প্রেমাতাল - পর্ব 51-52-53 । Golpo Porun

প্রেমাতাল

(মৌরি মরিয়ম)

Prematal
This Photo is from Pexels


প্রেমাতাল - পর্ব ৫৩

মৌরি মরিয়ম

হসপিটালে কেবিনের সামনেই তান্নাকে দেখা গেল। তিতিরের পেছন পেছন মুগ্ধও কেবিনে ঢুকতে নিতেই তান্না ওকে আটকে বলে,

-"তোর ভাগ্য ভাল যে আমার বাবা অসুস্থ নাহলে তোকে এখানেই মেরে পুঁতে দিতাম।"

একথা শুনে তিতির চমকে পেছনে তাকালো। মুগ্ধ চোখের ইশারায় ওকে ভেতরে যেতে বলল। তিতির ভেতরে গেল।

বাবার নিস্তেজ শরীর টা পড়ে আছে বিছানায়। বাবাকে এভাবে দেখে তিতিরের সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে গেল। নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। মা রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, কিন্তু কিছু বলল না। বাবা ঘুমিয়ে আছে। বাবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিতির। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো, 'আল্লাহ, আমি যদি জীবনেও একটা ভাল কাজ করি তার বিনিময়ে বাবা জীবনটা রক্ষা করো।'

প্রেমাতাল - সকল পর্ব

মুগ্ধকে তান্না কোনভাবেই ভেতরে ঢুকতে দিল না। তবুও মুগ্ধ বসে রইল হসপিটালের লবিতে। ওর কেন যেন এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছিল না।

বাবার ঘুম ভাঙলো রাত ৮ টার দিকে। তিতিরকে দেখতে পেয়েই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। তিতির কাছে গিয়ে বসে বাবার হাতটা ধরে বলল,

-"সরি বাবা, আমাকে তুমি মাফ করে দাও। তোমাকে না বলে আমি আর এক পা ও ফেলবো না। তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো বাবা, আমি আর কোনদিন এমন করবো না।"

তিতিরের চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়তে লাগলো। বাবা বললেন,

-"সুশান অনেক ভাল ছেলে। তোকে সুখে রাখবে। তুই চলে গিয়েছিস শুনেও বলেছে বাচ্চা মেয়ে বুঝতে পারেনি।"

তিতির কাঁদতে কাঁদতেইই বলল,

-"হ্যা বাবা, আমি জানি সুশান অনেক ভাল। আমি সুশানকেই বিয়ে করবো বাবা। আমি তোমার সব কথা শুনবো। তুমি শুধু সুস্থ হয়ে ওঠো না বাবা প্লিজ।"

বাবা আর কিছু বললেন না, শুধু তিতিরের হাতটা শক্ত করে ধরে রইলেন। যেন ছাড়লেই তিতির আবার পালিয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ পর বাবা আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। যাতে বমি না হয় তাই ওনাকে ঘুমের অষুধ দেয়া হয়েছে। কেবিনে একটা এক্সট্রা বেড ছিল সেখানেই মা আর তিতির বসে আছে। চেয়ারে বসে আছে তান্না। মা বলল,

-"তান্না বাসায় চলে যা, সকালে তো আবার অফিসে যেতে হবে।"

''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন

তান্না বলল,

-"না না, আমি থাকবো। আমি গেলে ইঞ্জেকশান কে এনে দিবে। ১০ টায় ইঞ্জেকশান দিতে হবে তো আবার। এখন যে এনে দিয়ে যাব সেটাও তো সম্ভব না। ইঞ্জেকশান টা ঠান্ডা দিতে হয়। এখানে তো আর ফ্রিজ নেই।"

মা চাপা গলায় আস্তে আস্তে বলল,

-"কে আনবে মানে? যার জন্য এতকিছু সে আনবে। গায়ে বাতাস লাগিয়ে বাবার পাশে সঙের মতো শুধু বসে থাকলে তো হবে না।"

তান্না বলল,

-"না না, ও পারবে না। এখানে পাওয়া যায় না। রাস্তার ওপাড়ে যেতে হবে।"

মা বলল,

-"অবশ্যই পারবে, যে মেয়ে এতকিছু পারে সে মেয়ে সবই পারবে। যা বলেছি তাই কর।"

