা দেখে বলল।"
তিতির বলল,
-"এসব কথা কাউকে বলতে হয়না। যত কম মানুষ জানবে তত ভাল।"
-"বাহ রে তা বলে আমিও জানবো না?"
-"পিউ বোধহয় লজ্জায় বলতে পারেনি।"
-"আরে বাবা লজ্জা কিসের? এটা তো ন্যাচারাল ব্যাপার।"
-"তুমি বুঝবে না।"
-"ইশ এমনভাবে বলছো যেন তোমার কতবার বেবি হয়েছে!"
তিতিরের মন খারাপ হয়ে গেল। সেদিন যদি ওদের বিয়ে হতো। প্ল্যানমতো আজ তিতিরেরও বেবি হতো। মুগ্ধ ব্যাপারটা খেয়াল করলো। ধ্যাত, কি বলতে কি বললো! মজা করতে গিয়ে কষ্ট দিয়ে ফেলল। এখন সরি বলা মানে খুঁচিয়ে ঘা বাড়ানো। অন্যভাবে তিতিরের মনটা ভাল করে দিতে হবে। কি বলা যায় ভাবতে লাগলো।
তিতির অন্যমনস্ক হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধ বলল,
-"আজ ড্রাইভ করতে ভাল লাগছে না।"
-"কেন?"
-"তোমাকে দেখতে পারছি না যে তাই।"
তিতির হেসে বলল,
-"সারাদিন তো দেখলে!"
-"আজ তোমাকে এতই সুন্দর লাগছে যে সারাদিন দেখেও আশ মেটেনি।"
-"সিলেটের সেই রাতের থেকেও বেশি সুন্দর?"
মুগ্ধ আচমকা ব্রেক করলো। সিটবেল্ট বেধে না রাখলে এক্ষুনি মাথায় ব্যাথা পেত তিতির। মুগ্ধ গাড়ি থামিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তিতিরের দিকে। তিতির লজ্জায় ব্লাশ করছিল, খুব ভালও লাগছে বোধহয় ওর। মেয়েরা বোধহয় এমনই, প্রিয় মানুষের এটেনশান পেলে খুশিতে ফুটতে থাকে। তিতির বলল,
-"এখানে গাড়ি থামালে কেন? কেমন জঙ্গল জঙ্গল! আমার ভয় করছে।"
মুগ্ধ বলল,
-"জঙ্গল না এটা একটা গ্রাম। আশেপাশে বাড়িঘর নেই এই যা।"
-"যাই হোক, একটু ভুতুরে টাইপ। চালাও তো। গাড়ি চললে ভয় করে না। না চললে মনে হয় এক্ষুনি গ্লাস ভেঙে ভুত ঢুকে পড়বে।"
-"তুমি মোটেও ভয় পাচ্ছো না তিতির, ভাব ধরো না। তুমি ভয় পাবার মত মেয়ে না। আর যা খুশি তা হোক কিন্তু আগে বলো, তুমি এটা কি বললে? কি মনে করালে?"
-"কই কিছু না তো।"
-"তুমি আসলে বুচ্ছো খুব দুষ্টু একটা মেয়ে। দেখলে মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতে জানো না। আসলে তলে তলে বহুত..."
-"কি? থামলে কেন? বলো.."
-"বলছি।"
একথা বলেই মুগ্ধ গাড়ির লাইটটা বন্ধ করে তিতিরের কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে আনলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। তিতির নিচু স্বরে বলল,
-"লাইট জ্বালাও ভয় করছে।"
অন্ধকারের যে নিজস্ব একটা আলো আছে সেই আলোতেই মুগ্ধ দেখলো তিতির তাকিয়ে আছে ওর চোখের দিকে। মুগ্ধর দৃষ্টিও তিতিরের চোখে। দুজন দুজনের খুব কাছে, একজনের নিঃশ্বাস আরেকজনের নিঃশ্বাসের সাথে মিশে যাচ্ছে। তিতির মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলো, মুগ্ধ যেন এটুকু কাছে এসে সরে না যায়। ওর বিবেক যেন এতটা নিষ্ঠুর আজ না হয়। এতদিনের অপূর্ণতা যেন একবার হলেও ভরিয়ে দেয় ও। মুগ্ধর দৃষ্টিটা চোখ থেকে নেমে তিতিরের ঠোঁটে চলে গেল। তিতির চোখ বন্ধ করলো। মুগ্ধ তিতিরের ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তিতির ভেসে গেল।
এলিফ্যান্ট রোড দিয়ে বের হয়ে ধানমন্ডি ৩ নাম্বার দিয়ে ঢুকলো মুগ্ধ। তিতির বলল,
-"আমাকে ৮ নাম্বারে নামিয়ে দিও। ওখান থেকে রিক্সা নিয়ে নেব।"
-"আচ্ছা।"
৮ নাম্বারে গিয়ে গাড়ি থামালো মুগ্ধ। তিতির বলল,
-"আজকে তোমার বার্থডে সেলিব্রেট করার জন্যই আমি দেখা করেছি। কাল থেকে আবার সবকিছু আগের মত হয়ে যাবে।"
মুগ্ধ একটা প্লাস্টিক হাসি দিয়ে বলল,
-"হুম, আমি জানি। কিন্তু আর এভাবে এসোনা তিতির। এবছরই তো তোমার বিয়ে! তারপর এরকম হুটহাট দেখা আর হবে না আমাদের। এখন থেকে অভ্যাস করাই ভাল। তুমি এখন একজনের বাগদত্তা। তবু কাছে এসেছ যখন মনে হয়েছে তুমি আমারই। তাই কাছে না আসাটাই ভাল।"
তিতিরের চোখে পানি এল। কিন্তু মুগ্ধর সামনে ও ভুলেও কাঁদবে না, আজকের দিনে তো নয়ই। হেসে বলল,
-"আচ্ছা ঠিকাছে। ভাল থেকো।"
-"হুম, টেক কেয়ার অফ ইওরসেল্ফ। চলো তোমাকে রিক্সা ঠিক করে দিচ্ছি।"
তিতির হাত ধরে থামালো মুগ্ধকে। বলল,
-"দাঁড়াও, একটু পর।"
-"কি?"
তিতির হেসে মুগ্ধর গালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
-"হ্যাপি বার্থডে এগেইন।"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"আই লাভ ইউ মাই রসগোল্লা।"
তিতির একটু মোটা হবার পর থেকে মুগ্ধ মাঝে মাঝে ওকে রসগোল্লা বলে ডাকতো। অনেকদিন পর ডাকটা আবার শুনে ভাল লাগলো তিতিরের। হেসে বলল,
-"আই লাভ ইউ টু।"
To be continued...
প্রেমাতাল - পর্ব ৫৫
মৌরি মরিয়ম
মুগ্ধ বাসায় ফিরতেই দেখলো পিউরা মাত্রই এসেছে, যাক বেশি দেরী হয়নি তাহলে। সবার সাথে গল্পগুজব, হইচই, খাওয়াদাওয়ার পর রাত ১২ টার দিকে পিউরা চলে গেল। মুগ্ধ নিজের ঘরে গিয়ে শুয়েছে কেবল। এমনসময় মা এসে দরজায় নক করলো,
-"ঘুমিয়ে পড়েছিস বাবা?"
-"না, মা.. খুলছি দাঁড়াও।"
দরজা খুলতেই মা বলল,
-"ঢুকবো না, একটা কথা বলতে এসেছি। ভুলে গিয়েছিলাম।"
-"হ্যা বলো।"
-"মুগ্ধ, তোর একটা পার্সেল এসেছে।"
-"কোত্থেকে এসেছে? কে পাঠইয়েছে?"
-"মতিঝিল থেকে পাঠিয়েছে কিন্তু কে পাঠিয়েছে তা তো লেখা নেই। হয়তো তোর বার্থডের জন্য কেউ গিফট পাঠিয়েছে।"
-"কে আবার গিফট পাঠাবে! যাই হোক, কোথায় সেটা?"
