প্রেমাতাল -পর্ব ৭-৮-৯-১০ । Golpo Porun
প্রেমাতাল
(মৌরি মরিয়ম)
![]() |
This Photo is from Pexels |
কতক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর মুগ্ধ তিতিরকে পাহাড়ের কিনার থেকে সরিয়ে আনলো। ওরা ছিল আকাশনীলা কটেজের পেছন দিকটায়। কটেজের পিছন দিকেও একটা বারান্দা ছিল। সেই বারান্দার সামনে ঘাসের উপর তিতির বসে পড়লো। মুগ্ধও বসলো তিতিরের পাশে। অনেকটা সময় কেটে গেল, একটা কথাও বলেনি তিতির। ও এখনো তাকিয়ে আছে সামনের পাহাড় আর আকাশের দিকে। মুগ্ধ বলল,
-"শোনো তিতির, আমাদের দেরি হয়ে যাবে। আমরা মাত্র ৪৮ কিলোমিটার এসেছি। আরো ৪২ কিলোমিটার যেতে হবে অন্ধকার হবার আগেই।"
তিতির উঠে দাঁড়ালো। পাহাড় থেকে নামতে নামতে তিতির কোনো কথা বলল না। ওরা নিলগিরিতেই লাঞ্চ সেড়ে নিয়েছিল। খেতে খেতেও কোন কথা বলেনি তিতির। সিএনজি চলতে শুরু করার কিছুক্ষণ পর তিতির বলেছিল,
-"থ্যাংকস! আপনি ওভাবে না দেখালে আমি অনেককিছু মিস করে যেতাম। পাহাড়ের উপর ইটের কটেজ দেখে খারাপ লাগা নিয়েই ফিরে যেতাম।"
মুগ্ধ বাম হাতটা নিজের বুকের উপর রেখে বলল,
-"মাই প্লেজার তিতিরপাখি!"
-"বিশ্বাস করেন, আমি আমার জীবনে এত সুন্দর দৃশ্য কখনো দেখিনি।"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"তিতির, তোমাকে আমার নিলগিরির আরো অনেক কিছু দেখাতে ইচ্ছে করছে। হয়তোবা তুমি আমার মতই প্রকৃতি প্রেমিক বলেই কিন্তু সবটা আমার সামর্থ্যের মধ্যে নেই।"
-"সবই তো দেখলাম। আরো কি ছিল?"
-"সকালের ম্যাজিক্যাল নিলগিরির মেঘের সমুদ্র দেখাতে খুব ইচ্ছে করছে, সূর্যাস্তের নিলগিরিকে দেখাতে ইচ্ছে করছে। পূর্ণিমা রাতের চাঁদ তারা ভরা নিলগিরিকে দেখাতে ইচ্ছে করছে।"
-"আপনি এই সবগুলো দেখেছেন?"
-"হুম! তবে এর বাইরে একটা জিনিস দেখতে ইচ্ছে করছে।"
-"কি?"
-"উপরের কটেজগুলো বাদে নিচে একটা কাঠের কটেজ দেখেছো না?"
-"হুম!"
-"ওই কটেজে অসংখ্য তক্ষক রাত হলেই হুমরি খেয়ে পড়ে।"
-"তক্ষক দেখতে চাচ্ছেন?"
-"নাহ, তক্ষক তোমার গায়ে এসে পড়লে তুমি কি করবে তা দেখতে ইচ্ছে করছে।"
-"আপনাকে যতটা ভালমানুষ মনে করেছিলাম আপনি আদৌ তা নন।"
মুগ্ধ হেসে ফেলল। বলল,
-"সবাই কেন জানি এই ভুলটা করে ফেলে।"
তিতির মৃদু হেসে বলল,
-"আমরা যদি আজ এখানে থেকে যাই তাহলে কি এগুলো দেখতে পারবো?"
-"কাল ভরা পূর্নিমা। আজই আকাশে এতবড় একটা চাঁদ উঠবে তাই হয়তো সেটা দেখাতে পারবো। সূর্যাস্ত তো ডেইলি হয় তাই সেটাও দেখাতে পারবো। সকালে মেঘের সমুদ্রও পাবো এই সময়ে, কিন্তু আজ আমরা এখানে থাকতে পারবো না। কারন, সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের থানচি পৌঁছতে হবে, তাছাড়া ৩ মাস আগে বুকিং দিতে হয় নিলগিরিতে থাকতে চাইলে।"
তিতির মন খারাপ করে বলল,
-"ওহ!"
-"মন খারাপ করোনা। আরো অনেক সৌন্দর্য তোমার অপেক্ষায় বসে আছে। যা তুমি কল্পনাও করতে পারছো না। আর এসব নাহয় পরে কোন একসময় এসে দেখে যাবে।"
তিতির এবার পুরো মুগ্ধর দিকে ফিরে বলল,
-"আপনি না যেকোন সাধারণ একটা যায়গা থেকেও সৌন্দর্য খুঁটিয়ে বের করতে পারেন।"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"কোন যায়গাই সাধারণ না। সব যায়গার মধ্যেই কোনো না কোনো সৌন্দর্য আছে, কম আর বেশি।"
-"হুম! আচ্ছা, সেন্ট মার্টিনসের সৌন্দর্যের কথা বলুন তো একটু। ওখাকার কি কি আপনার কাছে মনে হয়েছে এক্সট্রা অর্ডিনারি।"
-"তুমি গিয়েছো নাকি যাওনি?"
-"সেটা পরে বলছি, আগে আপনি বলুন না?"
-"সেন্ট মার্টিনসের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে ওখানে দুদিন থাকতে হবে। ম্যক্সিমাম মানুষ যে ১২ টায় গিয়ে ৩ টায় ফিরে আসে সেটা করলে হবে না।"
-"আচ্ছা। তারপর?"
''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন
-"ওখানকার সমুদ্রের পানিটা তো খুব স্বচ্ছ, সি গ্রিন কালারের। একদম মালদ্বীপের মত তাই রাতে বিচে গেলে দেখা যায় পানির নিচে লাইট জ্বলছে, মুক্তোর মতো। দ্যাটস দ্যা প্রাইসলেস মোমেন্ট হেয়ার! পূর্নিমা থাকলে তো কথাই নেই। আরেকটা সৌন্দর্য হচ্ছে রঙিন মাছ। ছেঁড়া দ্বীপে উপর থেকে দেখা যায় বটে তবে সবচেয়ে ভাল দেখা যায় পানির নিচ থেকে। ইদানিং ওখানে সি ডাইভিং এর মত একটা সিস্টেম চালু করেছে। তবে অতটা না জাস্ট সমুদ্রের নিচে একটু ঘুরিয়ে রঙিন মাছ, রঙিন প্রবাল দেখিয়ে নিয়ে আসবে। তবু এটা মাস্ট করা উচিৎ সবার। বিদেশে গিয়ে সি ডাইভিং এর আনন্দের চেয়ে নিজের দেশে এটা কম আনন্দের না। আর কাঁকড়া খাওয়া উচিৎ কারন, বেস্ট কাঁকড়া যে তিন যায়গায় পাওয়া যায় তার মধ্যে সেন্ট মার্টিনস একটা।"
-"কাঁকড়া আমার অনেক পছন্দ। অন্য দুটো যায়গা কোথায়?"
-"কুয়াকাটা সি বীচের লেবু বন, আর চিটাগাং এর নাভাল রোড।"
-"আপনি তো পুরো একটা এনসাইক্লোপিডিয়া!"
-"হা হা হা হা.. ঘুরাঘুরি ছাড়া অন্য কোন নলেজ আমার নেই।"
-"যাই হোক, এবার আসল কথায় আসি। যেজন্য আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সেন্ট মার্টিনসের কথা। আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা সন্ধ্যার পর বীচে নিয়ে যায়নি। তাই ওই সৌন্দর্যটা আমি মিস করেছি। কেউ কখনো বলেওনি এ ব্যাপারে। আর সি ডাইভিং টাইপের কিছু বাংলাদেশে আছে তা তো জানতামই না।"
-"ওহ!"
-"এখন মনে হচ্ছে বাংলাদেশের যে প্রান্তেই যাইনা কেন আপনার সাথে না গেলে সব সৌন্দর্য মিস করবো।"
মুগ্ধ মনে মনে ভাবল, 'আমারও যে তোমাকে আমার দেখা সব সৌন্দর্য আমার মত করে দেখাতে ইচ্ছে করছে তিতিরপাখি। তুমি হয়তো সরল মনে বলেছো কথাটা কিন্তু আমি বলতে পারছিনা তোমার মত করে।'
তিতর উত্তরের জন্য উৎসুক হয়ে চেয়ে ছিল। তাই মুগ্ধ বলল,
-"টিওবির নেক্সট ট্রিপগুলোতে যেয়ো। সব দেখাবো।"
-"ওকে।"
দরজায় আবার টোকা পড়লো.. ভাবীর গলা,
-"তিতির, এই তিতির? আবার ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?"
-"আসছি ভাবী।"
তিতির তাড়াতাড়ি চুলটা আঁচড়ে রুম থেকে বের হলো। ওর মা বলল,
-"কিরে, এত দেরী করলি কেন উঠতে? নে তাড়াতাড়ি খেতে বোস।"
-"সময় নেই, ফার্স্ট ক্লাসের পর বাইরে খেয়ে নেব।"
-"না, ক্লাসে লেট হলে হবে। খেয়ে যা।"
-"এখন কি আমার খাওয়া-দাওয়াটাও তোমরাই ঠিক করে দেবে মা?"