মায়ের খোঁচা দেয়া কথাগুলো তিতিরকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছিল, কিন্তু কিচ্ছু বলার ভাষা নেই ওর। সত্যিই তো ওর জন্যই এতকিছু হলো। ও বলল,

-"ভাইয়া তুই যা, আমি পারব।"

রাত পৌনে দশটার দিকে তিতির গেল ইঞ্জেকশান কিনতে। মুগ্ধ হসপিটালের লবিতে বসেই দেখছিল তিতির বেরোচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো ওর সাথে কেউ আছে নাকি সেটা বোঝার জন্য। যখন বুঝলো কেউ নেই তখন পিছন পিছন গেল। তিতিরকে ডাকলো কিন্তু ও দাঁড়ালো না। ও কি ইচ্ছে করে দাঁড়ালো না নাকি ডাকটা শুনতে পায়নি! তিতির রাস্তা পাড় হতে নিল আর কোত্থেকে একটা গাড়ি চলে এল। মুগ্ধ দৌড়াতে দৌড়াতে বলল,

-"তিতির দাঁড়াও, গাড়ি আসছে তো।" তিতির সেকথা শুনলোও না নিজেও খেয়াল করলো না, ততক্ষণে গাড়িটা একদম কাছে এসে থেমে গেল। কিন্তু তবু তিতিরের গায়ে হাল্কা একটা ধাক্কা লাগলো। তিতির ছিটকে পড়ে গেল রাস্তায়। মুগ্ধ তিতিরকে ধরে ওঠালো। বলল,

-"কি করছিলে তিতির? রাস্তাটা দেখে পার হবে তো? এভাবে কেউ রাস্তা পার হয়? আরেকটু হলে তো সাংঘাতিক বিপদ হতো।"

তিতির অবাক হয়ে বলল,

-"তুমি এখনো এখানে কি করছো? যাওনি কেন?"

-"আমার যেতে ইচ্ছে করছিল না।"

-"তুমি বাসায় চলে যাও। মা চিন্তা করবে।"

-"মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে নিয়েছি। কিন্তু তুমি আমাকে এটা বলো যে এত রাতে একা একা কোথায় যাচ্ছো তুমি?"

-"বাবার ইঞ্জেকশান কিনতে।"

মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,

-"তুমি কেন? তান্না কোথায়?"

-"মা ভাইয়াকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। ওর সকালে অফিস আছে তো।"

-"তো? ছুটি নিতে পারতো না?"

-"ছুটি পায়নি হয়তো।"

-"দুনিয়ার এমন কোন অফিস আছে যে বাবার হার্ট এ্যাটাক হলেও ছুটি দেয়না?"

-"বাদ দাও।"

-"আচ্ছা বুঝলাম কিন্তু কয়টাই বা বাজে এখন? এখন ইঞ্জেকশানটা এনে দিয়ে বাসায় যেতে তো ১১ টাও বাজতো না ওর। তোমার ভাই মনে হয় ১১ টা পর্যন্ত বাসার বাইরে থাকে না?"

-"এসব বলে কি লাভ? কেন বলছো? উল্টো আমার দেরী করাচ্ছো। ১০ টায় বাবাকে ইঞ্জেকশানটা দিতে হবে।"

-"ও হ্যা সরি, চলো।"

মুগ্ধও গেল তিতিরের সাথে। ইঞ্জেকশান নিয়ে মুগ্ধ টাকা দিতেই তিতির বাধা দিয়ে বলল,

-"দিওনা তুমি। আমি দিচ্ছি।"

-"কেন তিতির? এটুকু কি আমি করতে পারিনা? মাত্র তো পাঁচশো টাকাই।"

-"না, আমি টাকা নিয়ে এসেছি। ফেরত নিতে পারবো না। ব্যাগ আনিনি দেখতেই পাচ্ছো।"

মুগ্ধ টাকাটা রেখে দিল। তিতির নিজের টাকাটা দিয়ে ইঞ্জেকশান নিল। তারপর দুজনে দোকান থেকে বেড়িয়ে সোজা হসপিটালের সামনে চলে এল। তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,

-"তুমি আর আমাকে সেভ করতে বা সাপোর্ট দিওনা প্লিজ। আজ থেকে আমি একা। সব প্রতিকূল অবস্থা নিজেকেই ফেস করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই বাবা, ভাইয়া আমাকে আগলে আগলে রেখেছে। তারপর সেই ১৭ বছর বয়স থেকে তুমি আগলে আগলে রেখেছো। আর কত? এবার তো নিজেরই নিজের হাল ধরতে হবে।"

