প্রেমাতাল - পর্ব 48-49-50। Golpo Porun

প্রেমাতাল

(মৌরি মরিয়ম)

Prematal
This Photo is from Pexels


প্রেমাতাল - পর্ব ৪৭

মৌরি মরিয়ম

সন্ধ্যা হতে না হতেই তিতিরের জ্বর মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেল। ওকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। কিন্তু ও কিছুতেই যেতে চাচ্ছে না। উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বলছে। অবশেষে মুগ্ধ ওকে জোর করে তুলে নিয়ে গেল। ডাক্তার দেখে বলল, 'ভাইরাস জ্বর। এন্টিবায়োটিকস দিচ্ছি। চিন্তা করবেন না ঠিক হয়ে যাবে।' মুগ্ধর বুকের উপর থেকে পাথর নেমে গেল। তিতিরের খারাপ কিছু হয়নি তো এটা ভেবে এতক্ষণ ওর মন কু ডাকছিল।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে হসপিটালের সামনে যেতেই মুগ্ধ পড়লো বিপাকে। বৃষ্টি নেমেছে। বর্ষাকাল টাকে এজন্যই মাঝেমাঝে অসহ্য লাগে। কথা নেই বার্তা নেই হুটহাট বৃষ্টি। এটুকু সময়ের জন্য গাড়িটা আবার বেজমেন্টে পার্ক করবে সেটা ভেবেই রাস্তায় পার্ক করেছিল। এখন তিতিরকে নিয়ে গাড়ি পর্যন্ত যেতে গেলে তো তিতির ভিজেই যাবে। তিতির মুগ্ধর বুকে মাথা দিয়ে রেখেছিল। আর মুগ্ধ একহাতে তিতিরকে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। মুগ্ধ বলল,

প্রেমাতাল - সকল পর্ব

-"তিতির, তুমি একা একা দাঁড়াতে পারবে না দু'মিনিট? আমি গাড়িটা নিয়ে আসি?"

-"হ্যা পারবো। তুমি গেলেও পারবো।"

-"সত্যিসত্যি তো?"

তিতির চোখ পিটপিট করে বলল,

-"না মিথ্যামিথ্যি তো।"

-"এক থাপ্পড় দিব নড়লে। এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে।"

-"ওক্কে! কিন্তু থাপ্পড় নিবনা, চুম্মা নিব।"

তারপর আবার মুখজোড়া হাসি দিয়ে চোখ পিটপিট করলো। হাসলো মুগ্ধ! এক জ্বরে ওর ভেতরের বাচ্চাটা বেড়িয়ে এসেছে।

মুগ্ধ চিন্তায় চিন্তায় গেল। গাড়ি নিয়ে এসেই হা হয়ে গেল। যা ভয় করছিল তাই তিতির নেই। চারপাশ খুঁজতে খুঁজতে দেখলো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। সাথে সাথে গিয়ে টেনে নিয়ে গাড়িতে ওঠালো। তিতির বলল,

-"উফফ, আমি ভিজবো। আমাকে ভিজতে দাও।"

মুগ্ধ ততক্ষণে গাড়িতে উঠেছে মাত্র। একটা চড় মেরে বলল,

-"আমি বলেছিলাম না কোথাও না যেতে?"

যদিও আস্তেই মেরেছে মুগ্ধ তবুও তিতির কান্না করে দিল,

-"তুমি আমাকে মারলে?"

''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন

-"খুব ভাল করেছি। তোমাকে আরো মারা উচিৎ। তোমার কোন আইডিয়া আছে এই জ্বরে বৃষ্টিতে ভিজলে কি হতে পারে? কিংবা একটা অসুস্থ রোগীকে একা কোথাও রেখে ফিরে এসে তাকে না দেখলে কেমন লাগতে পারে?"

তিতির ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লাগলো। বেশিদূরের হসপিটালে যায়নি তাই ফিরতেও দেরী হলো না। বাসায় ফিরতে ফিরতেই পিউকে ফোন দিল।

-"হ্যালো, পিউ তুই কই?"

-"এইতো ভাইয়া বাসায় ফিরছি। জামে পড়েছি।"

-"আচ্ছা ঠিকাছে।"

-"কেন কিছু বলবি? বল না।"

-"তিতিরের জ্বর বেড়েছিল, ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। তুই এখন না ফিরলে ফিরতে বলতাম।"

-"ও আচ্ছা। ডাক্তার কি বলল?"

-"ভাইরাস জ্বর। এন্টিবায়োটিকস দিয়েছে।"

পাশ থেকে তিতির বলল,

-"আমি পিউপাখির সাথে কথা বলবো। দাও দাও।"

মুগ্ধ ঝাড়ি মেরে বলল,

-"চুপ, একদম চুপ। বাসায় গিয়ে কথা বলো।"

-"অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ।"

ওপাশ থেকে পিউ বলল,

-"ভাইয়া বকিস না তো। কথা বলতে চাচ্ছে যখন দে প্লিজ।"

মুগ্ধ দিল। তিতির ফোন ধরে বলল,

-"পিউউউ.."

-"হ্যা আমার সুইটি ভাবী বলো।"

-"জানো, তোমার ভাইয়া আমাকে মেরেছে?"

-"সেকী কেন?"

-"আমি বৃষ্টিতে ভিজেছি তাই।"

-"ওওও, সোনা ভাবীটা আমার, কেন ভিজলে এই জ্বর নিয়ে?"

-"আমি বৃষ্টি ভালবাসি যে তাই।"

-"আমিও, তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হও। তারপর আমরা একসাথে ভিজবো। ওকে ভাবী?"

-"আচ্ছা।"

-"টাটা।"

-"টাটা।"

ফোন রাখার পর মুগ্ধ বলল,

-"এক কাজ করো। আমাদের বাসর রাত কাটাবার পর সকালবেলা পিউকে গিয়ে বইলো, 'জানো পিউ তোমার ভাইয়া আমার সাথে সেক্স করেছে।"

-"আচ্ছা ঠিকাছে।"

মুগ্ধ তিতিরের রিপ্লাই শুনে অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো ওর দিকে।

বাসায় ফিরে দেখলো পিউ এখনো ফেরেনি। তিতিরের সিলেটের সেই কাপড়চোপড় সব মুগ্ধর কাছেই ছিল। সেখান থেকে কাপড় বের করলো। তারপর তাড়াতাড়ি তিতিরকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,

-"জাস্ট বৃষ্টির পানিটুকু ধুয়ে ফেলতে যতটুকু লাগে ততটুকু গোসল করবে। বেশি হলে আবার চড় মারবো তখনকার মত।"

তিতির বলল,

-"তাহলে তুমিই গোসল করিয়ে দাওনা। আমি তো বুঝিনা বৃষ্টির পানি ধুতে কতটুকু গোসল লাগে। তারপর যদি আবার চড় খাই?"

মুগ্ধ বলল,

-"জাতে মাতাল তালে ঠিক। যাও একা গোসল করো।"

তিতির মুগ্ধর গলায় ঝুলে পড়ে বলল,

-"প্লিজ আসো না।"

অবশেষে মুগ্ধ গেল। তিতিরকে বৃষ্টির ভেতর থেকে আনতে গিয়ে ও নিজেও ভিজে গিয়েছিল। ওরও তো মাথাটা ধুতে হবে। তিতির লক্ষী বাচ্চার মত দাঁড়িয়ে রইলো। মুগ্ধ শাওয়ার ছেড়ে তিতিরের চুলগুলো ধুয়ে দিল। তিতিরও পাক্নামি করলো, হাত উপরে উঠিয়ে মুগ্ধর চুলগুলো ধুয়ে দিল। তারপর মুগ্ধ শাওয়ার বন্ধ করে বলল,

-"হয়ে গেছে ম্যাম। এখন দয়া করে চেঞ্জ করে আমাকে উদ্ধার করেন। আমি যাই?"

-"এই না।"

-"তো?"

তিতির এগিয়ে এসে মুগ্ধকে বলল,

-"তুমি মাঝেমাঝে এত আনরোম্যান্টিক হয়ে যাও কেন?"

-"অসুস্থ মানুষের সাথে রোমান্স করতে হয়না।"

-"ইশ, কে বলেছে তোমাকে?"

-"বলতে হয়না। এটা জানা কথা।"

-"ভুল জানো তুমি। অসুস্থ মানুষকে বেশি আদর করতে হয়, যত্ন করতে হয়।"

-"হ্যা যত্ন তো করছি। আদর করবো সুস্থ হওয়ার পর।"

-"না না না।"

তিতির মুগ্ধকে যেতে দিল না। হাতদুটো শক্ত করে ধরে রইলো। মুগ্ধ হেসে তিতিরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। তারপর বলল,

-"ঠান্ডা লাগবে, জ্বর আরো বাড়বে। তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে বের হয়ে এসো, পাগলী আমার!"

তারপর তিতির তার বিশ্বজয় করা হাসিটা দিল। মুগ্ধও হেসে বেড়িয়ে গেল।

রাত ৮ টা বাজে। তিতিরকে যতদ্রুত সম্ভব ওষুধ খাওয়াতে হবে কিন্তু তার জন্য তো ওকে কিছু খাওয়াতেও হবে। মুগ্ধ ভেজা কাপড় চেঞ্জ করে রান্না ঘরে গিয়ে ভাত নিয়ে এল। ফিরে এসে দেখে তিতির এখনো বের হয়নি। বাথরুমের দরজায় নক করলো মুগ্ধ,

-"তিতির? কি ব্যাপার এতক্ষণ লাগে?"

তিতির বেড়িয়ে এল। ওর চুল দিয়ে পানি পড়ছে। মুগ্ধ বলল,

-"আজও চুল মুছতে শিখলে না? এদিকে এসো।"

মুগ্ধ নিজেই ওর চুলগুলো ভাল করে মুছে দিল। তারপর ভাত খাওয়াতে এলেই তিতির বলল,

-"আমি খাব না।"

-"না খেলে ওষুধ খেতে পারবে না। ওষুধ না খেলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে পারবে না। আর তাড়াতাড়ি সুস্থ না হলে তো তাড়াতাড়ি বিয়েও করতে পারবো না।"

-"আমি খাব।"

মুগ্ধ মনে মনে হাসলো। তারপর খাইয়ে দিল। খেতে খেতে তিতির বলল,

-"না, আমরা কালই বিয়ে করবো সুস্থ হই বা না হই।"

-"আচ্ছা বাবা আচ্ছা.. ঠিকাছে কালই বিয়ে করবো, এখন তো খাও।"

তিতির খাওয়া শুরু করলো এমন সময় পিউ এল। তিতির হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

-"আমার পিউপাখি!"