তিতিরের মার চোখদুটো বড় হয়ে গেল। মেয়ে কি মিন করতে চাচ্ছে! তিতির কথা না বাড়িয়ে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল। ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করছে না এখন আর। সারারাত না ঘুমানো এবং কান্নার জন্য চোখ দুটো বড্ড জলছে। সবকিছুর জন্য মুগ্ধ দায়ী। কেন ফোন করতে গেল এতদিন পর! কেনই বা গান রেকর্ড করে পাঠালো! মুগ্ধকে ও ভুলতে পারেনা কখনোই এটা ঠিক কিন্তু সবকিছুকে চাপা দিয়ে নিজেকে কন্ট্রোলে তো রাখতে পারে। অথচ সব যখন কন্ট্রোলে তখনই মুগ্ধ ফোন করে বা ভার্সিটির সামনে এসে হাজির হয় আর সব আবার ওলট পালট হয়ে যায় তিতিরের। কোন কাজ ঠিকভাবে করতে পারে না। কোন ব্যাপারে স্থির থাকতে পারে না। একদম অস্বাভাবিক হয়ে যায়। তখন শুধু একটাই কাজ, মুগ্ধর সাথে কাটানো স্মৃতিগুলোকে পার্ট বাই পার্ট রিভিশন করা। রাস্তার ধার ধরে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে হাঁটতে তিতির ভাবনায় ফিরে গেল আবার।
থানচির উদ্দেশ্যে সিএনজি চলছিল। নিলগিরির পর থেকে যত আপহিলস আর ডাউনহিলস আসুক না কেন তিতরের আর ভয় করছিলনা বরং মজা পাচ্ছিল। দুজনে গল্প করতে করতে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পার হওয়ার পর একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটল। সিএনজি হঠাৎ থেমে গেল। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করল,
-"ও মামা, কি হইলো?"
হাসু কতক্ষণ ঘাটাঘাটি করে বলল,
-"মামা, গাড়ি নষ্ট হইসে। আর যাওন যাবো না।"
-"হায় হায় কও কি মামা! এই মাঝপথ থেকে কিভাবে যাব আমরা?
তিতির বলল,
-"এখন কি হবে?"
হাসু বলল,
-"গাড়িতে ঝামেলা হইলে আমি কি করমু কন? এইডা ঠিক করোন তো আমার কাম না।"
-"তাইলে এখন তুমি কি করবা?"
-"কি আর করমু? গাড়িতে শুইয়া রাইত পার করমু। সকাল হইলে থানচি থিকা কত চান্দের গাড়ী বান্দরবান যাইবো না? কোন একটার সাহায্য নিমু।
মুগ্ধ চিন্তায় পড়ে গেল। আরো ১৭ কিলোমিটার বাকী! তিতিরকে নিয়ে কিভাবে যাবে এতটা পথ! আর এক ঘন্টাও বাকি নেই সন্ধ্যা হওয়ার! সিএনজিতে গেলে হয়তো পৌঁছে যেত সন্ধ্যার আগে। কিন্তু হেঁটে তো অসম্ভব। আর তিতির কতটা হাঁটতে পারবে এই উঁচু নিচু রাস্তায় সেটাও তো চিন্তার বিষয়। সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে তিতিরকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো মুগ্ধ। তিতির বেশ হেলেদুলে হাঁটছে। মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-"তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে সিএনজি নষ্ট হবে সেজন্য তুমি প্রস্তুতই ছিলে।"
তিতির হেসে বলল,
-"কি করা যাবে বলুন। যেটা হয়েছে সেটাকে মেনে নেওয়াই ভাল না?"
-"হুম!"
এরপর আর কেউ কোন কথা বলল না। চুপচাপ হাঁটছিল রাস্তার কিনার দিয়ে। একসময় মুগ্ধ বলল,
-"তোমার কষ্ট হচ্ছে উঁচুনিচু রাস্তায় হাঁটতে?"
-"না তো।"
-"ব্যাগপ্যাক টার অনেক ওজন না? ওটা আমাকে দাও।"
-"নো নো.. আমার বোঝা আমি টানতে পারি। আমি ছেলেদের ওপর ডিপেন্ডেন্ট না।"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"বাহ! তাহলে তো ভালই। কিন্তু তিতির আমি চিন্তা করছি অন্য কথা।"
-"কি?"
-"থানচি তো দূরের কথা, আগামী ১ ঘন্টায় নেক্সট যে আর্মি চেকপোস্ট আমরা সে পর্যন্তও যেতে পারবো না হেটে।"
-"এতদূর?"
-"হুম!"
-"তাহলে? অন্ধকার হয়ে গেলেও হাঁটবো?"
-"পাগল হয়েছো? এটা পাহাড়ী রাস্তা। রাত হলে কতরকম বন্যপ্রানী চলে আসে এখানে। তাছাড়া পাশেই কত বড় খাদ দেখেছো? সবচেয়ে বড় কথা হলো রাতে এই রাস্তায় চলার পারমিশন নেই। আর্মিদের নজরে এলে খবর আছে।"
-"তাহলে?"
-"সেটাই ভাবছি।"
-"চলুন আশেপাশের কোনো গ্রামে গিয়ে রাতটা থাকতে দেয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করি।"
-"এটা সিনেমা না তিতির।"
-"মানে?"
-"মানে তোমার কি মনে হয় পাহাড়ে অন্য যায়গার মত একটু পর পর গ্রাম থাকে? কক্ষনো না। এরপর যে গ্রামটা সেটা আর্মি চেক পোস্টেরও পরে।"
-"তাহলে তো আমরা ভুল করলাম। সিএনজিতেই থাকতে পারতাম রাতটা।"
-"সেরকম হলে কি তড়িঘড়ি করে ভাড়া মিটিয়ে চলে আসতাম?"
-"কেন? সিএনজিতে থাকতে কি প্রব্লেম ছিল?"
-"ওই সিএনজি ড্রাইভার যদি ডাকাত দলের কেউ হয়ে থাকে? ডাকাতদের সাহায্য করার জন্য ইচ্ছে করে সিএনজি নষ্টের ভান করে থাকে? কিংবা নিজেই যদি ছুরি ধরে ব্ল্যাকমেইল করে? কি করতে পারবে তুমি?"
বিস্ময়ে তিতিরের চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল। বলল,
-"মানে, কি বলছেন এসব?"
-"অসম্ভব কিছু না। এরকমটা এদিকে হয়। তুমি সাথে আছো বলেই ভয়টা বেশি লাগছে।"
-"এখন কি হবে?"
-"ডোন্ট ওরি। তাড়াতাড়ি হাটো। সামনে একটা দ্বিমুখী রাস্তা আছে বোধহয়। থানচির রাস্তায় না গিয়ে আমরা অপজিটে যাব।"
-"কেন আমরা থানচি যাব না?"
-"যদি ওই হাসুটার মধ্যে কোনো ঘাপলা থেকে থাকে তাহলে ওরা ওই থানচির রাস্তায় যাবে আমাদের খুঁজতে। কারন ওরা ভাববে আমরা ওদিকে গিয়েছি।"
To be continued...
প্রেমাতাল - পর্ব ৮
মৌরি মরিয়ম
থানচির রাস্তাকে পাশ কাটিয়ে ওরা বেশ কিছুদূর এসে পড়েছে। দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে। একপাশে বিশাল পাহাড়, অন্যপাশে গভীর খাদ। পাহাড়টা যেখানে ছোট হয়ে এসেছে সেখানে সেখান থেকেই জঙ্গল শুরু। ওদিকটায় গিয়েই হঠাৎ মুগ্ধ দাঁড়িয়ে পড়লো। তিতির বলল,
-"কি হলো?"
মুগ্ধ তিতিরকে দেখালো যায়গাটা। তিতির বলল,
-"জঙ্গল দেখে কি করবো?"
-"ভেতরে ঢুকে দেখবো। থাকার মত হলে এখানেই থাকবো রাতটা।"
-"এই জঙ্গলে সারারাত কাটাবো?"
-"তো তুমি কি ভেবেছিলে?"
-"আমি ভেবেছিলাম আপনি কোন একটা ব্যবস্থা করবেন।"
-"এই জনমানবশূন্য যায়গায় এর চেয়ে ভাল ব্যাবস্থা আমি কি করবো? কোন গ্রাম কিংবা আর্মি চেকপোস্টে যেতে চাইলে ৩/৪ ঘন্টা হেটে পৌঁছানো যাবে। অথচ আলো আর ম্যাক্সিমাম ৪০ মিনিট থাকবে। এই পরিস্থিতিতে বুদ্ধিমানরা যা করবে আমিও তাই করছি।"
-"মানে এখানেই থাকার ব্যবস্থা করবেন?"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"আজ্ঞে।"
তিতিরের সত্যি ভয় করছিল। মুগ্ধর সাথে এই জঙ্গলে একা রাত কাটাবে! এতক্ষণ যতটুকু দেখেছে তাতে ভালই মনে হয়েছে ছেলেটাকে, কিন্তু ওটা যদি ওর অভিনয় হয়ে থাকে? রাত হলেই ওকে একা পেয়ে যদি আসল রূপটা বের করে? কুকুরকে বিশ্বাস করা যায় কিন্তু ছেলেদের না। বলল,
-"টর্চ নেই আপনার কাছে?"
-"থাকলে?"
-"টর্চ জ্বালিয়ে হেঁটে চলে যাব থানচি। চলুন না। এই জঙ্গলে আমি থাকতে পারবো না। এখনো সন্ধ্যা হয়নি তার আগেই কি অন্ধকার! পুরো গা ছমছমে অবস্থা।"
-"তিতির তোমার বয়স কত?"
-"আপনি জানেন না মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে হয়না।"
-"জানি, তবে এখন তো আমরা কোন স্বাভাবিক সিচুয়েশনে নেই তাই এখন সবই যায়েজ।"
-"সব যায়েজ মানে?"
তিতিরের চোখ ছানাবড়া! মুগ্ধ বলল,
-"কত ১৬/১৭/১৮/১৯?"