-"তিতির, এভাবে বলো না। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।"

-"হয়তো হবে কিন্তু তোমার আমার পথটা আজ থেকে সারাজীবনের জন্য আলাদা হয়ে গেল। ভাল থেকো তুমি আর পারলে আমাকে ক্ষমা করো।"

একথা বলে তিতির চলে গেল উপরে। মুগ্ধ তারপরেও অনেক রাত পর্যন্ত বসে রইলো হসপিটালে।

রাত একটার পর যখন মুগ্ধ বাসায় ফিরলো তখনও মা, পিউ, স্নিগ্ধ সবাই জেগে। মুগ্ধ বলল,

-"তোমরা এখনো জেগে বসে আছো কেন?"

মা বলল,

-"তিতিরের বাবা কেমন আছে?"

যদি বলে তান্না দেখতেও দেয়নি তো মা আবার কি না কি বলবে কে জানে! এখন অন্তত কোন কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না ওর। তাই বলল,

-"এখন ভাল আছে। মেডিসিন চলছে, চলবে।"

-"কি থেকে কি হয়ে গেল!"

-"তোমরা যে যার মত ঘুমাতে যাও। সারারাত জেগে থাকার মত কিছু হয়নি।"

কেউ আর একটা কথাও বলল না। যে যার মত ঘুমাতে গেল। মুগ্ধ ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢুকেই থমকে গেল মুগ্ধ! বাসর ঘর এখনো সাজানো! কমন সেন্সের এত অভাব কেন এদের? বিয়ে ভেঙে গেছে, বউ নেই কিন্তু বাসর ঘর এখনো আগের মতোই সাজানো। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল মুগ্ধ। তারপর এক হাতে টান দিয়ে সব ফুলগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিল। লাল রঙের বেডকভার টাও টেনে ফেলে দিল ফ্লোরে। কি হবার কথা ছিল আর কি হলো! একেই বলে ভাগ্য। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে! কিন্তু কার উপর? কার উপর রাগ হলে একটু লাভ হবে? প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে কিন্তু চোখে পানি আসছে না। কেন আসছে না? কেন কাঁদতে পকছে না ও? কোন প্রশ্নের উত্তর আজ মুগ্ধর কাছে নেই। ও আজ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ফেইলার। সবার কাছে হেরে গেছে ও, সব কিছুর সাথে। এতদিনের ঝুলন্ত সেতু আজ ভেঙে পড়লো, বাহ!

ছোট্ট বেডসাইড টেবিলের উপরে ফ্রেমে রাখা ওদের কাপল ছবিটা হাতে নিল মুগ্ধ। দুজন দাঁড়িয়ে আছে, তিতির মুগ্ধর বামপাশে। মুগ্ধ তিতিরের কাধে হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে, তিতিরের বাম হাতটা মুগ্ধর বুকের উপর। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে, দুজনের মুখেই হাসি। তিতির আর কখনো এই বুকে আসবে না। মাতাল করা দৃষ্টি, আর পাগল করা হাসি নিয়ে আর তাকাবে না। সব শেষ আজ। ৭/৮ বছর ধরে দেখা স্বপ্নটা সত্যি হতে পারলো না, তার আগেই ঘুম ভেঙে গেল। এবার মা কে ও কি বোঝাবে? এতদিন তো বলতো, তিতির ফিরে আসবে তাই অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এখন? মা হয়তো কয়দিন চুপচাপ থাকবে সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার টাইম দেবে। কিন্তু তারপর তো ঠিকই বিয়ের জন্য প্রেশার দিতে থাকবে। মা কেন বোঝেনা যে অন্য কোন মেয়েকে ও আর এই জায়গাটা দিতে পারবে না। অন্য কোন মেয়ের সাথে ওর এতটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং কখনো হয়নি, হবেও না। অন্যকারো সাথে থাকা অসম্ভব, কেউ পারবে না তিতিরের মত হতে, কেউ না। অন্য কারো সাথে থাকার চেয়ে তিতিরকে ছাড়া থাকাটাও অনেক সহজ এটা মাকে কি করে বোঝাবে ও?