পিউ এসে তিতিরকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলল,

-"ইশ, ভাবী তোমার তো অনেক জ্বর।"

তিতির বলল,

-"ঠিক হয়ে যাবে।"

মুগ্ধ তিতিরকে খাওয়াতে খাওয়াতেই পিউকে জিজ্ঞেস করলো,

-"তোর সাথে কি ইকরার দেখা হয়েছিল?"

-"হ্যা, কেন ভাইয়া?"

-"ওকে কি বলেছিস যে তিতির এসেছে?"

-"হ্যা। না মানে... আপু স্নিগ্ধর কথা জিজ্ঞেস করছিল ওর সাথে নাকি কি কাজ আছে কিন্তু ও নাকি ফোন ধরছে না। পরে আমি বললাম আমি জানিনা ও তো বিকেলেই মা কে আনতে কুমিল্লা গিয়েছে। আপু জিজ্ঞেস করলো কেন মামীর তো আরো পরে আসার কথা। তখন না আমি মুখ ফসকে বলে ফেলেছি ভাবীর কথাটা। কি হয়েছে ভাইয়া?"

-"বাসায় এসেছিল আমার মেজাজটা খারাপ করতে।"

-"সরি ভাইয়া।"

-"আমাকে বলছিল মা নেই তাই খোঁজ নিতে এসেছে। আমিতো আগেই বুঝেছি ও তিতির আসার খবরটা পেয়েই এসেছে।"

-"আমি বুঝতে পারিনি শুনেই ও চলে আসবে। তাহলে বলতাম না।"

-"আচ্ছা আচ্ছা, ঠিকাছে। যা গেছে তা গেছে।"

-"ওকে ভাইয়া, আমি তাহলে ফ্রেশ হয়ে নিই?"

-"হ্যা, যা।"

তিতিরকে খাওয়ানো শেষ করে ওষুধগুলো টুকরো টুকরো করতে করতে মুগ্ধ বলল,

-"কি আজব না? এতবছর প্রেম করেও জানতে পারলাম না যে তুমি আস্ত ওষুধ খেতে পারো না। জানলাম এসে আজ সকালে। আরো কত কি জানি অজানা আছে আমার।"

তিতির বলল,

-"আর আমার?"

-"তোমারও হয়তো আছে। সত্যিই প্রেম করে একসাথে থাকা আর বিয়ের পর একসাথে থাকার মধ্যে অনেক পার্থক্য।"

তিতির বাচ্চাদের মত হাত তুলে বলল,

-"ইয়েএএএএ কি মজা কালকে আমাদের বিয়ে।"

মুগ্ধ বলল,

-"হ্যা, অনেক মজা। তাই তুমি এখন ঘুমাও। আমি মাকে একটা ফোন করি?"

-"ওক্কে।"

তিতির কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। মুগ্ধ মাকে ফোন করলো।

-"মা, কখন রওনা হচ্ছো?"

মা বলল,

-"আমরা কাল খুব ভোরে রওনা দিয়ে দিব। সকাল সকাল পৌঁছে যাব। তারপর তিতিরকে নিয়ে একটু শপিং এ যাব। তুই কিন্তু বিয়ের এরেঞ্জমেন্ট সব করে রাখিস যাতে সন্ধ্যানাগাদ বিয়েটা কম্পলিট হয়ে যায়।"

-"মা ওর তো অনেক জ্বর।"

-"ডাক্তারের কাছে না গিয়েছিলি?"

-"হ্যা, ওষুধ দিয়েছে, খাইয়ে দিয়েছি।"

-"তাহলে তো হলোই। জ্বরে কিছু হবে না, বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়া দরকার। তুই আর কথা বলিস না তো।"

-"আচ্ছা মা তাই হবে, সেফলি এসো। কাল দেখা হবে, রাখছি।"

-"আল্লাহ হাফেজ।"

যা ভেবেছিল মুগ্ধ তাই হলো। তিতির একটু পর পর হাঁচি দিচ্ছে, খুক খুক করে কাশছে। অনেকক্ষণ আগেই পিউ একবার এসেছিল রাত জাগবে বলে। মুগ্ধ বলেছে 'আমার এমনিতেও টেনশানে ঘুম হবেনা। আমিই থাকি, তুই ঘুমা।' পিউও বুঝেছে মুগ্ধ তিতিরের কাছে থাকতে চাচ্ছে তাই ও ভাইয়ের কথা মেনে নিল। তিতির কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি! বাতাসও ছিল তাই ফ্যান বন্ধ করতে হলো। মেয়েটা যা পাগলামি করে মাঝেমাঝে, খুব চিন্তা হয় মুগ্ধর! রাত ১ টা পর্যন্ত ঠায় বসে রইলো তিতিরের মাথার পাশে। তারপর তিতিরের পাশে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর তিতিরের ঘুম ভেঙে গেল। ফিরলো মুগ্ধর দিকে। বলল,

-"পানি খাব।"

মুগ্ধ উঠে পানি দিল। খেয়ে তিতির বলল,

-"তুমি ঘুমাওনি এখনো?"

-"না, ভাবছি।"

-"কি নিয়ে ভাবছো?

মুগ্ধ তিতিরের একটা গাল টিপে দিয়ে হেসে বলল

-"ভাবছি তোমাকে নিয়ে।"

তিতির মুগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরে জানতে চাইলো,

-"আমাকে নিয়ে কি ভাবছো?"

মুগ্ধ তিতিরের কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,

-"আমার বউটা যে কতটা পাগলী তাই ভাবছি।"

-"পাগলী? কেন কি করেছি আমি?"

মুগ্ধ সেকথার উত্তর না দিয়ে হঠাৎই বলল,

-"আচ্ছা তুমি কি সত্যি চলে এসেছো? আমার না এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। সত্যি কি এই সুখটা আমার কপালে ছিল?"

-"কি সুখ?"

-"এইযে, বাকী জীবনটা তোমার সাথে কাটাতে পারবো, এর চেয়ে সুখের আর কি হতে পারে? প্রতিদিন তোমার মুখটা দেখে ঘুমাতে যাব, আবার ঘুম থেকে উঠেও তোমার মুখটা দেখতে পাব। আর কি লাগে জীবনে?"

একথা শুনেই তিতির জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করে দিল। মুগ্ধ তো আকাশ থেকে পড়লো কান্নার মত কি বলল ও খুঁজে পেলনা! বলল,

-"কাঁদছ কেন তিতিরপাখিটা আমার?"

তিতির কাঁদতে কাঁদতেই বলল,

-"শুধু মুখ দেখবে কেন? আদর করবে না কেন?"

মুগ্ধ এবার হেসে দিল। তারপর হঠাৎই মনে হলো তিতির তো এরকম পাগলামি করে পরে সব ভুলে যায়। রেকর্ডিং করে রাখলে কেমন হয়, কাল যখন সব অস্বীকার করবে তখন শুনিয়ে মজা করা যাবে। ফোন বের করে রেকর্ডিং অন করলো মুগ্ধ। তারপর তিতিরের কপালে চুমু দিয়ে বলল,

-"শুধু মুখ না সব দেখবো আর অনেক অনেক আদরও করবো।"

-"তাহলে করো আদর।"

-"হুম, আগে সুস্থ হও। তারপর অনেক অনেক আদর করবো।"

-"না, আমাকে এখনি আদর করতে হবে। তুমি এমন কেন? আদর করতে চাও না কেন? অলওয়েজ খালি হাগ আর কিসসি! আর কিচ্ছু করতে পারোনা তুমি?"

মুগ্ধ তিতিরের মুখে এসব কথা শুনে হা করে তাকিয়ে রইলো ওর মুখের দিকে। অসুস্থ না হলে এখনি বুঝিয়ে দিতো মুগ্ধ কি পারে আর না পারে! তিতির বলল,

-"খালি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকো কেন? হুম? আর কিছু কি তোমার চোখে পড়ে না?"

-"তিতির পাগল হলে আবার?"

তিতির সেকথার পাত্তা না দিয়ে ওড়নাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল ফ্লোরে। তারপর বলল,

-"এই দেখো কত্ত সুন্দর একটা ক্লিভেজ! জীবনে তো একবার তাকালেও না।"

মুগ্ধ অবাক হতে হতে শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল। ওড়নাটা তুলতেই তিতির জোরে জোরে বলল,

-"খবরদার, ওটা ধরবা না। ফেলো ফেলো বলছি।"

মুগ্ধর ভয় করলো যদি পিউ চলে আসে! পিউকে দেখে হয়তো তিতির নালিশ করবে। কার কাছে কি বলছে সেই বোধ এখন ওর নেই। মুগ্ধ ওড়নাটা ফেলে দিল। তিতির তিতিরের কথামতো ওড়নাটা ফেলে দিল। তিতির মুগ্ধর একটা হাত নিয়ে ওর কোমরে রাখলো। তারপর বলল,

-"এখানে ধরো।"

মুগ্ধর নিঃশাস বন্ধ হবার জোগাড়। কোনরকমে বলল,

-"আস্তে কথা বলো পিউ উঠে আসবে নাহয়।"

-"আচ্ছা আস্তে কথা বলবো কিন্তু তাহলে আদর করো।"

-"তিতিরপাখি আমার, তুমি না অনেক লক্ষী! ঘুমাও প্লিজ, এভাবে আদর করা যায়না বাবা।"

তিতির এ ব্যাপারে কোন কথা না বলে বলল,

-"এই তুমি এই টি-শার্ট টা পড়ে আছো কেন? খুলো এটা, এটা খুব পচা।"

তারপর টি-শার্ট টা ধরে খুলতে চেষ্টা করতে লাগলো। মুগ্ধ বলল,

-"আরে, পাগল হলে নাকি?"

তিতির জবাব দিল না। টি-শার্ট টা কামড়ে ছিঁড়তে চেষ্টা করলো। পাতলা টি-শার্ট হওয়ায় খানিকটা ছিঁড়েও গেল। তারপর মুগ্ধ নিজেই টি-শার্ট টা খুলে দিল। তিতির পাগলের মত হামলে পড়ে কামড়াতে লাগলো মুগ্ধর বুকে। কামড়াতে কামড়াতে একসময় রক্ত বের হয়ে গেল। মুগ্ধ বাধা দিল না।

একটু পর হঠাৎই তিতির উঠে সোজা হয়ে বসলো। মুগ্ধ বলল,

-"কি?"