-"১৭+।"
-"স্টাডির দিক থেকে হিসাব করলে তুমি আমার ৬ বছরের ছোট। আর বয়সের হিসাব করলে ৮ বছরের ছোট। ঠিকই আছে তাহলে তুমি এটা বলতেই পারো।"
-"কোনটা? ওই টর্চ জ্বালিয়ে হেঁটে যাওয়ার কথাটা?"
-"হুম!"
-"আপনি বলেছিলেন আর্মিদের পারমিশন নেই। কিন্তু বিপদে পড়লে কি আর করা, বুঝিয়ে বলতে হবে।"
-"হায়রে! বুঝতে চাওনা কেন? বাচ্চাদের নিয়ে এই একটা প্রব্লেম।"
-"প্রব্লেম না মনে করে বুঝিয়ে বলুন, ঠিকই সব বুঝবো।"
-"বুঝিয়ে বলবো কি করে? তুমি তো এখনো এডাল্ট হওনি। এডাল্ট কথা তোমাকে কি করে বলি।"
-"ওসব এডাল্ট চ্যাপ্টার স্কুলে থাকতে পার করে এসেছি। বলুন তো।"
-"মানে কি করেছো স্কুলে থাকতে?"
-"উফফ! আপনি বলুন, আমি সব এডাল্ট কথাই বুঝি।"
-"আজকালকার ছেলেমেয়েরা অনেক ফাস্ট হয়!"
-"সময় নষ্ট করছেন। বোঝাতে না পারলে চলুন হাঁটা শুরু করি। আমি রাতেরবেলা এই জঙ্গলে থাকতে পারবো না।"
-"আচ্ছা দাঁড়াও, দাঁড়াও।"
তিতির দাঁড়ালো। মুগ্ধ বলল,
-"আমি একা থাকলে এই রাতেও হেটে চলে যেতাম। টর্চ লাগতো না। চাঁদের আলোর কাছে টর্চ ম্লান। কিন্তু তোমাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। চেকপোস্টে আর্মিরা আমাদের বিপদের সুযোগ নিতে পারে।"
-"আর্মিরা তো আমাদের হেল্প করবে, বিপদের সুযোগ কেন নেবে?"
''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন
-"আর্মিরা হেল্প করতো যদি দিন হতো। কারন, দিনে হেল্প ছাড়াও আমরা যেতে পারবো। আর এখন যখনই বুঝবে আমরা বিপদে আছি তখনই হেল্প করার বিনিময়ে খুব ভদ্রভাবে তোমাকে চাইবে। তখন আমি কি করবো? দিয়ে দেব? আর না দিলেও ওদের প্রব্লেম নাই ওদের নিয়ে নেওয়ার মত জোড় আছে। তার উপর তোমার নাই ন্যাশনাল আইডি কার্ড।"
-"আপনি সবাইকে এত সন্দেহ করেন কেন? তখন সিএনজি ড্রাইভারকে সন্দেহ করলেন, এখন আবার আর্মিদের।"
-"জানতাম দোষ এখন আমারই হবে। শোনো আমি কাউকে অকারনে সন্দেহ করিনা। পাহাড়ের এমন বহুত কাহিনী আমি জানি। যা হয় তাই বললাম।"
তিতির চুপ করে রইল। মুগ্ধ বলল,
-"আচ্ছা চলো যাই। তোমার কিছু হলে আমার কি! আমি ছেলে মানুষ আমার তো কোন প্রব্লেম নাই। এজন্যই কারো ভাল করতে নেই।"
মুগ্ধ হাঁটা শুরু করলো। তিতির দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে মুগ্ধর জ্যাকেট টেনে ধরল। বলল,
-"না যাবনা। প্লিজ রাগ করবেন না। আমি তো পাহাড়ের ব্যাপারে কিছুই জানিনা তাই ভুলে বলে ফেলেছি, সরি।"
-"আমার বান্দরবান থেকে আপনাকে নিয়ে আসাটাই ভুল হয়েছে।"
-"হঠাৎ আমাকে 'আপনি' করে বলছেন কেন?"
-"ঠিকই আছে, ছোটমানুষ ভেবে তুমি করে বলেছিলাম। কিন্তু আদৌ আপনি ছোট না। বহুত পাক্না।"
তারপর অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
-"শালার... মেয়েরা সাথে থাকলে ঝামেলা হবেই। যতই তুমি তাদের জন্য করো। শেষ পর্যন্ত তোমকেই চরিত্রহীন ভাববে!"
তিতির দেখলো রাগে মুগ্ধর কপালের রগ দুটো কাঁপছে। লাল হয়ে গেছে মুখটা। তাড়াতাড়ি বলল,
-"আমি কখন আপনাকে চরিত্রহীন ভাবলাম?"
-"ভেবেছেন, ভেবেছেন বলেই এই রাতের বেলা হেঁটে থানচি চলে যেতে চেয়েছেন। ভয়টা তো জঙ্গল নিয়ে না। ভয়টা আমাকে নিয়ে। ভাবছেন রাত হলেই আমি আপনার কোন ক্ষতি করবো। এসব বলা লাগেনা বোঝা যায়।"
তিতির মনে মনে ভাবলো 'এই ছেলে তো দেখছি মনের মধ্যে ঢুকে বসে আছে।' কিন্তু মুখে বলল,
-"না না বিশ্বাস করুন, আমি এসব ভাবিনি। আপনাকে বিশ্বাস না করলে কি আমি একা এতদূর আপনার সাথে আসতাম?"
মুগ্ধ চুপ করে রইলো। তিতির আবার বলল,
-"প্লিজ আমাকে আগের মত তুমি করে বলুন। নাহলে কেমন যেন লাগছে আমার।"
মুগ্ধ খানিকটা স্বাভাবিক হলো। বলল,
-"আচ্ছা, আচ্ছা। দিন থাকতে কিছু কাজ সেড়ে ফেলতে হবে, এসো।"
মুগ্ধ এগিয়ে গেল জঙ্গলের দিকে। পিছনে পিছনে তিতির। গাছপালার কারনে এদিকটায় অতটা আলো নেই। তবে সবকিছু দেখা যাচ্ছে। জঙ্গলে কয়েকটা কমলা গাছ দেখতে পেল মুগ্ধ। বেশ কয়েকটা কমলা ছিঁড়ে নিল। তারপর ভেঙে যাওয়া গাছের ডাল কুঁড়োলো রাত নেমে এলে আগুন ধরাতে হবে তো। তিতিরও সাহায্য করছে। এমন সময় একটা সিএনজি আসার আওয়াজ পেল। মুগ্ধর চোখে মুখে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠলো। তিতিরকে বলল,
-"তুমি এই বড় গাছটার আড়ালে দাড়াও। আমি দেখি, লিফট পেলে তোমকে ডাকবো। তখন বের হবে। তার আগে না।"
-"ওকে!"
মুগ্ধ হাত বাড়িয়ে থামালো সিএনজিটাকে। সিএনজি থামলো। মুগ্ধর আশা ম্লান হয়ে গেল। সিএনজিতে অলরেডি পিছনে ৩ জন আর ড্রাইভারের দুপাশে দুজন বসা। সবাইকেই খুব ভীত লাগছিল। ড্রাইভার বলল,
-"কি অইসে ভাই? গাড়ি থামাইলেন ক্যান?"
-"আসলে আমরা একটা বিপদে পড়েছি তাই ভেবেছিলাম যদি কোন সাহায্য পাওয়া যায়। পেছন থেকে একটা ছেলে বলল,
-"ভাই কি বলবো? আমরা নিজেরাই বিশাল বিপদ পার করে আসলাম। আপনাকে কি সাহায্য করবো?"
-"কি বিপদ?"
ড্রাইভার বলল,
-"ডাকাইত ধরসিল। তাও ভাল ওনগো লগে মাইয়া মানুষ নাই। মাইরা দইরা ট্যাকা পয়সা সব রাইক্ষা দিসে।"
ড্রাইভারের কথা শেষ না হতেই আরেকটা ছেলে বলল,
-"আমাদের সবার মোবাইল, ল্যাপটপ সব নিয়ে নিয়েছে।"
ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো,
-"ভাই আপ্নের লগে কি মাইয়া মানুষ আছে?"
মুগ্ধর যেন উত্তর রেডিই ছিল। বলল,
-"না আমর সাথে আমার ছেলে ফ্রেন্ডরা আছে। কেন বলুন তো?"
-"আইজকা একটা পোলা আর একটা মাইয়া সিএনজিতে কইরা থানচি যাইতাসিল। মাইয়াডা পরীর মত সুন্দর। ওই মাইয়াডারে নিলগিরিতে দ্যাখসে ডাকাইত দলের এক পোলা। দেইক্ষা তো ওগো সরদাররে খবর দিসে, পোলা মাইয়া যখন খাইতে গ্যাছে তখন হেয় যাইয়া সিএনজি ড্রাইভারের লগে সেটিং করসে। তারপর কতদূর যাইয়া ড্রাইভার কইসে সিএনজি নষ্ট হইয়া গ্যাছে। এমন যায়গায় অরা যাইবোই বা কই, রাইতে ধরবো ভাবছিল। কিন্তু ডাকাইত আওনের আগেই পোলা মাইয়ারে লইয়া পগারপার। ডাকাইতরা মাইয়া না পাইয়া ড্রাইভার ডারে মাইরা কি অবস্থা যে করসে কি কমু ভাই! হালার তোর যদি এইসব কামে অভিজ্ঞতা না থাহে তয় তুই আজাইরা ঝামেলায় জড়াইতে গেলি ক্যা?"