ঘড়ির কাটায় রাত আড়াইটা। তিতিরের বাবা ঘুমাচ্ছে, অন্য বেডে মাও ঘুমাচ্ছে। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কাঁদছে তিতির, দৃষ্টি বাইরের দিকে। মায়ের পাশে ঘুমানোর মত যায়গা রয়েছে কিন্তু ওর চোখে তো ঘুম নেই। মুগ্ধ এখন কি করছে কে জানে। পাগলটার কত প্ল্যান ছিল আজকের রাতটাকে নিয়ে। আজ এক হবার কথা ছিল ওদের কিন্তু সারাজীবনের জন্য আলাদা হয়ে গেল। ও তো হসপিটালের জানালার গ্রিলে চোখের জলের আহুতি দিচ্ছে কিন্তু মুগ্ধ? ওর তো ওর ঘরটাতেই থাকতে হবে, সেই ঘরে যে ঘরে ওদের জন্য বাসর ঘর সাজানো হয়েছিল। সেই ঘরে যে ঘরে বসে আজ বিকেলেও ও ভয় দেখিয়েছিল তিতিরকে। সে ঘরে কি করে থাকবে পাগলটা? তিতির নিজের পেটে হাত রাখলো, আর পারবে না ও মুগ্ধর বাচ্চার মা হতে! আর পারবেনা নাতি-নাতনীর মুখ দেখিয়ে বাবা-মার মন ভোলাতে। সব শেষ।

আজ দুটি মানুষের মৃত্যু হলো। যে মৃত্যু কেউ চোখে দেখতে পায়না। যে মৃত্যুতে কেই লাশ হয়ে যায় না। যে মৃত্যুর পর সৎকার করতে হয়না, লোক খাওয়াতে হয়না। যে মৃত্যু লুকিয়ে থাকে হাজার হাসির আড়ালে, লক্ষ সুখের মাঝের কাঁটা হয়ে। যে মৃত্যুতে জীবন শেষ হয়ে যায়না, শেষ হয়ে যায় শুধু সুখটুকু, অনুভূতিগুলো। আজ থেকে শুরু হলো দুটি মানুষের মৃতজীবন।

To be continued...

প্রেমাতাল - পর্ব ৫২

মৌরি মরিয়ম

দুই সপ্তাহ পর তিতিরের বাবাকে বাসায় আনা হলো। তারপর তিতির একটু নিশ্চিন্ত হলো। ডাক্তার বলে দিয়েছে বাবাকে এখন থেকে খুব সাবধানে রাখতে হবে, উনি আর কোন ভারী কাজ করতে পারবেন না। এমনকি ওনাকে বাজার করতেও দেয়া যাবে না। ফুল বেডরেস্টে থাকতে হবে, নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে।

তিতির ইদানিং খুব স্বাভাবিক আর হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করে। সবকিছুই বাবাকে একটু ভাল রাখার জন্য। সারাদিন অফিস করে ফিরে বাবার সাথে গল্প করে তিতির, সারাক্ষণ হাসতে থাকে। তারপর রাতে যখন বিছানায় যায়, আস্তে আস্তে একসময় অসহনীয় হয়ে ওঠে রাতটা। যে তিতিরের ঘুমাতে কোন নির্দিষ্ট সময় বা বিছানা লাগতো না সে তিতির আজ সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করে একটু ঘুমের জন্য, ঘুম আর আসেনা। আসবে কিভাবে, ঘুমের ওষুধ তো মুগ্ধর কাছে। সারাদিনের ব্যাস্ততার মধ্যে কোনভাবে ভুলে থাকা যায় মুগ্ধকে। কিন্তু রাতে? একসাথে থাক আর ফোনেই থাক রাতগুলো যে কতভাবে স্পেশাল করতো মুগ্ধ, নিজের জন্মটাকেই সার্থক মনে হতো তখন। আর আজ মুগ্ধর কণ্ঠস্বরটাও শুনতে পায়না ও। মুগ্ধ আর ওকে ফোন করেনা, ও নিজেও আর ফোন করেনা মুগ্ধকে। মুগ্ধর সাথে কাটানো মধুময় স্মৃতিগুলো ভেবে ভেবে কেটে যায় তিতিরের রাতগুলো। তারপর কোনদিন ভোরের দিকে ৩,৪ ঘন্টা ঘুমায়, কোনদিন তাও না। এভাবেই এক সময় অভ্যস্ত হয়ে যায় তিতির। এভাবেই কেটে যায় মুগ্ধহীন মৃতজীবনের অনেকগুলো মাস।