-"তোর আলমারিতে ডান পাশের লকারে রেখেছি।"
-"আচ্ছা, ঠিকাছে।"
মা চলে যেতেই আলমারি খুলে জিনিসটা বের করলো মুগ্ধ।
বেশ বড় একটা বক্স র্যাপিং করা। কে পাঠালো! তিতিরের অফিস মতিঝিলে কিন্তু তিতিরের সাথে তো দেখাই হলো! ও দিলে তো হাতে হাতেই দিতে পারতো। তমালের বাসা মতিঝিল, মানে আরামবাগ আর কি! ও কি পাঠালো? যাই হোক খুললেই বোঝা যাবে। র্যাপিং খুলতেই একটা বড় কাগজের বক্স দেখতে পেল মুগ্ধ। বক্সটা খুলতেই দেখলো একটা হালকা আকাশী রঙের ফরমাল শার্ট, একটা নেভি ব্লু টাই, মুগ্ধর প্রিয় ব্র্যান্ডের একটা পারফিউম, একটা সানগ্লাস আর একটা কালো ডায়েরি। এ কাজ তিতির ছাড়া আর কারো নয়। সবার আগে ডায়েরিটা হাতে নিল। ডায়েরি হাতে নিতেই একটা চারভাজ করা কাগজ পড়লো নিচে। কাগজের উপরে লেখা "Open me first" তিতিরের হাতের লেখা। নিজের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো ওর। ডায়েরিটা রেখে কাগজটা খুলল। ইয়া বড় একটা কাগজে মাত্র দু'লাইন লেখা,
"পন্ডিতি করে আবার ডায়েরির শেষের পাতাগুলো আগে পড়োনা প্লিজ। প্রথম পাতা থেকে পড়া শুরু করো, সিরিয়ালি পড়বে।"
মুগ্ধ গিফটগুলোকে বিছানার একপাশে রেখে ডায়েরিটা নিয়ে শুয়ে পড়লো। আরাম করে পড়বে। ডায়েরিটা খুলতেই প্রথম পাতায় দেখলো একদম পুরোনো দিনের মত স্টাইল করে লেখা চিঠি। পড়তে শুরু করলো মুগ্ধ,
এই,
তোমাকে কোনদিনও নাম ধরে ডাকিনি। কখনো তোমাকে নাম ধরে ডাকার ইচ্ছেও করেনি, চেষ্টাও করিনি। তাই চিঠিতেও নাম সম্বোধন করলাম না।
এটা পেয়ে কি ভাবছো রঙঢঙ করে চিঠি লিখছি কেন? কেন জানি ইচ্ছে হলো লিখতে।
তুমি এমন একটা সময়ে আমার জীবনে এসেছিলে যখন আমি প্রেম বুঝতাম কিন্তু জানতাম না ভালবাসা কি? তুমি এসে ভালবাসার সাথে পরিচয় করালে। এমনভাবে, বোঝালে দেখালে ভাল কত রকম ভাবে বাসা যায়। আমি নিজের অবচেতন মনেই সবকিছু তোমার মত করে ভাবতে শুরু করি। তোমার আইডিওলজি গুলো ফলো করতে শুরু করি। আমার মনে হয় তুমি যেটা করো সেটাই ঠিক, মনে হয় একটা আদর্শ পুরুষ হতে হলে তোমার মত হতে হবে। সুহাস খুব ভাল ছেলে কিন্তু তোমার মত নয়। ও খুব ভদ্র, কখনো দুষ্ট কথা বলে না। কিন্তু আমার মনে হয় পুরুষ মানুষদের দুষ্টুই হওয়া উচিৎ।
ও আমার সাথে লাঞ্চ করতে আসে প্রায়ই, বলে আসেনা সারপ্রাইজ দিতে চায়। কিন্তু যদি আমি অলরেডি লাঞ্চ করে ফেলি ও মন খারাপ করে আর খায়না। তুমি হলে বলতে,"খেয়েছো ভাল করেছো। এখন আমার সাথে আবার খাবে।" পুরুষ মানুষদের তো এমনই হওয়া উচিৎ তাইনা বলো?
সুহাস ঠিক তোমার মত করেই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে মাঝে মাঝে। সেটা বুঝতে পেরে যদি আমি ওর দিকে তাকাই ও চোখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু তুমি তো তাকিয়ে থাকতে, তোমার ওই দৃষ্টি দিয়ে মেরে ফেলতে আমাকে। আর কেউ পারবে না আমাকে তোমার মত করে মারতে। এ মরণ সুখের মরণ। আমি আর কোনদিনও এভাবে মরতে পারবো না। তবু আমি সুহাসকেই বিয়ে করতে চলেছি। আমি জানি আমাকে ছাড়া থাকতে তোমার কতটা কষ্ট হয়। কত স্বপ্ন দেখেছিলে তুমি আমাকে নিয়ে। আর আমি? তোমার স্বপ্নগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়ে চলে আসি। আমার আর কোন উপায় নেই। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার অসহায় লাগে। জানো, বাবা সারাদিন বাসায় থাকে। সামনের মসজিদে নামাজ পড়তে যায় শুধু। নামাজ পড়ে এসেই হাপাতে থাকে। তিনবেলা মুঠো ভরতি করে ওষুধ খায়। আমি এই দৃশ্য সহ্য করতে পারি না। আমার বাবা আর কোনদিনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে না এটা আমি মানতেই পারিনা। আবার তোমাকে ছাড়া সারাটা জীবন অন্য একজনের সাথে সংসার করতে হবে এটাও ভাবতে পারি না। যাই হোক, পারলে আমাকে ক্ষমা করো, তোমার ভালবাসার মান রাখতে পারিনি আমি। অথচ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সব মুহূর্তগুলো তোমার দেয়া। কি জানো? নীলগিরিতে পাহাড় দেখানো, পথে ডাকাতদের হাত থেকে বুকে আগলে আমাকে বাঁচানো, থানচিতে আমার কানে কাজলের কালি লাগিয়ে দেয়া, কথায় কথায় আমাকে গান শোনানো, রেমাক্রি ফলসে আমার পাগলামিগুলো হাসিমুখে সহ্য করা, রেমাক্রিতে আমাকে মেঘ ছোঁয়ানো, নফাখুমের পথে হুট করে সবার মধ্যে থেকে আমাকে কোলে তুলে নেয়া, নাফাখুম জলপ্রপাতের পানিতে আমাকে নিয়ে ভাসা, তোমার সাথে চিটাগাং যাওয়া, বান্দরবানের সেই রাত! তোমার আমার প্রথম চুমু, একসাথে মহুয়া খাওয়া, টিওবির প্রত্যেকটা ট্যুরে দুজনের একসাথে যাওয়া পাগলামি করা, আমার প্রত্যেকটা জন্মদিনকে স্পেশাল করা, বিছনাকান্দির পানিতে তোমার বুকের উপর আমার ভেসে বেড়ানো! এই সবকিছু! স্পেশালি সিলেটের সেই রাত। আমার সারাটা শরীর মন সেদিন চাইছিল তোমাকে, আমি লজ্জায় বলতে পারিনি। যতটুকু পেয়েছি তাও অবশ্য কম না। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কিন্তু খুব সুন্দর করে আদর করো। আরো কতরকম পাগলামি ভরা আদর তুমি করতে পারো জানার ইচ্ছে ছিল। ভাগ্যে হলো না। এসব নিয়ে সরাসরি কখনো আলোচনা করোনা প্লিজ, খুব লজ্জা পাব।
ভাল থেকো।
-তোমার রসগোল্লা তিতিরপাখি।
চিঠি শেষ। পৃষ্ঠা ওলটালো মুগ্ধ। ওদের বান্দরবান যাওয়ার টিকেট, সিলেট আর বান্দরবানের হোটেলের ভাউচার স্কচটেপ দিয়ে ডায়েরিতে আটকানো। এখন বুঝতে পারলো তিতির কেন ওগুলো নিয়ে যেত। আরো কয়েকটা পৃষ্ঠা ওলটাতেই ডায়েরিতে একটা খাম আটকানো দেখলো। খামের উপর লেখা "Miss me? open it" খামটা খুলতেই টিস্যুতে পেঁচানো একটা শক্ত, মোটা কাগজ পেল। টিস্যু সরাতেই দেখলো কাগজে অসংখ্য ঠোঁটের ছাপ। এ ঠোঁট মুগ্ধর চিরচেনা। তিতির ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে কাগজে ছাপ দিয়েছে। মুগ্ধ ঠোঁটের ছাপগুলোর উপর হাত বুলিয়ে নিল। তারপর কাগজটাতে চুমু দিল। ওর চোখ ভরে উঠেছে জলে।
চার মাস পর বেলা ১১ টার দিকে মুগ্ধর ফোন এল তিতিরের কাছে। তিতির একটু অবাক হলো মুগ্ধ ফোন করলে রাতে করে, অফিসে থাকতে কখনোই ফোন করে না। কোন অঘটন কি ঘটলো? তিতিরের বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। ফোন ধরে বলল,
-"হ্যালো.."