তিতির গাছের আড়াল থেকে সব শুনে ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল। ড্রাইভারের পাশের ছেলেটা বলল,
-"আমার মনে হয় ড্রাইভারটা ইচ্ছে করে করেনি এমন। ডাকাতদের ভয়ে করেছে।"
পিছন থেকে আরেকজন বলল,
-"টাকার লোভেও করতে পারে।"
মুগ্ধ বলল,
-"আবার দুটোই হতে পারে।"
আরেকটা ছেলে বলল,
-"কিন্তু আমি বুঝলাম না ডাকাতরা ওদের রেখে আমাদের ধরলো কেন?"
মুগ্ধ বলল,
-"ওইতো, ওদের না পেয়ে খালি হাতে চলে যাবে! তাই আপনাদের কাছ থেকে যা পারে হাতিয়ে নিয়েছে। এই রাস্তায় আজ যারা যাবে হয়তো সবারই আপনাদের মত অবস্থা হবে।"
ড্রাইভার বলল,
-"না না, অরা মাইয়ারে ধরনের লাইজ্ঞা থানচির দিক গ্যাছেগা। অগো দলের একজন কইতাসিল, 'অই মাইয়ারে আমার চাই ই চাই। লাগলে পুরা রাস্তা খুইজ্জা তাপা তাপা কইরালামু। যাইবো আর কই?'
বুজলেন ভাই... ডাকাইতগো কাছে মাইয়া মানুষ পাইলে টাকা কিছুনা।"
মুগ্ধ বলল,
-"আমাদের মেয়ে ফ্রেন্ডরা আসতে চেয়েছিল ভাগ্যিস আনিনি।"
ড্রাইভারটা বলল,
-"আরে ভাই সকাল সকাল গেলেগা তো আর কোনো ঝামেলা হইতো না। কত মাইয়ারাই তো আসে।"
মুগ্ধ বলল,
-"তাও ঠিক!"
-"আচ্ছা ভাই আমরা যাই।"
-"আচ্ছা আচ্ছা।"
সিএনজি চলে যেতেই মুগ্ধ জঙ্গলের ভেতর তিতিরকে যেখানে রেখে এসেছিল সেখানে চলে গেল। তিতির এখনো ভয়ে কাঁপছে। ওকে দেখেই বলল,
-"সরি।"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"আরেএএএ.. ইটস ওক্কে তিতিরপাখি! তুমি যখন আমার সাথে আছো, তোমাকে সেফ রাখার দায়িত্বটাও আমার!"
-"আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো আপনি কি কিছু টের পেয়েছিলেন?"
-"নাহ, কিন্তু যখন হাসু বলেছিল সিএনজি নষ্ট হয়ে গেছে তখন ওর চেহারাটা চোরের মত ছিল। সেটা দেখে আন্দাজ করেছিলাম। এরকম ঘটনা আমি অনেক আগে শুনেছিলাম। এজন্যই তো ম্যাক্সিমাম লোক চান্দের গাড়িতে থানচি যায়, আর ভোরে রওনা দেয় যাতে দুপুরের মধ্যে থানচি পৌঁছে যেতে পারে।"
-"ওহ!"
-"তাছাড়া আমরা তাজিংডং থেকে ফেরার পথে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। টর্চে চার্জ ছিলনা, তার উপর অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার। পানি শেষ হয়ে গিয়েছিল, খাবার ছিল না। কি যে অবস্থায় পড়েছিলাম বলে বোঝাবার মত না। সকাল হলে দেখি যেখান থেকে শুরু করেছিলাম ওখানেই ফিরে এসেছি সারারাত হেটে।"
-"আহারে!"
-"হুম, তারপর থেকে যেকোনো ট্রিপে গেলে সবরকম প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দেয়ার প্রিপারেশন থাকে আমার।"
-"ভাগ্যিস ছিল, তা না হলে আমার যে কি হতো।"
মুগ্ধ কিছু বলল না। তিতির এবার বলল,
-"আচ্ছা ডাকাতরা যদি এদিকে আসে?"
-"আসুক, প্রব্লেম কি?"
-"আপনি কি ঢিসুম ঢিসুমও জানেন নাকি?"
-"জানলে কি হবে?"
-"ঢিসুম ঢিসুম করে ডাকাতদের খাদে ফেলে দেবেন।"
-"এহহহ! এখনো বিয়ে করিনি। মরার ইচ্ছে নেই।"
-"তাহলে যে বললেন, আসুক আসলে প্রব্লেম নেই।"
-"না মানে আসবে তো তোমাকে নিতে। তো দিয়ে দিলেই ঝামেলা শেষ।"
তিতির ভয় ভয় চোখে চেয়ে রইল। হঠাৎ মুগ্ধ একটা বুনোহাঁসকে দেখতে পেল। অনেক দৌড়াদৌড়ি করেও ধরতে পারলো না। তিতির বলল,
-"ধুর থামেন তো, কি হবে ওটা ধরে?"
-"পুড়িয়ে খেতাম। রাতে কি খাওয়া লাগবে না?"
-"এম্মা, হাঁস পুড়িয়ে খাবেন? ছিঃ।"
-"আরে মশলাপাতি আছে তো। সুন্দর করে বার-বি-কিউ করতাম। হাত চেটে খেতে। খালি ধরতে পারলাম না বলে।"
-"আপনি ব্যাগে মশলা নিয়ে ঘোরেন?"
-"হুম, ট্যুরে গেলে।"
তারপর হঠাৎ মুগ্ধর মনে পড়লো হাঁস ধরার ধান্দায় সূর্যাস্তটা মিস হয়ে যাচ্ছে। তিতিরকে বলল,
-"চলো চলো.. সূর্যাস্ত মিস হয়ে যাচ্ছে।"
ভয়ডর সব ভুলে তিতির-মুগ্ধ জঙ্গল থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় চলে গেল। মুগ্ধ বলল,
-"ব্যাগপ্যাক রেখে এসেছো কেন? নিয়ে এসো। আমরা যেখানেই যাব আমাদের ব্যগপ্যাক আমাদের সাথেই থাকবে। কখন কি লাগে বলা যায়না।"
তিতির আবার জঙ্গলে ঢুকে ওর ব্যগপ্যাকটা এনে কাধে নিল। তারপর মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরে ধরে রাস্তা থেকে কিছুটা নেমে গেল। যায়গাটা রিস্কি ছিল তবু মুগ্ধ আছে সেই ভরসায় তিতির নামলো। তারপর মুগ্ধ তিতিরকে নিয়ে একটা পাথরের উপর বসলো। তারপর সামনে তাকিয়ে মুগ্ধ বলল,
-"এখান থেকে সূর্যাস্তটা দেখে যে ফিল পাবে সেটা রাস্তা বা জঙ্গল থেকে দেখে পেতে না। আর রাস্তা থেকে আমাদের দেখাও যাবে না। তাই তোমাকে এখানে নিয়ে এলাম।"
তিতির সূর্যাস্ত দেখবে কি! ও দেখছিল মুগ্ধকে। এমন একটা মানুষ আর উপর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। ওর কেন জানি ইচ্ছে করছিল মুগ্ধর বুকে মাথা রেখে বসে সূর্যাস্তটা দেখতে। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব না।
সূর্যটা আস্তে আস্তে একটা উঁচু পাহাড়ের নিচে লুকিয়ে পড়ছে। পুরো আকাশটা লাল হয়ে গেছে। কোথাও কমলা রং কোথাও আগুন লাল, কোথাও সিঁদুর লাল। তার ফাঁকেফাঁকে আকাশের নীল রংটাও উকি দিচ্ছিল। পাহাড়চূড়া থেকে সূর্যাস্তের সৌন্দর্য যে এইরকম ভয়াবহ তা তিতির ভাবতেও পারেনি।
হঠাৎ একটা জীপের শব্দ পেল ওরা। মুগ্ধ চোখের পলকে তিতিরকে টেনে নিয়ে পাথরটার উপর থেকে সরে পাহাড়ের আরো নিচের দিকটায় সরে গিয়ে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। তিতির ভয়ের চোটে আচমকা কখন যেন মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরেছে। একটু পা ফসকে গেলেই নিচে বিশাল খাদ। মুগ্ধ জানে তিতিরের সেদিকে চোখ পড়লে ভয় পাবে। তাই ওর একটা হাত দিয়ে তিতিরের চোখ ঢেকে মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে রাখলো। তিতির শুনতে পেল মুগ্ধর বুকের ভেতর শব্দ হচ্ছে... ঢিপ ঢিপ ঢিপ ঢিপ!
জীপগাড়িটা জঙ্গলের সামনে এসে থামলো। একটা লোক বলল,
-"ওস্তাদ, অরা এই জঙ্গলে ঢুকে নাই তো রাতটা পার করার জন্য?"
আরেকটা কন্ঠস্বর শোনা গেল,
-"থানচির রাস্তায় যহন যায় নাই, এই রাস্তায় গ্যাছে। ভাল কইরা খুইজা দেখ, পুরা জঙ্গল তন্নতন্ন কইরা খুঁজবি। লাগলে আগুন জ্বালাইয়া দে। ওই ****পোলার গলাটা নামাই দিয়া মাইয়াডারে লইয়া আয়, যাহ।"
তিতির মুগ্ধর বুকে মুখ লুকিয়ে কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে, পুরো শরীর কাঁপছে ওর। মুগ্ধ ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কান পেতে রইল উপরে কি হচ্ছে সেটা বোঝার জন্য!
To be continued....
প্রেমাতাল - পর্ব ৯
মৌরি মরিয়ম
মুগ্ধর মনে হলো রাস্তার দিকটায় কেউ নেই, কারন কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। শুধু জঙ্গলের ভেতর থেকে শুকনো পাতায় পা ফেলার ঝুপঝাপ শব্দ আসছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর পায়ের আওয়াজটা কাছে চলে এল। আবার কথোপকথন শোনা গেল। তার মানে ওদের দলের সর্দারটা জঙ্গলে ঢোকেনি, এখানেই ছিল। একজন বলল,
-"ওস্তাদ, জঙ্গলে কেউ নাই।"
সর্দার চেঁচিয়ে বলল,
-"কেউ নাই মানে? গেল কই তাইলে?"