অফিস থেকে ফিরেই তড়িঘড়ি করে গোসলটা করে নিল তিতির। চুলগুলো কোনরকমে মুছে দ্রুত হেয়ার ড্রায়ারে শুকিয়ে নিল। তারপর মায়ের রেখে যাওয়া মেজেন্ডা রঙের কাতান শাড়িটা পড়ে নিল তিতির। চোখে কাজল টেনে বেড়িয়ে আসতেই মা বলল,

-"একি অবস্থা? একটুও সাজিসনি দেখছি। কেমন মরামরা দেখাচ্ছে! আয় আমার সাথে।"

মা তিতিরের হাত ধরে আবার ঘরে নিয়ে গেল। তিতির বলল,

-"আমাকে কিন্তু এভাবেই সুন্দর লাগছে।"

মা বলল,

-"না মা, একটু সাজতে হয়। হালকা একটু মেকাপ কর। আর শাড়ির সাথে মিলিয়ে লিপস্টিক লাগা।"

এসব বলতে বলতে মা আলমারি থেকে গয়না বের করে আনলো। তিতির বলল,

-"আমি গয়নাগাটি পড়বো না মা। ভাল্লাগেনা আমার এসব পড়তে।"

-"বেশি না, শুধু এই দুলটা আর এই নেকলেসটা পড়ে নে। আর হাতে এই দু'গাছা চুড়ি। নাহলে একদমই খালি খালি লাগছে।"

তিতির আর কথা বাড়ালো না, ওগুলো পড়ে নিল। হালকা মেকাপও করলো, লিপস্টিকও লাগালো। মুগ্ধর সাথে পরিচয় হবার পর ও কোনদিন লিপস্টিক লাগায়নি। আজই প্রথম। মা বলল,

-"বাহ এখন কত সুন্দর লাগছে আমার মেয়েটাকে।"

তিতির হাসলো। হাসিতো রেকর্ড করাই থাকে ঠোঁটের মধ্যে। প্রয়োজন হলেই তিতির ছেড়ে দেয় সেই রেকর্ড।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সুহাসের ফ্যামিলির সবাই চলে এল। সুহাসের বাবা-মা, দাদু, ভাই-ভাবি, ছোট বোন সবাই এসেছে। সবার মাঝে ঘোমটা মাথায় দিয়ে লাজুক মুখে বসে আছে তিতির। তিতিরের বাবা-মা, ভাই-ভাবিও আছে। সবাই কত গল্পগুজব করছে, কত হাসি-আনন্দ! আজ সবাই কত খুশি! হঠাৎ সুহাসের দিকে চোখ পড়তেই তিতির দেখলো সুহাস হা করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। চোখে চোখ পড়তেই সুহাস অপ্রস্তুত হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। ওর যায়গায় মুগ্ধ হলে চোখ ফেরাতো না, বেহায়ার মত তাকিয়েই থাকতো। হাজার চেষ্টা করলেও কেউ কোনদিন মুগ্ধ হতে পারবে না, মুগ্ধ মুগ্ধই। তাই মুগ্ধর যায়গাটা এ অন্তরে সারাজীবন সুরক্ষিত থাকবে!

দুই ফ্যামিলির উপস্তিতিতে তিতির আর সুহাসের এঙ্গেজমেন্টটা হয়ে গেল। আজ সুহাস আলতো করে তিতিরের হাতটা ধরে যত্ন করে আংটি পড়িয়ে দিয়েছে। তারপর তিতিরও পড়িয়েছে। বাবা হাসছিল, বাবা খুশি। বাবার খুশির জন্য তিতির আজকাল সব করে। বাবার ভাল থাকার জন্যই আজও মৃত্যুর পথকে বেছে নিতে পারেনি তিতির।

আংটিটার দিকে কতক্ষণ চেয়ে থেকে রাত প্রায় ২ টার দিকে তিতির মুগ্ধকে ফোন করলো। প্রায় সাথে সাথেই ফোন ধরলো মুগ্ধ, ও বোধহয় জেগেই ছিল।

-"হ্যালো তিতির!"

-"কেমন আছো?"

-"ভাল, তুমি কেমন আছো?"

-"ভাল।"

-"মা, স্নিগ্ধ, পিউ সবাই ভাল আছে?"