-"তিতির?"
-"হ্যা।"
-"কেমন আছো?"
মুগ্ধর কন্ঠটা একটু অন্যরকম লাগলো। কি হয়েছে কে জানে! বলল,
-"ভাল, তুমি কেমন আছো?"
-"অনেক ভাল, আরো ভাল থাকার ব্যবস্থা করছি।"
-"কি?"
-"আমি বিয়ে করছি, ইকরাকে।"
তিতিরের মনে হলো ওর বুকের মধ্যে কেউ ১০০ ছুরির কোপ বসিয়েছে। মুগ্ধ ইকরাকে বিয়ে করছে কেন? দুনিয়াতে কি মেয়ের অভাব? স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
-"ও, কংগ্রাচুলেশনস! কবে বিয়ে?"
-"এই শুক্রবার।"
-"তাহলে তো আর ৪ দিন পরই।"
-"হ্যা।"
-"এত তাড়াতাড়ি সব এরেঞ্জমেন্ট কি করে করবে?"
-"কোন এরেঞ্জমেন্ট নেই। আমরা ইকরাদের বাসায় যাব, কাজী আসবে বিয়ে পড়াবে শেষ। ইকরাকে নিয়ে চলে আসব। কোন অনুষ্ঠান হবে না, কেউ ইনভাইটেড থাকবে না, শুধু ফুপীরা আর আমরা।"
-"ওহ, এটাও ভাল।"
-"ঠিকাছে তিতির রাখছি, আমি অফিসে তো।"
-"আচ্ছা।"
মুগ্ধ ফোনটা রেখে দিল। তিতিরের নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিল, কি এমন হয়েছে যে এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হচ্ছে মুগ্ধর? আর যে ইকরাকে ও সহ্যই করতে পারেনা সেই ইকরাকেই বিয়ে করছে! ভাবতে থাকলো তিতির, কিন্তু কোন কূলকিনারা পেল না।
ফোনটা এল দুপুরবেলা। মুগ্ধর মায়ের নাম্বার দেখে তিতিরের বুক কেঁপে উঠলো। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল,
-"হ্যালো তিতির?"
-"জ্বী আন্টি। আসসালামু ওয়ালাইকুম।"
-"ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো মা?"
-"ভাল, আন্টি আপনি ভাল আছেন?"
-"আছি বাবা, ভালই আছি। তোমার সাথে একটু কথা ছিল।"
-"হ্যা আন্টি বলুন।"
-"মুগ্ধ তোমাকে আজ ফোন করেছিল?"
-"হ্যা করেছিল।"
-"তাহলে তো জানোই বোধহয় বিয়ের ব্যাপারটা।"
নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে তিতির বলল,
-"ও বলেছে আমাকে।"
-"এই শুক্রবারই ওদের বিয়েটা ঠিক করেছি। মাগো তোমার কাছে আমার একটা রিকোয়েস্ট.. যেহেতু তুমি মুগ্ধকে বিয়ে করতে পারবে না, তুমি ওর জীবন থেকে পার্মানেন্টলি সরে যাও।"
-"আন্টি ওর সাথে এখন আর আমার সম্পর্ক নেই।"
-"জানি মা, কিন্তু এর মধ্যে ও হয়তো তোমার সাথে দেখা করতে চাইতে পারে। তুমি দেখা করোনা মা। অনেক কষ্টে, অনেক কিছুর পর আমি ওকে এই বিয়েতে রাজী করাতে পেরেছি। প্লিজ এখন তুমি এমন কিছু করোনা বা এমন কিছু বলোনা যাতে আবার মুগ্ধ ডিসিশন চেঞ্জ করে ফেলে। এভাবে তো চলতে পারেনা, তাইনা? আমি আজ আছি কাল নেই। আমি মরার পর কে দেখবে ওকে? এভাবে একা একা সারাজীবন কাটাবে এটা আমি মা হয়ে কিভাবে সহ্য করি বলো? ইকরা ওকে পাগলের মত ভালবাসে, সেই ছোটবেলা থেকে। তুমি মুগ্ধর সাথে থাকলে আমি যতটা নিশ্চিন্ত থাকতাম, ইকরা ওর সাথে থাকলেও আমি ঠিক ততটাই নিশ্চিন্ত থাকব।"
-"আমি ওদের বিয়েতে বাধা দেবনা আন্টি। আমিও চাই মুগ্ধর একাকিত্ব ঘুচুক।"
-"লক্ষী মা আমার। নিশ্চিন্ত করলে আমাকে। ঠিকাছে রাখছি।"
ফোন রেখে তিতির কান্নায় ভেঙে পড়লো।
To be continued...
প্রেমাতাল - পর্ব ৫৭ এবং শেষপর্ব
মৌরি মরিয়ম
ড্রইং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে তিতির দেখলো বাবা খবরের কাগজ পড়ছে। তিতির বাবার সামনে গিয়ে ফ্লোরে বসলো। বাবা কাগজ থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,
-"কিছু বলবি মা?"
তিতির কখনো এভাবে একা বাবার সামনে বসে সরাসরি মুগ্ধর ব্যাপারে কথা বলেনি। কিভাবে বলবে? লজ্জা লাগছে, আর ভয়ও করছে। ডাক্তার বলেছিল বাবাকে সাবধানে রাখতে হবে। ওনার হার্ট অনেক দূর্বল। ওর অনেক আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝেই বাবা ওর দিকে তাকালো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-"কি হয়েছে তোর? এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?"
তিতির অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে অবশেষে বলেই ফেলল,
-"বাবা, আজকে মুগ্ধর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।"
বাবা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়ের দিকে। বাবা কিছু বলার আগেই তিতির কেঁদে ফেলল। বলল,
-"বাবা, প্লিজ কিছু একটা করো। আজও তোমরা মেনে নিলে ও বিয়েটা করবে না। শুধু আমাকে পাবার মিথ্যে আশায় ও এতবছর অপেক্ষা করেছে। কিন্তু এখন ওর মায়ের চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে বিয়েটা করতে রাজী হয়েছে। আমি ও ছাড়া আর কারো সাথে সুখী হবো না বাবা। ওর কিছু দিক হয়তো খারাপ কিন্তু অনেক দিক দিয়েই আবার ভাল। সব মানুষ তো সব দিক দিয়ে ভাল হয়না বাবা। খারাপ-ভাল মিলিয়েই তো মানুষ। ও খারাপ হোক কি ভাল ও ম্যজিক জানে বাবা। যতদিন আমার ওর সাথে সম্পর্ক ছিল ও সেই ম্যাজিক দিয়েই আমাকে ভাল রেখেছে। আজ পর্যন্ত কোনদিন ও আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি।"
বাবা চুপ। তিতির কাঁদতে কাঁদতেই আবার বলল,
-"ওর অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়ে গেলে আমি সহ্য করতে পারবো না বাবা। মাকে আমি সকালবেলাই বলেছিলাম। মা বুঝলোই না। তোমরা আমাকে বোঝ না কেন বাবা? আমার যে খুব কষ্ট হয় বাবা। ও ছাড়া আমার জীবনটা অন্ধকার। বাবা প্লিজ কিছু একটা করো। ছোটবেলা থেকে কোনদিন তোমার অবাধ্য হইনি বাবা, আজও পারবো না। তুমিই কিছু করো বাবা প্লিজ প্লিজ প্লিজ। তুমি আমাকে পারমিশন দাও ওর কাছে যাওয়ার। দুনিয়ার আর কারোর পারমিশনের দরকার নেই আমার।"
তিতির বাবার পা জড়িয়ে ধরলো। বাবা তিয়িরকে উঠিয়ে পাশে বসিয়ে বলল,
-"দেখ মা, আমি বুঝতে পারছি কিন্তু ব্যাপারটা এতই ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে যে তোর সাথে মুগ্ধর সম্পর্কটা আর সম্ভবই না। তান্নার সাথে মুগ্ধর যেটা হয়েছে সে ইস্যুটা ছোট ছিল কিন্তু খুব খারাপ একটা ইন্সিডেন্ট ছিল। ওরা কখনোই স্বাভাবিক আচরণ করতে পারবে না। অনেকবার ভেবেছি তোর মুখ চেয়ে মেনে নেব কিন্তু তোর মা এবং আমিও মুগ্ধকে মন থেকে মানতে পারি না। বিয়ে তো শুধু দুটো মানুষের না। দুটো ফ্যামিলিরও। এই বিয়ে নামক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়েই দুটি অপরিচিত ফ্যামিলি ঘনিষ্ঠ হয়। মুগ্ধর সাথে বিয়ে হলে তোর সাথে আমাদের দূরত্ব বাড়তে থাকবে। কারন, আমাদের দুই ফ্যামিলির ঘনিষ্ঠ হওয়াটা অসম্ভব। সুহাস অনেক ভাল ছেলে মা, আর তোকে খুব ভালওবাসে। তুই সুখী হবি দেখিস, ও তোকে এত সুখে রাখবে যে আজকের কথা ভেবে তুই তখন হাসবি আর ভাববি কত ছেলেমানুষিই না করেছি! সময় সব ঠিক করে দেয় মা। সব ঠিক হয়ে যাবে।"
তিতির শেষ আশাটাও ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে থাকলো।
ভাবী ড্রইং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,
-"বাবা আসব?"
-"আমরা একটু ইম্পরট্যান্ট কথা বলছি। তুমি পরে আসো মা।"
-"বাবা আমার মুগ্ধ ভাইয়া আর তিতিরের ব্যাপারেই কিছু বলার ছিল।"
বাবা, তিতির দুজনেই চমকে তাকালো। বাবা বলল,
-"এসো।"
ভাবী বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-"বাবা এতদিন আমি ভয়ে চুপ করে ছিলাম, কিন্তু আজও যদি চুপ করে থাকি তাহলে তো আমি মানুষের কাতারেই পড়বো না।"
বাবা বলল,
-"কি বলতে চাচ্ছো বলো।"
-"বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে আপনি, মা আর তিতির কখনো আমাকে বুঝতে দেননি আমি শ্বশুরবাড়িতে আছি। আপনাদের আদরে আদরে এতটা বছর কাটিয়েছি, যথেষ্ঠ শ্রদ্ধাও করি আপনাদেরকে। সেই শ্রদ্ধা বজায় রেখেই কথাগুলো বলছি, বেয়াদবি হলে ক্ষমা করবেন।"
-"আহা বলবে তো কি কথা?"
-"তিতিরের যায়গায় যদি আমি থাকতাম তাহলে ফ্যামিলিকে রাজী করানোর জন্য আমি আরো অনেক আগেই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতাম, সুইসাইড এটেম্পট নিতাম নাহলে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলতাম। শুধু আমি না বাবা, আজকালকার যেকোন মেয়ে হলে এটাই করতো। কিন্তু বাবা তিতির এসব লেইম উপায় বেছে নেয়নি। কেন জানেন? ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে আপনারা কষ্ট পেতেন। সুইসাইড এটেম্পট নিলে আরো বেশি কষ্ট পেতেন, সাথে মুগ্ধ ভাইয়াও কষ্ট পেত। তাই ও এসব না করে নিজে শত কষ্ট সহ্য করে ৩/৪ বছর ধরে শুধু আপনাদেরকে রাজী করানোর চেষ্টাই করছে। হ্যা, একবার চলে গিয়েছিল, অন্য কোন মেয়ে হলে আরো অনেক আগে যেত। তারপরও সেটা তো পালিয়ে যাওয়া না বাবা। ও বলেই গিয়েছে আর জ্বরের ঘোরে গিয়েছিল। সুস্থ্য থাকলে ও কখনোই যেত না। আপনার অসুস্থতার খবর পেয়ে তো ঠিকই সব ছেড়ে চলে এসেছে। কিন্তু বাবা আপনারা কি একটা বারও গভীর রাতে তিতিরের ঘরে গিয়ে খোঁজ করেছেন মেয়েটা কি করছে? গত ৩/৪ বছর ধরে তো আমি ওকে একটা রাতও ঠিকভাবে ঘুমাতে দেখিনি। রাত ৪/৫ টায় ঘুমিয়েছে আবার ৯ টায় অফিসে গিয়েছে। এসব কিছুই কি এক্টাবারের জন্যও আপনাদের চোখে পড়েনি? জানি বাবা ওর সুখের জন্যই সব করছেন কিন্তু ও তো সুখে নেই বাবা। সব একদিন ঠিক হয়ে যাবে সত্যি, কিন্তু যেটা আজই ঠিক করা যাবে সেটা কোন অজানা একদিনের জন্য কেন ফেলে রাখবেন? জানি তিতির আজও সব মেনে নেবে চুপচাপ। কিন্তু একবার ভাবুন তো বাবা সুহাস ভাইয়ের সাথে বিয়ের দিন যদি ও সুইসাইড করে? কি করবেন মেয়ের লাশটা নিয়ে?"
বাবা চিৎকার করে উঠলো,
-"থামো। আর বলোনা।"
তারপর তিতিরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-"আমার মেয়ে এসব করবে না।"
তিতির কেঁদে চলেছে। ভাবী বলল,
-"হ্যা বাবা, ও এসব করবে না আপনি সেটা জানেন। কারন ও অনেক স্ট্রং একটা মেয়ে। তাই আপনারা ওর ইচ্ছেটা মাটিচাপা দিয়ে আপনাদের ইচ্ছেটাকে ওর উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। কেন বাবা? স্ট্রং মানুষদের কি কষ্ট হয়না? হয় বাবা হয়, দূর্বলদের যতটা কষ্ট হয় স্ট্রং মানুষদেরও ঠিক একই কষ্ট হয়। মানুষ বুঝতে পারে না কারন, দূর্বলরা কষ্টটা দেখাতে পারে.. স্ট্রং রা পারে না। একটু আগে ওর লাশের কথা শুনে আপনি আঁৎকে উঠলেন কিন্তু বাবা ও তো অলরেডি লাশ হয়েই আছে, জীবিত লাশ। সেটা কি আপনাদের চোখে পড়ছে না? আমি প্রথম থেকেই এসব দেখছি বাবা, কিন্তু আপনার ছেলের ভয়ে কিছু বলতে পারিনি।"
-"তিতিরের কষ্টটা আমি বুঝতে পারি মা। ও মুগ্ধকে অন্ধভাবে ভালবাসে কিন্তু মুগ্ধর মধ্যে ভেজাল আছে। ওর এই কষ্ট আমি সহ্য করতেও পারবো কিন্তু সারাজীবনের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না। সারাজীবন আমি থাকবো না তাই ভাল একটা ছেলের সাথে ওর জীবনটা বেধে রেখে যেতে চাই। তাহলে নিশ্চিন্তে মরতে পারবো।"
ভাবী তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে ফুটিয়ে বলল,
-"বাবা, একটা কথা না বলেই আপনাকে আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি বলতেই হচ্ছে। হয়তো আমার ঘর ভাঙবে। কি আছে কপালে কে জানে কিন্তু আজ আমি বলবো। আপনার সোনার টুকরো ছেলেকে আপনি যা দেখেন সে আদৌ তা না। তার অনেকগুলো রূপ আছে বাবা। ফ্রেন্ডদের সাথে তার এক রূপ, আপনাদের সামনে আরেকরূপ, আমার সাথে আবার আরেক রূপ। অনেকগুলো মুখোশ তার, যখন যেটা দরকার চুপটি করে পালটে নেয়। বোঝা যায়না কারন, সবগুলো মুখোশের তো একই চেহারা।"
বাবা গর্জে উঠলো,
-"বৌমা, কি বলছ তুমি এসব?"
-"আমি ঠিক বলছি বাবা। শুরু যখন করেছি সব বলব আজ। আপনার ছেলে যা বলল আপনি বিশ্বাস করে নিলেন। একবার নিজে মুগ্ধ ভাইয়ার ব্যাপারে খোঁজ নিতে কি পারতেন না বাবা? নেননি কারন, আপনার ছেলের উপর আপনার অগাধ বিশ্বাস। আপনার ছেলে আপনার বিশ্বাসের মান রাখেনি। সে মুগ্ধ ভাইয়ার সম্পর্কে যত আজেবাজে কথা এসে বলেছে সব বিশ্বাস করেছেন, তিতিরের কাছেও জানতে চাননি। মুগ্ধ ভাইয়া আপনার ছেলেকে মেরেছে, গালি দিয়েছে.. কিন্তু বাবা আপনার ছেলেকে মুগ্ধ ভাইয়া কেন মারলো? আপনার ছেলে আপনাকে পুরো ঘটনাটা বলেছে নিজের আকামের অংশটা হাইড করে। শুধু শুধু কেউ কাউকে এতটা মারে না বাবা। আপনার ব্যাপারটা তলিয়ে দেখা উচিৎ ছিল। আমি জানি আপনার ছেলে আপনাকে ভাইয়ার ব্যাপারে আরো অনেক কথাই বানিয়ে বলেছে। সেসব কথা তিতিরের সামনে আমি আর বলতে চাচ্ছি না। কিন্তু আপনি তো জানেন বাবা, আপনি যা জানেন তার সব মিথ্যে। ভাবছেন এতকিছু আমি কিভাবে জানি? আপনার ছেলে নিজেই কলার ঝুলিয়ে আমাকে বলেছে, 'দেখেছো বাবা মা আমকে কতটা বিশ্বাস করে? এবার দেখবো শালা মুগ্ধ কিভাবে জেতে।' সে মুগ্ধ ভাইয়াকে নিজের শত্রু ভাবে। নিজের ইগো বাঁচাতে সে মুগ্ধ ভাইয়াকে আপনার কাছে খারাপ করেছে। মুগ্ধ ভাইয়া আজ এত উপরে উঠেছে, এত উন্নতি করেছে এটাও আপনার ছেলের চক্ষুশূল। তিতিরকে বিয়ে করতে পারলে নাকি মুগ্ধ ভাইয়ার কাছে ও হেরে যাবে। কিন্তু বাবা এটা কোন ধরণের একতরফা প্রতিযোগিতায় নেমেছে আপনার ছেলে? এতদিন আমি ভয়ে কিছু বলতে পারিনি বাবা আমার সংসার বাঁচানোর জন্য। আজ আর এই সংসারের প্রতি আমার কোন টান নেই। আপনার ছেলের মত নরপশুর সাথে থাকতে এখন আমার গা ঘিনঘিন করে। কেন নরপশু বললাম জানেন বাবা? কারন আমার তিন তিনটা সন্তান সে পৃথিবীতে আসার আগেই মেরে ফেলেছে। বাবা না হওয়ার পেছনে কি সব অদ্ভুত যুক্তি তার আমি আপনাকে তা বলতেও পারবো না।"
শেষের কথাগুলো বলতে বলতে ভাবী কেঁদে ফেলল। বাবা ভেঙে পড়লেন। বললেন,
-"তুমি আমাকে আগে এসব কেন বলোনি?"
ভাবী বলল,
-"এসব কথা আজ থাক বাবা, যারা শেষ তারা শেষ কিন্তু যে আছে তাকে বাঁচান। প্লিজ বাবা তিতিরকে মুগ্ধ ভাইয়ার সাথে বিয়ে দিন। অনুমতি দিন বাবা ও ফোন করে মুগ্ধ ভাইয়ার বিয়েটা বন্ধ করুক।"
-"কিন্তু ওর তো সুহাসের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। সুহাসের ফ্যামিলি কে কি বলবো এখন?"
-"বাবা সেটা ইম্পরট্যান্ট না। এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে বিয়ে তো আর হয়ে যায়নি। তাছাড়া তিতিরের সুখটা এখন আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্ট। অনেকগুলো ভুল হয়ে গিয়েছে বাবা, আর কোন ভুল হতে দিয়েন না। হাতজোর করছি আমি মুগ্ধ ভাইয়ার সাথে তিতিরের বিয়ে দিন।"
ভাবীর কথা শেষ হতে না হতেই তান্না ঘরে ঢুকলো। শুধু শেষের কথটাই শুনেছে ও। ওইটুকু শুনেই ভাবীর গালে আচমকা একটা চড় মেরে চুলের গোছা ধরে বলল,
-"ঘরের শত্রু বিভীষণ না? আজকে তোর খবর আছে তোর।"
বাবা তান্নাকে বলল,
-"তান্না, ওকে ছাড়ো।"
-"না বাবা, ওর সাহস হয় কি করে আমার বোনের ব্যাপারে কথা বলার?"
-"কে তোমার বোন?"
তান্না অবাক হয়ে বউকে ছেরে বাবার সামনে এসে বলল,
-"কি বলছো বাবা? আর কে তিতির আমার বোন।"
-"নাহ, তিতির তোমার বোন না। তিতির আমার মেয়ে। আর তুমি আজ থেকে আমাকে আর বাবা বলে ডাকবে না।"
তান্না বলল,
-"বাবা! কি হলো তোমার?"
বাবা তান্নার কথার উত্তর না দিয়ে তিতিরকে বলল,
-"মা, তাড়াতাড়ি মুগ্ধকে ফোন করে বিয়েটা আটকা।"
তিতিরের খুশি হওয়ারও সময় নেই। দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে ফোন তুলে কল করলো। একি মুগ্ধর ফোন বন্ধ কেন? আবার ডায়াল করলো, বন্ধ। আবার ডায়াল করলো, এবারও বন্ধ। এভাবে ৫ বার ফোন করেও মুগ্ধকে না পেয়ে তিতির দৌড়ে ড্রইং রুমে গিয়ে কেঁদে ফেলল,
-"বাবা, মুগ্ধর ফোন বন্ধ। প্লিজ তুমি অনুমতি দাও, আমি ওর কাছে যাই। ওর কাজিনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে, ফুপাতো বোন। বিয়ে বাসাতেই হবে। ফুপীর বাসাও আমি চিনি। যাই বাবা?"
-"চল, আমিও যাব।"
তারপর চিৎকার কিরে বলল,
-"চম্পা, কই আছিস আমার পাঞ্জাবি আর ওয়ালেট টা ঘর থেকে নিয়ে আয় তো।"
তান্না বলল,
-"বাবা তুমি এতদূর যাবে? হার্ট এ্যাটাকের পর তো তুমি কোথাও যাও না।"
-"আমার ভুলের মাশুল দিতে আর আমার মেয়ের জীবন বাঁচাতে আজ আমাকে যেতে হবে। আর হ্যা, তুমি ভেবোনা তোমাকে আমি ছেড়ে দেব। তোমার সাথে বোঝাপড়াটা আমি এসে করবো। চল তিতির।"
তান্না বলল,
-"বাবা পাগলামি করোনা। আচ্ছা ঠিকাছে আমি তিতিরকে নিয়ে যাচ্ছি।"
বাবা বলল,
-"আমি তোমাকে বিশ্বাস করিনা।"
চম্পা বাবার পাঞ্জাবি আর ওয়ালেট নিয়ে হাজির। বাবা পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে তিতিরের হাত ধরে মেইন দরজার দিকে গেল। তিতির বলল,
-"বাবা, ভাইয়া ভাবীকে যদি কিছু করে। ভাবীকে নিয়ে চলো।"
বাবা ডাকলো,
-"বৌমা, বৌমা.."
ভাবী এসে বলল,
-"জ্বী বাবা?"
-"তুমি আমাদের সাথে চলো।"
-"আমি যাব! কিন্তু কেন?"
-"আগে চলো। এত কথা বলার সময় নেই এখন।"
ততক্ষণে মা বেড়িয়ে এল ঘর থেকে। বলল,
-"কি ব্যাপার? এত হইচই কিসের? চম্পা পাঞ্জাবি আনলো দেখলাম, কোথায় যাচ্ছো?"
বাবা বলল,
-"ফিরে এসে সব বলব।"
তান্নাও ড্রইং রুম থেকে বেড়িয়ে এল। বলল,
-"বাবা, তুমি যদি ওই হারামজাদার সাথে তিতিরের বিয়ে দাও তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।"
বাবা বলল,
-"আমি ফিরে এসে নিজেই তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেব।"
ট্যাক্সি খুব দ্রুত চলছে। তিতির অনবরত কাঁদছে আর ড্রাইভারকে আরো জোরে চালাতে বলছে। ভয়ে ওর আত্মা শুকিয়ে গিয়েছে। এতকিছুর পর বাবাকে রাজী করাতে পেরেছে এখন যদি যাওয়ার আগেই মুগ্ধ-ইকরার বিয়ে হয়ে যায়? উফফ মরেই যাবে তিতির। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-"বাবা, যদি বিয়ে হয়ে যায়?"
-"কাঁদেনা মা, ও যদি তোর ভাগ্যে থাকে তাহলে বিয়ে হবে না। ধৈর্য ধর, আর আল্লাহকে ডাক। সব ঠিক হয়ে যাবে।"
বাবার চোখেও জল দেখলো তিতির। খুব মায়া হলো বাবার জন্য। এতদিন ভাইয়া এইভাবে বাবাকে ভুল বুঝিয়ে এসেছে! ভাবীও কাঁদছে। তিতির মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো।
ইকরাদের বাসার সামনে গাড়ি থামতেই তিতির দৌড় দিল। বাবা ভাড়া মিটিয়ে পেছন পেছন এল। বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো তিতির। পা দুটো থরথর করে কাঁপছে। কে একজন এসে দরজা খুলে দিল। ভেতরে ঢুকতেই ড্রইং রুমে অনেক লোকজন দেখতে পেল তিতির। এত লোকজনের মধ্যে চেনা মানুষটি ওকে দেখেই চমকে উঠে দাঁড়াল। দূর থেকেই বলে উঠলো,
-"তিতির! তুমি?"
তিতির কোন কথা বলতে পারলো না। মুগ্ধ তিতিরের সামনে এসে দাঁড়াল। তিতির কাঁদতে কাঁদতে কোনরকমে জিজ্ঞেস করলো,
-"বিয়ে কি হয়ে গেছে?"
খুশিতে মুগ্ধর চোখে জল এল। হেসে জবাব দিল,
-"নাহ। কনে এখনো পার্লারে।"
তিতির-মুগ্ধ দুজনেই একসাথে হেসে উঠল। তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-"ফোন বন্ধ কেন? জানো কতবার ফোন করেছি?"
-"ফোন তো রাগের চোটে ভেঙে ফেলেছি।"
ততক্ষণে তিতিরের বাবা আর ভাবীও চলে এল। তিতিরের বাবাকে দেখে মুগ্ধ অবাক হয়ে বলে উঠলো,
-"আঙ্কেল আপনি?"
বাবা বলল,
-"আমি তিতিরকে তোমার হাতে তুলে দিতে এসেছি।"
মুগ্ধ যে কি করে কৃতজ্ঞতা জানাবে বুঝতে পারলো না। মাথা কাজ করছে না এখন।
তিতিরকে দেখতে পেয়ে মুগ্ধর মা কাছে এল। অবাক হয়ে বলল,
-"তিতির তুমি কখন এলে? কি করে এলে? আর একি অবস্থা হয়েছে তোমার চেহারার?"
সাথে সাথেই তিতিরের বাবাকেও দেখতে পেল। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এল,
-"ভাই আপনি এখানে!"
বাবা হাতজোড় করে বললেন,
-"আপা, আমি নিজের ভুলের জন্য লজ্জিত। ছেলের কথা অন্ধভাবে বিশ্বাস করে আমি আমার মেয়েকেও কষ্ট দিয়েছি, আপনার ছেলেকেও। এই ভুলের শাস্তি আমার মেয়েটাকে দিয়েন না। দয়া করে আমার মেয়েকে আপনার ঘরের বউ করে নিন।"
মা হেসে বলল,
-"ছিঃ ছিঃ ভাই কি বলছেন এসব! যা হয়েছে তাতে আমার মনে হয়েছিল আপনারা ওদের সম্পর্কটা কখনোই মানবেন না। তাই আমি ছেলের বিয়ে দিচ্ছিলাম। ও সারাজীবন একা থাকবে এটা মানতে পারছিলাম না। যাই হোক, তিতির যখন এসেছে, তখন তো আর মুগ্ধর সাথে অন্য কারো সাথে বিয়ে দেয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। কিন্তু তার জন্য হয়তো আমার ননদের সাথে আমার সম্পর্ক সারাজীবনের জন্য নষ্ট হবে। হলে হোক, আমার ছেলের সুখ আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্ট।"
ইকরা বউ সেজে এসে এই অবস্থা দেখে অনেক চিল্লাপাল্লা করলো। তাই তিতির-মুগ্ধর বিয়ের বাকীসব কথাবার্তা মুগ্ধদের বাসায় গিয়ে হলো। ঠিক হলো যেহেতু পিউ আর তিতিরের মা উপস্থিত নেই সেহেতু বিয়ে আজ হবে না। তবে দেরীও করতে চাচ্ছে না কেউ। তাই বিয়ে হবে পরশুদিন। তাছাড়া সময় কম তবু একমাত্র মেয়ের বিয়ে উনি চুপিচুপি দিতে চান না। তিরিরের মায়েরও একই ইচ্ছা। তাই কাল সব আয়োজন করবে, পরশুদিন বিয়ে। রাত ১০ টার দিকে মুগ্ধ ওদেরকে পৌঁছে দিল। মুগ্ধর মা খুব জোরাজুরি করলো ডিনার করার জন্য। কিন্তু তিতিরের বাবার এক কথা, 'মেয়ে বিয়ে দিয়েই এঘরে খাব। তার আগে না।' মুগ্ধ পৌঁছে দিতে গেলে তিতিরের বাবা রিকোয়েস্ট করে ভেতরে যেতে। মুগ্ধ হেসে বলে,
-"নাহ, পরশু একেবারে জামাই হয়েই ঢুকবো।"
বাবা হেসে বলল,
-"আমার কথা আমাকেই ফেরত দেয়া হচ্ছে? আচ্ছা বাবা, তাই হবে।"
মুগ্ধ হাসলো। বাবা ভেতরে ঢুকে গেলেন। ভাবী ভেতরে ঢুকতে যাবে এমন সময় মুগ্ধ ডাকলো,
-"ভাবী.."
ভাবী ঘুরে তাকালো। মুগ্ধ বলল,
-"থ্যাংকস।"
-"কেন?"
-"বাবাকে রাজী করানোর জন্য।"
-"আপনি কি করে জানলেন?"
-"তোমার ননদ বলেছে।"
-"কখন বলল? সারাক্ষণ তো একসাথেই ছিলাম। ও তো আপনার সাথে কোন কথাই বলেনি।"
-"অনেক কথাই বলেছে। আমরা সবার সামনে দিয়েও কথা বলতে পারি যা সবাই শুনতে পায়না।"
-"বাহ, তা ভাল কিন্তু শুকনো থ্যাংকস দিলে হবে না। তোমাদের হানিমুনে আমাকে নিয়ে যেতে হবে।"
-"ওহ, এই ব্যাপার! অবশ্যই নিয়ে যাব। তখন কিন্তু না করলে শুনছি না। আর হানিমুনে গেলে কিন্তু বউয়ের চাকরী করতে হবে। তখনও না বললে মানবো না।"
তিতির হেসে ফেলল। ভাবী বলল,
-"এমা, আপনি কি অসভ্য।"
-"বারে! তাহলে তুমি বড় অসভ্য। তুমিই প্রথম যেতে চেয়েছো।"
-"না বাবা আমার যাওয়া লাগবে না, তাই বলে শুকনো থ্যাংকস ও নিচ্ছি না। পরে অন্যকিছু চেয়ে নেব।"
এই বলে ভাবী চলে গেল। মুগ্ধ চিৎকার করে বলল,
-"আইএম অলওয়েজ দেয়ার ফর ইউ।"
ভাবী চলে গেলেও তিতির গেল না। বলল,
-"শেষপর্যন্ত তোমাকে সাদা পাঞ্জাবিতে লাইভ দেখতে পারলাম। সত্যিই হিরো লাগছে।"
মুগ্ধ হাসলো। তিতির আবার বলল,
-"সত্যিই কি আমাদের বিয়ে হচ্ছে?"
-"হুম, বেঁচে থাকলে আর আল্লাহ কপালে রাখলে হবে।"
-"তুমি আর কোনদিনও এভাবে কাঁদবে না প্লিজ।"
-"আরে, ছিঃ তুমি আবার সেই কথা মনে করিয়ে দিচ্ছো? লজ্জা লাগছে।"
-"লজ্জা ফজ্জা জানিনা। তোমার ওই কান্না আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। যদি আর ওভাবে কাঁদো, তোমাকে আমি এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক দিয়ে তালাক দিয়ে দেব।"
মুগ্ধ হেসে তিতিরের হাত ধরে বলল,
-"হাতে এত আঁচড়ের দাগ কিসের?"
-"আমি রাগের মাথায় খামচি দিয়েছিলাম।"
-"কেন? তোমাকে না বলেছিলাম যাই হয়ে যাক, কখনো নিজের শরীরের ওপর রাগ দেখাবে না?"
-"সরি।"
-"পরশু রাতে সারা শরীরে দাগ বসাব দাঁড়াও।"
-"উফ, অসভ্য কোথাকার। আমি গেলাম।"
-"শোনো, আমার ফোন ভাঙা। যদিও কাল সকালে একটা ফোন কিনে নিব কিন্তু আজ রাতে আর কথা হবে না।"
-"প্রব্লেম নেই, পরশু থেকে তো আর ফোন লাগবে না, লাইভ কথা বলবো সারাক্ষণ।"
-"না রসগোল্লা। সারাক্ষণ পারবো না কারন সারাদিন আমার অফিস থাকবে।"
-"জানি। সারাক্ষণ বলতে রাতে।"
-"রাতে তো অন্য কাজ থাকবে। কত যুদ্ধের পর তোমাকে পেতে যাচ্ছি, কথার চেয়ে কাজই বেশি হবে।"
তিতির লজ্জা পেয়ে বলল,
-"গেলাম, টাটা।"
রাতের বেলা মুগ্ধ খুব আফসোস করতে লাগলো ফোনটা ভাঙার জন্য। মুগ্ধ বাসায় ফিরতে ফিরতে মা ঘুমিয়ে পড়েছে, সারাদিন যা ধকল গেল! আর স্নিগ্ধর কাছেও ফোন চাওয়া যাবে না। কারন, মরে গেলেও ও এই রাতের বেলা ফোন দেবে না। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে কেটে গেল মুগ্ধর সারাটা রাত। ওদিকে আজ বিছানায় শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমে তলিয়ে গেল তিতির। এত নিশ্চিন্তে বহুদিন ঘুমায়নি তিতির।
বিয়ের দিন সকাল সকাল মুগ্ধর বাসা থেকে লোকজন এল তিতিরকে হলুদ দিতে। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো পিউ ৮ মাসের বেবি পেটে নিয়ে চলে এসেছে হলুদ দিতে। পিউ এসেই তিতিরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-"উফ, ভাবী কি যে শান্তি লাগছে। ইকরাপুর সাথে ভাইয়ার বিয়েটা আমি মানতেই পারছিলাম না, তাই যাইনি। শেষপর্যন্ত তোমার সাথে বিয়ে হচ্ছে শুনে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না।"
-"তুমি এসেছো, কি যে ভাল লাগছে আমার।"
তারপর তিতির পিউয়ের পেটে হাত রেখে বলল,
-"ইশ রে, আমার পিউ বাবুটার আবার একটা বাবু হবে।"
পিউ হেসে বলল,
-"কয়েকদিন পর তোমারও হবে।"
তিতির লজ্জা পেয়ে হাসলো। পিউ বলল,
-"কেমন জানি ফিলিংস ভাবী। একদম ডিফ্রেন্ট।"
সন্ধ্যাবেলায় মুগ্ধ-তিতিরের বিয়ে হয়ে গেল। কবুল বলতে বলার সাথে সাথে মুগ্ধ এক নিশ্বাসে কবুল কবুল কবুল বলে নিজেই হেসে দিল। আশেপাশের সবাইও হাসলো। ওদিকে তিতিরকে কবুল বলতে বললেও প্রায় কাছাকাছি অবস্থা হলো। যতই প্রেমের বিয়ে হোক, সাধারণত মেয়েরা তো চুপ করেই থাকে.. মুরুব্বিরা অনেক বার কবুল বলতে বলার পর কনে কবুল বলে। কিন্তু তিতিরকে কাজী কবুল বলতে বলার সাথে সাথেই বলল, 'কবুল' কাজী আবার বলল, 'আরেকবার বলুন মা'
তিতির সাথে সাথেই আবার বলল, 'কবুল'। তৃতীয়বারও একই ঘটনা ঘটলো।
তান্না অনিচ্ছাসত্ত্বেও সব হাসিমুখে করছে। বাবার কথা না মানলে তো ত্যাজ্যপুত্র করবে। গাড়িতে ওঠার সময় তিতির আর ওর মা জড়িয়ে ধরে এমনভাবে কাঁদছিল যেন ওকে জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে, আর জীবনেও ওদের সাথে দেখা হবে না। বাবাও কাঁদছিল, তান্না আর ভাবীও কাঁদছিল। গাড়িতে উঠে মুগ্ধ তিতিরের কানে ফিসফিস করে বলল,
-"এমনভাবে কাঁদছিলে যেন আমি তোমাকে খুন করতে নিয়ে যাচ্ছি। আমার অপরাধবোধ হচ্ছিল খুব।"
-"তুমি বুঝবে না। আমি নিজেও বুঝতে পারছি না কেন এমন হলো। আমি তো এই দিনটার জন্যই কত কি করলাম। আর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরই আমি এত কান্নাকাটি করলাম!"
-"কি বললে? বিয়ে হয়ে গিয়েছে? বাহ আসলেই তো আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। খেয়ালই ছিলনা আমার।"
তিতির হাসলো। স্নিগ্ধ, মুগ্ধ আর তিতির বসেছে পেছনের সিটে। সামনে পিউ, ড্রাইভ করছে ওর বর। স্নিগ্ধ সিওসিতে এ্যাটাক দিতে ব্যস্ত। মুগ্ধ চুপিচুপি তিতিরের কোমরে হাত দিয়ে হালকা একটু চাপ দিয়ে একদম নিজের কাছে নিয়ে এল। কানে কানে বলল,
-"ও বউ, আজকে থেকে তো তুমি আমার সত্যি সত্যি বউ। ভাবতেই কেমন যেন লাগছে।"
তিতির তাকালো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধরও পলক পড়ছে না। তিতিরকে এই প্রথম এত সাজে দেখছে, ব্রাইডাল সাজ যেমন হয় তেমনই। লিপস্টিক ও আজ ভাল লাগছে মুগ্ধর। আবার কানে কানে বলল,
-"আজ তো তুমি শেষ।"
তিতিরও ফিসফিস করে বলল,
-"পাশে ভাইবোনরা আছে, একটু তো সামলে কথা বলো।"
-"ধুর এত সামলাসামলির কি আছে? আজ থেকে আমার সবকিছু বেসামাল।"
-"উফফ থামো তো।"
-"আচ্ছ রাতে দেখছি ব্যাপারটা, আপাতত থামলাম।"
বাসায় ফিরে যখন সবাই লিফটে উঠতে যাচ্ছিল তখন তিতিরকে টেনে ধরলো মুগ্ধ। তারপর আচমকাই তিতিরকে কোলে নিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। সব কাজিনরা হাততালি আর সিটি বাজিয়ে মুগ্ধকে উৎসাহ দিচ্ছিল। তিতির বলল,
-"তুমি আমাকে কোলে নিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠছো কেন?"
মুগ্ধ উঠতে উঠতে বলল,
-"যেদিন আমাদের সম্পর্ক হয়েছিল সেদিন বৃষ্টিতে তোমাকে কোলে নিইনি বলে তোমার মন খারাপ হয়েছিল তখন আমি তোমাকে বলেছিলাম যত উপর তলাতেই থাকিনা কেন বিয়ের দিন আমি তোমাকে কোলে করে সিড়ি দিয়ে ওঠাব।"
-"তুমি কি পাগল? ওটা কোন সিরিয়াস কথ ছিল নাকি? আমি এমনি ঘুমের তালে বলেছিলাম"
-"হুম সব সময়ের সব কথাই আমার কাছে সিরিয়াস ছিল, আছে, থাকবেও। আর তোমাকে উঠানো কোন ব্যাপার না।"
-"আগে ব্যাপার ছিল না, কারন আমি শুকনা ছিলাম, এখন তো মোটা হয়ে গেছি তোমার কষ্ট হচ্ছে।"
-"চুপ থাকোনা বাবা। চলেই তো আসছি।"
তিতির খুব খুব খুশি হলো, সাথে অবাকও হলো মুগ্ধ এতবছর আগের কথা এখনো মনে রেখে সেই মত কাজ করছে? ও এত ভাল কেন!
সবাই ড্রইং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। পিউ তিতিরকে নিয়ে মুগ্ধর ঘরে ঢুকলো। তিতিরের চুল খুলতে, মেকাপ উঠাতে হেল্প করলো। তারপর বলল,
-"যাও যাও ভাবী, গোসল করে আসো। নাহলে যেই মেকাপ এখনো আছে তাতে আমার ভাইয়ের পেট খারাপ হবার সম্ভাবনা প্রবল।"
তিতির লজ্জা পেয়ে বলল,
-"ছিঃ পিউ কি বলছ এসব?"
পিউ হেসে বলল,
-"আমার আগে যদি তোমার বিয়ে হতো তখন আমার বিয়ের সময়ও তুমি এরকম দুষ্টু দুষ্টু কথা বলতে। এটাই তো নিয়ম।"
তিতির বলল,
-"ইশ, কি ভালই না হতো। তোমার বিয়ের আগেই যদি আমি তোমার ভাবী হতে পারতাম।"
-"আচ্ছা যাই হোক, এখনো যা হয়েছে ভালই হয়েছে।"
-"হুম।"
-"আর হ্যা, আমি কিন্তু দুষ্টুমি করলেও সত্যি গোসল করতে বলেছি। এত মেকাপ নিয়ে ঘুমালে তোমারই স্কিনে প্রব্লেম হবে যদিও কে জানে আজ ঘুমাবে কিনা!"
তিতির খুব উৎসাহ নিয়ে বলল,
-"এই পিউ, তোমরা ঘুমিয়েছিলে বাসর রাতে?"
পিউ হেসে বলল,
-"হুম, ভোর ৫ টায়।"
-"হায় হায়, উঠেছো কখন?"
-"৮ টায়, তারপর তো সারাদিন আমি শুধু ঢুলি, হি হি। পরের রাতে তো টাচই করতে দিইনি, সারারাত ঘুমিয়েছি।"
তিতির হাসলো। পিউ বলল,
-"এরেঞ্জ ম্যারেজে যদিও বা বাসর রাতে হাসবেন্ড ছাড় দেয়, লাভ ম্যারেজে কখনো ছাড়বে না।"
-"স্বাভাবিক, বেচারা! কত অপেক্ষা করে তারা তাই না?"
-"উউউউউউ, আচ্ছা আমার ভাইয়ের তো তাহলে চাঁদ কপাল। বউ তার স্বামীর এত বছরের অপেক্ষার কথা ভেবে বাসর ঘরে রেডি হয়ে বসে আছে। উফফফ, ভাইয়ারই দিন।"
-"ধ্যাত, তুমি যে কি বলো না! আমি তো ওভারঅল বললাম।"
-"আরে লজ্জা পাচ্ছো কেন? আমরাও তো বাসর রাতের জন্য অনেক এক্সইটেড ছিলাম। সেই ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় ওর সাথে প্রেম হয়েছিল, তখন থেকে আমরা দুজন বাসর রাতের জন্য অপেক্ষা করতাম।"
-"কি? এত পাক্না ছিলে?"
পিউ হেসে বলল,
-"হ্যা। যাই হোক, ভাবী এখন আমি যাই। আবার কাল গল্প হবে। কদিন তো আছি আমি। ভাইয়া নিশ্চই বাইরে উসখুস করছে।"
তিতির মুগ্ধকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য রেডি হয়ে বাথরুমে অপেক্ষা করছে। কিন্তু মুগ্ধ ঘরে আসছে না কেন? মুগ্ধ ঘরে না এলে তো তিতির বাথরুম থেকে বেরও হতে পারছে না। আরো কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ ঘরে এল। পাজামা, পাঞ্জাবি খুলে আলমারি থেকে একটা ট্রাউজার বের করে পড়ে নিল। টি-শার্ট পড়তে নিয়েও পড়লো না কারন, তিতির বুকের লোমগুলো পছন্দ করে! সুন্দর করে বাসর ঘর সাজানো হয়েছে। ঘরের দুপাশে ৩ টা ৩ টা বড় ৬ টা মোম জালিয়ে রাখা হয়েছে।
তিতির দরজা খুলে বের হলো। মুগ্ধ বেখায়ালিভাবে তাকাতেই দেখতে পেল তিতিরকে। তিতিরকে দেখামাত্রই মুগ্ধর চোখ আটকে গেল। হাতের টি-শার্টটা হাত থেকে পড়ে গেল। সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। বুকের ভেতরটায় কোন এক সমুদ্রের উত্তাল স্রোত বয়ে গেল। করেছে কি তিতির! ব্লাউজ ছাড়া শুধু শাড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পড়েছে। সেই যে ওদের প্রেমের ৪ মাসের সময় যখন ওরা বান্দরবান গিয়েছিল তখন ও তিতিরকে বলেছিল যে ও এভাবে শাড়ি পড়া খুব পছন্দ করে। সেটা মনে রেখে আজ পড়েছে। ইশ, না জানি ওর কতদিনের প্ল্যান এটা। বিয়ে না হলে তো জানতেই পারতো না। মুগ্ধ কয়েক পা এগিয়ে গেল তিতিরের কাছে। তিতিরের শরীর কাঁপছে, লজ্জায় কুঁকড়ে আছে। কোন সাজ নেই মুখে, তাকাচ্ছে না মুগ্ধর দিকে। চুল বেয়ে বেয়ে পানি পড়ছে। মুগ্ধ আস্তে আস্তে একদম ওর কাছে চলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-"তিতির কি করেছো তুমি! মাথাটায় আগুন ধরিয়ে দিলে যে। বলেছিলাম আজ রাতে তুমি শেষ, এখন তো মনে হচ্ছে আমিই শেষ।"
তিতির লজ্জা পেয়ে হাসলো। মুগ্ধ আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে তিতিরকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গেল। তিতিরকে ও আজ ভালবাসার নতুন এক পর্ব দেখাবে। তিতিরকে পাগল করে তারপর ওর পাগলামি দেখার বেস্ট সময় আজ! আজ কোন ভয় নেই, দুঃখ নেই, হতাশা নেই, নেই কোন বাধা! আজকের রাত যেন শেষ না হয়, আজকের রাত ভালবাসার রাত।
The End..