অন্য একটা গলা পাওয়া গেল,
-"ওস্তাদ, আমার মনে লয় অরা এই রাস্তায় আহে নাই, যেমনেই হউক থানচি গ্যাছেগা। উল্টা রাস্তায় ক্যান আইবো কন? অরা তো আর জানতো না আমরা পিছন লাগছি।"
সর্দার বলল,
-"জানতো জানতো। ওই কুত্তার ছাও যেমনেই হউক ট্যার পাইসিলো। নাইলে এত জলদি পলাইতো না।"
এবার ৪র্ধ কোন ব্যক্তির গলা পাওয়া গেল,
-"কিন্তু ওস্তাদ, গাড়ি ছাড়া এত জলদি অরা থানচি গেল ক্যামনে?"
-"গাড়ি ছাড়া যায় নাই। গাড়ি দিয়াই গ্যাছে।"
-"গাড়ি পাইলো কই?"
-"***পো.. আমারে জিগাস গাড়ি কই পাইলো? কত বড় কইলজা!"
-"ওস্তাদ, মাফ কইরা দেন।"
সর্দার বলল,
-"যা সর, তরে লইয়া টাইম নষ্ট করার টাইম নাই আমার। ওই রবিন্যা এদিক আয়।"
কিছুক্ষণ পর সর্দার জিজ্ঞেস করলো,
-"তুই ওই মাইয়ার ছবি দেহাইয়া আমার গায়ে জ্বালা ধরাইছস!"
তিতির চমকে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাইলো। মুগ্ধ তিতিরের মুখ চেপে ধরল।
লোকটা কাঁচুমাচু হয়ে বলল,
-"ওস্তাদ আপনের পায়ে ধরি.. আমারে এইবারের মত মাফ কইরা দ্যান। আমি কোনদিন আর এমুন কাঁচা কাজ করুম না।"
-"করবি ক্যামনে? সুযোগ পাইলে না করবি! আমার দলে ভুল করার সাজা কি অয় জানোস না?"
-"ওস্তাদ, আমারে মাফ কইরা দ্যান ওস্তাদ, আপনে যা কইবেন করুম। আর জীবনেও এই ভুল করুম না। জান ভিক্ষা দেন।"
-"তাইলে তর বউরে আইজ রাইতে আমার ঘরে পাডাই দিস। তর বউ যদি আমারে খুশি করবার পারে তাইলে তুইও মাফ পাবি।"
লোকটা এবার কেঁদে ফেলল। তারপর বলল,
-"ওস্তাদ, বউডা পোয়াতি। ৫ মাস চলতাছে। অরে আমি ক্যামনে পাডামু?"
তারপর একটা ছুরির আঘাতের আওয়াজ হলো আর সাথে সাথে লোকটার মাথাটা আর মাথাকাটা দেহটা খাদে পড়ে গেল। লোকটাকে ওইভাবে পড়তে দেখে তিতির অজ্ঞান হয়ে গেল। সর্দার বলল,
-"বজলু, আমি বাইত্তে যাইতাসি। এক ঘন্টার মইধ্যে তুই রবিনের বউরে উঠাইয়া নিয়া আয়।"
-"জ্বী ওস্তাদ!"
-"মনে রাখিস যদি কোন ভুল হয় তাইলে তর অবস্থাও রবিনের মত অইব।"
-"কোন ভুল অইবো না ওস্তাদ। আমি অখনই যাইতাসি।"
এরপর সবাই জীপে উঠে চলে গেল। জীপের শব্দ যতক্ষণ শোনা গিয়েছে মুগ্ধ ওর যায়গা থেকে নড়েনি। তারপর যখন শব্দটা পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেল তখন মুগ্ধ তিতিরকে নিয়ে ওখান থেকে সরে সেই পাথরটার উপর এল যেখানে ওরা বসেছিল। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে চারপাশটা। শুধু চাঁদের আলো ছাড়া অন্য কোন আলো নেই।
একহাতে তিতিরকে ধরে অন্য হাত দিয়ে ব্যগ থেকে পানি বের করে তিতিরের চোখে মুখে ছিটালো। তিতির চোখ খুলল। মুগ্ধ ওর মুখটা তুলে ধরে পানি খাওয়ালো। পানি খাওয়া শেষ হতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো তিতির। মুগ্ধ বলল,
-"আরে, বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন? ওরা চলে গেছে তো। আর আসবে না।"
তিতির তখনও মুগ্ধর এক হাতের উপর পড়ে ছিল, ওঠার মত শক্তি ওর নেই। কোনরকমে বলল,
-"আপনি না থাকলে আমি আজকেই শেষ হয়ে যেতাম।"
-"সেজন্যই তো আল্লাহ আজকে আমাকে এখানে তোমার সাথে রেখেছে। যাই হোক, চলো জঙ্গলে যাই।"
-"নাহ, আমি যাবনা। যদি ওরা আবার আসে?"
-"জঙ্গলে ওরা খুঁজেছে। যেহেতু পায়নি ওরা আর আজকে আসবে না। ওরাতো ভেবেই নিয়েছে আমরা থানচি চলে গিয়েছি, শুনলেই তো। তাছাড়া ওদের আজকের কাজ এখান থেকে ফিক্সড করেই গিয়েছে। ওটা শুনতে পারোনি কারন তখন তুমি অজ্ঞান হয়ে ছিলে।"
-"কি কাজ বলুন না!"
-"ওসব শুনে তোমার কাজ নেই।"
-"না না প্লিজ বলুন না।"
-"ওরা অন্য কাউকে তুলে আনার প্ল্যান করেছে।"
-"সেকি!"
-"হুম! বাদ দাও তো। চলো চলো.. খাদের পাশে সারারাত থাকবো নাকি?"
তিতির উঠতে চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। ওর সাড়া শরীর অসাড় হয়ে পড়েছে। এত ভয় ও জীবনেও কোনদিন পায়নি। মুগ্ধ তিতিরের কাধ থেকে ব্যগপ্যাক টা নামিয়ে কাধে নিজের ব্যাগপ্যাকের উপরে নিল। তারপর তিতিরকে কোলে তুলে নিয়ে রাস্তায় উঠলো। জঙ্গলের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বেশ ভেতরে ঢুকে গেল, একদম রাস্তার পাশের পাহাড়টার পিছন দিকটায়। যাতে ওরা আগুন জ্বালালে রাস্তা থেকে কেউ দেখতে না পায়।
মুগ্ধ দুটো ব্যাগ কাধে নিয়ে আর তিতিরকে কোলে নিয়ে অবলীলায় হাটছিল। তখন তিতির অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মুগ্ধর দিকে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল মুগ্ধর গলাটা ধরে রাখতে। কিন্তু হাত উঠানোর মত শক্তি পেলনা।
মুগ্ধ তিতিরকে কোল থেকে নামিয়ে একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসালো। তারপর ব্যাগপ্যাক দুটো নামালো। শেষ বিকেলে যে কাঠগুলো কুড়িয়েছিল সেগুলো এখন অনেক দূরে। তিতিরকে বলল,
-"তিতির আমি সেই কাঠগুলো নিয়ে আসি, তুমি একটু বসো হ্যা?"
তিতির মুগ্ধর জ্যাকেট খামচে ধরে বলল,
-"প্লিজ! আমাকে একা রেখে কোথাও যাবেন না। দরকার নেই আলো জ্বালানোর। চাঁদের আলোতেই সব দেখা যাচ্ছে।"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"হুম চাঁদের আলোতে তো দেখা যাচ্ছেই, কিন্তু দেখার জন্য তো আর আলো জ্বালাতে হবে না। বন্যপ্রাণী আর শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য আগুন জ্বালাতে হবে। আলো দেখলে ওরা আর আসবে না।"
-"আমি এতকিছু জানিনা। আমাকে একা রেখে আপনি যেতে পারবেন না।"
মুগ্ধ গেলনা। ওখান থেকেই কাঠ কুড়িয়ে আগুন জ্বালালো। তারপর ব্যাগপ্যাক থেকে কাপড়ের কি একটা বের করে সেটা নিয়ে কিছু একটা করতে লগলো মুগ্ধ। কিচ্ছুক্ষণ পর তিতির বুঝতে পারলো ওটা একটা তাঁবু! তিতির বলল,
-"আপনার কাছে তাঁবু ছিল?"
-"হ্যা, না থাকলে কি নিশ্চিন্তে জঙ্গলে থাকার চিন্তা করতাম? কেন তুমি বুঝতে পারোনি আমার কাছে তাঁবু আছে।"
-"না।"
-"ও।"
-"কিন্তু তাঁবু নিয়ে এসেছিলেন কেন? তাঁবু কি নিজের আনতে হয়? সাফি ভাইরা প্রোভাইড করেনা?"
-"হ্যা, তা তো করেই। আমার নিজের তাঁবু আছে তাই নিয়ে এসেছিলাম যাতে শেয়ার করতে না হয়।"
-"ওহ!"