-"হ্যা, কিন্তু মা সামান্য অসুস্থ।"

-"কি হয়েছে?"

-"তেমন কিছু না। ডায়াবেটিকস, হাই প্রেশার, এসব নিয়েই প্রব্লেম।"

-"ও।"

তারপর দুজনেই চুপ। একসময় মুগ্ধ বলল,

-"জানো? পিউয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে।"

-"বাহ, কবে? কার সাথে?"

-"ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথেই। সামনের মাসের ৭ তারিখ।"

-"ওহ। তাহলে তো বেশিদিন বাকী নেই।"

-"হুম।"

-"আমাকে জানালেও না।"

-"কার্ড এলেই পৌঁছে যাবে তোমার কাছে। যদিও জানি তুমি আসবে না, তবু।"

-"আসব কিভাবে তোমার ফ্যামিলির সামনে মুখ দেখাবার অবস্থা তো আমার নেই।"

-"ফালতু কথা বলোনা তো।"

-"যাই হোক, পিউকে বলো আমার দোয়া সবসময় ওর সাথে থাকবে। ও অনেক অনেক সুখী হবে।"

-"হুম, তা এতদিন পর হঠাৎ তুমি আজ ফোন করলে?"

-"হ্যা, একটা কথা বলার জন্য।"

-"কি?"

-"আজ রাতে সুহাসের সাথে আমার এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে।"

-"ওহ! কংগ্রাচুলেশনস!"

-"থ্যাংকস।"

-"বিয়ে কবে?"

-"সামনের বছরের শুরুতেই।"

-"এত দেরীতে কেন?"

-"সুহাসদের কি একটা প্রব্লেম যেন আছে। তাই সময় লাগবে।"

-"ও।"

-"এবার তুমিও বিয়ে করে ফেল।"

মুগ্ধ হাসলো। তিতির জিজ্ঞেস করলো,

-"হাসছো যে?"

-"এমনি। আচ্ছা, এখন রাখি। কাল আবার অফিস আছে।"

-"আচ্ছা।"

-"ভাল থেকো, সুখে থেকো আর নিজের খেয়াল রেখো। টাটা..."

ফোন রেখেই তিতির কেঁদে ফেলল। কত কাছের মানুষ্টা আজ কত দূরের হয়ে গেছে! চাইলেই তাকে আর যা ইচ্ছা তা বলা যায়না। আংটিটা হাত থেকে খুলে রাখলো তিতির। এটুকুই ও পারে। আর তো কিছু ওর সাধ্যের মধ্যে নেই।

মুগ্ধ ইচ্ছে করেই ফোন রেখে দিল। আর কথা বলার মত শক্তি, সাহস আর মনের জোর নেই মুগ্ধর। রাত ২ টা বাজে, একসময় ৩ টা বাজবে। একসময় ৪ টাও বাজবে। কিন্তু মুগ্ধ ঘুমাতে তো পারবে না। একসময় সকাল হবে তারপর অফিসেও যেতে হবে। অফিসে না গেলে মা, ভাই-বোনদের খাওয়াবে কি? বাবা কেন এমন করলো? সবার দায়িত্ব ওর কাধে দিয়ে ফাঁকি মেরে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল! ঠিক না, ঠিক না।

আজ তিতিরের এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে, কিছুদিন পর বিয়ে হবে, বাসর হবে অন্য একটা ছেলের সাথে। নাকে নাকফুল পড়বে তিতির কিন্তু অন্য একটা ছেলের জন্য। অন্য কারো বাচ্চার মা হবে তিতির। আর ও হাত গুটিয়ে বসে বসে দেখবে। কিছু করার নেই তো! ভালবাসা যে বড্ড অসহায়, বুকে প্রেম আছে কিন্তু বুকে জমানো সব আশার সলতেগুলো আস্তে আস্তে ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। তবু বেঁচে থাকতে হবে মা, ভাই-বোনের জন্য। শালার মরারও উপায় নেই।

To be continued...