তিতির উত্তর দিল না। আচমকাই মুগ্ধ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজের কামিজটা খুলে ফেলল। মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,

-"এই কি করছো?"

কিন্তু ততক্ষণে তিতির খুলে ফেলেছে। মুগ্ধ কাঁথাটা তিতিরের গায়ে দিতেই তিতির সেটা ফেলে দিল। তারপর মুগ্ধর থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্টটা খুলতে চেষ্টা করলো। মুগ্ধ ধরে ফেলল। ওর সারা শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। নিঃশ্বাস টা যেন গলায়ই আটকে যাবে। কোনভাবে বলল,

-"তিতির আমাকে এভাবে মেরোনা প্লিজ, লক্ষী না তুমি?"

তিতির কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-"তুমি এমন করছো কেন? কেন আদর করছো না? তুমি আসলে আমাকে আদর করতেই চাওনা।"

মুগ্ধ তিতিরকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁথাটা আবার গায়ে দিয়ে দিল। তারপর ওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বলল,

-"আমি এভাবে কিছু করতে চাইনা তিতির। সুস্থ হয়ে তো সব ভুলে যাবে। কিন্তু আমি চাই আমাদের ফার্স্ট এক হওয়ার স্মৃতিটা সারাজীবন তুমি মনে রাখো। এত এত আদর করবো যা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। আজকে শুধু পাগলামি করো না প্লিজ।"

তিতির কিছু বলল না আর। কাঁদতেই থাকলো। মুগ্ধ তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-"তোমাকে আমার অচেনা লাগছে। সুস্থ থাকলে তুমি কখনোই এরকম করতে না, উল্টো লজ্জা পেতে। তোমাকে আমার ওইভাবেই ভাল লাগে। এখন থেকে তো তুমি সারাক্ষণ আমার কাছে থাকবে, অনেক অনেক আদর করবো, তুমি দেখে নিও।"

তিতির কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।

কিন্তু মুগ্ধর চোখে আর ঘুম নেই, চলছিল বিরামহীন তুফান বাইরে ও ভেতরে!

ভোরে তিতিরের ঘুম ভাঙতেই দেখলো ও আর মুগ্ধ জড়াজড়ি করে একটা কাঁথার মধ্যে শুয়ে আছে। মুগ্ধ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, ইশ কী মায়াবী লাগছে। কিন্তু বাসায় তো পিউ আছে। পিউ থাকতেও মুগ্ধ ওর সাথে ঘুমালো! পিউ কি মনে করলো! ধ্যাত, ছেলেটার না একফোঁটা লজ্জা নেই। উঠে বসতেই কাঁথা সরে গেল আর ও অবাক হয়ে দেখলো ওর গায়ে কিচ্ছু নেই। শুধু একটা সালোয়ার পড়া। তাড়াতাড়ি কাঁথাটা টেনে গায়ে জড়ালো। মনে করতে চেষ্টা করতে লাগলো কাল রাতে কি হয়েছিল! কিছুতেই মনে করতে পারছে না। ওদিকে কাঁথা টান দিতেই মুগ্ধর ঘুম ভেঙে গিয়েছে। মুগ্ধ বলল,

-"এখন আর ঢেকে কি হবে?"

তিতির লজ্জায় প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,

-"তুমি এটা কেন করলে?"

মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,

-"হায় খোদা! এখন আমার দোষ হলো?"

তিতির কিছু বলল না। মুগ্ধ উঠে বাথরুমে গেল আর বলল,

-"ড্রেস পড়েন।"

মুগ্ধ বাথরুমে ঢুকতেই তিতির তাড়াতাড়ি কাপড় পড়ে নিল। ভাবতে লাগলো কি হয়েছিল রাতে? মুগ্ধ ওভাবে কথা বলল যে! ও নিজেই কি জ্বরের ঘোরে কিছু করেছে? মুগ্ধ ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ইয়ারফোন লাগালো। তারপর একটা নিজের কানে দিয়ে আরেকটা তিতিরের দিকে এগিয়ে দিল। তিতির বলল,

-"এটা কি?"

মুগ্ধ মুচকি হেসে বলল,

-"শোনোই না মন দিয়ে।"

রেকর্ডিংটা শুনতে শুনতে তিতির লজ্জায় লাল, নীল, বেগুনী হয়ে গেল। কি করবে কোথায় লুকোবে বুঝতে পারছিল না। পুরোটা শোনার পর তিতির আর লজ্জায় মুগ্ধর দিকে তাকাতে পারছিল না। মুগ্ধ বলল,

-"কি বুঝলে? কিছু বলো?"

তিতির একটা কথাও বলল না। মুগ্ধ মিটিমিটি হাসছিল আর বলছিল,

-"আহা! এখন লজ্জা পাচ্ছো কেন? এখন তোমার আশিকি কোথায় গেল?"

প্রেমাতাল - পর্ব ৪৮

মৌরি মরিয়ম

সন্ধ্যা হতে না হতেই তিতিরের জ্বর মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেল। ওকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। কিন্তু ও কিছুতেই যেতে চাচ্ছে না। উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বলছে। অবশেষে মুগ্ধ ওকে জোর করে তুলে নিয়ে গেল। ডাক্তার দেখে বলল, 'ভাইরাস জ্বর। এন্টিবায়োটিকস দিচ্ছি। চিন্তা করবেন না ঠিক হয়ে যাবে।' মুগ্ধর বুকের উপর থেকে পাথর নেমে গেল। তিতিরের খারাপ কিছু হয়নি তো এটা ভেবে এতক্ষণ ওর মন কু ডাকছিল।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে হসপিটালের সামনে যেতেই মুগ্ধ পড়লো বিপাকে। বৃষ্টি নেমেছে। বর্ষাকাল টাকে এজন্যই মাঝেমাঝে অসহ্য লাগে। কথা নেই বার্তা নেই হুটহাট বৃষ্টি। এটুকু সময়ের জন্য গাড়িটা আবার বেজমেন্টে পার্ক করবে সেটা ভেবেই রাস্তায় পার্ক করেছিল। এখন তিতিরকে নিয়ে গাড়ি পর্যন্ত যেতে গেলে তো তিতির ভিজেই যাবে। তিতির মুগ্ধর বুকে মাথা দিয়ে রেখেছিল। আর মুগ্ধ একহাতে তিতিরকে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। মুগ্ধ বলল,

-"তিতির, তুমি একা একা দাঁড়াতে পারবে না দু'মিনিট? আমি গাড়িটা নিয়ে আসি?"

-"হ্যা পারবো। তুমি গেলেও পারবো।"

-"সত্যিসত্যি তো?"

তিতির চোখ পিটপিট করে বলল,

-"না মিথ্যামিথ্যি তো।"

-"এক থাপ্পড় দিব নড়লে। এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে।"

-"ওক্কে! কিন্তু থাপ্পড় নিবনা, চুম্মা নিব।"

তারপর আবার মুখজোড়া হাসি দিয়ে চোখ পিটপিট করলো। হাসলো মুগ্ধ! এক জ্বরে ওর ভেতরের বাচ্চাটা বেড়িয়ে এসেছে।

মুগ্ধ চিন্তায় চিন্তায় গেল। গাড়ি নিয়ে এসেই হা হয়ে গেল। যা ভয় করছিল তাই তিতির নেই। চারপাশ খুঁজতে খুঁজতে দেখলো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। সাথে সাথে গিয়ে টেনে নিয়ে গাড়িতে ওঠালো। তিতির বলল,

-"উফফ, আমি ভিজবো। আমাকে ভিজতে দাও।"

মুগ্ধ ততক্ষণে গাড়িতে উঠেছে মাত্র। একটা চড় মেরে বলল,

-"আমি বলেছিলাম না কোথাও না যেতে?"

যদিও আস্তেই মেরেছে মুগ্ধ তবুও তিতির কান্না করে দিল,

-"তুমি আমাকে মারলে?"

-"খুব ভাল করেছি। তোমাকে আরো মারা উচিৎ। তোমার কোন আইডিয়া আছে এই জ্বরে বৃষ্টিতে ভিজলে কি হতে পারে? কিংবা একটা অসুস্থ রোগীকে একা কোথাও রেখে ফিরে এসে তাকে না দেখলে কেমন লাগতে পারে?"

তিতির ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লাগলো। বেশিদূরের হসপিটালে যায়নি তাই ফিরতেও দেরী হলো না। বাসায় ফিরতে ফিরতেই পিউকে ফোন দিল।

-"হ্যালো, পিউ তুই কই?"

-"এইতো ভাইয়া বাসায় ফিরছি। জামে পড়েছি।"

-"আচ্ছা ঠিকাছে।"

-"কেন কিছু বলবি? বল না।"

-"তিতিরের জ্বর বেড়েছিল, ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। তুই এখন না ফিরলে ফিরতে বলতাম।"

-"ও আচ্ছা। ডাক্তার কি বলল?"

-"ভাইরাস জ্বর। এন্টিবায়োটিকস দিয়েছে।"

পাশ থেকে তিতির বলল,

-"আমি পিউপাখির সাথে কথা বলবো। দাও দাও।"

মুগ্ধ ঝাড়ি মেরে বলল,

-"চুপ, একদম চুপ। বাসায় গিয়ে কথা বলো।"

-"অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ।"

ওপাশ থেকে পিউ বলল,

-"ভাইয়া বকিস না তো। কথা বলতে চাচ্ছে যখন দে প্লিজ।"

মুগ্ধ দিল। তিতির ফোন ধরে বলল,

-"পিউউউ.."

-"হ্যা আমার সুইটি ভাবী বলো।"

-"জানো, তোমার ভাইয়া আমাকে মেরেছে?"

-"সেকী কেন?"

-"আমি বৃষ্টিতে ভিজেছি তাই।"

-"ওওও, সোনা ভাবীটা আমার, কেন ভিজলে এই জ্বর নিয়ে?"

-"আমি বৃষ্টি ভালবাসি যে তাই।"

-"আমিও, তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হও। তারপর আমরা একসাথে ভিজবো। ওকে ভাবী?"

-"আচ্ছা।"

-"টাটা।"

-"টাটা।"

ফোন রাখার পর মুগ্ধ বলল,

-"এক কাজ করো। আমাদের বাসর রাত কাটাবার পর সকালবেলা পিউকে গিয়ে বইলো, 'জানো পিউ তোমার ভাইয়া আমার সাথে সেক্স করেছে।"

-"আচ্ছা ঠিকাছে।"

মুগ্ধ তিতিরের রিপ্লাই শুনে অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো ওর দিকে।

বাসায় ফিরে দেখলো পিউ এখনো ফেরেনি। তিতিরের সিলেটের সেই কাপড়চোপড় সব মুগ্ধর কাছেই ছিল। সেখান থেকে কাপড় বের করলো। তারপর তাড়াতাড়ি তিতিরকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,

-"জাস্ট বৃষ্টির পানিটুকু ধুয়ে ফেলতে যতটুকু লাগে ততটুকু গোসল করবে। বেশি হলে আবার চড় মারবো তখনকার মত।"

তিতির বলল,

-"তাহলে তুমিই গোসল করিয়ে দাওনা। আমি তো বুঝিনা বৃষ্টির পানি ধুতে কতটুকু গোসল লাগে। তারপর যদি আবার চড় খাই?"

মুগ্ধ বলল,

-"জাতে মাতাল তালে ঠিক। যাও একা গোসল করো।"

তিতির মুগ্ধর গলায় ঝুলে পড়ে বলল,

-"প্লিজ আসো না।"

অবশেষে মুগ্ধ গেল। তিতিরকে বৃষ্টির ভেতর থেকে আনতে গিয়ে ও নিজেও ভিজে গিয়েছিল। ওরও তো মাথাটা ধুতে হবে। তিতির লক্ষী বাচ্চার মত দাঁড়িয়ে রইলো। মুগ্ধ শাওয়ার ছেড়ে তিতিরের চুলগুলো ধুয়ে দিল। তিতিরও পাক্নামি করলো, হাত উপরে উঠিয়ে মুগ্ধর চুলগুলো ধুয়ে দিল। তারপর মুগ্ধ শাওয়ার বন্ধ করে বলল,

-"হয়ে গেছে ম্যাম। এখন দয়া করে চেঞ্জ করে আমাকে উদ্ধার করেন। আমি যাই?"

-"এই না।"

-"তো?"

তিতির এগিয়ে এসে মুগ্ধকে বলল,

-"তুমি মাঝেমাঝে এত আনরোম্যান্টিক হয়ে যাও কেন?"

-"অসুস্থ মানুষের সাথে রোমান্স করতে হয়না।"

-"ইশ, কে বলেছে তোমাকে?"

-"বলতে হয়না। এটা জানা কথা।"

-"ভুল জানো তুমি। অসুস্থ মানুষকে বেশি আদর করতে হয়, যত্ন করতে হয়।"

-"হ্যা যত্ন তো করছি। আদর করবো সুস্থ হওয়ার পর।"

-"না না না।"

তিতির মুগ্ধকে যেতে দিল না। হাতদুটো শক্ত করে ধরে রইলো। মুগ্ধ হেসে তিতিরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। তারপর বলল,

-"ঠান্ডা লাগবে, জ্বর আরো বাড়বে। তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে বের হয়ে এসো, পাগলী আমার!"

তারপর তিতির তার বিশ্বজয় করা হাসিটা দিল। মুগ্ধও হেসে বেড়িয়ে গেল।

রাত ৮ টা বাজে। তিতিরকে যতদ্রুত সম্ভব ওষুধ খাওয়াতে হবে কিন্তু তার জন্য তো ওকে কিছু খাওয়াতেও হবে। মুগ্ধ ভেজা কাপড় চেঞ্জ করে রান্না ঘরে গিয়ে ভাত নিয়ে এল। ফিরে এসে দেখে তিতির এখনো বের হয়নি। বাথরুমের দরজায় নক করলো মুগ্ধ,

-"তিতির? কি ব্যাপার এতক্ষণ লাগে?"

তিতির বেড়িয়ে এল। ওর চুল দিয়ে পানি পড়ছে। মুগ্ধ বলল,

-"আজও চুল মুছতে শিখলে না? এদিকে এসো।"

মুগ্ধ নিজেই ওর চুলগুলো ভাল করে মুছে দিল। তারপর ভাত খাওয়াতে এলেই তিতির বলল,

-"আমি খাব না।"

-"না খেলে ওষুধ খেতে পারবে না। ওষুধ না খেলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে পারবে না। আর তাড়াতাড়ি সুস্থ না হলে তো তাড়াতাড়ি বিয়েও করতে পারবো না।"

-"আমি খাব।"

মুগ্ধ মনে মনে হাসলো। তারপর খাইয়ে দিল। খেতে খেতে তিতির বলল,

-"না, আমরা কালই বিয়ে করবো সুস্থ হই বা না হই।"

-"আচ্ছা বাবা আচ্ছা.. ঠিকাছে কালই বিয়ে করবো, এখন তো খাও।"

তিতির খাওয়া শুরু করলো এমন সময় পিউ এল। তিতির হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

-"আমার পিউপাখি!"

পিউ এসে তিতিরকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলল,

-"ইশ, ভাবী তোমার তো অনেক জ্বর।"

তিতির বলল,

-"ঠিক হয়ে যাবে।"

মুগ্ধ তিতিরকে খাওয়াতে খাওয়াতেই পিউকে জিজ্ঞেস করলো,

-"তোর সাথে কি ইকরার দেখা হয়েছিল?"

-"হ্যা, কেন ভাইয়া?"

-"ওকে কি বলেছিস যে তিতির এসেছে?"

-"হ্যা। না মানে... আপু স্নিগ্ধর কথা জিজ্ঞেস করছিল ওর সাথে নাকি কি কাজ আছে কিন্তু ও নাকি ফোন ধরছে না। পরে আমি বললাম আমি জানিনা ও তো বিকেলেই মা কে আনতে কুমিল্লা গিয়েছে। আপু জিজ্ঞেস করলো কেন মামীর তো আরো পরে আসার কথা। তখন না আমি মুখ ফসকে বলে ফেলেছি ভাবীর কথাটা। কি হয়েছে ভাইয়া?"

-"বাসায় এসেছিল আমার মেজাজটা খারাপ করতে।"

-"সরি ভাইয়া।"

-"আমাকে বলছিল মা নেই তাই খোঁজ নিতে এসেছে। আমিতো আগেই বুঝেছি ও তিতির আসার খবরটা পেয়েই এসেছে।"

-"আমি বুঝতে পারিনি শুনেই ও চলে আসবে। তাহলে বলতাম না।"

-"আচ্ছা আচ্ছা, ঠিকাছে। যা গেছে তা গেছে।"

-"ওকে ভাইয়া, আমি তাহলে ফ্রেশ হয়ে নিই?"

-"হ্যা, যা।"

তিতিরকে খাওয়ানো শেষ করে ওষুধগুলো টুকরো টুকরো করতে করতে মুগ্ধ বলল,

-"কি আজব না? এতবছর প্রেম করেও জানতে পারলাম না যে তুমি আস্ত ওষুধ খেতে পারো না। জানলাম এসে আজ সকালে। আরো কত কি জানি অজানা আছে আমার।"

তিতির বলল,

-"আর আমার?"

-"তোমারও হয়তো আছে। সত্যিই প্রেম করে একসাথে থাকা আর বিয়ের পর একসাথে থাকার মধ্যে অনেক পার্থক্য।"

তিতির বাচ্চাদের মত হাত তুলে বলল,

-"ইয়েএএএএ কি মজা কালকে আমাদের বিয়ে।"

মুগ্ধ বলল,

-"হ্যা, অনেক মজা। তাই তুমি এখন ঘুমাও। আমি মাকে একটা ফোন করি?"

-"ওক্কে।"

তিতির কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। মুগ্ধ মাকে ফোন করলো।

-"মা, কখন রওনা হচ্ছো?"

মা বলল,

-"আমরা কাল খুব ভোরে রওনা দিয়ে দিব। সকাল সকাল পৌঁছে যাব। তারপর তিতিরকে নিয়ে একটু শপিং এ যাব। তুই কিন্তু বিয়ের এরেঞ্জমেন্ট সব করে রাখিস যাতে সন্ধ্যানাগাদ বিয়েটা কম্পলিট হয়ে যায়।"

-"মা ওর তো অনেক জ্বর।"

-"ডাক্তারের কাছে না গিয়েছিলি?"

-"হ্যা, ওষুধ দিয়েছে, খাইয়ে দিয়েছি।"

-"তাহলে তো হলোই। জ্বরে কিছু হবে না, বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়া দরকার। তুই আর কথা বলিস না তো।"

-"আচ্ছা মা তাই হবে, সেফলি এসো। কাল দেখা হবে, রাখছি।"

-"আল্লাহ হাফেজ।"

যা ভেবেছিল মুগ্ধ তাই হলো। তিতির একটু পর পর হাঁচি দিচ্ছে, খুক খুক করে কাশছে। অনেকক্ষণ আগেই পিউ একবার এসেছিল রাত জাগবে বলে। মুগ্ধ বলেছে 'আমার এমনিতেও টেনশানে ঘুম হবেনা। আমিই থাকি, তুই ঘুমা।' পিউও বুঝেছে মুগ্ধ তিতিরের কাছে থাকতে চাচ্ছে তাই ও ভাইয়ের কথা মেনে নিল। তিতির কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি! বাতাসও ছিল তাই ফ্যান বন্ধ করতে হলো। মেয়েটা যা পাগলামি করে মাঝেমাঝে, খুব চিন্তা হয় মুগ্ধর! রাত ১ টা পর্যন্ত ঠায় বসে রইলো তিতিরের মাথার পাশে। তারপর তিতিরের পাশে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর তিতিরের ঘুম ভেঙে গেল। ফিরলো মুগ্ধর দিকে। বলল,

-"পানি খাব।"

মুগ্ধ উঠে পানি দিল। খেয়ে তিতির বলল,

-"তুমি ঘুমাওনি এখনো?"

-"না, ভাবছি।"

-"কি নিয়ে ভাবছো?

মুগ্ধ তিতিরের একটা গাল টিপে দিয়ে হেসে বলল

-"ভাবছি তোমাকে নিয়ে।"

তিতির মুগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরে জানতে চাইলো,

-"আমাকে নিয়ে কি ভাবছো?"

মুগ্ধ তিতিরের কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,

-"আমার বউটা যে কতটা পাগলী তাই ভাবছি।"

-"পাগলী? কেন কি করেছি আমি?"

মুগ্ধ সেকথার উত্তর না দিয়ে হঠাৎই বলল,

-"আচ্ছা তুমি কি সত্যি চলে এসেছো? আমার না এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। সত্যি কি এই সুখটা আমার কপালে ছিল?"

-"কি সুখ?"

-"এইযে, বাকী জীবনটা তোমার সাথে কাটাতে পারবো, এর চেয়ে সুখের আর কি হতে পারে? প্রতিদিন তোমার মুখটা দেখে ঘুমাতে যাব, আবার ঘুম থেকে উঠেও তোমার মুখটা দেখতে পাব। আর কি লাগে জীবনে?"

একথা শুনেই তিতির জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করে দিল। মুগ্ধ তো আকাশ থেকে পড়লো কান্নার মত কি বলল ও খুঁজে পেলনা! বলল,

-"কাঁদছ কেন তিতিরপাখিটা আমার?"

তিতির কাঁদতে কাঁদতেই বলল,

-"শুধু মুখ দেখবে কেন? আদর করবে না কেন?"

মুগ্ধ এবার হেসে দিল। তারপর হঠাৎই মনে হলো তিতির তো এরকম পাগলামি করে পরে সব ভুলে যায়। রেকর্ডিং করে রাখলে কেমন হয়, কাল যখন সব অস্বীকার করবে তখন শুনিয়ে মজা করা যাবে। ফোন বের করে রেকর্ডিং অন করলো মুগ্ধ। তারপর তিতিরের কপালে চুমু দিয়ে বলল,

-"শুধু মুখ না সব দেখবো আর অনেক অনেক আদরও করবো।"

-"তাহলে করো আদর।"

-"হুম, আগে সুস্থ হও। তারপর অনেক অনেক আদর করবো।"

-"না, আমাকে এখনি আদর করতে হবে। তুমি এমন কেন? আদর করতে চাও না কেন? অলওয়েজ খালি হাগ আর কিসসি! আর কিচ্ছু করতে পারোনা তুমি?"

মুগ্ধ তিতিরের মুখে এসব কথা শুনে হা করে তাকিয়ে রইলো ওর মুখের দিকে। অসুস্থ না হলে এখনি বুঝিয়ে দিতো মুগ্ধ কি পারে আর না পারে! তিতির বলল,

-"খালি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকো কেন? হুম? আর কিছু কি তোমার চোখে পড়ে না?"

-"তিতির পাগল হলে আবার?"

তিতির সেকথার পাত্তা না দিয়ে ওড়নাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল ফ্লোরে। তারপর বলল,

-"এই দেখো কত্ত সুন্দর একটা ক্লিভেজ! জীবনে তো একবার তাকালেও না।"

মুগ্ধ অবাক হতে হতে শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল। ওড়নাটা তুলতেই তিতির জোরে জোরে বলল,

-"খবরদার, ওটা ধরবা না। ফেলো ফেলো বলছি।"

মুগ্ধর ভয় করলো যদি পিউ চলে আসে! পিউকে দেখে হয়তো তিতির নালিশ করবে। কার কাছে কি বলছে সেই বোধ এখন ওর নেই। মুগ্ধ ওড়নাটা ফেলে দিল। তিতির তিতিরের কথামতো ওড়নাটা ফেলে দিল। তিতির মুগ্ধর একটা হাত নিয়ে ওর কোমরে রাখলো। তারপর বলল,

-"এখানে ধরো।"

মুগ্ধর নিঃশাস বন্ধ হবার জোগাড়। কোনরকমে বলল,

-"আস্তে কথা বলো পিউ উঠে আসবে নাহয়।"

-"আচ্ছা আস্তে কথা বলবো কিন্তু তাহলে আদর করো।"

-"তিতিরপাখি আমার, তুমি না অনেক লক্ষী! ঘুমাও প্লিজ, এভাবে আদর করা যায়না বাবা।"

তিতির এ ব্যাপারে কোন কথা না বলে বলল,

-"এই তুমি এই টি-শার্ট টা পড়ে আছো কেন? খুলো এটা, এটা খুব পচা।"

তারপর টি-শার্ট টা ধরে খুলতে চেষ্টা করতে লাগলো। মুগ্ধ বলল,

-"আরে, পাগল হলে নাকি?"

তিতির জবাব দিল না। টি-শার্ট টা কামড়ে ছিঁড়তে চেষ্টা করলো। পাতলা টি-শার্ট হওয়ায় খানিকটা ছিঁড়েও গেল। তারপর মুগ্ধ নিজেই টি-শার্ট টা খুলে দিল। তিতির পাগলের মত হামলে পড়ে কামড়াতে লাগলো মুগ্ধর বুকে। কামড়াতে কামড়াতে একসময় রক্ত বের হয়ে গেল। মুগ্ধ বাধা দিল না।

একটু পর হঠাৎই তিতির উঠে সোজা হয়ে বসলো। মুগ্ধ বলল,

-"কি?"

তিতির উত্তর দিল না। আচমকাই মুগ্ধ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজের কামিজটা খুলে ফেলল। মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,

-"এই কি করছো?"

কিন্তু ততক্ষণে তিতির খুলে ফেলেছে। মুগ্ধ কাঁথাটা তিতিরের গায়ে দিতেই তিতির সেটা ফেলে দিল। তারপর মুগ্ধর থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্টটা খুলতে চেষ্টা করলো। মুগ্ধ ধরে ফেলল। ওর সারা শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। নিঃশ্বাস টা যেন গলায়ই আটকে যাবে। কোনভাবে বলল,

-"তিতির আমাকে এভাবে মেরোনা প্লিজ, লক্ষী না তুমি?"

তিতির কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-"তুমি এমন করছো কেন? কেন আদর করছো না? তুমি আসলে আমাকে আদর করতেই চাওনা।"

মুগ্ধ তিতিরকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁথাটা আবার গায়ে দিয়ে দিল। তারপর ওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বলল,

-"আমি এভাবে কিছু করতে চাইনা তিতির। সুস্থ হয়ে তো সব ভুলে যাবে। কিন্তু আমি চাই আমাদের ফার্স্ট এক হওয়ার স্মৃতিটা সারাজীবন তুমি মনে রাখো। এত এত আদর করবো যা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। আজকে শুধু পাগলামি করো না প্লিজ।"

তিতির কিছু বলল না আর। কাঁদতেই থাকলো। মুগ্ধ তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-"তোমাকে আমার অচেনা লাগছে। সুস্থ থাকলে তুমি কখনোই এরকম করতে না, উল্টো লজ্জা পেতে। তোমাকে আমার ওইভাবেই ভাল লাগে। এখন থেকে তো তুমি সারাক্ষণ আমার কাছে থাকবে, অনেক অনেক আদর করবো, তুমি দেখে নিও।"

তিতির কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।

কিন্তু মুগ্ধর চোখে আর ঘুম নেই, চলছিল বিরামহীন তুফান বাইরে ও ভেতরে!

ভোরে তিতিরের ঘুম ভাঙতেই দেখলো ও আর মুগ্ধ জড়াজড়ি করে একটা কাঁথার মধ্যে শুয়ে আছে। মুগ্ধ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, ইশ কী মায়াবী লাগছে। কিন্তু বাসায় তো পিউ আছে। পিউ থাকতেও মুগ্ধ ওর সাথে ঘুমালো! পিউ কি মনে করলো! ধ্যাত, ছেলেটার না একফোঁটা লজ্জা নেই। উঠে বসতেই কাঁথা সরে গেল আর ও অবাক হয়ে দেখলো ওর গায়ে কিচ্ছু নেই। শুধু একটা সালোয়ার পড়া। তাড়াতাড়ি কাঁথাটা টেনে গায়ে জড়ালো। মনে করতে চেষ্টা করতে লাগলো কাল রাতে কি হয়েছিল! কিছুতেই মনে করতে পারছে না। ওদিকে কাঁথা টান দিতেই মুগ্ধর ঘুম ভেঙে গিয়েছে। মুগ্ধ বলল,

-"এখন আর ঢেকে কি হবে?"

তিতির লজ্জায় প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,

-"তুমি এটা কেন করলে?"

মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,

-"হায় খোদা! এখন আমার দোষ হলো?"

তিতির কিছু বলল না। মুগ্ধ উঠে বাথরুমে গেল আর বলল,

-"ড্রেস পড়েন।"

মুগ্ধ বাথরুমে ঢুকতেই তিতির তাড়াতাড়ি কাপড় পড়ে নিল। ভাবতে লাগলো কি হয়েছিল রাতে? মুগ্ধ ওভাবে কথা বলল যে! ও নিজেই কি জ্বরের ঘোরে কিছু করেছে? মুগ্ধ ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ইয়ারফোন লাগালো। তারপর একটা নিজের কানে দিয়ে আরেকটা তিতিরের দিকে এগিয়ে দিল। তিতির বলল,

-"এটা কি?"

মুগ্ধ মুচকি হেসে বলল,

-"শোনোই না মন দিয়ে।"

রেকর্ডিংটা শুনতে শুনতে তিতির লজ্জায় লাল, নীল, বেগুনী হয়ে গেল। কি করবে কোথায় লুকোবে বুঝতে পারছিল না। পুরোটা শোনার পর তিতির আর লজ্জায় মুগ্ধর দিকে তাকাতে পারছিল না। মুগ্ধ বলল,

-"কি বুঝলে? কিছু বলো?"

তিতির একটা কথাও বলল না। মুগ্ধ মিটিমিটি হাসছিল আর বলছিল,

-"আহা! এখন লজ্জা পাচ্ছো কেন? এখন তোমার আশিকি কোথায় গেল?"

প্রেমাতাল - পর্ব ৪৯

মৌরি মরিয়ম

মা আর স্নিগ্ধ ফেরার পর ওরা সবাই মিলে মিটিং এ বসলো। তিতির বসলো একদম মুগ্ধর মার গা ঘেঁষে। মা ওকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল। প্রথম কথা উঠলো কাকে কাকে দাওয়াত করা হবে। মুগ্ধ বলল,

-"এত দাওয়াত ফাওয়াতের কি দরকার মা? আপাতত নিজেরা নিজেরাই করি। কয়েক মাস পরে নাহয় অনুষ্ঠান করবো, তখন সবাইকে দাওয়াত দিও?"

মা বলল,

-"হ্যা সেটা তো করতেই হবে। কিন্তু এখনও তো তোর চাচা,ফুপী,মামা খালাদের না বলে পারবো না। অন্তত যারা ঢাকায় আছে।"

-"না মা, কাউকেই বলোনা। লাগলে সামনের মাসেই অনুষ্ঠান টা করবো। তবু আজ কাউকে বলো না।"

-"কিন্তু বিয়ের জন্য সাক্ষী লাগে।"

-"আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ডদের ডেকে নিচ্ছি। রিলেটিভ কাউকে চাচ্ছি না। জানি এসেই পিঞ্চ করতে শুরু করবে, আজকের দিনে আমি মেজাজ খারাপ করতে চাই না।"

-"আচ্ছা ঠিকাছে কিন্তু বাবা বিয়ে পড়াতে কাজী আসবে, রেজিস্ট্রি করতে উকিল আসবে, তোর ফ্রেন্ডরা আসবে তাই রান্নাবান্নার ব্যবস্থা তো কিছু করতে হবে।"

-"হ্যা, সেটা তোমার যা মন চায় করো।"

-"বাসায় প্রায় সবই আছে।শুধু টুকটাক কিছু বাজার লাগবে।"

-"আচ্ছা আমি আর স্নিগ্ধ যাচ্ছি বাজারে, কি কি লাগবে লিস্ট করে দাও।"

-"দুজন গিয়ে কি করবি? তুই একা যা। স্নিগ্ধকে অন্য কাজে পাঠাবো।"

স্নিগ্ধ বলল,

-"কি কাজ আম্মু?"

মা বলল,

-"ওইযে ফুলের কাজ করে না? তুই ওদের আনতে যাবি। বাসরঘর সাজাবার জন্য।"

তিতির লজ্জা পেল, কিন্তু কিছু বলল না। ছোট ভাইবোনদের সামনে মুগ্ধও যেন একটু লজ্জা পেয়ে গেল। বলল,

-"আরে না মা। বাসরঘর সাজানো লাগবে না।"

-"একটা থাপ্পড় মারবো যদি সবকিছুতে না না করিস। বিয়ে যেমনভাবেই হোক সেটা প্রত্যেকটা মানুষের জীবনের খুব স্পেশাল একটা দিন। সেটাকে স্পেশাল করার জন্য কিছু তো করতেই হবে। এই দিন জীবনে বারবার আসবে না।"

-"আচ্ছা আচ্ছা যা মন চায় করো।"

-"উকিল আর কাজীর সাথে কথা বলেছিস?"

-"হ্যা, ওনারা সন্ধ্যা ৬ টায় চলে আসবে।"

-"আচ্ছা।"

মা এবার তিতিরের দিকে ফিরে বলল,

-"মা চলো আমরা একটু শপিং এ যাই। তোমাকে বউ সাজাতে হবে না?"

তিতির বলল,

-"না না, আন্টি আমি এখন শপিং এ যাব না।"

-"এখনো আন্টি বলছো? মা বলো।"

তিতির হেসে বলল,

-"হ্যা মা। আমার মা।"

-"হ্যা, এবার বলো শপিং এ কেন যেতে যাচ্ছো না?"

-"এখন বিয়েটাই সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্ট মা। কি পড়লাম কি সাজলাম সেটা আমার কাছে ইম্পরট্যান্ট না। শুধু শুধু টাকা নষ্ট করে কি লাভ? সময়ওতো নষ্ট হবে। আপনার ছেলের কাছে আমার কয়েকটা শাড়ি আছে। সেখান থেকে একটা শাড়ি পড়ে নেব।"

মা তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

-"মাগো, তোমার শ্বশুর বেঁচে থাকলে দেখতে কত কি করতো। আমাদের তো পালিয়ে বিয়ে হয়েছিল। খুব সাদামাটাভাবে হয়েছিল আমাদের বিয়ে। তাই মুগ্ধর বিয়ে নিয়ে আমাদের দুজনের অনেক স্বপ্ন ছিল। ইচ্ছে করছে না এমন চুপচাপ বিয়ে দিতে। যাই হোক, তুমি যখন চাইছো না শপিং এ যেতে আমি জোর করবো না। কিন্তু বউ তো সাজতে হবে মা। পালিয়ে গিয়ে আমাদের বিয়ে হলেও তোমার শ্বশুর আমাকে বেনারসি শাড়ি দিয়েছিল বিয়েতে। খুব যত্ন করে রেখেছিলাম মুগ্ধর বউয়ের জন্য। তুমি কি আজ ওটা পড়বে? আর মুগ্ধর বউয়ের জন্য যে গয়নাগুলো বানিয়েছিলাম সেগুলো?"

-"অবশ্যই পড়বো মা। আমি শুধু শপিং এ যেতে চাচ্ছিলাম না। আপনার বিয়ের শাড়ি পড়বো এটাতো আমার সৌভাগ্য।"

-"আচ্ছা ঠিকাছে তাহলে।"

বিকাল ৪ টা। তিতির মুগ্ধর ঘরের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখছে। সাজগোজ কিছু নয়, শুধু একটা লাল বেনারসি। মুগ্ধর মায়ের বিয়ের বেনারসি। আর কানে ঝুমকা, গলায় নেকলেস, হাতে চুড়ি, কপালে টিকলি-টায়রা, নাকে নথ আর চোখে গাঢ় করে কাজল লাগিয়েছে ব্যাস। ঘরের বিছানায় লাল রঙের একটা বেডকভার দেয়া হয়েছে। বিছানার উপর বেলী আর গোলাপ ফুল দিয়ে বাসরঘর সাজানো হয়েছে, সিম্পলভাবে সাজানো হয়েছে কিন্তু তিতিরের মনে হলো এত সুন্দর বাসরঘর এর আগে কোনদিনও দেখেনি ও। আজ রাতে এই বিছানায়ই মুগ্ধর হাতে তিতিরের মরণ হবে, সুখের মরণ। ভাবতেই লজ্জা লাগলো তিতিরের।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেয়ে তিতির ফিরে তাকাতেই সাদা পাঞ্জাবী পড়া মুগ্ধকে দেখতে পেল। মুগ্ধ ওকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লো। ইশ কি সুন্দর দেখাচ্ছে তিতিরকে। মুগ্ধ তিতিরের দিকে এগিয়ে গেল। ও এমন হা করে তাকিয়ে আছে যে তিতিরের লজ্জাই করছে। মুগ্ধ কাছে এসে আঁচলটা তুলে ঘোমটা দিয়ে দিল তিতিরের মাথায়। তারপর মুখটা দুহাতে ধরে বলল,

-"পুরা বউ, তোমাকে যে কি সুন্দর লাগছে তিতির। বলে বোঝাতে পারবো না। অসাধারণ অসাধারণ। দাঁড়াও.."

একথা বলেই মুগ্ধ আলমারির দিকে গেল। আলমারি খুলে সিলেটের সেই লাল টিপের পাতাটা বের করলো। একটা টিপ উঠিয়ে তিতিরের কপালে পড়িয়ে দিল। তারপর বলল,

-"একদম পারফেক্ট বউ আমার।"

তিতির মুচকি হাসলো। বলল,

-"এই তুমি যে এমন সময় ঘরে এলে কেউ কিছু মনে করবে না?"

-"আরে না।"

-"আমি বাইরে যাই, কেউ যদি চলে আসে?"

মুগ্ধ তিতিরকে যেতে দিল না। বলল,

-"সবাই ব্যাস্ত, কেউ আসবে না। আর শোনো একটা কথা, আমি বোধহয় এ মাসে ছুটি পাব না। তাই হানিমুনের জন্য তোমাকে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে।"

-"আমার কোন সমস্যা নেই।"

-"কাছে কোথাও গেলে যেতে পারতাম শুক্র, শনি বার।"

-"আমরা কোথায় যাব?"

-"কেন কাশ্মীর। সব ভুলে গেছো? আমরা প্ল্যান করেছিলাম না হানিমুনে কাশ্মীর যাব?"

-"ভুলিনি, মনে আছে। তবু যদি চেঞ্জ করো তাই জিজ্ঞেস করলাম।"

-"না চেঞ্জ করবো কেন? যেরকম প্ল্যান হয়েছিল সেরকমই হবে। যেহেতু ১২ দিনের ট্রিপ তাই এখনই যেতে পারছি না। এতগুলো দিনের ছুটি হুট করে পাওয়া সম্ভব না।"

-"আচ্ছা আচ্ছা সমস্যা নেই তো।"

-"তোমার পাসপোর্ট আছে?"

-"না।"

-"ওহ, তাহলে এর মধ্যে পাসপোর্ট টাও করে ফেলবো।"

-"আচ্ছা।"

"আচ্ছা তিতির, এসবের কোন মানে হয় বলো?"

-"কোন সবের?"

-"এইযে.... বাসরঘর রেডি, বিছানা রেডি, বর রেডি, বউ রেডি। অথচ শুধু একটা বিয়ের জন্য বসে থাকতে হচ্ছে, এর কোন মানে হয়? চলো শুরু করে দিই?"

তিতির মুগ্ধর বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল,

-"যাহ, যত্ত আজেবাজে কথা!"

-"এহ, আজেবাজে কথা আমি বলি? কাল রাতে কি বলেছিলে? আমি হাগ আর কিস ছাড়া কিছুই করতে পারি না! আর শুধু কি বলা! কি যে করেছো! আমার ইজ্জত যায় যায় অবস্থা, প্যান্ট ধরে টানাটানি! ছিঃ এই ছিল তোমার মনে?"

তিতির লজ্জায় লুটিয়ে পড়ছিল। নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধ বলল,

-"আজকে রাতে যে তোমার কি হবে তিতির! রেডি থেকো। কাল সারারাত আমাকে কষ্ট দিয়েছো। সব শোধ তুলবো আজ রাতে। খালি বিয়েটা হয়ে যেতে দাও। খুব ভালভাবে বোঝাবো মুগ্ধ কি পারে আর কি পারে না।"

তিতির মুগ্ধর বুকে কিল মারতেই মুগ্ধ তিতিরকে জড়িয়ে ধরলো। জড়িয়ে ধরলো মুগ্ধও। তিতির বলল,

-"তুমি আমাকে আর গান শোনাও না কেন? সেইযে সিলেট গিয়েছিলাম। দু'দিনে একটা গানও শোনাওনি।"

-"তখন কি গান গাওয়ার মত মন মানসিকতায় ছিলাম? তুমিও তো শুনতে চাওনি।"

-"তা অবশ্য ঠিক।"

-"দুজনেরই তো তখন বুকের ভেতর কষ্টের চাষবাস চলছিল।"

-"হুম।"

-"এখন শুনবে?"

-"হ্যা। কিন্তু কেউ শুনলে কি ভাববে?"

-"শুধুমাত্র বাংলা সিনেমাতেই সম্ভব অনেক দূর থেকেও গান শুনতে পাওয়া। এটা বাস্তব, তাই এখানে বসে গাইলে তা বাইরে যাবেও না। আর কেউ হুট করে আসবেও না।"

-"তাহলে শুনবো, গাও.. আমি কান পেতে আছি।"

-"এটা আমার অনেক অনেক প্রিয় একটা গান তিতির। কিন্তু তবুও এই গানটা আমি কখনো তোমাকে শোনাইনি। জমিয়ে রেখেছিলাম বিয়ের রাতে তোমাকে শোনাব বলে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি রাতে গান টান গাওয়ার যময় পাব না। তাই এখনই শোনাচ্ছি।"

তিতির লজ্জা পেয়ে সরে যাচ্ছিল,

-"উফফফ তুমি না!"

মুগ্ধ ওকে আবার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে দেয়ালে হেলান দিয়ে গাইতে শুরু করলো,

"বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি

বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি

আজকে আমার প্রাণ পেয়েছে

অনেক নতুন ভাষা

অনেক দিনের স্বপ্ন যে

অনেক দিনের আশা

বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি

বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি

তোমায় পেয়ে হয় যে মনে

আর জনমেও সাথে ছিলাম

আমরা দুজন মনের সুখে

অনেক জনম ঘুরে এলাম

চিরদিনই থাকবে একই

আমাদের এই ভালবাসা

বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি

বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি

তুমি আমার অনেক আপন

মেনে নিয়েও বলে এমন

হওনা তুমি আরো কাছে

হওনা তুমি আরো আপন

এক সাগরে মিলবো বলে

তোমার আমার স্রোতে ভাষা।

বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি

বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি

আজকে আমার প্রাণ পেয়েছে

অনেক নতুন ভাষা

অনেক দিনের স্বপ্ন যে

অনেক দিনের আশা

বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি

বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি!"

To be continued...প্রেমাতাল

পর্ব ৫০

মৌরি মরিয়ম

তিতির বরাবরই এভাবে মুগ্ধর বুকে মাথা রেখে গান শুনতে পছন্দ করে। মুগ্ধর বুকের পাঁজর যেন প্রতিটা ধুকধুক এর মধ্য দিয়ে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় তিতিরের গাল। আর গানের প্রতিটা কথা, সুর সাথে প্রিয় মানুষটার কণ্ঠস্বর কানের এত কাছে! গান শেষ করে তিতিরের কানে কানে মুগ্ধ বলল,

-"আজ রাতে তো তুমি শেষ।"

তিতির লজ্জায় লজ্জায় এখনই শেষ হয়ে যাচ্ছে। দৌড়ে চলে যাচ্ছিল। মুগ্ধ হাত ধরে থামাতে গিয়ে খেয়াল করলো তিতিরের হাতে সুন্দর নকশা করা মেহেদি। বলল,

-"তুমি মেহেদি পড়েছো?"

-"হ্যা।"

-"আমি একদমই খেয়াল করিনি। কখন পড়লে? খুব সুন্দর হয়েছে। নতুন বউয়ের হাতে মেহেদি নাহলে কি হয়?"

-"জানো মাও এই কথাটাই বলেছিল। আমি পড়তে চাইনি প্রথমে, লজ্জা লাগছিল। পরে মা আর পিউয়ের জোরাজুরিতে পড়েছি।"

-"কখন লাগিয়েছো? আমি তো দেখলামই না।"

-"তুমি তখন বাজারে গিয়েছিলে। বাজার দিয়েই তো আবার চলে গেলে।"

-"হ্যা, কাজ ছিল তো। নিজের বিয়ের সব আয়োজন তো নিজেকেই করতে হচ্ছে।"

-"হুম, সেজন্যই দেখতে পাওনি।"

-"অল্পসময় রেখেছো তবু কি সুন্দর গাঢ় রঙ হয়েছে দেখেছো? তার মানে হচ্ছে তোমার বর তোমাকে অনেক ভালবাসবে।"

-"আমার বর তো আমাকে এমনিতেই অনেক ভালবাসে, মেহেদির রঙে কিছু যায় আসে না।"

মুগ্ধ ওকে কাছে এনে বলল,

-"ভালবাসা তো আজ রাতে টের পাবে সুন্দরী।"

তিতির এক ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে। মুগ্ধ হাসতে লাগলো।

কিচ্ছুক্ষণ পর ঘর থেকে বের হতেই মুগ্ধর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল ড্রইং রুমে ইকরাকে দেখে। সাথে ফুপীও আছে। মা কি ওদেরকে বলেছে নাকি ওরা নিজ দায়িত্বে এসে হাজির হয়েছে? মা ভয়ে ভয়ে তাকালো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ কিছু বলল না। তবে আশেপাশেই থাকলো। কারন তিতির ওখানেই আছে, কখন যে ফুপী তিতিরকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে বসে তার ঠিক নেই।

যেমন চিন্তা করলো তেমনই হলো কিছুক্ষণ পরই ফুপী তিতিরকে জিজ্ঞেস করলো,

-"এভাবে বাবা-মা কে না জানিয়ে বিয়ে করছো তোমার ভয় করছে না?"

তিতির কি বলবে ভেবে পেল না আবার চুপ করে থাকলেও তো বেয়াদব ভাববে। ও ভাবতে ভাবতেই মুগ্ধ গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে উত্তর দিল,

-"ফুপী, সবার বিয়েতে যে বাবা-মা থাকবে এমন তো কোন কথা নেই। আমার বাবা-মার বিয়েতেও তো মায়ের বাবা-মা ছিল না। তো? তারা কি সুখী হয়নি?"

-"তোর বাবা-মায়েরটা তো অন্য ব্যাপার ছিল। ভাবীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল তাই।"

মা জানে মুগ্ধ আরো কথা বললে ওর মুখের লাগাম ছুটে যাবে। তাই মুগ্ধ কিছু বলার আগেই মা বলল,

-"ওদের ব্যাপারটা আমাদেরটার চেয়েও বেশি অন্য ব্যাপার। তোমরা তো সবটা জানো না তাই বুঝতে পারছো না।"

যেহেতু মা বলেছে তাই মুগ্ধ আর এব্যাপারে কিছু বলল না। পিউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

-"পিউ তুই তিতিরকে নিয়ে তোর ঘরে বা আমার ঘরে যা। আমার ফ্রেন্ডরা চলে এসেছে নিচে। এক্ষুনি ওপরে চলে আসবে।"

পিউ তিতিরকে নিয়ে মুগ্ধর ঘরে গেল। ইকরা লুকিয়ে চোখেরজল মুছে নিল তবু মুগ্ধর চোখ এড়ালো না। ইকরা কাঁদছে, কাঁদুক! শুধু ভালবাসলেই তো আর হয়না। ভালবাসার সঠিক পথটাও জানতে হয়।

মুগ্ধর ফ্রেন্ড তমাল চলে এসেছে। তমাল বলল,

-"এতদিনে তাহলে বিয়ে করছিস।"

মুগ্ধ হাসতে হাসতে বলল,

-"কথা বলবিনা শালা, মেরে নাক ফাটিয়ে দেব। তুমি তো তোমার হিরোইনের সাথে বাচ্চাকাচ্চা ফুটিয়ে ফেলেছো আর আমি কেবল সুখের মুখ দেখলাম।"

তমাল মুগ্ধর কাধে হাত রেখে বলল,

-"সরি দোস্ত, আমার বোকামির জন্যই তোদের দুজনের জীবনে কাল নেমে এসেছিল। সেদিন আমার ওই কাজ করা উচিৎ হয়নি। সুপ্তিকে তো আমি ঠিকই বিয়ে করতে পেরেছি। কিন্তু আমার পাপে তোরা..."

মুগ্ধ তমালকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

-"আরে থাম ভাই, ওইসব কথা বলে লাভ নেই। কপালে যা ছিল তাই হয়েছে, এখনো কপালে যা আছে তাই হতে চলেছে।"

তমাল চুপ, মুগ্ধ আবার বল,

-"সুপ্তি আর বাচ্চাদের আনিসনি কেন?"

-"সুপ্তি ওর বাবার বাড়িতে। পরে একদিন বউ দেখাতে নিয়ে আসবো।"

ওরা কথা বলতে বলতেই মুগ্ধর অন্য ফ্রেন্ডরা চলে এল। সবাই গল্পগুজব করছে। মা রান্নাবান্নায় ফিনিশিং দিতে গিয়েছে। ফুপী তাকে হেল্প করছে। ইকরা আর স্নিগ্ধও ড্রইং রুমের এক কোনায় বসে গল্প করছে। পিউ এসে ইকরাদের সাথে জয়েন করলো। তার মানে তিতির এখন একা। মনটা বারবার তিতিরের কাছে যেতে চাইছে। সবার চোখের আড়াল থেকে পা পিছিয়ে পিছিয়ে মুগ্ধ চোরের মত গিয়ে ঘরে ঢুকলো। তিতির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করছিল। আচ্ছা, এজন্যই তাহলে পিউ বেড়িয়ে গিয়েছে। মুগ্ধ আচমকা গিয়ে তিতিরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। তিতির লাফিয়ে উঠলো।

-"উফ তুমি না!"

-"ভয় পেলে কেন? কি ভেবেছিলে অন্য কেউ?"

-"নাহ, তবে হঠাৎ তো তাই চমকে গিয়েছিলাম।"

মুগ্ধ পেছন থেকেই তিতিরের কানের নিচে একটা চুমু দিল। তারপর বলল,

-"এই পৃথিবীতে মুগ্ধ ছাড়া আর কেউ কি আছে যে তোমার গায়ে টাচ করতে পারে?"