তাঁবু পুরোপুরি টাঙানো হতেই মুগ্ধ তিতিরকে সেখানে নিয়ে গেল। তারপর ব্যাগ থেকে একটা স্টিলের মগ আরেকটা কাপড়ে মোড়ানো কাচের মগ আর কিছু ছোট ছোট কৌটা বের করলো। তিতির বলল,
-"আপনার ব্যাগটা পুরো একটা ছোটখাটো বাসা।"
মুগ্ধ হেসে স্টিলের মগে পানি নিয়ে তাঁবু থেকে বেড়িয়ে গেল। পানিটা আগুনে গরম করে নিয়ে আবার তাঁবুতে ঢুকলো। ঝটপট দুই কাপ কফি বানিয়ে ফেলল মুগ্ধ। তারপর এক কাপ কফি, বিস্কুট আর গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা কমলা তিতিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-"এই হলো আজকের ডিনার।"
তিতির হেসে বলল,
-"আপনি এগুলো খেয়ে সারারাত কাটিয়ে দিতে পারবেন?"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"হুম! তাজিংডং এ হারিয়ে যাওয়া সেই রাতে এক ফোটা পানিও ছিলনা। সেই তুলনায় এটা আল্লাহর রহমতে অনেক ভাল ডিনার। বাই দ্যা ওয়ে তোমার হবে তো এতে?"
তিতির হেসে বলল,
-"আমি ডায়েট কন্ট্রোল করি। রাতে শুধু সবজি সেদ্ধ খাই অথবা যেকোনো একটা ফল। সেই তুলনায় এটা অনেক।"
-"বাপরে! তুমি কেন ডায়েট করো? তুমি তো স্লিমই আছো!"
-"হুম, ডায়েট কন্ট্রোল করি বলেই স্লিম আছি, নাহলে গোল হয়ে যেতাম। অনেক খেতে পারি তো আমি!"
-"ওহ। যাই হোক, কফিটা ঠান্ডা হবার আগে খেয়ে নাও। দূর্বলতাটা কমে যাবে।"
খাওয়া শেষ করে মুগ্ধ বলল,
-"তুমি শুয়ে পড়ো। আমি বাইরে আছি, কিছু লাগলে ডেকো।"
মুগ্ধ বেড়িয়ে গিয়ে আগুনের পাশে একটা গাছে হেলান দিয়ে বসলো। তারপর হঠাৎ তাঁবুর দিকে অনিচ্ছাকৃতভাবে তাকাতেই দেখতে পেল তিতির ওর ড্রেস খুলছে। তাঁবুটা কাপড়ের তাই ছায়াটা দেখা গেল। সাথে সাথে মুগ্ধ চোখ ফিরিয়ে নিল। এই দৃশ্যটা দেখামাত্রই কেমন যেন লাগলো ওর। বুকের ভেতর শিরশির করে উঠলো। আবার তাকাতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু তাহলে ওর আর ওই জানোয়ার গুলোর মধ্যে কোন তফাৎ থাকবে না। তাই তাকালো না।
কফি খাওয়ার পর তিতিরের উইকনেস কিছুটা কেটেছে। ড্রেস চেঞ্জ করে কিচ্ছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর মনে হলো এই শীতের রাতে মুগ্ধ এভাবে বাইরে বসে আছে! ও কেন এটা মেনে নিল! ছেলেটা ওর জন্য কতকিছু করলো। সাথে সাথে উঠে তাঁবুর দরজার উপড়ের ছোট্ট নেটের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। দেখলো আগুনের পাশে একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে মুগ্ধ। তিতির ডাকলো,
-"এই যে শুনছেন?"
মুগ্ধ বলল,
-"হ্যা বলো। কিছু লাগবে?"
-"হ্যা, আপনাকে লাগবে।"
-"মানে?"
-"বাইরে থাকার মানে কি হলো?"
-"কেন কি হয়েছে?"
-"আপনি ভেতরে আসুন।"
-"কেন?"
-"এই শীতের মধ্যে সারারাত বাইরে বসে কাটাবেন?"
-"আরে এখানে আগুন আছে, শীত লাগছে না।"
-"না প্লিজ আপনি ভেতরে এসে শুয়ে পড়ুন। ভেতরে যথেষ্ট যায়গা আছে দুজনের জন্য।"
মুগ্ধ বলল,
-"আরে, আমিও যদি ভেতরে থাকি তো আমাদের পাহাড়া দেবে কে?"
-"আপনি বলেছেন ডাকাতরা আর আসবেনা।"
-"হুম, কিন্তু বন্যপ্রাণীরা আসতে পারে।"
-"আপনিই বলেছিলেন আগুন জ্বালালে ওরা আসবে না। প্লিজ আসুন না। আপনি সারারাত এভাবে বাইরে বসে থাকলে আমার ঘুম আসবে না।"
মুগ্ধ অগত্যা তাঁবুর ভেতরে ঢুকলো। তারপর ব্যাগ খুলে একটা টি-শার্ট আর একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট বের করল। তারপর হুট করে নিজের জ্যাকেট, শার্ট খুলে টি-শার্ট টা পড়লো। এই এতটুকু সময়ের মধ্যেই মুগ্ধর লোমশ বুকটা দেখতে মিস করেনি তিতির। বেহায়ার মত তাকিয়ে ছিল, মুগ্ধ খেয়াল করেছে কিনা কে জানে! সে যাই হোক, ছেলেদেরকে খালি গায়ে কতই তো দেখেছে ও। কিন্তু এরকম তো লাগেনি কখনো। এখন যে আবারও দেখতে ইচ্ছে করছে!
তিতির এসব ভাবতে ভাবতেই মুগ্ধ বলল,
-"বাইরে থাকবো বলে চেঞ্জ করিনি। ভ ভিতরেই যদি থাকি তাহলে চেঞ্জ করা উচিৎ। তুমি থাকো, আমি বাইরে থেকে চেঞ্জ করে আসি।"
মুগ্ধ চেঞ্জ করে আসলো এবং দুজনে দুইপ্রান্তে শুয়েও পড়লো। হঠাৎ তিতিরের ঘুম ভেঙে গেল। মুগ্ধকে ডাকলো,
-"এইযে, এই..
মুগ্ধ চোখ মেলে তাকাতেই তিতির বলল,
-"আপনি জেগে ছিলেন?"
-"না, কেন?"
-"একবার ডাকতেই উঠে গেলেন!"
-"ওহ, আমার ঘুম খুব পাতলা। বল কি বলবে।"
-"ইয়ে মানে একটু প্রব্লেমে পড়েছি।"
-"কি?"
-"আসলে আমি..
তিতিরের আমতা আমতা করা দেখে মুগ্ধ বুঝে নিল। বলল,
-"বাথরুম পেয়েছে?"
তিতির লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। মুগ্ধ বলল,
-"এত লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। এটা ন্যাচারাল একটা ব্যাপার।"
তিতির চুপ করে রইল। মুগ্ধ বলল,
-"খোলা যায়গায় করতে হবে, এছাড়া কোন উপায় নেই। এখানে ঘরবাড়িই নেই, টয়লেট কোত্থেকে আসবে বলো?"
-"কিন্তু খোলা যায়গায়...!"
-"একটু প্রব্লেম হবে বাট একটা রাতই তো ম্যানেজ করে নাও। তাছাড়া তুমি আমি ছাড়া এখানে কেউ নেই।"
মুগ্ধ তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তিতির যেতে যেতে ভাবছিল, এমন পরিস্তিতিতে আল্লাহ কেন যে ফেলে। এত লজ্জা লাগছিল যে তিতিরের মনে হচ্ছিল এখনি মরে যাক, আবার চেপেও রাখতে পারছিল না।
তিতির সাহস করে অনেকটা দূরে গিয়েছিল। ফিরে আসার সময় কেন জানি অনেক ভয় লাগছিল। মনে হচ্ছিল পেছন থেকে কেউ টেনে ধরবে, তাই এক দৌড় দিল। দৌড় দিয়ে এসে মুগ্ধর সাথে ধাক্কা খেল। মুগ্ধ বলল,
-"কি হলো?"
-"কিছুনা।"
-"তুমি না কাউকে ভয় পাওনা? তুমি না ছেলেদের উপর ডিপেন্ডেন্ট না?"
-"ছেলেরা এমনই হয় না? সুযোগ বুঝে খোটা দেয়!"
-"এই না, সরি সরি। আসলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছেলেরা মেয়েদের উপর ডিপেন্ডেন্ট আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের উপর ডিপেন্ডেন্ট। এটাই সত্যি। যাকগে.. চলো ঘুমাই।"
-"না।"
-"না মানে?"
-"মানে আপনি বলেছিলেন রাতে গান শোনাবেন, এখন গান শোনাতে হবে।"
-"এখন? এই অবস্থায়?"
-"হুম! আর কোনো কথাই শুনতে চাচ্ছি না।"
-"আচ্ছা আচ্ছা দাড়াও আমি জ্যাকেট টা নিয়ে আসি, শীত করছে।"
-"আপনি দাঁড়ান, আমি এনে দিচ্ছি।"
-"কেন? আমি পারবো তো।"
-"আমিও পারবো তো!"
তিতির দৌড়ে গিয়ে জ্যাকেট টা নিয়ে এল। সেটা গায়ে দিয়ে মুগ্ধ গাছে হেলান দিয়ে বসলো। তিতির আগুনের পাশে ওর মুখোমুখি বসলো। তারপর মুগ্ধ একবার চাঁদের দিকে তাকালো, তারপর তিতিরের দিকে তাকিয়ে গাইতে শুরু করলো..
"ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে..
সামলে রাখো জোছনাকে!
কারো নজর লাগতে পারে..
মেঘেদের উড়োচিঠি উড়েও তো আসতে পারে।
জোছনা বড়ই লাজুক মাখা,
লুকিয়ে থাকে ধরা দেয়না।
সেকি তোমার গড়া
নাকি শুধুই মায়া বোঝা যায়না
ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে।"
তিতিরের মনে হলো গানটা মুগ্ধ ওকে নিয়েই গাইছে। অজানা একটা লজ্জায় পেয়ে গেল ওকে!
To be continued...
প্রেমাতাল - পর্ব ১০
মৌরি মরিয়ম
-"ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে..."