প্রেমাতাল - পর্ব ৫৩

মৌরি মরিয়ম

এলার্ম বেজে উঠতেই তিতির হাত বাড়িয়ে সেটাকে বন্ধ করলো। রাতে ঘুম আসেনা, ইনসমনিয়া হয়ে গিয়েছে বোধহয়। ঘুমাতে ঘুমাতেই ২/৩ টা বেজে যায়। তাই এলার্ম দিয়ে রেখেছিল, যাতে ভোর ৫ টায় উঠতে কোন প্রব্লেম না হয়।

তিতির আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। বাইরে তাকিয়ে দেখলো এখনো আলো ফোটেনি। এম্নিতেই তো শীতের দিনে সকাল কে ভোর মনে হয় আর ভোরকে রাত। কম্বলটা সরিয়ে বিছানা থেকে নামলো। লাইট জ্বালিয়ে চুলগুলো হাতখোপা করতে করতে ঘরের দরজা খুলে বের হলো। রান্নাঘরে ঢুকে

পানি গরম দিয়ে তিতির একটা বাটিতে দুটো ডিম ভেঙে ভালভাবে ফেটে নিল। তারপর অন্য একটা বড় বাটিতে ময়দা, বেকিং সোডা, চিনি, লবণ একসঙ্গে চেলে নিল। এরপর তাতে ফাটানো ডিমের মিশ্রণটা ঢেলে দিল, সঙ্গে একটু বাটারমিল্ক দিয়ে পুরোটা একসাথে ব্লেন্ড করে নিল। এরপর এতে লাল রঙ (ফুড কালার) এবং ভ্যানিলা এসেন্স দিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে নিল। তারপর গতকাল কিনে আনা হার্টশেপ মাঝারি সাইজের কেক প্যানটায় মিশ্রণটি ঢেলে ছড়িয়ে দিল। ৩৫০ ডিগ্রি প্রি হিটেড ওভেনে ২০ মিনিট বেক করতে দিয়ে দিল। চুলা জ্বালিয়ে গোসলের পানি গরম দিল, গোসল না করলে শীত লাগে বেশি। রান্নাঘরটা যতটুকু নোংরা হয়েছিল পরিস্কার করলো, যেকটা জিনিস মেখেছিল ধুয়ে রাখলো। কেক ডেকোরেশনের জন্য ফ্রেশ ক্রিম, চিজ, বাটার, চিনি, ভ্যানিলা ইত্যাদি ফ্রিজ থেকে বের করে পরিমাণমত একটা বাটিতে নিয়ে আবার ফ্রিজে রেখে দিল। বাটিটা ওর ঘরে রেখে আবার রান্নাঘরে ফিরে এল। রান্নাঘরের লাইট বন্ধ করে চোরের মত অপেক্ষা করতে লাগলো কেকটা বেক হবার জন্য। আর আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলো যাতে মা এত তাড়াতাড়ি না ওঠে। যদিও মা ভোরে উঠে নামাজ পড়লেও ৬ টার আগে নিজের ঘর থেকে বের হন না। তবু ভয় ভয় করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর পায়ের আওয়াজ পেতেই বুক কেপে উঠলো তিতিরের। মা? যদি মা হয় কি বলবে ও এখন? ফ্ল্যাটের মেইন দরজা খোলার শব্দ পেয়ে তিতির বুঝলো মা না, বাবা নামাজ পড়তে যাচ্ছে। ২০ মিনিট পর ওভেন থেকে কেকটা নামিয়ে কেকের মাঝখানে টুথপিক ঢুকিয়ে দেখলো বেক হয়েছে কিনা। হয়নি, আবার দিল ৫ মিনিটের জন্য। ৫ মিনিট পর একইভাবে চেক করে দেখলো বেক হয়ে গিয়েছে। ওভেন বন্ধ করে কেকটা নামিয়ে নিল। তারপর কেকটা হাতে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো। দরজা লাগিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। যাক মা ওঠার আগে সব করতে পেরেছে। ফ্যান ছেড়ে কেকটা ঠান্ডা হতে দিয়ে গরম পানি নিয়ে গোসলে ঢুকলো তিতির।

গোসল করে বেড়িয়ে মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে তিতির কেকটা ডেকোরেশন করতে বসলো। কেকের মাঝ থেকে কেটে তিনটা ভাগ করে নিল। একটি বাটিতে ফ্রেশ ক্রিম, চিজ, বাটার, চিনি, ভ্যানিলা দিয়ে বিট করে নিল। এরপর মিশ্রণটি কেকের নিচের অংশে খানিকটা দিয়ে কেকের আরেকটা অংশ দিয়ে চাপা দিল স্যান্ডউইচের মতো করে। তারপর আবার একইভাবে ক্রিমের মিশ্রণটি ঢেলে কেকের আরেকটা অংশ দিল। এবার কেকের উপরে চকলেট চিপস ও সুইট বল দিয়ে হালকা ডেকোরেশন করলো। ব্যাস রেড ভেলভেট চিজ কেক রেডি। কেকটাকে যত্ন করে বক্সে ঢুকিয়ে সরাসরি ব্যাগে চালান করে দিল তিতির।

আলমারি খুলে মুগ্ধর দেয়া চিকন সিলভার পাড়ের গাঢ় নীল শাড়িটা বের করলো তিতির। শাড়িটা শুধু একবারই পড়েছিল। শাড়িটা ওর খুব পছন্দের যাতে নষ্ট না হয়ে যায় তাই বেশি পড়ত না ও। শাড়িটা পড়ার সময় কুচি দিতে দিতে আয়নায় একবার তাকালো। বাহ বেশ লাগছে তো! শাড়ি পড়া শেষ করে কানে সিলভার একটা ঝুমকা পড়লো। গাঢ় করে কাজলে চোখ আঁকলো। তারপর কপালে বড় একটা নীল টিপ পড়লো। হাতে কয়েকটা চুড়ি পড়লো। চুলগুলো খোলাই রাখলো। সাজ কমপ্লিট! এবার আয়নায় নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখলো, সব ঠিকঠাক আছে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে ৭ টা বাজে। এত তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে কি করবে! আধাঘন্টা শুয়ে রইলো। ৮ টা বাজতেই ঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিং এ গেল তিতির। টেবিলে বাবা, মা, ভাবী। ভাল হয়েছে ভাইয়া নেই, ও বোধহয় অফিসের জন্য বেড়িয়ে গিয়েছে, ৮ টায়ই বের হয় প্রতিদিন। ওকে দেখেই মা বলল,

-"বাহ, সুন্দর লাগছে তো তোকে। লিপস্টিক পড়িসনি কেন?"

-"লিপস্টিক ভাল্লাগেনা মা।"

-"তুই না একদম কেমন জানি!"

বাবা বলল,

-"কি দরকার? আমার মেয়ে তো এমনিতেই সুন্দর।"

তিতির খাওয়া শুরু করলো। ভাবী বলল,

-"সত্যি তিতির, তোমাকে কিন্তু সত্যি অনেক সুন্দর লাগছে।"

মা বলল,

-"কি রে? আজ এত সাজগোজ? আবার শাড়িও পড়েছিস দেখছি।"

-"সব ভুলে যাও নাকি? তোমাকে বলেছিলাম না সেদিন আজ অফিসের পিকনিক। সব কলিগরা শাড়ি পড়বে, আমাকেও ধরলো। কি আর করা, পড়লাম।"

-"মাঝে মাঝে শাড়ি পড়বি, ভাল লাগে দেখতে।"

তিতির হেসে বলল,

-"আচ্ছা।"

নাস্তাটা শেষ করেই তিতির বেড়িয়ে পড়লো। ব্যাগটা খুব সাবধানে নিচ্ছিল ও, যাতে কেকটা নষ্ট না হয়, যদিও কিছু হবে না কারন কেকটা বক্সেই আছে তবু সাবধানের মার নেই। সুহাসের সাথে এঙ্গেজমেন্ট হওয়ার ৪/৫ মাস হলো! এঙ্গেজমেন্টের পর থেকে মা কত ভাল ব্যাবহার করে! আবার আগের মত। আসলে বাবা-মায়েরা সবসময় সন্তানের ভাল চান। কিন্তু ভাল চাইতে গিয়েই অনেক সময় কষ্ট দিয়ে বসে, বুঝে উঠতে পারেনা সন্তানের আসল ভালটা কোথায়! জেনারেশন গ্যাপের কারনেই এটা হয়। কিন্তু সন্তানরাও তো বাবা-মাকে তার চেয়েও বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলে মাঝে মাঝে, বুঝে দিক আর না বুঝে দিক তিতিরও কম কষ্ট দেয়নি বাবা-মা কে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত থেকে আংটিটা খুলে টিস্যুতে পেঁচিয়ে ব্যাগের পকেটে রাখলো তিতির। রাতে বাসায় ফেরার সময় আবার পড়তে হবে।

প্রেমাতাল - সকল পর্ব

To be continued.....

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url