আমি পদ্মজা - পর্ব ৪১-৪২-৪৩-৪৪ | Golpo Porun

আমি পদ্মজা

(ইলমা বেহরোজ)

poddoja
This photo is from Pexels

আমি পদ্মজা - ৪১

সূর্যমামার ঘুম ভাঙতে তখনো বাকি। তবে তার আগেই ডাকাডাকি করে সবার ঘুম ভাঙানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে পাখিরা। পদ্মজা স্বামীর বুকের ওম ঝেড়ে ফেলে অজু করে আসে। এসে দেখে তার সোহাগের স্বামী এখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পদ্মজা ডেকে তুলে, একসাথে ফজরের নামায আদায় করে। নামায শেষ করেই আমির ঘুমিয়ে পড়ে। পদ্মজা রান্নাঘরে যায়। গিয়ে দেখে,ফরিনা বেগম এখনও আসেননি। আজ মেট্রিক পরীক্ষার ফলাফল। উত্তেজনায় পদ্মজার সর্বাঙ্গ কাঁপছে। সে পায়চারি করতে করতে লাবণ্যর ঘরের সামনে আসে। দরজা খোলা। পদ্মজা বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখল, রানি মাটিতে বসে আছে। উদাস হয়ে কিছু ভাবছে। রাতে ঘুমায় না। নিজের মতো জগত করে নিয়েছে। খাবার রেখে যাওয়া হয়,যখন ইচ্ছে হয় খায়। পদ্মজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এরপর জায়গা ত্যাগ করল। রানি অন্য কাউকে দেখলে খুব রেগে যায়। তাই এই ভোরবেলা তার সামনে না যাওয়াই মঙ্গল। পদ্মজা সদর ঘরে পায়চারি করতে থাকল। ফরিনা বেগম তাসবিহ পড়তে পড়তে সদর ঘরে প্রবেশ করেন। পদ্মজাকে দেখে প্রশ্ন করলেন, 'উইট্টা পড়ছ তুমি! চুলায় আগুন ধরাইছো?'

পদ্মজা অপরাধীর মতো মাথা নত করে 'না' উচ্চারণ করল। ফরিনা এ নিয়ে কথা বাড়ালেন না। মৃদু কণ্ঠে আদেশ করলেন, 'লাবণ্যরে ডাইককা তুলো গিয়া। ছেড়িডা আইজও মানুষ হইলো না। ভোরের আলো ফুইটা গেছে। হে এহনও ঘুমায়।'

'আচ্ছা,আম্মা।'

আমি পদ্মজা - সকল পর্ব

পদ্মজা আবার লাবণ্যর ঘরের সামনে আসল। এবার আর বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে চলে যায়নি। ভেতরে ঢুকল। পদ্মজা আওয়াজ করে দরজা খুলে। তাও রানির ভাবান্তর হলো না। সে যেভাবে মাটিতে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল,সেভাবেই রয়েছে। পদ্মজা রানির দিকে চেয়ে চেয়ে পালঙ্কের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এরপর লাবণ্যকে ডাকল, 'এই লাবণ্য। লাবণ্য?' 

লাবণ্য আড়মোড়া ভেঙে ঘুমু ঘুমু চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে বলল, 'উ?'

'আজ ফলাফল। আর তুই ঘুমাচ্ছিস।'

পদ্মজার কথা বুঝতে লাবণ্যর অনেক সময় লাগল। যখন বুঝতে পারল লাফিয়ে উঠে বসল। বুকে হাত রেখে, হাসঁফাঁস করতে করতে বলল, 'কী বললি এটা! দেখ কলিজাডা লাফাইতাছে। কী ভয়ানক কথা মনে করায়া দিলি, উফ!'

পদ্মজা হাসল। বলল, 'কলিজা লাফায় না,বুক ধুকপুক করে।'

'হ,ওইটাই...ওইটাই। আমি ফেইল করব। রানি আপার মতো মাইর খাব দেখিস। আমার শ্বাস কষ্ট হইতাছে।' লাবণ্য ভয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সে আতঙ্কে আছে। এই চিন্তায় রাতে ঘুম আসেনি। ঘুমাতে ঘুমাতে মাঝরাত হয়ে গেছে। পদ্মজা লাবণ্যর ছটফটানি দেখে ভয় পেয়ে যায়। স্বান্ত্বনা দিয়ে বলল, 'এমন কিছুই হবে না, দেখিস। বেহুদা চিন্তা করছিস। সূর্য উঠে যাবে। নামায পড় জলদি। আল্লাহর কাছে দোয়া কর।'

লাবণ্য হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে,কলপাড়ে ছুটে যায়। এইবার পদ্মজা হেসে ফেলল। রানির দিকে চোখ পড়তেই হাসিটা মিলিয়ে যায়। রানি কাঁদছে। পদ্মজা দুই পা রানির দিকে এগিয়ে আবার পিছিয়ে যায়।

আবার এগিয়ে যায়। রানির পাশে বসে ডাকল, 'আপা?'

রানি চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে তাকায়। পৃথিবীর সব কষ্টরা বুঝি এক জোট হয়ে রানির চোখে ভীড় জমিয়েছে। রানি অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, 'প্রিয় মানুষ হারানোর কষ্ট এতোডা যন্ত্রনা কেন দেয় পদ্মজা? তুমি তো অনেক জ্ঞানী। সবাই তোমারে বুদ্ধিমতী কয়। তুমি একটা বুদ্ধি দেও না। এই কষ্টের পাহাড় কমানোর বুদ্ধি। আমারে দেখায়া দিবা শান্তির পথ?'

মানুষের কতটা কষ্ট হলে এভাবে শান্তি খুঁজে? পদ্মজার চোখ টলমটল করে উঠে। সে ঢোক গিলে বলল, 'পুরনো স্মৃতি মুছে সামনের কথা ভাবো। নামায পড়ো, হাদিস পড়ো,কোরআন পড়ো। একদিন ঠিক শান্তি খুঁজে পাবা।'

'আমার মতো পাপীরে আল্লাহ কবুল করব?'

'আল্লাহ তায়ালার মতো দয়াবান, উদার আর কেউ নেই। পাপ মুছার জন্য অনুতপ্ত হয়ে সেজদা দিয়েই দেখো না আপা। ক্ষমা চেয়ে দেখো। আল্লাহ ঠিক তোমার জীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনবেন। সেদিন বুঝবে,আল্লাহ তোমার সেজদা কবুল করেছেন।'

রানি জানালার বাইরে তাকায়। আমগাছের ডালে চোখ রেখে বলল, 'কেন এমনডা হইলো আমার সাথে?'

"ব্যভিচার করেছো আপা। বিয়ের আগে এভাবে...! আপা এসব ভেবো না আর। যা হওয়ার হয়েছে।'

'দুনিয়াত আর চাওনের বা পাওনের কিচ্ছু নাই আমার।'

'আখিরাতের জন্য সম্পদ জমাও এবার।'

রানি অন্যরকম দৃষ্টি নিয়ে পদ্মজার  দিকে তাকায়। পদ্মজা মাথায় সোজা সিঁথি করে সবসময়। এক অংশ সিঁথি দেখা যাচ্ছে। বাকিটুকু শাড়ির আঁচলে ঢাকা। মেয়েটা এত স্নিগ্ধ, এতো সুন্দর, এতো পবিত্র দেখতে! দেখলেই মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। পদ্মজা বলল,'আখিরাতের সম্পদ এবাদত, খাঁটি এবাদত।'

'তুমি খুব ভালো পদ্মজা।' রানি মৃদু হেসে বলল। তার চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। পদ্মজা অপ্রস্তুত হয়ে হাসল। বলল,'এখন নামায আদায় করতে পারবে? তাহলে পড়ে নেও।'

' ওইদিনডার পর আর গোসল করি নাই।'

'আজ করবে কিন্তু।'

'করব।'

'আসি?'

'আসো।'

পদ্মজা বেরিয়ে আসে। দরজার বাইরে পা রাখতেই রানির কান্নার স্বর কানে আসে। পদ্মজা থমকে দাঁড়ায়। পিছন ফিরে একবার রানিকে দেখে। রানি হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। পদ্মজা মনে মনে প্রার্থনা করে, 'আল্লাহ,ক্ষমা করে দাও রানি আপাকে। শান্তির পথে ফিরে  আসার রহমত দাও।'

__________________

বাড়ির সবাই মেট্রিক পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আমির সেই সকাল দশটায় বের হয়েছে। এখন বাজে,দুপুর তিনটা। লাবণ্য মিনিটে মিনিটে গ্লাস ভরে পানি খাচ্ছে। আর বার বার টয়লেটে যাচ্ছে। পদ্মজা ঝিম মেরে বসে আছে। হেমলতা সবসময় পদ্মজাকে বলতেন, মেট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়ার  জন্য। পদ্মজার একবার মনে হচ্ছে সে ফার্স্ট ডিভিশন ফলাফল করবে। আরেকবার মনে হচ্ছে, সেকেন্ড ডিভিশনে চলে যাবে। সে এক হাতের আঙুল দিয়ে অন্য হাতের তালু চুলকাচ্ছে। এই মুহূর্তে মাকে খুব মনে পড়ছে। কতদিন হলো,দেখা হয় না। প্রথম প্রথম  মায়ের জন্য প্রায় কাঁদতো সে। এখন অবশ্য মানিয়ে নিয়েছে। আছরের আযান পড়ছে। এখনও ফিরেনি আমির। পদ্মজা নামায পড়তে চলে যায়। নামায পড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। এরপর যা দেখল, খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে সে। আমিরের সাথে হেমলতা, পূর্ণা এসেছে। দুজনের পরনে কালো বোরখা। তিনজন আলগ ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলের দিকে আসছে। মাথার উপর কড়া রোদ নিয়ে মরুভূমিতে সারাদিন হাঁটার পর পথিক তৃষ্ণার্ত হয়ে পানির দেখা পেলে যেমন আনন্দ হয়,ঠিক তেমন আনন্দ হচ্ছে পদ্মজার। ইচ্ছে হচ্ছে দুই তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে নেমে যেতে। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। পদ্মজা উন্মাদের মতো দৌড়াতে থাকে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় উল্টে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। তবুও দৌড় থামল না। সদর ঘরের সবাইকে তোয়াক্কা না করে বাড়ির বউ ছুটে বেরিয়ে যায়। হেমলতা কিছু বুঝে উঠার আগেই তার নয়নের মণি ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে। পদ্মজার ছোঁয়ায় চারিদিকে যেন বসন্ত শুরু হয়। পূর্ণা পদ্মজাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে, ফোঁপাতে থাকল। পদ্মজা হেমলতার বুকে মাথা রেখে পূর্ণাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, 'এতদিনে আসতে মনে হয়েছে তোমাদের? এভাবে পর করে দিলে আম্মা? আর পূর্ণা,তুইতো আসতে পারিস। বোনকে মনে পড়ে না?'

শাড়ির আঁচল টেনে পদ্মজার মাথার চুল ঢেকে দিলেন হেমলতা। এরপর বললেন, 'মেয়ের শ্বশুরবাড়ি আসা কী এতই সোজা?' 

'তাহলে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর কী দরকার? যদি মা-বাবা সহজে না আসতে পারে।'

'আপা..আমার তোমাকে খুব মনে পড়ে।' পূর্ণা বাচ্চাদের মতো করে কাঁদছে। পদ্মজা পূর্ণার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, 'আমারও মনে পড়ে।'

হেমলতা পদ্মজার চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন, '৭৫০ মার্ক পেয়েছিস। স্টার মার্ক। ফার্স্ট ডিভিশন। এই খুশিতে আর কাঁদিস না।'

পদ্মজার চোখভর্তি জল। গাল,ঠোঁট  চোখের জলে ভেজা। এমতাবস্থায় হাসল। তাকে মায়াবী ভোরের শিশিরের মতো দেখায়। হেমলতা অন্দরমহলের সদর দরজার দিকে তাকিয়ে দেখেন, হাওলাদার বাড়ির বাকিরা তাকিয়ে আছে। তিনি পদ্মজাকে সরিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে আসেন। ফরিনা বেগমের মুখ দেখে পদ্মজার ভয় হচ্ছে। উনার মুখ আগে আগে ছুটে। আম্মাকে কিছু বলবেন না তো? 

হেমলতা সবাইকে সালাম দিয়ে বললেন, 'আমির ধরে নিয়ে আসলো।'

মজিদ হাওলাদার বিনীত স্বরে বললেন, 'এই প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছেন। আজ আসবেন আগে জানলে, গরু জবাই করে রাখতাম।'

হেমলতা হাসলেন। বললেন, 'বলেছেন, এই অনেক।'

'বললেই হবে না। করতে হবে। কয়দিন কিন্তু থেকে যাবেন।' 

'এটা বলবেন না। আজই ফিরতে হবে আমার। কিছুক্ষণ থেকেই চলে যাব।'

'প্রথম বার আসলেন আর কিছুক্ষণ থেকেই চলে যাবেন?'

'আবার আসব।  অনেকদিন থেকে যাবো।'

'আজকের রাতটা থেকে যান।'

'আম্মা আজ থেকে যাও,আমার সাথে।' পদ্মজা অনুরোধ করে বলল।

হেমলতা হাসলেন। ফরিনা কিছু বলছেন না। ভ্রুকুটি করে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি হেমলতাকে ভেতরে ভেতরে ভয় পান। কেমন ধারালো চোখের দৃষ্টি। যেন, একবার তাকিয়েই ভেতরের সব দেখে ফেলতে পারে। আর চোখমুখের ভাব দেখলে মনে হয়, কোন দেশের রাজরানি। তার উপর আমির দরদ দেখিয়ে শ্বাশুড়ি নিয়ে এসেছে। ফরিনা বিরক্ত  হচ্ছেন। হেমলতা ফরিনার দিকে তাকাতেই ফরিনা চোখ সরিয়ে নেন। হেমলতা ফরিনাকে প্রশ্ন করলেন, 'আপা,কথা বলছেন না যে? আমার উপস্থিতি বিরক্ত করেছে খুব?'

হেমলতার কথার ফরিনা সহ উপস্থিত সবাই অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ফরিনা হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, 'কী বলছেন আপা? বিরক্ত হইতাম কেরে? এই পরথম আইছেন। খুশিই হইছি।'

'তাই বলুন।'

' দরজায় দাঁড়ায়া গপ আর কতক্ষণ হইবো। ঘরে আহেন।' ফরিনা দ্রুত সটকে পড়েন। সদর ঘরে আগে আগে হেঁটে আসেন। হাঁপাতে থাকেন। বিড়বিড় করেন, 'মহিলা এত্ত চালাক। সত্যি সত্যি সব বুইঝা ফেলে।'

হেমলতা সবার আড়ালে শাড়ির আঁচল মুখে চেপে সেকেন্ড দুয়েক হাসলেন। হেমলতাকে হাসতে দেখে, পদ্মজাও  হাসল। সবাই সদর ঘরে এসে বসে। লাবণ্য ও পদ্মজার ফলাফল দেওয়ার উপলক্ষে শিরিন,শাহানাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। তারা এখন হাওলাদার বাড়িতেই আছে। দুই বোন হেমলতা,পূর্ণার জন্য নাস্তা তৈরি করতে রান্নাঘরে গেল। লাবণ্য দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে আছে। আমির এখনও লাবণ্যর ফলাফল কাউকে বলেনি। সে সদর ঘর থেকে লাবণ্যকে ডাকল, 'লাবণ্য? এই লাবণ্য? শুনছিস? এদিকে আয়। আজ তোর খবর আছে।'

আমিরের কথা শুনে লাবণ্যর বুকের ধুকপুকানি থেমে যায়। এখুনি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে অবস্থা।  নিশ্চিত ফেইল করেছে! লাবণ্য চিৎ হয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতে থাকে,কখন সে মারা যাবে। আমির আবার ডাকল, 'বেরিয়ে আয় বলছি। নয়তো দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকব। তখন কিন্তু গায়ে মার বেশি পড়বে।'

লাবণ্য তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামে। গায়ের ওড়না ঠিক করে দরজা খুলে। সদর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে নামাযের সব সূরা পড়তে থাকে।

আমির চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতেই লাবণ্য কেঁপে উঠে। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, 'আগামী বছর মেট্রিকে পাশ করাম, কসম!'

'এই বছরই তো পাশ করেছিস! তাহলে আগামী বছর আবার মেট্রিক দিবি কেন?'

লাবণ্য চকিতে তাকাল। তার মুখটা হা হয়ে যায়। লাবণ্যর মুখের ভঙ্গি  দেখে সবাই হাসল। লাবণ্য খুশিতে কেঁদে দিল। আমির লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে,মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,'আরেকটুর জন্য ফেইল করিসনি।'

লাবণ্য হাসতে হাসতে কাঁদছে।  লাবণ্যর পাগলামি দেখে আমিরও হাসছে। তখন সদর ঘরে প্রবেশ করে রিদওয়ান হাওলাদার। হেমলতা রিদওয়ানের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকান। হেমলতার চোখে চোখ পড়তেই রিদওয়ান বিব্রত হয়ে উঠে। চোখ সরিয়ে নেয়। একটু পর আড়চোখে তাকিয়ে দেখে,হেমলতা তখনও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন। রিদওয়ান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। এ যেন সাপুড়ে ও সাপের খেলা।  

চলবে...

আমি পদ্মজা - ৪২

রাতের খাবার শেষ হয়েছে সবেমাত্র। এশার আযান পড়েছে অনেক আগে। পূর্ণা পদ্মজা ও লাবণ্যকে পেয়ে পুলকিত। আনন্দ বয়ে যাচ্ছে মনে।  একটু পর পর উচ্চস্বরে হাসছে। হেমলতা একবার ভাবলেন নিষেধ করবেন,এতো জোরে হাসার জন্য। এরপর কী ভেবে আর নিষেধ করলেন না। তিনি বাড়ির বড়দের সাথে কথা বলছেন। আমির সবার মনোযোগ পাওয়ার জন্য বলল, 'আমার একটা কথা ছিল।'

সবাই আমিরের দিকে তাকাল। আমির নির্দ্বিধায় বলল,'আগামীকাল  ফিরব আমি।'

হেমলতা বললেন,

'ঢাকায়?'

'জি। পদ্মজাকে নিয়েই যাব। সাথে লাবণ্যও যাবে। দুজনকে কলেজে ভর্তি করে দেব।'

লাবণ্য পূর্ণার পাশ থেকে উঠে এসে,আমিরের পাশে দাঁড়াল। আবদার করে বলল, 'দাভাই,তুমি কইছিলা আমি পাশ করলে,আমারে দেশের বাইরে পড়তে পাঠাইবা।'

'ছেড়ি মানুষ বাইরে যাইতি কেন? কইলজাডা বড় হইয়া গেছে?' রেগে বললেন ফরিনা।

লাবণ্য মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে আমিরকে বলল,'কথা রাখতে হইবো তোমার।'

আমিরে একবার মজিদকে দেখল। এরপর লাবণ্যকে বলল,'সত্যি যেতে চাস?'

'হ।'

লাবণ্যর মাথায় গাট্টা মারল আমির। এরপর বলল, 'আগে শুদ্ধ ভাষাটা শিখ। এরপর দেশের বাইরে পড়তে যাবি।'

লাবণ্য আহ্লাদিত হয়ে বলল, 'পদ্মজা শিখায়া দিব।এইডা কোনো ব্যাপার না দাভাই।'

'আপাতত ঢাকা চল। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে অভ্যস্ত হ। এরপর সত্যি পাঠাব।'

'তুই পাগল হইয়া গেছস বাবু? এই ছেড়িরে একা বাইরে পাডাইয়া দিবি?'

'জাফর ভাই আছে,ভাবি আছে। সমস্যা নেই আম্মা। একটাই তো বোন আমার। নিজের মতো পড়াশোনা করুক।'

ফরিনা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকেন। মজিদ কথা বলছেন না। মানে তিনিও আমিরের দলে। তাহলে আর কথা বলে কী হবে? এই সংসারে এমনিতেও তার দাম নেই। কেউ কথা শুনে না। নিজের মতোই বকবক করেন। ফরিনা উঠে চলে যান। হেমলতা বললেন,'কালই চলে যেতে হবে? দুই-তিন দিন পর হবে না?'

আমির নম্র ভাবে বলল, 'না আম্মা। আমি আট বছর হলো ঢাকা গিয়েছি। এর মধ্যে এই প্রথম তিন মাসের উপর গ্রামে থেকেছি। ব্যবসা ফেলে এসেছি। আমার অনুপস্থিতিতে আলমগীর ভাইয়া সামলে ছিল। এখন তো ভাইয়াও চলে এসেছে। আর আমার ব্যবসা আমারই সামলানো উচিত। যত দ্রুত সম্ভব যেতে চাই। আপত্তি করবেন না।'

হেমলতা পদ্মজার দিকে চেয়ে বললেন,'তাহলে আগামীকালই যাচ্ছো?'

'জি। আব্বা,আম্মাকে তো অনেক আগেই বলেছি। পদ্মজাও জানে। কিন্তু পদ্ম ভাবেনি সত্যি সত্যি যাব। দেখুন, কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কাল চলে যাব বলেই  আজ আপনাকে নিয়ে এসেছি। আজ রাতটা মেয়ের সাথে থাকেন। আবার কবে দেখা হয়!'

হেমলতা বেশ অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থাকেন। তারপর বললেন,'তোমাদের কীসের ব্যবসা আজও জানলাম না।'

মজিদ অবাক হয়ে বললেন,'আত্মীয় হলেন এতদিন এখনও জানেননি মেয়ের জামাই কীসের ব্যবসা করে! বাবু, এটাতো বলা উচিত ছিল?'

'আমিতো ভেবেছি জানেন। তাই বলিনি। আম্মা,আমাদের এক্সপোর্ট ইমপোর্ট  বিজনেস। মানে মালামাল বিভিন্ন দেশে আমদানি -রপ্তানি করা হয়। এ কাজে আব্বা,রিদওয়ান, ভাইয়া,চাচা আছে। তাছাড়া, নিম্নমানের দেশগুলো থেকে কম দামে পণ্য এনে উন্নত দেশগুলোতে বেশি মূল্যে বিক্রি করি। সব পণ্য গোডাউনে রাখা হয়। আমাদের অফিসও আছে। গোডাউন আর অফিসের সব কাজ আমাকে সামলাতে হয়। বলতে পারেন, আমারই সব।'

'অনেক বড় ব্যাপার।' হেসে বললেন হেমলতা। তিনি জানতেন না আমির এতোটা বিত্তশালী। এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট বিজনেস কম কথা নয়। এ সম্পর্কে মোটামুটি  তিনি জানেন। কলেজ থাকাকালীন জেনেছেন।  

পদ্মজাকে পূর্ণা জড়িয়ে ধরে রেখেছে। পদ্মজা বলল,'কথা বলছিস না কেন?"

'কাল চলে যাবা আপা?'

'তাই তো কথা হচ্ছে।'

'আমার খুব মনে পড়ে তোমাকে।'

'কাঁদছিস কেন? আসব তো আমি।'

'সে তো অনেক অনেক মাস পর পর।'

পদ্মজা কিছু বলতে পারল না। হেমলতা কথা বলছেন আমির আর মজিদের সাথে। খলিল,আলমগীর নীরব দর্শক হয়ে বসে আছে। বিকেল থেকে রিদওয়ানের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। পদ্মজা হেমলতার উপর চোখ রেখে পূর্ণাকে প্রশ্ন করল,'আম্মা খুব শুকিয়েছে। খায় না?'

'না। মাঝে মাঝে সারাদিন পার হয়ে যায় তবুও খায় না।'

'জোর করে খাওয়াতে পারিস না?'

'ধমক মারে। শুনে না কথা।'

'আম্মা ঘাড়ত্যাড়া।"

'ঠিক বলেছো।'

'উনি কেমন? ঝগড়া করে আম্মার সাথে?'

'উনিটা কে?'

'আব্বার প্রথম বউ।'

'তুমিতো দেখতেও যাওনি।'

'শ্বশুরবাড়ি থেকে চাইলেই যাওয়া যায় না। বল না,কেমন? আদর করে তোদের?'

'ভালো খুব। সহজ,সরল। আম্মাকে খুব মানে। প্রেমা-প্রান্তকে অনেক আদর করে। দেখতেও খুব সুন্দর। আগে সাপুড়ের বউদের মতো সাজতো। আমার পছন্দ না বলে এখন আর সাজে না।'

'তুই নাকি খুব খারাপ ব্যবহার করিস?'

'এখন করি না। তুমি  কাকে দিয়ে এতো খোঁজ রাখো?'

'সে তোর জানতে হবে না। তাহলে উনি ভালো তাই তো?'

'হুম।'

'মিলেমিশে থাকিস তাহলে।'

'ঢাকা যাওয়ার আগে দেখে যাও একবার।'

'বাপের প্রথম বউকে দেখার ইচ্ছে নেই আমার।' পদ্মজা থমথমে স্বরে বলল।

পূর্ণা বলল,'আচ্ছা। আমি আজ তোমার সাথে ঘুমাব।'

'হুম ঘুমাবি। আম্মার খেয়াল রাখবি। আম্মাকে দেখে মনে হচ্ছে,কোনো বিষয় নিয়ে খুব চিন্তা করে। সারাক্ষণ ভাবে। তুই কথা বলবি,সময় দিবি।'

'আমি তোমার মতো সব সামলাতে পারি না।'

'চেষ্টা করবি। ভোরে উঠে মগা ভাইয়াকে পাঠাব। আব্বা আর প্রেমা-প্রান্তকে নিয়ে আসতে। সবাইকে চোখের দেখা দেখে যাব।'

পূর্ণা পদ্মজাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কান্না পাচ্ছে খুব। কত দূরে চলে যাবে তার আপা! পদ্মজা অনুভব করে পূর্ণার ভেতরের আর্তনাদ। সে পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, 'খুব দ্রুত আসব।'

''আমি পদ্মজা'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন

পদ্মজা মাঝে শুয়েছে। তার দুই পাশে হেমলতা আর পূর্ণা। পূর্ণা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে পদ্মজাকে। আর পদ্মজা হেমলতার এক হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। হেমলতা নিরবতা ভেঙে পদ্মজাকে বললেন,'পদ্ম?'

'হু,আম্মা?'

' শহরে নিজেকে মানিয়ে নিবি। শক্ত হয়ে থাকবি। আর মনে রাখবি, কেউ কারোর না। সবাই একা। সবসময় নিজের উপর বিশ্বাস রাখবি,নিজের উপর আস্থা রাখবি। সৎ পথে থাকবি। কখনো কারো উপর নির্ভরশীল হবি না।  যদি তুই কারো উপর ভালো থাকার দায়িত্ব দিয়ে দিস,কখনো ভালো থাকবি না। নিজের ভালো থাকার দায়িত্ব নিজেরই নিতে হয়। নিজেকে কখনো একা ভাববি না। যেখানেই থাকি আমি, আমার প্রতিটা কথা তোর সাথে মিশে থাকবে। ছায়া হয়ে থাকবে। আল্লাহ সবাইকে কোনো না কোনো উদেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। সেই উদ্দেশ্য সফল হলে আর বেঁচে থাকার মানে থাকে না। মৃত্যুতে ঢলে পড়ে। আমার ইদানীং মনে হয়, আমার দায়িত্ব ছিল তোকে জন্ম দেয়া,বড় করে তোলা,বাস্তবতা দেখানো। সেই দায়িত্ব কতটুকু রাখতে পেরেছি জানি না। কিন্তু  তোর দায়িত্ব অনেক বড় কিছু!'

 পদ্মজা চাপা স্বরে  বলল,'কী সেটা?'

'জানি না।'

'তুমি এতো কী ভাবো আম্মা? মুখটা এরকম ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে কেন? খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করবে। আমি পরেরবার এসে যেন দেখি,মোটা হয়েছো।

হেমলতা হাসলেন। সাদা ধবধবে দাঁত ঝিলিক মারে। তিনি পদ্মজাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন,'পরেরবার যখন আসবি একদম অন্য রকম দেখবি।'

'কথা দিচ্ছো?'

'দিচ্ছি।'

পদ্মজা হাসল। পূর্ণা বলল,'আমাকেও  জড়িয়ে ধরো আপা।'

পদ্মজা পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে। আর হেমলতা দুই মেয়েকে একসাথে জড়িয়ে ধরেন। তারপর বললেন,'এবার চুপচাপ ঘুম হবে। কোনো কথা না।'

মাঝরাতে হেমলতার ঘুম ভেঙে যায়। তিনি চোখ খুলে কান খাড়া করে শুনেন,কেউ হাঁটছে। কাঁথা গা থেকে সরিয়ে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নামেন। সাবধানে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়েন। পায়ের শব্দটা যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে যান। সাদা পাঞ্জাবি পরা একটা পুরুষের অবয়ব দেখতে পান। তিনি তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকলেন,'রিদওয়ান? '

রিদওয়ান কেঁপে উঠে পিছনে ফিরল। চোখ দুটি বড় বড় হয়ে যায়। সে যে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে,দেখেই বোঝা যাচ্ছে। হেমলতা প্রশ্ন করলেন,'এত রাতে এখানে কী করছো?'

'জ...জি হাঁটছিলাম।'

'এতো রাতে?'

'প্রায়ই হাঁটি। জিজ্ঞাসা করতে পারুন অন্যদের।'

হেমলতা রিদওয়ানকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত  পরখ করে নিয়ে বলল,' কোনোভাবে আমাকে খুন করতে এসেছো কী?'

রিদওয়ান থতমত খেয়ে গেল। বলল, 'ন..না না! আপনাকে কেন খ..খুন করতে যাবো?'

'প্রমাণ সরাতে।' হেমলতার সহজ কথা।

রিদওয়ান হঠাৎই অন্যরকম স্বরে কথা বলল, 'সে তো আমিও একজন প্রমাণ। স্বচক্ষে দেখা জ্বলজ্বলন্ত প্রমাণ। আপনিও আমাকে খুন করে প্রমাণ সরাতে পারেন। যেহেতু দুজনই একই পথের। কাউকে কারোর খুন করার প্রয়োজন নেই। আমি এখানে অন্য কাজে এসেছি।'

হেমলতা কঠিন চোখে তাকান। পরপরই চোখ শীতল করে নিয়ে বললেন,'শুভ রাত্রি।

রিদওয়ান হেসে হেলেদুলে হেঁটে চলে যায়। হেমলতা ঘরের ঢুকার জন্য ঘুরে দাঁড়ান। হাঁটার পূর্বেই শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যান। ভাগ্যিস আওয়াজ হয়নি! তিনি হাতে ভর দিয়ে উঠার চেষ্টা করেন। বাম হাতের মাংস পেশি শক্ত হয়ে আছে। হাত নাড়াতে কষ্ট হয়। ভর দিয়ে উঠা আরো কষ্টদায়ক। তিনি ওভাবেই বসে থাকলেন অনেকক্ষণ।

চলবে....

আমি পদ্মজা - ৪৩

পাখিদের কলতানে পদ্মজার ঘুম ভাঙল। পদ্মজা জানালার ফাঁক গলে আসা  দিনের আলো দেখতে পেল। সে তড়িঘড়ি করে উঠে বসে।  অন্যদিন ফজরের আযানের সাথে সাথে উঠে পড়ে। আজ দেরি হয়ে গেল!

'পূর্ণাকে তুলে নিয়ে যা। একসাথে অযু করে নামায পড়তে বস।' 

হেমলতার কণ্ঠ শুনে পদ্মজা ঘুরে তাকাল। তিনি কোরঅান শরীফ পূর্বের জায়গায় রেখে বললেন, 'পূর্ণাকে একটু বুঝ দিস। নামায পড়তে চায় না।'

'আচ্ছা,আম্মা।'

পদ্মজা পূর্ণাকে ডেকে নিয়ে কলপাড়ে যায়। এরপর দুই বোন একসাথে নামায পড়তে বসল। নামায শেষ করে হেমলতার সামনে এসে দাঁড়াল পদ্মজা। হেমলতা জানালার বাইরে তাকিয়ে আছেন। পদ্মজা হেমলতার চোখ দেখে বলল, 'আম্মা, তোমার চোখ এমন লাল হলো কেন?'

হেমলতা দুই চোখে হাত বুলিয়ে বললেন, 'রাতে ঘুমাইনি তাই।'

পদ্মজা উৎকণ্ঠা,'কেন? কেন ঘুম হয়নি? কীরকম দেখাচ্ছে তোমাকে।  বিছানায় পড়াটাই শুধু  বাকি।'

কিছু চুল পদ্মজার মুখের উপর চলে এসেছে। হেমলতা তা কানে গুঁজে দিয়ে আদরমাখা কণ্ঠে বললেন,'আজ আমার মেয়ে চলে যাবে। তাই আমি সারারাত জেগে আমার আদরের মেয়েকে দেখেছি।' 

হেমলতার কথা শুনে পদ্মজা আবেগী হয়ে উঠে। হেমলতাকে জড়িয়ে ধরে কান্নামাখা কণ্ঠে বলল, 'আমার খুব মনে পড়ে তোমাকে। চলো আমার সাথে। একসাথে থাকব। তোমার না ইচ্ছে ছিল,আমাকে নিয়ে শহরে থাকার।

'পাগল হয়ে গেছিস! মেয়ের জামাইর বাড়িতে কেউ গিয়ে থাকে? ২-৩ দিন হলে যেমন তেমন।'

হেমলতার শরীরের উষ্ণতা পদ্মজাকে ওম দিচ্ছে। মায়ের উষ্ণতায় কী অদ্ভুত শান্তি! পদ্মজা কান্না করে দিল। হেমলতা পদ্মজার মুখ তুলে বললেন, 'সকাল সকাল কেউ কাঁদে? বাড়ির বউ তুই, শ্বাশুড়ি কী করছে আগে দেখে আয়। যা।'

পদ্মজা আরো কাঁদতে থাকল। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল মুছছে। আবার ভিজে যাচ্ছে। বুকটা হাহাকার করছে। কত দূরে চলে যাবে সে!

কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যায়। পিছন থেকে শোনা যায়,হেমলতা বলছেন,

'বাচ্চাদের মতো করছিস কিন্তু।' 

পদ্মজা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে। ঢোক গিলে নিজেকে শক্ত করল। এরপর রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। পদ্মজা ঘর ছাড়তেই হেমলতার চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। তিনি দ্রুত জল মুছেন। পালঙ্কের দিকে চেয়ে দেখেন,পূর্ণা চিৎ হয়ে ঘুমাচ্ছে। কখন ঘুমাল? হেমলতার হাসি পেয়ে গেল। তিনি কাঁথা দিয়ে পূর্ণাকে ঢেকে দিলেন।

পদ্মজা রান্নাঘরে ঢুকতেই ফরিনা মুখ ঝামটালেন,'আইছো ক্যান? যাও ঘুমাও গিয়া।'

'কখন এতো দেরি হয়ে গেছে বুঝিনি।' মিনমিন করে বলল পদ্মজা'

'বুঝবা কেন? মা আইছে তো। হউরির লগে তো আর মায়ের মতো মিশতে মন চায় না।'

পদ্মজা অবাক হয়ে  তাকাল। আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল,'আমিতো মিশতেই চাই। আপনি সবসময় রেগে থাকেন।'

'মুখের উপরে কথা কইবা না। যাও এহন।'

পদ্মজা ঘুরে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য। ফরিনা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন,'কইতেই যাইবাগা নাকি? জোর কইরা তো কাম করা উচিত। এই বুদ্ধিডা নাই?'

পদ্মজা স্তব্ধ হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিদিন সে কাজ করার জন্য জোরাজুরি করে,কিন্তু ফরিনা করতে দেন না। এজন্যই সে এক কথায় চলে যাচ্ছিল। আর এখন কী বলছেন! সে ব্যাপারটা হজম করে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। ফরিনা গলার স্বর পূর্বের অবস্থানে রেখেই বললেন,' হইছে,কাম করতে হইব না। এরপর তোমার মায়ে কইবো দিনরাত কাম করাই তার ছেড়িরে। যাও। বারায়া যাও।'

পদ্মজা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।  লতিফা ঠোঁট চেপে হাসছে। ফরিনার এমন ব্যবহারের সাথে সে অভ্যস্ত। বেশ অনেকক্ষণ পর পদ্মজা বলল, 'আম্মা,আমি করবটা কী?'

পদ্মজা মাথা থেকে ঘোমটা সরে গেছে। মুখটা দেখার মতো হয়েছে। ফরিনা পদ্মজার মুখ দেখে হেসে ফেললেন। আবার দ্রুত হাসি লুকিয়েও ফেললেন। এই মেয়েটাকে তিনি অনেক আগেই ভালোবেসে ফেলেছেন। এতো শান্ত,এতো নম্রভদ্র! হেমলতাকে হিংসে হয়। হেমলতার গর্ভকে হিংসে হয়। পদ্মজার ঢাকা যাওয়া নিয়ে প্রথম প্রথম ঘোর আপত্তি ছিল ফরিনার।  কিন্তু এখন নেই। উপর থেকে যাই বলুন না কেন, তিনি মনে মনে চান পদ্মজা পড়তে যাক। অনেক পড়ুক। অনেক বেশি পড়ুক। এই মেয়ের জন্ম রান্নাঘরে রাঁধার জন্য নয়। রানীর আসনে থাকার জন্য। পদ্মজা ফরিনার দুই সেকেন্ডের মৃদু হাসি খেয়াল করেছে। সে সাহস পেল। ফরিনার কাছে এসে দাঁড়ায়। ফরিনা চোখমুখ কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,'ঘেঁষতাছো কেন?'

পদ্মজা শিমুল তুলোর ন্যায়  নরম স্বরে বলল,'আমার খুব মনে পড়বে আপনাকে। আপনার বকাগুলোকে। আপনি খুব ভালো।'

ফরিনা তরকারিতে মশলা দিচ্ছিলেন। হাত থেমে যায়। পদ্মজার দিকে তাকান। পদ্মজা বলল, 'আমি আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরব আম্মা?'

ফরিনা কিছু বলতে পারলেন না। এই মেয়েটা এতো অদ্ভুত, এতো ভালো কেন? পদ্মজার চোখের দিকে চেয়ে অনুভব করেন, কয়েক বছরের লুকোনো ক্ষত জ্বলে উঠেছে। ক্ষতরা পদ্মজার সামনে উন্মোচন হতে চাইছে। কোনোভাবে কী যন্ত্রনাদায়ক এই ক্ষত সারাতে পারবে  পদ্মজা? ভরসা করা যায়? পদ্মজার মায়ামাখা দুটি চোখ দেখে বুকে এমন তোলপাড় শুরু হয়েছে কেন? ৩২ বছর আগের সেই কালো রাত্রির কথা কেন মনে পড়ে গেল? যে কালো রাত্রির জন্য আজও এই সংসার,এই বাড়িকে তিনি আপন ভাবতে পারেন না। প্রতিটি মানুষের সাথে বাজে ব্যবহার করেন। সেই যন্ত্রণা কেন বুক খুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে? 

উত্তরের আশায় না থেকে পদ্মজা জড়িয়ে ধরল ফরিনাকে। ফরিনা মৃদু কেঁপে উঠলেন। এরপর পদ্মজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। পদ্মজা ফরিনার বুকে মাথা রাখতেই টের পেল,ফরিনার বুক ধুকধুক, ধুকধুক করছে।

______________

হাওলাদার বাড়ির থেকে ডানে দুই মিনিট হাঁটার পর ঝাওড়া নামের একটি খালের দেখা পাওয়া যায়। খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে হাওলাদার বাড়ির সবাই। ট্রলার নিয়ে মাঝি অপেক্ষা করছে। ট্রলারটি হাওলাদার বাড়ির। পদ্মজা পরনে কালো বোরকা। লাবণ্য যাবে না। সকাল থেকে তার ডায়রিয়া শুরু হয়েছে। তিন-চার দিন পর আলমগীর ঢাকা নিয়ে যাবে। আজ আমির আর পদ্মজা যাচ্ছে। প্রেমা,প্রান্ত,মোর্শেদ,বাসন্তী সবাই সকালেই এসেছে। সবার সাথে কথা হয়েছে। পূর্ণা হেঁচকি তুলে কাঁদছে। হেমলতা পদ্মজার দুই হাত মুঠোয় নিয়ে চুমু দিলেন। তারপর বললেন,'ঠিক মতো পড়বি,খাবি। স্বামীর খেয়াল রাখবি। কাঁদবি না কিন্তু। একদম কাঁদবি না।'

'তুমি কাঁদছো কেন আম্মা?'

'না,না কাঁদছি না।'  বলেও হেমলতা কেঁদে ফেললেন। পদ্মজার কান্নার বেগ বেড়ে যায়। বোরকা ভিজে একাকার। একদিকে মা অন্যদিকে তিন ভাই-বোন কেঁদেই চলেছে। হেমলতা নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন,পারছেন না। পদ্মজা বলল, 'আর কেঁদো না আম্মা। তুমি অসুস্থ।'

হেমলতা ঢোক গিলেন কান্না আটকাতে। তারপর বললেন, 'কাঁদব না। সাবধানে যাবি। দেরি হচ্ছে তো। আমির,নিয়ে যাও আমার মেয়েকে। যা মা। সাবধানে যাবি। নিয়মিত নামায পড়বি।'

পদ্মজা হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করল। পদ্মজার দেখাদেখি আমিরও করল। বাড়ির সব গুরুজনদের সালাম করে ট্রলারে পা রাখতেই হেমলতার কণ্ঠে উচ্চারিত শব্দমালা ভেসে আসে,'আমার প্রতিটা কথা মনে রাখবি। কখনো ভুলবি না। আমার মেয়ে যেন  অন্য সবার চেয়ে গুণেও আলাদা হয়। শিক্ষায় কালি যেন না লাগে।'

পদ্মজা ফিরে চেয়ে বলল, 'ভুলব না আম্মা। কখনো না। তুমি চোখের জল মুছো। আমাদের আবার দেখা হবে।'

হেমলতা তৃতীয় বারের মতো চোখের জল মুছেন। এরপর হাত নেড়ে বিদায় জানান। ট্রলার ছেড়ে দেয়। পদ্মজা এক দৃষ্টে হেমলতার দিকে তাকিয়ে থাকে। হেমলতা চেয়ে থাকেন পদ্মজার দিকে। দুজনের চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় বর্ষণ হচ্ছে। কাঁদছেন মোর্শেদ। তবে পদ্মজার জন্য কম,হেমলতার জন্য বেশি। হেমলতার দিনগুলো এখন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।  আরো কাঁদছেন ফরিনা। প্রতিদিন বাড়িজুড়ে একটা সুন্দর মুখ,সুন্দর মনের জীবন্ত পুতুল মাথায় ঘোমটা দিয়ে আর হেঁটে বেড়াবে না। আবারও মরে যাবে তার দিনগুলো। হারিয়ে যাবে সাদা কালোর ভীড়ে।

মাদিনী নদীর ঠান্ডা আদ্রতা বাতাসে মিশে ছুঁয়ে দিচ্ছে পদ্মজার মুখ। জল শুকাতে শুকাতে আবার ভিজে যাচ্ছে। আমির পদ্মজার কোমর এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,'এবার তো থামো।'

আমিরের আলত ছোঁয়ায় পদ্মজা আরো প্রশ্রয় পেয়ে কাঁদতে থাকল। আমির বলল, 'এ তো আরো বেড়ে গেছে! থামো না। আমি আছিতো। আমরা ছয় মাস পর পর আসব। অনেকদিন থেকে যাবো।'

'সত্যি তো? কাজের বাহানা দেখাবেন না?'

'মোটেও না।' আমির পদ্মজার চোখের জল মুছে দিল। এরপর চোখের পাতায় চুমু দিল। পদ্মজা নুয়ে যায়। বলল, 'নদীর পাড় থেকে কেউ দেখবে।'

'কেউ দেখবে,কেউ দেখবে,কেউ দেখবে! এই কথাটা ছাড়া আর কোনো কথা পারে আমার বউ?'

পদ্মজা আমিরের দিকে একবার তাকাল। এরপর চোখের দৃষ্টি সরিয়ে বলল, 'আমরা ট্রলার দিয়ে ঢাকা যাব?'

'সেটা সম্ভব না। কিছুক্ষণ পরই ট্রেনে উঠে যাবো।'

আমির পদ্মজাকে ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়াতেই, আমিরকে হতবাক করে দিয়ে পদ্মজা ট্রলারের ভেতর ঢুকে গেল। 

চলবে....

আমি পদ্মজা - ৪৪

ট্রেনের বগিতে হেঁটে সামনে এগোচ্ছে আমির। তার এক হাতে লাগেজ অন্য হাতে পদ্মজার হাত। শক্ত করে ধরে রেখেছে,যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। পদ্মজার মুখ নিকাবের আড়ালে ঢেকে রাখা। সে এদিকওদিক তাকিয়ে আমিরকে প্রশ্ন করল,'খালি সিট রেখে আমরা কোথায় যাচ্ছি?'

'কেবিনে।'

ততক্ষণে দুজন ৭৬ নাম্বার কেবিনের সামনে চলে আসে। আমির দরজা ঠেলে পদ্মজাকে নিয়ে ঢুকল। চারটা বার্থ। চারজনের কেবিন বোঝাই যাচ্ছে। পদ্মজা বলল, 'আরো দুজন আসবে কখন? ট্রেন তো ছেড়ে দিচ্ছে।'

'চার বার্থই আমাদের।'

পদ্মজা ডান পাশের বার্থে বসতে বসতে বলল, 'অনেক খরচ করেছেন।'

আমির লাগেজ জায়গা মতো রেখে পদ্মজার পাশে বসল। বলল, 'নিকাব খুলো এবার। কেউ আসছে না।'

পদ্মজা নিকাব খুলল। ঝমঝম শব্দ তুলে ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে।  আমির জানালা খুলে দিতেই  পদ্মজার চুল তিরতির করে উড়তে থাকল। পদ্মজা দ্রুত দুই হাত মুখের সামনে ধরে, বাতাস  থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। আমির বাম পাশের বার্থে বসে হাসল। বলল, 'হাত সরাও। দেখি একটু বউটাকে।'

পদ্মজা দুই হাত সরাল। ঠোঁটে আঁকা হাসি। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। চুল অবাধ্য হয়ে উড়ছে। আমির এক হাতের উপর থুতুনির ভর দিয়ে বলল,'এই হাসির জন্য দুনিয়া এফোঁড়ওফোঁড় করতে রাজি।'

পদ্মজা দাঁত বের করে হাসল। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। আমির পদ্মজার পাশে এসে বসে,পদ্মজার চুল খোঁপা করে দিল। তারপর বলল, ' এবার বোরকাটা খুলে ফেল। গরম লাগছে না?'

পদ্মজা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। আমির বলল,'কেউ আসবে না পদ্মবতী। পৌঁছাতে বিকেল হবে।  নিশ্চিন্তে শুধু বোরকা খুলতে পারো। আর কিছু খুলতে হবে না।'

পদ্মজার কান রি রি করে উঠে। আমিরের উরুতে কিল দিয়ে বলল,'ছিঃ।'

আমির উচ্চস্বরে হেসে উঠল। পদ্মজা ভ্রুকুটি করে বোরকা খুলে। এরপর জানালার ধারে বসে বলল, 'আমরা যে বাড়িতে যাচ্ছি,আর কে কে থাকে?'

'একজন দারোয়ান আর একজন বুয়া আছে। যে বাড়ি না তোমার বাড়ি।''

'উনারা বিশ্বস্ত?'

'নয়তো রেখে এসেছি?'

পদ্মজা কিছু বলল না। আমির পদ্মজার পাশ ঘেঁষে বসল। পদ্মজার কানের দুলে টোকা দিয়ে, কোমর জড়িয়ে ধরল। পদ্মজা মেরুদণ্ড  সোজা করে বসে। শীতল একটা অনুভূতি সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। চোখ বুজে স্বভাববশত বলে উঠে, 'কেউ দেখবে!'

আমির ভ্রুকুঞ্চন করে চোখ তুলে তাকায়। পদ্মজা বুঝতে পারে, সে ভুল শব্দ উচ্চারণ করে ফেলেছে। জিহ্বা কামড়ে আড়চোখে আমিরকে দেখে হাসার চেষ্টা করল। আমির বেশ অনেকক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, পদ্মজার ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে বলল, 'দেখুক। যার ইচ্ছে দেখুক।'

দরজায় টোকা দিচ্ছে কেউ। শব্দে পদ্মজার  ঘুম ছুটে গেল। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে,মনে পড়ছে না। আমিরের কোলে তার মাথা ছিল। মানুষটা এতক্ষণ বসে ছিল? পদ্মজাকে এভাবে উঠতে দেখে আমির ইশারায় শান্ত হতে বলল। পদ্মজা দ্রুত নিকাব পড়ে নেয়। এরপর আমির দরজা খুলল। ঝালমুড়ি নিয়ে একজন লম্বা ধরণের লোক দাঁড়িয়ে আছে। নাকটা মুখের তুলনায় একটু বেশি লম্বা। আমির বলল, 'এভাবে অনুমতি না নিয়ে টোকা দেয়া অভদ্রতা। আমাদের দরকার পরলে আপনাদের এমনিতেই খুঁজে নিতাম। আর এমন করবেন না। আপনার জন্য আমার বউয়ের ঘুম ভেঙে গেছে। নিন টাকা। ঝালমুড়ি দেন।'

লোকটি বেশ আনন্দ নিয়ে ঝালমুড়ি বানিয়ে দিল। বোধহয় আর বিক্রি হয়নি। হতে পারে আমিরই প্রথম কাস্টমার। লোকটি চলে গেল। আমির কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। তারপর পদ্মজাকে বলল, ' একজন লোক ঝালমুড়ি বিক্রি করতে এসেছিল। এই নাও খাও। এরপর আবার ঘুমাও।'

 দুজনে একসাথে ঝালমুড়ি খেতে খেতে সুখ-দুঃখের গল্প শুরু করে। আমির তার শহুরে জীবনের গতিবিধি বলছে। কখন কখন বাসায় থাকে। কীভাবে ব্যবসায় সময় দেয়। পদ্মজা মন দিয়ে শুনছে। একসময় পদ্মজা বলল, 'একটা কথা জানার ছিল।'

'কী কথা?'

"আমার মনে হচ্ছে,আপনাদের বাড়িতে লুকোনো কোনো ব্যাপার আছে। শুধু মনে হচ্ছে না , একদম নিশ্চিত আমি।'

আমির উৎসুক হয়ে ঝুঁকে বসল। আগ্রহভরে জানতে চাইল,"কীরকম?'

পদ্মজা আরো এগিয়ে আসে। আকাশে দুপুরের কড়া রোদ। ছলাৎ করে রোদের ঝিলিক জানালায় গলে কেবিনে ঢুকে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। বাতাস ভ্যাপসা গরম। মাঝে মাঝে শীতল,ঠান্ডা। সেসব উপেক্ষা করে পদ্মজা তার ভেতরের সন্দেহগুলো বলতে শুরু করল,'রুম্পা ভাবিকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। আমি নিশ্চিত। কেন বন্দি করে রাখা হয়েছে সেটা দাদু জানেন। উনি সবসময় রুম্পা ভাবির ঘরের দরজায় নজর রাখেন। আমি অনেকবার ঢুকতে চেয়েছি,পারিনি। বাড়ির পিছনের জঙ্গলে কিছু একটা আছে। সেটা ভূত,জ্বীন জাতীয় কিছু না। অন্যকিছু। এমনটা মনে হওয়ার তেমন কারণ নেই। আমার অকারণেই মনে হয়েছে, জঙ্গলটা আপনাঅাপনি সৃষ্টি হয়নি আর ভয়ংকরও হয়নি। কেউ বা কারা এই জঙ্গলটিকে যত্ন করে তৈরি করেছে। ভয়ংকর করে সাজিয়েছে। এছাড়া, বাড়ির সবাইকে আমার সন্দেহ হয়। এ ব্যাপারে আপনি কী বলেন?'

আমির একটুও অবাক হলো না,মুখের প্রকাশভঙ্গী পাল্টালো না। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, 'জানি আমি এসব।'

পদ্মজা আমিরের দুই হাত খামচে ধরে এক নিঃশ্বাসে বলল,'আমাকে বলুন। অনুরোধ লাগে,বলুন। আমি শুনতে চাই। অনেকদিন ধরে নিজের ভেতর পুষে রেখেছি।'

আমির অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। বলল,'আমার ধারণা তোমার ধারণা অবধিই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে কিছু জানি না। এই রহস্য খুঁজে বের করার ইচ্ছে হওয়া সত্ত্বেও আমি হজম করেছি। আমার ইচ্ছে মাটিচাপা দিয়েছি।'

আমিরের গলাটা কেমন শুনাল। পদ্মজা কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,'কেন? কেন দিয়েছেন?'

আমির হাসল। বলল,'ধুর! এখন এসব গল্প করার সময়? শুনো, এরপর কী করব....'

পদ্মজা কথার মাঝে আটকে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল,'কথা ঘুরাবেন না। আমি খেয়াল করেছি,হাওলাদার বাড়ির প্রতি আপনি উদাসীন। কোনো ব্যাপার পাত্তা দেন না। সবসময় বাড়ির চেয়ে দূরে দূরে থাকেন। কোনো ঘটনায় নিজেকে জড়ান না। কেন নিজেকে গুটিয়ে রাখেন?'

আমিরের দৃষ্টি অস্থির। সে এক হাতে বার্থ খামচে ধরার চেষ্টা করে। ঘন ঘন শ্বাস নেয়। পদ্মজা খুব অবাক হয়! আমিরের এতো কষ্ট হচ্ছে কেন?

পদ্মজার উৎকণ্ঠা, 'কী হলো আপনার? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?'

'না! কিছু হয়নি। এই পদ্মজা?'

আমির চট করে পদ্মজার দুই হাত শক্ত করে ধরল। চোখ দুটিতে ভয়। পদ্মজা আমিরের চোখের দিকে তাকাল। আমির বলল,'আমার তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে। অনেকবার বলতে গিয়েও পারিনি। আজ যখন কথা উঠেছে...আচ্ছা পদ্মজা, আমার পরিচয় জেনে আমাকে ছেড়ে যাবে না তো? আমি তোমাকে হারালে একাকীত্বে ধুঁকে ধুঁকে নিঃশেষ হয়ে যাব। আমার জীবনের একমাত্র সুখের আলো তুমি।'

পদ্মজার হৃৎপিণ্ড থমকে গেল। সে পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছে না। আমির উত্তরের আশায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে। পদ্মজা ধীর কণ্ঠে বলল,'লুকোনো সব কথা বলুন আমাকে। আপনি আমার স্বামী। আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনো ভাবি না আমি। বিশ্বাস করুন!'

আমির নতজানু হয়ে বলল,'আমি আমার আব্বার অবৈধ সন্তান। আমার জন্মদাত্রী জন্ম দিয়েই মারা যায়। দিয়ে যায় অভিশপ্ত জীবন।'

পদ্মজা দুই পা কেঁপে উঠে। মাথা ভনভন করে উঠে। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত গড়িয়ে যায়। আমির ঢোক গিলে আবার বলল,'আমার জন্মদাত্রী মারা যাওয়ার পর আব্বা আমাকে নিয়ে আসেন। আমার বর্তমান আম্মা আমাকে দেখে খুব রেগে যায়। কিছুতেই আমাকে মানতে চায়নি। তখন ছেলেমেয়ে ছিল না আম্মার। তাই মাস ঘুরাতেই আমাকে মেনে নিল। ছেলের মতো আদর শুরু করল। এসব দাদুর মুখে পরে শুনেছি। আব্বা আমাকে তুলে এনে জায়গা দিলেও সন্তানের মতো ভালোবাসেননি কখনো। যখন আমার এগার বছর আমি আর রিদওয়ান একসাথে জানতে পারি,আমি আব্বার অবৈধ সন্তান। আব্বা আবার রিদওয়ানকে খুব আদর করতেন। রিদওয়ান ছোট থেকেই আমার সাথে ভেজাল করতো। ঝগড়া করতো। যখন এমন একটা খবর জানতে পারল,ও আরো হিংস্র হয়ে উঠে। আমি তখন অনেক শুকনো আর রোগা ছিলাম। রিদওয়ান স্বাস্থ্যবান, তেজি ছিল। আব্বার এমন ছেলেই পছন্দ। কেন পছন্দ জানি না। উনিশ থেকে বিশ হলেই রিদওয়ান খুব মারতো। আব্বার কাছে বিচার দিলে রিদওয়ান আরো দশটা বানিয়ে বলতো। তখন আব্বা আমাকে মারতেন। রিদওয়ান একবার আমাকে জঙ্গলে বেঁধে ফেলে রেখেছিল। দেড় দিন পড়ে ছিলাম। রাতে ভয়ে প্যান্টে প্রস্রাব করে দিয়েছি। মুখ বাঁধা ছিল। তাই এতো চিৎকার করেছি তবুও কেউ শুনেনি। ভয়ে বুক কাঁপছিল। মনের ভয় মিশিয়ে ভয়ংকর ভয়ংকর ভূত,দানব দেখেছি। বাঁচানোর মতো কেউ ছিল না। দেড়দিনের সময় আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন,ফকির মিয়া নামে একজন,উনি আমাকে জঙ্গলে বাঁধা অবস্থায় পান। বাড়িতে বৈঠক বসে। রিদওয়ানকে দুটো বেতের বারি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।  রিদওয়ান এক তো বলিষ্ঠবান তার উপর আমার দুই বছরের বড়। কিছুতেই পেরে উঠতাম না।পানিতে ঠেসে ধরে রেখেছে অনেকবার। ওর মস্তিষ্ক অসুস্থ। আমার জীবন জাহান্নাম হয়ে উঠে। আম্মাকে বললেও আম্মা বাঁচাতে পারতেন না। সবসময় নিশ্চুপ। কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য যখন আমার পনেরো বয়স  শীতের রাতে পালিয়ে যাই। শীতে কাঁপতে কাঁপতে ক্ষেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। এরপরদিন চোখ খুলে দেখি,আমি হাওলাদার বাড়িতে। আমার সামনে রিদওয়ান, আব্বা,চাচা,আম্মা সবাই। বুঝে যাই,আমার কোনো জায়গা নাই আর। এখানেই থাকতে হবে। যতই কষ্ট হউক থাকতে হবে।'

আমিরের কণ্ঠে স্পষ্ট কান্না। চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। পদ্মজা হেঁচকি তুলে কাঁদছে। আমির অশ্রুসজল চোখ মেলে পদ্মজার দিকে তাকাল। হেসে ফেলল। পদ্মজার দুই চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,'আরেএ পাগলি! কাঁদছো কেন? এসব তো পুরনো কথা। আমার পড়াশোনাটা আবার চলছিল ভালোই। আমি ভালো ছাত্র ছিলাম। এ দিক দিয়ে বুদ্ধিমান ছিলাম। সবসময় ভালো ফলাফল ছিল। এজন্য কদর একটু হলেও পেতাম। যখন আমার আঠারো বয়স বাড়িতে অস্বাভাবিক কিছু অনুভব করি। রাত করে অদ্ভুত কিছুর শব্দ শুনি। জঙ্গলে আলো দেখতে পাই। চাচাকে প্রায় রাতে জঙ্গলে যেতে দেখি। রিদওয়ান আর চাচা মিলে কিছু একটা নিয়ে সবসময় আলাপ করতো। ওদের চোখেমুখে থাকতো লুকোচুরি খেলা। আমি একদিন রাতে চাচাকে অনুসরণ করি। প্রায় দশ মিনিট হাঁটার পর চাচা দেখে ফেলে। এই ভুলের জন্য কম মার খেতে হয়নি সেদিন! তবুও বেহায়ার মতো কয়দিন পর আবার অনুসরণ করি। রিদওয়ান পিছনে ছিল দেখিনি। আব্বা সেদিন অনেক মারল। দা ছুঁড়ে মারেন। এই যে থুতুনির দাগটা,এটা সেই দায়ের আঘাত। একসময় আব্বা আমাকে নিয়ে আলোচনায় বসলেন। বললেন, আমাকে শহরে পাঠাবেন। পড়ালেখার জন্য। কোনো ব্যবসা করতে চাইলে তারও সুযোগ করে দিবেন। আমি যেন এই বাড়ি আর বাড়ির আশপাশ নিয়ে মাথা না ঘামাই। আমি মেনে নেই। রিদওনায়ের সাথে থাকতে হবে না আর। এর চেয়ে আনন্দের কী আছে? চলে আসি ঢাকা। শুরু হয় নিজের জায়গা শক্ত করার যুদ্ধ। এখানে এসেও অনেক অপমান সহ্য করতে হয়। তবুও থেমে যাইনি। যুদ্ধ করে চলেছি। আমাকে বাঁচতে হবে। মানুষের মতো বাঁচতে হবে। কারো লাথি খেয়ে না। যখন আমার তেইশ বছর,তখন থেকে আমার কদর বেড়ে যায়। ব্যবসায় মোটামুটি সফল হয়ে যাই। ভাগ্য ভালো ছিল আমার। অতিরিক্ত পরিশ্রম আমাকে নিরাশ করেনি। তখন আব্বা আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রিদওয়ান আগের মতো হাত তুলার সাহস পায় না। সেই আমি আজ এই জায়গায়। এখন আমার যে অবস্থান হাওলাদার বাড়ির কারোর সাহস নেই আমার চোখের দিকে তাকানোর। আমি চাইলেই শোধ নিতে পারি। কিন্তু নেব না। তারা থাকুক তাদের মতো। রিদওয়ান ছোটবেলা যা করেছে, মেনে নিয়েছি। এখন তোমার দিকেও নজর দিয়েছে। ওর নজর আমার বাড়িগাড়ি,অফিস-গোডাউনেও আছে। আমি টের পাই। ও পারলে আমাকে খুন করে দিত। কিন্তু পারে না। আমার ক্ষমতার ধারেকাছেও ওর জায়গা নেই। এখন আমার নিজের এক বিশাল রাজত্ব আছে। আমার অহংকার করার মতো অনেক কিছু আছে। হাওলাদার বাড়ির কেউ কেউ মিলে আমাকে নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করছে। আমি নিশ্চিত। তাই হাওলাদার বাড়িতে আমি থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। আম্মা ছাড়া ওই বাড়ির সবার ভালোবাসা মুখোশ মাত্র। আমার দরকার ছিল একজন ভালো মনের সঙ্গিনী। আমি পেয়ে গেছি আর কিছু দরকার নেই। আমি আমার অর্ধাঙ্গিনীকে তার আসল সংসারে নিয়ে যাচ্ছি।  এখন আমার মন শান্ত। কোনো চিন্তা নেই। খুব বেশি সুখী মনে হচ্ছে।'

আমির পদ্মজার হাতে চুমু খেল। পদ্মজা তখনও কাঁদছে। সে আচমকা আমিরকে জড়িয়ে ধরল। গভীরভাবে,শক্ত করে। এরপর কান্নামাখা কণ্ঠে বলল,'আমি কখনো আপনাকে কষ্ট দেব না। কোনোদিন না। কেউ আপনাকে ছুঁতে আসলে আমি তার গর্দান নেব। আমি উন্মাদ হয়ে তাকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করব।'

'কারো সেই ক্ষমতা নেই আর। মিছেমিছি ভয় পাচ্ছো।'

পদ্মজা আরো শক্ত করে ধরার চেষ্টা করে। আমির পদ্মজার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,'এই প্রথম আমার বউয়ের গভীর আলিঙ্গন পেলাম। ভালো লাগছে। ছেড়ো না কিন্তু।'

_____________

প্লাটফর্মে হাঁটছে ওরা। আমির পদ্মজার এক হাত ধরে রেখেছে। খুব দ্রুত হাঁটছে। পদ্মজা তাল মেলাতে পারছে না। চেষ্টা করছে। মোটরগাড়ি নিয়ে একজন কালোচশমা পরা লোক অপেক্ষা করছিল। আমির সেখানে গিয়ে থামে। লোকটা সালাম দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিল। ব্যাগ জায়গামতো রাখে। আমির আগে পদ্মজাকে উঠতে বলল। পদ্মজা অবাক হয়। এরকম গাড়ির সাথে সরাসরি পরিচয় নেই তার। কিন্তু প্রকাশ করল না। আমিরের কথামতো গাড়িতে উঠে বসল। এরপর আমির উঠল। গাড়ি চলতে শুরু করে। আমির পদ্মজাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,'আমাদের নিজস্ব গাড়ি। কথা ছিল কিন্তু, আমার গাড়ি দিয়ে রাতবেরাতে যখন তখন ঘুরতে বের হবো।'

পদ্মজা কিছু বলল না। সে উপভোগ করছে নতুন জীবন। ঘন্টাখানেকের মধ্যে একটা বাড়ির সামনে গাড়ি থামে। কালো চশমা পরা লোকটা দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে আমিরের ডান পাশের দরজা খুলে দিল। আমির পদ্মজাকে নিয়ে নামল। পদ্মজা বাড়িটা দেখে মুগ্ধ হয়। দ্বৈত(ডুপ্লেক্স) বাড়ি। একজন দারোয়ান দৌড়ে এসে সালাম দিল। পদ্মজার সাথে পরিচিত হলো। এরপর আসে একজন মধ্যবয়স্ক নারী। ইনি বোধহয় বাড়ির কাজের লোক। সবাই একসাথে বাড়ির ভেতর ঢুকল। পদ্মজা তার নতুন বাড়ি মন দিয়ে দেখছে। পূর্ব দিক থেকে সদর দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেল বিশাল বৈঠকখানা উত্তর দক্ষিণে লম্বা। দক্ষিণ পাশে বারান্দা তাতে নানা ধরনের ফুল ফুটে আছে টবের মধ্যে, মনে হবে যেন একটা ছোটোখাটো বাগান। বৈঠকখানার দক্ষিণ পশ্চিম কোণার দিকে বেশ বড় শোবার ঘর। পদ্মজা প্রশ্ন করার আগে আমির বলল,'না,এটা আমাদের ঘর না।'

উত্তর পশ্চিম কোণার দিকে রান্নাঘর এবং টয়লেট। আর এই দুয়ের মাঝে মানে বৈঠকখানার পশ্চিম দিকের মাঝখানটায় খাওয়ারঘর(ডাইনিং)। বৈঠকখানার মাথার উপর দিকে তাকালে সেখানে সোনালী কালারের ঝাড়বাতি ঝুলছে। বৈঠকখানার উত্তর দিকে একটা সিড়ি সাপের মত পেঁচিয়ে উপর দিকে উঠে গেছে। আমির পদ্মজাকে নিয়ে সেদিকে হাঁটে। সিঁড়ি পেরুনোর পর হাতের বাঁ দিকে অনেক বড় একটা শোবার ঘর। দামী,দামী জিনিসে সৌন্দর্য আকাশছোঁয়া। দুজন একসাথে ঢুকে। পদ্মজা চোখ ঘুরিয়ে সবকিছু দেখছে। আমির বলল,'গোসল করে নাও?'

 পদ্মজা বোরকা খুলে কলপাড় খুঁজতে থাকল। আমির গোসলখানার দরজা খুলে দিয়ে বলল,'এইযে এদিকে।'

দুজন একসাথে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হলো। পদ্মজা দুই তলাটা আরেকটু দেখার জন্য  ডানদিকে মোড় নিল। প্রথমে চোখে পড়ল বড় ব্যালকনি। এরপর আরেকটা শোবার ঘর। ব্যালকনিতে লতাপাতার ছোট ছোট টব।

______________

বিরাট অট্টালিকায় সুখের সাথে কেটে যায় পাঁচ মাস। লাবণ্য দেশ ছেড়েছে দুই মাস হলো। বুয়া কাজ ছেড়েছে তিন মাস। পদ্মজা আর কাজের লোক নিতে দিল না। সে এক হাতেই নাকি সব পারবে। তবুও আমির একটা ১২-১৩ বছর বয়সী মেয়ে রেখেছে সাহায্যের জন্য। ভোরের নামায পরে রান্নাবান্না করে পদ্মজা। এরপর শাড়ি পাল্টে নেয়। কলেজে যাওয়ার জন্য। আমিরকে ব্লেজার,টাই পরতে সাহায্য করে। প্রথম যেদিন আমিরকে ব্লেজার পরতে দেখেছিল,অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,'এই পোশাকের নাম কী? আপনাকে খুব বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।'

আমির হেসে জবাব দিয়েছিল, 'ব্লেজার। বাইরে থেকে আনা।'

এমন অনেক কিছুই পদ্মজার অজানা ছিল। সবকিছু এখন তার চেনাজানা। এই বিলাসবহুল জীবন বেশ ভালো করেই উপভোগ করছে। মানুষটা সারাদিন ব্যস্ত থাকে। তবুও ফাঁকেফাঁকে টেলিফোনে যোগাযোগ করে। পদ্মজাকে নিয়ে গোডাউন দেখিয়েছে,অফিস দেখিয়েছে। সবকিছু সাজানো, গোছানো। গোডাউনে বিভিন্ন ধরণের পণ্য। কত কত রকমের দ্রব্য। পদ্মজা জীবনে ভালোবাসা এবং অর্থ দুটোই চাওয়ার চেয়েও বেশি পেয়েছে। 

সকাল নয়টা বাজে। আমির তাড়াহুড়ো করছে, তার নাকি আজ দরকারি মিটিং আছে। পদ্মজা শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে দৌড়ে দৌড়ে খাবার পরিবেশন করছে। আমির দুই তলা থেকে নেমেই বলল,'আমি গিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। কলেজ চলে যেও।'

'আরেএ,খেয়ে যাবেন তো।'

'সময় নেই। আসছি।'

'খেয়ে যান না।'

'বলছি তো,তাড়া আছে। জোরাজুরি করছো কেন?'

আমির দ্রুত বেরিয়ে যায়। পিছু ডাকতে নেই,তাই পদ্মজা ডাকল না। মনাকে ডেকে বলল,'খেয়ে নাও তুমি।'

মনা পদ্মজার সাহায্যকারী। পদ্মজার ছোটখাটো ফরমায়েশ পালন করে। পদ্মজা বৈঠকখানায় গিয়ে বসে। আজ কলেজে যেতে ভালো লাগছে না। ভোরে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি। অকারণে মন বিষণ্নতায় চেয়ে আছে। অকারণেও না বোধহয়! আমির বিরক্ত হয়ে কথা বলেছে,এজন্যই বোধহয় মন আকাশে বৃষ্টি নেমেছে। পদ্মজা পুরোটা দিন উপন্যাস পড়ে কাটিয়ে দিল। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে কলিং বেল বাজে। পদ্মজা দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দিল। আমির দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে বাতাস। পদ্মজা বলল, 'আসুন।'

আমির ভেতরে আসে না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে তাকিয়ে আছে পদ্মজার দিকে। পদ্মজা কপাল কুঁচকাল। বলল,'কী হলো? আসুন।'

আমির চট করে পদ্মজাকে কোলে তুলে নিল। পদ্মজা চেঁচিয়ে উঠে বলল,'কেউ দেখবে।' 

আমির মনাকে ডাকল,'মনা? কই রে? দেখে যা।'

'আপনি ওকে ডাকছেন কেন?'

'এবার কাউকে দেখাবই।'

'উফফ! আল্লাহ,ছাড়ুন।'

'মনা? মনা?'

মনা দুই তলা থেকে নেমে আসে। আমির মনাকে দেখে বলল,'এই দেখ তোর আপারে কোলে নিয়েছি। দাঁড়া,তোর সামনে একটু আদর করি।'

পদ্মজা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। চাপাস্বরে বলল,'মনা কী ভাববে! আমি আর বলব না,কেউ দেখবে। ছেড়ে দিন।'

আমির পদ্মজাকে নামিয়ে দিল। মনা কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। আমির বলল,'যা ঘরে যা।'

মনা যেন এইটা শোনার অপেক্ষায় ছিল। দৌড়ে চলে যায়। পদ্মজা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আমিরকে গুরুজনদের মতো বলল,'আক্কেলজ্ঞান কখন হবে আপনার? বয়স তো কম হলো না।'

অবিকল পদ্মজার কথার ধরণ অনুসরণ করে আমির বলল,'আর কতদিন কেউ দেখবে কথাটা মুখে থাকবে? বিয়ের তো কম দিন হলো না।'

'আপনি...আপনি কালাচাঁদ না কালামহিষ।'

'এটা পূর্ণা বলতো না? হেহ,আমি মোটেও কালো না।'

'তো কী? এইযে দেখুন,দেখুন। আমার হাত আর আপনার হাত।'

পদ্মজা হাত বাড়িয়ে দেখায়। আমির খপ করে পদ্মজার হাত ধরে চুমু খেয়ে বলল,'এই হাতও আমার।'

আমি পদ্মজা - সকল পর্ব

পদ্মজা বলল,'ঠেসে ধরা ছাড়া আর কিছু পারেন আপনি? ছাড়ুন।'

আমির পদ্মজার হাত ছেড়ে দিয়ে হাসতে থাকল। 

চলবে...

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url