গান শেষ হওয়ার পর কিছুক্ষণ দুজনই চুপ! তারপর তিতির বলল,
-"এই গানটা আমি কখনো শুনিনি। কিন্তু গানটা খুব সুন্দর।"
-"এটা অনেক আগের গান। মান্না দে এর গাওয়া। জানি আজকালকার ছেলে মেয়েরা মান্না দে এর গান শোনে না। কিন্তু আমি আবার ওনার অনেক বড় ফ্যান। বাবার সাথে ছোটবেলা থেকে ওনার গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছি।"
-"আসলে আমিও আগের গান শুনিনা, আগের গানগুলো খুব বোরিং হয়। কিন্তু এই গানটা দারুন।"
-"আগের গানগুলো বোরিং না, ইন্সট্রুমেন্ট গুলো বোরিং। এখনকার মত এত আধুনিক ইন্সট্রুমেন্ট তো আর তখন ছিলনা। তুমি যদি এই গানটারই আগের ভার্শন শোনো তোমার ভাল লাগবে না। কিন্তু আগের গানগুলোর মত এত রোমান্টিক গান এখন খুব কমই হয়।"
-"তা যাই হোক, আপনি যে এত সুন্দর গাইতে পারেন আমি কিন্তু ভাবিওনি!"
-"ধুর! কি যে গাই নিজেই বুঝি!"
-"কেন কেউ কখনো বলেনি আপনাকে আপনি কেমন গান?"
-"আমি কাউকে গান শোনাই না, নিজের জন্য গাই।"
-"কেন? আপনার উচিৎ এই প্রতিভাটা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া।"
-"আমার গান গাওয়াটা কোন প্রতিভা না। আর আমি গান দিয়ে কিছু করতেও চাইনা। নিজের মনের শান্তির জন্য গাই। আর মাঝে মাঝে স্পেশাল দু'একজনকে শোনাই তাও যদি ইচ্ছে করে। বাবাকে বেশি শোনানো হয়, উনি খুব পছন্দ করেন। আর..."
-"আর কি?"
-"আর বউকে শোনাবো প্রতিরাতে, সেই হতভাগিনী শুনতে না চাইলেও শোনাবো। বিরক্ত হলেও মানবো না।"
তিতির হেসে ফেলল। বলল,
-"গার্লফ্রেন্ড কে শোনান না?"
মুগ্ধ হো হো করে হেসে ফেলল। তিতির যে কায়দা করে জানতে চাইছে ওর গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা সেটা বুঝতে বাকী রইল না মুগ্ধর। তিতির বলল,
-"হাসির কি হলো?"
-"কিছুনা। চলো ঘুমাই। আমি কাল রাতেও একটু ঘুমাইনি, বাসে ঘুম আসেনা আমার।"
-"আচ্ছা"
তিতিরের গা জ্বালা করতে লাগলো। কি ভাব! গার্লফ্রেন্ডের কথা বলতেই কথা ঘুরিয়ে নিল। বদ একটা।"
তাঁবুর দুই প্রান্তে দুজন শুয়ে পরলো। শুয়েই মুগ্ধ পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো। জানে নেটওয়ার্ক থাকার কোনই সম্ভাবনা নেই তবু একবার চেক করা জাস্ট। নাহ নেটওয়ার্ক নেই। বলল,
-"এখান্র নেটওয়ার্ক থাকলে আমাদের এরকম বিপদে পড়তে হতো না।"
-"হুম! সকালে বাসায় কথা বলেছিলাম যে বান্দরবান পৌঁছেছি। তারপর তো আর নেটওয়ার্কই পেলাম না। বাবা বোধহয় চিন্তা করছে।"
-"কেন? তুমি বলোনি পাহাড়ে নেটওয়ার্ক থাকেনা?"
-"বলেছি, ভাইয়াও নিশ্চই বলবে কিন্তু বাবা আমাকে নিয়ে একটু বেশিই চিন্তা করে।"
-"স্বাভাবিক! একমাত্র মেয়ে কিনা!"
-"একমাত্র হোক আর যতগুলোই হোক মেয়েদের প্রতি বাবারা বোধহয় এমনই হয়।"
-"হ্যা, সেটাই।"
সিঙ্গেল তাঁবু, পাশাপাশি তিতির মুগ্ধ। মাঝখানে মাত্র এক হাতের দুরত্ব। তিতির মুগ্ধর উল্টোদিকে ফিরে শুয়েছিল। হঠাৎ বাইরে চোখ পড়লো তিতিরের। কাপড়ের ভেতর দিয়েও বাইরে ছায়া দেখা যায়। বাতাসের তোড়ে আগুনের উথাল পাথাল জ্বলা দেখে ওর কেমন যেন ভয় করলো। ও মুগ্ধর দিকে ফিরলো। মুগ্ধর চোখ বন্ধ.. যাক ও যখন ঘুমিয়েই পড়েছে, অস্বস্তি লাগবে না আর।
হঠাৎ তিতিরের খেয়াল হলো, ভেতর থেকে বাইরে দেখা গেলে তো বাইরে থেকেও ভেতরে দেখা যাওয়ার কথা, হোক সে ছায়া! ও যখন ড্রেস চেঞ্জ করছিল তখন তো ভেতরে কেউ নেই ভেবে সব খুলে ফেলেছিল। মুগ্ধ দেখেনিতো আবার? মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেল। পরমুহূর্তেই ভাবলো, ধুর! কিসব ভাবছে ও। যে মানুষটা নিজে লাইফ রিস্ক নিয়ে ওকে বাঁচালো তাকেই কিনা ও খারাপ ভাবছে! মুগ্ধ নিশ্চই দেখেনি। মুগ্ধ যদি খারাপ হতো তাহলে এই পরিবেশে ওর পাশে হাত গুটিয়ে শুয়ে না থেকে ওকে গিলে খেত! এসব ভাবতে ভাবতেই তাকালো মুগ্ধর দিকে।
তিতির কম্বল নিয়ে শুয়েছিল, মুগ্ধর নাকি শীত করছিল না তাই মুগ্ধ কম্বল গায়ে না দিয়ে মাথার নিচে দিয়ে বালিশ বানিয়ে শুয়েছিল। এখনো কম্বলে মাথা দিয়ে মুগ্ধর টি-শার্ট সরে গিয়ে গলা থেকে বুকের কিছু অংশ বেড়িয়ে ছিল। সেদিকে চোখ পড়তেই তিতিরের সারা শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। তিতির চোখ ফিরিয়ে নিল। তারপর উঠে বসলো। উঠে বসতেই মুগ্ধর পায়ের দিকে চোখ পড়লো। ও এক পায়ের উপর এক পা ভাজ করে রেখেছে। বড় বড় লোমগুলো ওর ফরসা পায়ের উপর শুয়ে আছে। এই দৃশ্য দেখে ওর শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার! ছেলেদেরও উচিৎ মেয়েদের সামনে ভালমতো ড্রেসআপ করা। মেয়েদের সামনে থ্রি কোয়ার্টার পড়ে পা দেখিয়ে বেড়ানো কোন বিরত্ব নয়। তিতির এবার মুগ্ধর মুখের দিকে তাকালো। মুগ্ধর ঠোঁটের নিচে বামপাশে ছোট্ট একটা তিল আছে, আগে খেয়াল করেনি। এটা তো আরো ভয়ঙ্কর জিনিস! তিতির নিজের শরীরের তিল নিজে চেয়ে চেয়ে দেখে! তিল জিনিসটা এত ভাল লাগে ওর! তিতির চোখ সরাতে পারছিল না। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ মুগ্ধ চোখ মেলে তাকালো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তিতিরের নিঃশ্বাস আটকে গেছিল ভয়ে। কারন, মুগ্ধ একটা পলকও ফেলছিল না। তিতিরের ভয়ে জমে যাওয়া দেখে মুগ্ধ হেসে ফেলল। তিতির যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। বুকে হাত দিয়ে বলল,
-"উফফ! আপনি সত্যিই খুব খারাপ! ভয় দেখালেন কেন?"
-"তুমি আমাকে স্ক্যান করছিলে কেন?"
-"মানে?"
''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন
-"এর চেয়ে ডিটেইলে বললে লজ্জা পেয়ে যাবে তো! তবু বলবো?"
তিতির ভাবলো, মুগ্ধ কি বুঝে ফেলল তিতির ওকে কিভাবে দেখছিল আর কি কি ফিল হচ্ছিল? তাড়াতাড়ি বলল,
-"না না, থাক!"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"ঘুমাচ্ছো না কেন?"
-"ঘুম আসছে না।"
-"দিনের বেলায় সিএনজিতে ওভাবে ঘুমালে রাতে ঘুম আসবে কিভাবে?"