তিতির মুগ্ধর দিকে ঘুরে গলা জড়িয়ে ধরে চোখে চোখ রাখলো। মুগ্ধ তিতিরের কোমরে হাত রাখলো। বলল,

-"লেটস হ্যাভ আ কিস! ইট উইল বি দ্যা লাস্ট কিস অফ আওয়ার আনম্যারেড আইফ।"

তিতির চোখ নামিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। মুগ্ধ তিতিরের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে নিবিড়ভাবে চুমু খেল। তিতির ভেসে গেল অন্য কোন দুনিয়ায়। সিলেটের পর এই প্রথম মুগ্ধর এত কাছে আসা। যদিও কাল থেকে নাকি অনেক কিছুই হয়েছে সেসব কিছুই সেভাবে খেয়াল নেই তিতিরের। মুগ্ধ বলার পর সব মনে পড়লেও অনুভূতিগুলো তো আর পাওয়া যায় না। দুজনেই দুজনকে বেহুঁশ হয়ে চুমু খাচ্ছে। কেউই কেউকে ছাড়ছে না। কতক্ষণ যে পার হয়ে গেল কে জানে! হঠাৎ রিংটোন বেজে উঠতেই তিতির ছেড়ে দিল,

-"যাও তোমার ফোন এসেছে।"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"আমার ফোন পকেটে, তোমার ফোন এসেছে।"

মুখে হাসলেও মুগ্ধর কলিজার ভেতর অজানা একটা ভয় একটা কামড় দিয়ে উঠলো। তিতিরের ফোনটা বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখা ছিল। তিতির ফোনটা হাতে নিয়েই ছুঁড়ে ফেলে দিল বিছানার ওপর। যেন ইলেক্ট্রিক শক লেগেছে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। মুগ্ধর দিকে ফিরে ভয়ে ভয়ে বলল,

-"ভাইয়া।"

মুগ্ধর সারা শরীরের রক্ত যেন পানি হয়ে গেল। যা বোঝার বুঝে গেল মুগ্ধ। ফোনটা তুলে তিতিরের হাতে দিয়ে বলল,

-"ফোনটা ধরো।"

-"না প্লিজ, আমি ফোন ধরবো না।"

-"তিতির, আমাদের কপালে যা আছে তাই হবে তুমি ফোনটা ধরো। আমার মনটা কেমন যেন করছে।"

-"না আমি ফোন ধরতে পারবো না।"

ওরা কথা বলতে বলতে কলটা কেটে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা মেসেজ এল। তিতির বলল,

-"ভাইয়া মেসেজ দিয়েছে। আমার ভয় করছে মেসেজ টা ওপেন করতে। কোন বিপদ কি হয়েছে? আমি কি চলে এসে ভুল করলাম?"

মুগ্ধ ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ ওপেন করলো। মেসেজটায় ছিল,

"Baba heart attack koreche kalke, amader kauke kichu boleni. Aj amra ter peye hospital e anlam, sathe sathe emargency te admit koreche.. Dr. boleche onk deri hoye gese, Allah ke dakte... R kichu paren r na paren plz ektu doa korben, apnader notun jibon shuker hok!"

মুগ্ধ তিতিরকে বলল,

-"তিতির, আমাদেরকে বের হতে হবে এক্ষুনি।"

তিতির মোবাইলটা হাতে নিয়ে মেসেজটা পড়েই ফ্লোরে বসে পড়ে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-"আমার পাপে সব হয়েছে, শুধু এই ভয়টা পেয়ে আমি এতবছর আসতে পারিনি।"

-"এসব বলার বা ভাবার সময় এখন না তিতির। প্লিজ তুমি ওঠো।"

তিতিরকে ধরে ওঠলো মুগ্ধ। তিতিরের দৃষ্টি এলোমেলো। কেঁদেই চলেছে, কিছু করার নেই.. পুরো পৃথিবীটা ভেঙে পড়েছে ওর মাথার উপর। ওর বাবা কি চলে যাবে? নাহ, আল্লাহ যেন এতবড় শাস্তি ওকে না দেয়। বাবাকে ও সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। বাবার কিছু হলে ও নিজেকে কক্ষনো ক্ষমা করতে পারবে না। আল্লাহ ওর পাপের শাস্তি যেন ওর বাবাকে না দেয়। মুগ্ধ বলল,

-"আরে কি হলো চলো? আর তার আগে শাড়িটা পালটে নাও। বাবা এভাবে তোমাকে দেখলে তার আরো ক্ষতি হতে পারে।"

তিতির গয়নাগাটি সব খুলল। তাড়াহুড়ো করে হাতের চুরি খুলতে গিয়ে খোদাই করা ডিজাইনের ঘষা লেগে হাত কেটে গেল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না তিতির। মুগ্ধ যে ঘরে আছে সেদিকে খেয়াল নেই তিতিরের, ওর সামনেই শাড়ি খুলতে লাগলো। উফফ এত সেপটেপিন কেন লাগিয়েছে শাড়িতে! মুগ্ধ হেল্প করলো।

সবগুলো সেপটেপিন খোলা হতেই মুগ্ধ আলমারি থেকে একটা শার্ট নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। দরজার বাইরে গিয়েই পাঞ্জাবিটা খুলে শার্ট টা পড়ে নিল। ওকে এভাবে চেঞ্জ করতে দেখেই মা কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,

-"কি হয়েছে মুগ্ধ? চেঞ্জ করলি? আর তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?"

-"তিতিরের বাবা হার্ট এট্যাক করেছে।"

মা নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। এর মধ্যে তিতির শাড়ি গয়না হাতে নিয়ে সালোয়ার কামিজ পড়ে বেড়িয়ে এল। ওগুলো মায়ের হাতে দিয়ে বলল,

-"আমাকে মাফ করবেন মা।"

মা বলল,

-"এসব কথা এখন রাখো। তাড়াতাড়ি যাও।"

তিতির মুগ্ধর দিকে তাকাতেই মুগ্ধ বলল,

-"চলো।"

ওরা বেড়িয়ে গেল। সামান্য কজন অতিথিরা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।

মুগ্ধর ৭ তলার বাসা থেকে লিফটে উঠতেই তিতির তাকিয়ে দেখলো ম্যাক্সিমাম ফ্লোরে লিফট কল করা আছে অলরেডি। ৬ তলায় লিফটের দরজা খুলতেই তিতির মুগ্ধর হাত ধরে টেনে বের করলো। তারপর সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে লাগলো। অগত্যা মুগ্ধও দৌড় লাগালো। তিতিরের কান্না এক সেকেন্ডের জন্য থামেনি। গাড়িতে ওঠার পর থেকে তিতির বারবার ঘড়ি দেখছিল। মুগ্ধ বলল,

-"টেনশন করোনা। রাস্তায় জ্যাম নেই তাড়াতাড়িই পৌঁছে যাব। তান্নাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করো বাবা কোন হসপিটালে আছে?"

তিতির তাই করলো। তান্না কোন উল্টোপাল্টা কথা বলল না। সোজাসুজি বলে দিল কোন হসপিটালে আছে। মুগ্ধ বলল,

-"এ সব কিছুর জন্য আমি দায়ী। আমার কাছে আসার জন্য যদি আমি তোমার উপর প্রেশার ক্রিয়েট না করতাম তাহলে তুমি আসতেও না আর এই অঘটন টাও ঘটতো না।"

-"নিজেকে দোষ দিও না। তুমি প্রেশার ক্রিয়েট না করলেও আমি আসতাম। বাসায় আমার উপর দিয়ে যা যাচ্ছিল তা আমি মানতে পারছিলাম না আর। তাই আমি গিয়েছি। কিনতি এটাও সত্যি বাবা নির্বাক ছিলেন সবকিছুতে। মা আর ভাইয়ার অত্যাচারে যেমন বাবা বাধা দেননি তেমনি নিজে এমন কোন কথা বলেনি যাতে আমি কষ্ট পাই। আর আমি বাবাকে এতটা কষ্ট দিলাম? আমি মানুষ না। আমি সত্যিই একটা কুলাঙ্গার।"

-"এসব বলেনা তিতির। সব ঠিক হয়ে যাবে।"

তিতির ঠোঁট কামড়ে ধরে কাঁদছে। চোখের পানি গাল বেয়ে বেয়ে পড়ে ওর জামা ভিজে গেছে। মুগ্ধর তো ক্ষমতা নেই এই কান্না থামাবার। আল্লাহ কেন এত কঠিন মুহূর্ত লিখে রাখে কপালে! মুগ্ধ বলল,

-"কাঁদেনা তিতির, কাঁদেনা। আমি বাবাকে হারিয়েছি। আমি বুঝি বাবা হারানোর কষ্টটা কেমন। তুমি অনেক ভাল আর অনেক লক্ষী একটা মেয়ে আল্লাহ তোমাকে এত তাড়াতাড়ি এতটা কষ্ট দেবে না, দেখে নিও কিচ্ছু হবে না বাবার। তুমি তো বাবার কাছেই যাচ্ছো। তোমাকে দেখলে বাবার বুকের কষ্ট একদম কমে যাবে।"

তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,

-"আমাকে ভালবেসে তুমি শুধু কষ্টই পেলে। আমি একটু সুখ দিতে পারলাম না তোমাকে।"

মুগ্ধ বাম হাতটা তিতিরের গালে রেখে চোখ মুছে দিয়ে বলল,

-"পাগলী এভাবে ভেবো না। যা পেয়েছি তা হাজার জনম তপস্যা করেও সবাই পায়না। আমার কোন আক্ষেপ নেই। তুমি আমার ভাগ্যেই লেখা নেই। এটা আমি মেনে নিলাম আজকে, তুমিও মেনে নাও।"

প্রেমাতাল - সকল পর্ব

তিতির মুগ্ধর হাতটা ধরে কাঁদতে লাগলো। আজ শনিবার, রাস্তায় কোন জ্যাম নেই কিন্তু রাস্তা শেষই হচ্ছে না। বনানী থেকে ধানমন্ডি এটুকু রাস্তা যেন আজ হাজার মাইলের দূরত্ব হয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটা যেন একটা সেকেন্ডের ঘর পার করতে ৫ সেকেন্ড সময় নিচ্ছে।

To be continued...

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url