-"ছেলেদের কাজই মেয়েদের দূর্বলতা নিয়ে খোঁটা দেয়া।"
-"আচ্ছা আচ্ছা সরি। রাগ করোনা, শুয়ে পড়ো। ঘুম আসবে একসময়।"
তিতির শুতে পড়লো। মনে মনে ভাবল, "যতটা ভাল ছেলে বলে মনে হয় ততটাও না, ফাজিলের হাড্ডি একটা। এর থেকে সাবধান থাকতে হবে।"
কিচ্ছুক্ষণ একটু পর তিতির বলল,
-"আমার খুব শীত লাগছে, সেজন্যই বোধহয় ঘুম আসছে না।"
মুগ্ধ নিজের কম্বলটাও দিল তিতিরকে। বলল,
-"এটা নাও। আমার শীত একটু কম, কম্বল গায়ে দেয়া লাগবে না।"
-"কিন্তু আপনি তো এটা দিয়ে বালিশ বানিয়েছিলেন।"
-"বালিশ লাগবে না। লাগলে বাসা থেকে নিয়ে আসতাম। তুমি এটা নাও তো।"
তিতির দুটো কম্বল একসাথে করে গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো তা টেরই পেলনা। যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখলো মুগ্ধ শীতে কাঁপছে। কি করবে! তাড়াতাড়ি মুগ্ধর কম্বলটা মুগ্ধর গায়ে দিয়ে দিল। তবু মুগ্ধর কাঁপুনি কমলো না। তারপর নিজেরটাও দিল। তাতেও কাজ হলোনা। নিজের ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে তা দিয়ে ওকে চেপে ধরলো। আস্তে আস্তে ওর কাঁপুনি থামলো। তিতির ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আছে কিনা। না জ্বর নেই। শীতেই কাঁপছিল! এহ, খুব বীরপুরুষ সেজে ওকে কম্বল দিয়ে ঘুমানো হয়েছিল। তিতির বসে থাকলো কি করবে এছাড়া। কিন্তু ঘুমের জ্বালায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলো না, শুয়ে পড়লো। তারপর শীত লাগায় কখন যে মুগ্ধর সাথে একই কম্বলের মধ্যে ঢুকে পড়লো তা ও টেরই পেলনা।
ভোরে মুগ্ধর ঘুম ভাঙতেই একটা উষ্ণ কোমলতা অনুভব করলো। তারপর চোখ মেলে তাকাতেই সেকেন্ডের মধ্যেই ওর হার্টটা যেন লাফিয়ে উঠলো। তিতির ওর বুকের সাথে লেগে ঘুমাচ্ছে! মুগ্ধ তাড়াতাড়ি সরে গেল। ছিঃ ছিঃ তিতির জেগে এরকম দেখলে কি ভাবতো!
মুগ্ধ উঠে তাঁবু থেকে বের হলো। বাইরে একটু একটু আলো ফুটেছে। এখনই বেড়িয়ে পড়তে হবে। তা নাহলে আবার কোন বিপদ চলেও আসতে পারে। মুগ্ধ তিতিরকে তাঁবুর বাইরে থেকেই ডাকলো। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলোনা। ভেতরে গিয়ে ডাকতেও কোন সাড়াশব্দ নেই। তারপর মাথায় হাত দিয়ে ডাকলো। তিতির চোখ মেলে বলল,
-"উফফ, আপনি কেন সবসময় ঘুমাতে দেন না?"
-"ডাকাত আসছে।"
তিতির এক লাফে উঠে বসে বলল,
-"কই কই?"
মুগ্ধ হেসে দিয়ে নিজের জিনিসপত্র গুছাতে গুছাতে বলল,
-"বাহ! খুব ভাল ওষুধ তো!"
তিতির যখন বুঝলো ওকে বোকা বানানো হয়েছে তখন ও রাগ করে বলল,
-"আপনার মত খারাপ মানুষ আমি আগে দেখিনি।"
মুগ্ধ হাসি বজায় রেখে বলল,
-"এখন রওনা না দিলে আরো বড় বিপদ আসবে, তখন কি করবে?"
-"কি বিপদ?"
-"উঠে রেডি হয়ে নাও তাড়াতাড়ি।"
উফফ, এই ছেলের ভাব দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
ব্যাগ গোছাতে গোছাতে মুগ্ধর চোখ পড়ল আগের দিনের কেনা পেঁপেটার দিকে। পাকা টা খেয়েছিল আর আধপাকা টা রেখে দিয়েছিল। এখন সেটা পেকে গেছে। বলল,
-"ওয়াও, পেঁপেটার কথা তো মনেই ছিলনা। আমি বাইরে বসে এটা কাটি। তুমি তোমার জিনিসপত্র গুলো গুছিয়ে রেডি হয়ে নাও।"
তিতির রেডি হয়ে বের হতেই দেখলো মুগ্ধ পেঁপে কাটা শেষ। ওকে দেখেই বলল,
-"অল্প পানি দিয়ে মুখ ধুতে হবে, পানি শেষের দিকে।"
-"ও, আচ্ছা প্রব্লেম নেই।"
তিতির মুখ ধুতে ধুতে মুগ্ধ তাঁবু খুলে ভাঁজ করে ব্যাগে ঢোকালো। তারপর কাটা পেঁপেগুলো একটা পলিথিনে নিয়ে বলল,
-"চলো।"
-"খেয়ে যাবনা? আমার তো খিদে পেয়েছে।"
-"যেতে যেতে খাব। এখনে বসে খাওয়া মানে সময় নষ্ট করা।"
-"আচ্ছা।"
ওরা হাটছে আর পেঁপে খাচ্ছে। পেপে খাওয়া একসময় শেষ হয়ে গেল কিন্তু রাস্তা আর শেষ হয়না। রাস্তার পাশে একটা গাছ দেখিয়ে মুগ্ধ বলল,
-"এটা কি গাছ জানো?
তিতির বলল,
-"না তো। কি গাছ?"
-"এটা আলু গাছ। কিন্তু আমরা নরমালি সবসময় যে গোল আলু খাই এটা সেটা না। এটা হলো পাহাড়ী আলু। এতবড় হয়। একটা আলুতেই ১/২ কেজি হয়ে যায়। আলুগুলো খেতে যে কি মজা! নাফাখুম থেকে নাইক্ষ্যাং আর সাতভাইখুম যাওয়ার সময় জিনাপাড়া থাকতে হবে, পাহাড়ী গ্রাম। ওখনে আমাদের এই আলুর ঝোল খেতে দিবে তুমি দেখো।"
-"ওহ!"
-"তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো? অনেক অপ্রয়োজনীয় কথা বলি আমি?"
-"না না। বলুন না। আমার তো এসব জানতে ভালই লাগে।"
-"হুম, একটা যায়গায় যাব, অথচ সে যায়গার মানুষ কি খায়, কিভাবে জীবন কাটায়, কেমন তাদের ধ্যান ধারণা এসব না জানলে তো আর ঘোরার কোন মানে হয়নান। খালি গেলাম আর দেখে চলে আসলাম সেটা তো আর ট্রাভেলিং না।"
-"হুম!"
-"তোমার কি ঘুম পেয়ে গেল নাকি আবার?"
-"না।"
-"তাহলে কোন কথা বলছো না, শুধু হু হা করছো যে? হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?"
-"হুম, আসলে আমি এত হাঁটিনি কোনদিন?"
-"আচ্ছা তাহলে একটু বসে যাই চলো।"
ওরা বসলো। তিতর বসেই পানি খেল। মুগ্ধ বলল,
-"অল্প অল্প করে পানি খাবে নাহলে বেশি তৃষ্ণা লাগবে।"
-"আচ্ছা।"
ওরা রাস্তার একপাশে বসে আছে। সামননে খাদ! অন্যপাশে পাহাড়ী জুম ক্ষেত। এরকম দৃশ্য দেখে কাল পর্যন্ত তিতির লাফিয়েছে। এখন সৌন্দর্যে চোখ সয়ে গেছে। মুগ্ধ হঠাৎ একটা গান ধরলো,
" চলোনা যাই বসে নিরিবিলি,
দুটি কথা বলি নিচু গলায়..
আজ তোমাকে ভোলাবো আমি
আমার মিষ্টি কথামালায়।
তোমাকে বলবো হ্যালো সুইটহার্ট..
খবর শুনেছ নাকি?
তোমার আমার প্রনয়
নিয়ে দেশজুড়ে মাতামাতি।
ঢাকা শহরের অলিগলিতে
তোমার আমার পোস্টার!
সব পত্রিকার ফ্রন্ট পেজে ছবি
তোমার এবং আমার।
আজ তোমাকে ভোলাবো আমি
আমার মিষ্টি কথামালায়।
আমাদের কথা সংসদে গেছে
দুই নেত্রী রাজি।
তারা বলেছেন আর দেরী কেন?
এখনি ডাকুন কাজি।
আজ তোমাকে ভোলাবো আমি আমার মিষ্টি কথামালায়...."
গান শেষ হতেই তিতির বলল,
-"নয় নম্বর বিপদ সংকেত!"
-"হুম।"
-"আচ্ছা গানটার মধ্যে তোমাকে বলবো হ্যালো" এর পরে মিস্টার ছিলো না? আপনি যে সুইটহার্ট বললেন?"
-"এটা তো মেয়েদের গান, তাই মিস্টার ছিল। আমি ছেলে হয়েও কি ওটা বলবো? আবার গানটাও খুব পছন্দ। তাই একটু চেঞ্জ করে নিয়েছি।"
তিতির হেসে বলল,
-"ওহ! বাই দ্যা ওয়ে.. কই ঢাকা শহরের কোন গলিতে তো আপনার কোনো পোস্টার দেখিনি কখনো।"
মুগ্ধ তাকালো তিতিরের দিকে। তিতিরের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। মুগ্ধ বলল,
-"কি করবো বলো পোস্টার বের হবার আগেই তো সব মেয়েরা আমাকে ছেড়ে চলে যায়।"
-"সব মেয়েরা ছেড়ে চলে যায়! মানে কয়টা গার্লফ্রেন্ড ছিল আপনার?"
-"হবে ৭/৮ টা। কখনো গুনে দেখিনি।"
তিতিরের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। তবু মুখটা স্বাভাবিক রেখে বলল,
-"এতগুলো গার্লফ্রেন্ড কে সামলান কিভাবে? ধরা খেয়ে যান না?"
-"আরে তুমি ভুল বুঝছো! এতগুলো তো আর একসাথে ছিল না। একজন গেছে আরেকজন এসেছে এরকম।"
-"এতগুলো মেয়ে সবাই আপনাকে ছেড়ে গেছে, না কাউকে কাউকে আপনিও ছেড়ে দিয়েছেন?"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"আমি একজনকেও ছাড়িনি।"
-"খুব অবলীলায় যে এসব বলছেন? আবার হাসছেনও। আমার তো মনে হচ্ছে আপনার মাধ্যেই কোনো ঘাপলা আছে।"
মুগ্ধ অন্যদিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো!