প্রেমাতাল - পর্ব ১১-১২-১৩-১৪ । Golpo Porun

প্রেমাতাল

(মৌরি মরিয়ম)

Prematal
This Photo is from Pexels

-"এত হাসছেন কেন, শুনি?"

-"এমনি।"

-"এমনি না, আপনি খুব খারাপ। খালি মনে মনে কি যেন ভাবেন আর হাসেন।"

মুগ্ধ একথার পর আবার হাসলো। তিতির এবার রেগেমেগে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

-"আপনি আসলেই খুব খারাপ!"

তারপর হাটা শুরু করলো। মুগ্ধ দৌড়ে ওকে ধরলো। পাশাপাশি হাটতে হাটতে বলল,

-"সরি সরি, আর হাসবো না। বলো কি জানতে চাও।"

-"দরকার নেই।"

-"বাপরে! তোমার দেখি অনেক রাগ! তোমার বয়ফ্রেন্ড তোমাকে সামলায় কিভাবে?"

-"আমার বয়ফ্রেন্ড নেই।"

-"সেকি! এত সুন্দরী মেয়ের কিনা বয়ফ্রেন্ড নেই।"

প্রেমাতাল - সকল পর্ব

তিতির চোখ বড় করে তাকালো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ ঢঙ করে দূরে সরে গেল। তারপর এক লাইন গাইলো,

"ওই চোখে তাকিয়ো না, আমি লুটপাট হয়ে যাব। আমি বরবাদ হয়ে যাব!"

তিতিরের কি হলো কে জানে রাগ ধরে রাখতে পারলো না গানটা শুনে। হেসে ফেলল। তারপর মুগ্ধ আবার তিতিরের পাশাপাশি হাটতে শুরু করলো। তিতির কিছু বলছিল না। মুগ্ধ বলল,

-"আসলে আমার ফার্স্ট গার্লফ্রেন্ড হয় ভার্সিটি তে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময়। ৫ মাস পর ব্রেকাপ। তারপর আবার সেই বছরই আরেকটা গার্লফ্রেন্ড হয়, ৩ মাস ছিল। তারপর আবার থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় আরেকটা গার্লফ্রেন্ড হয়। ১০/১২ দিনেই চলে যায়। ব্যস শেষ আমার কাহিনী।"

-"আপনি যে বলেছিলেন ৭/৮ টা?"

-"আরে ওটা তো মজা করে বলেছি।"

-"ও।"

-"থার্ড ইয়ার মানে তো অনেক আগের কথা, না?"

-"হ্যা, তিন বছর প্রায়।"

-"এতদিন ধরে একাই আছেন?"

-"হ্যা, তারপর থেকে আর রিলেশনশিপে যাইনি। একবারে বিয়ে করবো। শুধু শুধু এক্সদের সংখ্যা বাড়িয়ে লাভ কি? তারপর হয়তো বিয়ে করতে গিয়ে দেখবো আমার বউ এক্স এর ছোট বোন। কি ভয়ঙ্কর হবে বুঝতে পারছো?"

একথা বলেই মুগ্ধ হো হো করে হেসে দিল। তিতির হেসে বলল,

-"আপনার খারাপ লাগে না কোনো এক্স এর জন্য?"

-"খারাপ লাগবে কেন? ওরা ভাল আছে, এটাই তো বড় কথা। আমি বয়ফ্রেন্ড হিসেবে খুব খারাপ। যখন বুঝেছে আমার সাথে রিলেশন করে ভুল করেছে তখন চলে গেছে। দুজনের জন্যই ভাল হয়েছে।"

-"ব্রেকাপ গুলো কি কি কারনে হয়েছে জানতে পারি?"

-"সবগুলো ব্রেকাপ সেইম কারনে হয়েছে।"

-"কি কারন?"

-"আমি কেয়ারলেস, আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন, আমি অগোছালো, আমি ভাব মারি, আমি বোরিং,ব্যাগডেটেড। আমার সাথে থাকা আর গাছের সাথে থাকা সমান।"

-"কি বলছেন? আপনি কেয়ারলেস, দায়িত্বজ্ঞানহীন হলে আমি এতক্ষণে ডাকাতদের হাতে খুন হয়ে যেতাম।"

মুগ্ধ হাসলো। তিতির আবার বলল,

-"আপনি অগোছালো এটা নিয়ে আর কি বলবো? আপনি সবকিছু আমার আগে গুছিয়েছেন! পেঁপে কাটতে পারেন, রান্না করতে পারেন। এগুলো অগোছালো ছেলেরা পারে?"

-"ওরা তো আর কেউ আমার সাথে কোথাও ট্রিপে যায়নি আর বিয়ে করে এক বাড়িতেও থাকিনি তাই এসব দেখার বা জানার সুযোগ পায়নি। যা জেনেছে যা দেখেছে তা হলো, আমি কেয়ারলেস কারন, আমি ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দেইনা। প্রতিবেলায় ফোন করে খবর নেই না খেয়েছে কিনা। শুধুমাত্র রাতে একবার ফোন দেই। কি হেয়ার কাট দিল, কি লিপস্টিক লাগালো, কি ড্রেস পড়লো কিছুই খেয়াল করিনা বলিও না কেমন লাগছে! একচুয়েলি আমার এত সাজগোজ পছন্দ না। বাট আনফরচুনেটলি সবগুলোই সাজুনী ছিল। তিতির হেসে বলল,

-"তারপর?"

''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন

-"আমি ব্যাগডেটেড কারন, আমি ফেসবুকের ছবিতে কমেন্ট করিনা এটা একজনের অভিযোগ ছিল। আমি নাকি ভাব মারি কারন রেস্টুরেন্টে গেলে অন্য কাপলদের দেখিয়ে বলতো, 'দেখো ছেলেটা মেয়েটাকে খাইয়ে দিচ্ছে। আর তুমি জীবনেও আমাকে খাইয়ে দিলে না।' আমি হেসে বলতাম 'ও' কিন্তু খাইয়ে দিতাম না।"

-"আচ্ছা, আসলেই আপনি তাহলে একটু অন্যরকম। সব মেয়েরাই এসব কম বেশি চায়। যেমন ধরুন একটা মেয়ে তো অবশ্যই চাইবে যে তার বয়ফ্রেন্ডটা তাকে একটু খেয়াল করে দেখুক। একটু প্রশংসা করুক। কিন্তু আপনি তা করতেন না।"

-"মুখে এক ইঞ্চি মেকাপ থাকলে বুঝবো কি করে কঙ্কাবতী না কৃষ্ণকলি? ফরসা কালো নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তবে আসল ব্যাপারটা জানলে হয়তো সেটা নিয়ে গান শুনিয়ে প্রশংসা করতাম। তারপর ধরো একটা ছেলের মন পর্যন্ত পৌঁছতে যেমন পেটের দিকে আই মিন খাওয়ার দিকে নজর দিতে হয়, তেমনি একটা মেয়ের মন পর্যন্ত যেতেও তার চোখের দিকে নজর দিতে হয়। সুন্দর চোখের প্রতি আমার দূর্বলতা আছে। আমি অবশ্যই সেটা নিয়ে তাকে কিছু বলতাম কিন্তু চোখের উপর এক্সট্রা আইল্যাশ লাগলে আর কি কি সব দিয়ে চোখটাকে ভুতের মত রঙিন করে রাখলে বুঝবো কি করে যে কোন উপমাটা খাটবে? তাই কিছুই বলিনি।"

-"তো আপনি তাদেরকে বলতে পারতেন যে আপনি ওসব পছন্দ করেন না। আপনি না বললে তারা বুঝবে কি করে?"

-"বলবো কেন? যে যেরকম তার সেরকমই থাকা উচিৎ। আমার তো কোন রাইট নাই নিজের পছন্দ অপছন্দ অন্য কারো উপর চাপিয়ে দেয়া। আমি তো আর এসবের জন্য কাউকে ছাড়িনি। আর এসব অভিযোগ থাকলেও এসবের জন্য আমাকেও কেউ ছাড়েনি। ছেড়েছে আমার ট্রাভেলিং এর জন্য।"

-"সেকি! কেন?"

-"এইযে এরকম পাহাড়ে, জঙ্গলে আসলেই নেটওয়ার্ক থাকে না। কথা হয়না, তার জন্য নাকি অস্থির লাগে। গার্লফ্রেন্ডের চাইতে আমি ট্রাভেলিং কে বেশি ভালবাসি, আমি নাকি গার্লফ্রেন্ড ছাড়তে পারবো কিন্তু ট্রাভেলিং ছাড়তে পারবো না তাই ব্রেকাপ!"

-"আচ্ছা আপনি যখন ৪/৫ দিনের ট্রিপে যেতেন তখন আপনার গার্লফ্রেন্ডের কথা মনে পড়েনি? খারাপ লাগেনি?"

-"নাহ! প্রকৃতি আমার সবচেয়ে বড় আর ইম্পরট্যান্ট প্রেমিকা। প্রকৃতির কাছে গেলে আর কিছু লাগেনা।"

-"আমার তো মনে হচ্ছে আপনার কারো সাথেই সম্পর্কটা তেমন গভীর ছিলনা। কাউকেই আপনি সত্যিকার অর্থে ভালবাসেননি।"

-"সেটাও হতে পারে। তবে আমি লয়াল ছিলাম।"

-"ওহ!"

-"অনার্সের পর থেকেই মা আমার জন্য মেয়ে দেখছে। আমার মা ভীষন সৌখিন, সে বড় ছেলেকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আমি অনেক চুজি বুঝলে? মায়ের দেখা একটা মেয়েও পছন্দ হয়নি। মা তো পুরো বিরক্ত আমার উপর।"

-"তাই? আচ্ছা, কিরকম মেয়ে আপনার পছন্দ আমাকে বলুন তো। আমি আপনার জন্য মেয়ে দেখে দেব।"

-"বলছি তার আগে শোনো কেন আমার মায়ের দেখা মেয়ে পছন্দ হয়নি।"

-"ওহ, অবশ্যই... বলুন।"

-"দলবেঁধে মেয়ে দেখতে যাওয়া, সালামি দেয়া, এই ব্যাপারটা আমার কেমন যেন লাগে। যেকোনো মেয়ের জন্য খুবই অসম্মানজনক। তাই আমি মেয়ের ছবি দেখে ফোনে কথা বলেছি কিংবা বাইরে দেখা করেছি।"

-"তারপর?"

-"আমার সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট প্রশ্ন ছিল ট্রাভেলিং কেমন লাগে?"

-"ওয়াও, এন্সার কি ছিল?"

-"অনেক ধরনের এন্সার ছিল। একটা শুধু বলি। একজন বলেছিল, 'ওয়েস্ট অফ মানি। তার চেয়ে সেই টাকায় ঘরের একটা জিনিস বানানো যায়, ড্রেস কেনা যায়'।"

তিতির হাসতে লাগলো। মুগ্ধ বলল,

-"আমি ট্রাভেলিং ছাড়া থাকতে পারবো না। তাই এটাকে সহজভাবে নেবে এমন কোনো মেয়েকেই বিয়ে করতে চাই। সবচেয়ে ভাল হয় তারও যদি ট্রাভেলিং এ ইন্টারেস্ট থাকে। দুজন মিলে সারা দুনিয়া ঘুরব। খুব বেশি সুন্দরী না হলেও চলবে। শুধু চোখ দুটো সুন্দর হলেই হবে, ডুব দেব সেই চোখে।"

তারপর পাশাপাশি হাটতে হাটতেই তিতিরের চোখের দিকে তাকালো। তিতির সে দৃষ্টির অর্থ বুঝলো না। খুব ইন্টারেস্ট নিয়ে বলল,

-"তারপর আর কি কোয়ালিটি চাই?"

-"বেশি সাজগোজ করেনা এমন কোনো মেয়ে হলেই ভাল হয়। মেকাপ দেখলেই আমার একটা নেগেটিভ ইম্প্রেশন ক্রিয়েট হয়।"

-"আর?"

-"রান্নাবান্না না জানলেও চলবে। আমি মোটামুটি সবই রাঁধতে পারি, আর রাঁধতে ভালও লাগে। ফ্রি টাইমে আমার কাছ থেকে হেল্প পাবে। আর বোকা, ইমোশনাল মেয়ে চাই। ওরা অনেক ভালবাসতে জানে।"

-"আর?"

-"বেশি লম্বা না হলেও চলবে। ফরসা, কালো কোনোটাতেই প্রব্লেম নেই।"

-"কিন্তু আপনি তো লম্বা। লম্বা মেয়েদেরই আপনার পাশে ভাল লাগবে।"

মুগ্ধ হাসলো। তিতির বলল,

-"হাসছেন যে?"

-"এমনি।"

-"ও ভাল কথা, সবই বললেন কেন এক্স রা আপনাকে কেয়ারলেস, দায়িত্বজ্ঞানহীন, ভাব মারা আর ব্যাগডেটেড বলত। কিন্তু বললেন না তো কেন আপনাকে বোরিং বলতো। আপনি তো মোটেই বোরিং না। দুদিন ধরে তো দেখছি।"

-"ওহ ওটা তো ইচ্ছে করেই স্কিপ করেছি।"

-"কেন?"

-"বললে তুমি লজ্জা পেয়ে যাবে। আর আমি এটা তোমাকে বলেছি বলেও অনেক কিছু ভাবতে পারো।"

-"আরে ধুর! কিছুই ভাববো না। আপনার এক্স আপনাকে বোরিং বলার কারনে আমি কেন লজ্জা পাব?"

-"আমরা তো অতটাও ফ্রি হইনি।"

তিতির কিছু না বুঝেই বাচ্চাদের মত বায়না করতে লাগলো। আরে বলুন না। আমি মোটেই লজ্জা পাব না। আপনার মত মানুষকে কেন বোরিং বলবে আমি তো ভেবেই পাচ্ছিনা।"

-"সবাই না শুধু সেকেন্ড গার্লফ্রেন্ডটা বোরিং বলেছিল যার সাথে ৩ মাস রিলেশনশিপ ছিল।"

তিতিরের মেজাজটাই খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। বলল,

-"ইন্ট্রোডাকশন টা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে।"

-"বলার পর আবার রাগ করোনা কিন্তু।"

-"আরে না না বলুন।"

-"আই নেভার কিসড হার... বিকজ অফ হার লিপস্টিক!"

তিতির পুরো হা হয়ে গেল। ও ভাবতেই পারেনি এমন কিছু। ওরা হাটছিল। তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধ অন্যদিকে ফিরে কথাটা বলল। তিতির সাথে সাথে সোজা হয়ে অন্যদিকে তাকালো। লজ্জা পেয়ে পুরো চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। মুগ্ধর একবার ইচ্ছে হলো বলুক, 'জানতাম এমনটাই হবে।' কিন্তু কেন জানি আর বলল না।

৩ ঘন্টা হেটে ওরা মাত্র ৪ কিলোমিটার এসেছে। হঠাৎ দূর থেকে একটা গাড়ির আওয়াজ আসছিল। পিছনে ফিরতেই দেখলো একটা বাস আসছে। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,

-"তিতির, বাসে যেতে পারবে?"

তিতিরের চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠলো। বলল,

-"হ্যা পারবো।"

-"লোকাল বাস কিন্তু! দাঁড়িয়েও যেতে হতে পারে।"

-"নো প্রব্লেম। হাটতে তো আর হবে না।"

মুগ্ধ বাসটা থামালো। বাসের হেল্পার জানালো যায়গা নেই। অলরেডি অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। তখন মুগ্ধ ওদের বিপদের কথা বলতেই বাস ওদের তুলে নিল। বাসে উঠে মুগ্ধ বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়ালো। আর তিতির তা নাগাল পেলনা। তাই মুগ্ধর হাত ধরে দাঁড়ালো। মুগ্ধও তিতিরের হাত শক্ত করে ধরে রাখলো। কিন্তু একটা ডাউনহিল পার করতেই বাস নিচের দিকে যেতে শুরু করলো আর তিতির পড়ে যাওয়ার ভয়ে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধও অবশ্য তিতিরকে ধরে ফেলেছিল। এরকম শত শত আপহিল, ডাউনহিল ছিল রাস্তায়। পুরো রাস্তাই মুগ্ধ একহাতে হ্যান্ডেল ধরে আরেক হাতে তিতিরকে নিজের বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। তিতিরের তখন মনে হচ্ছিলো, ও বোধহয় মুগ্ধকে ভালবেসে ফেলেছে! আবার ভাবলো দুদিনের পরিচয়ে কি ভালবাসা সম্ভব? নাকি এটা শুধুই ভালোলাগা! কিন্তু ভালবাসা যদি নাই হয় তাহলে ওকে এভাবে জড়িয়ে ধরে থাকতেও কেন অস্বস্তি হচ্ছে না?"

থানচির সরকারি গেস্ট হাউজের মাঠে ওদের তাঁবু গেড়ে থাকার কথা ছিল। মুগ্ধ বাস থেকে নেমেই ফোন বের করলো। এখানে তো নেটওয়ার্ক থাকার কথা। হ্যা নেটওয়ার্ক পাওয়া গেল, কিন্তু সাফির ফোন বন্ধ। তাড়াতাড়ি একটা অটো নিয়ে গেস্ট হাউজে গেল মুগ্ধ-তিতির। তখনও ওরা জানতো না কি বিপদ ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল থানচিতে!

To be continued...

প্রেমাতাল - পর্ব ১২

মৌরি মরিয়ম

মুগ্ধ-তিতির আলো ফুটতেই মানে ৫ টার দিকে রওনা দিয়েছিল। ৩ ঘন্টা হাটা আর প্রায় ১ ঘন্টা বাস জার্নির পর ওরা থানচি পৌঁছেছিল। থানচি গেস্ট হাউজে ঢুকেই মুগ্ধ রিসিপশনের দিকে গেল। পিছন পিছন গেল তিতির। ঘড়ির কাটা ছিল তখন ৯ টার আশেপাশে। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,

-"আচ্ছা ২৬ জনের একটা দল এসেছে না কাল?"

-"ওনারা তো আজ ভোরেই রেমাক্রি রওনা দিয়ে দিয়েছে। তা প্রায় ৩/৪ ঘন্টা হবে। আপনারা ওনাদের খুঁজছেন কেন?"

-"আমরাও ওই দলেই নাফাখুম ট্রিপে এসেছি। পথে আমরা ওদের হারিয়ে ফেলি।"

-"ওহ হ্যা। ওনারা তো ২৮ জনেরই বুকিং দিয়েছিল।"

-"হ্যা। এত আগে রওনা দিয়েছে। এখন তো ধরতেও পারবোনা ওদের।"

-"ওনারা যদি টানা নৌকায় যেত তাহলে আপনারা ইঞ্জিন নৌকায় গিয়ে ধরতে পারতেন। কিন্তু ওনারা তো ইঞ্জিন নৌকা নিয়েছে সবগুলোই।"

-"ওরা কোনো মেসেজ দিয়ে গেছে আমাদের জন্য?"

প্রেমাতাল - সকল পর্ব

-"না কিছু বলেনি।"

তিতির বলল,

-"এখন কি হবে?"

-"দাড়াও দেখছি।"

তারপর মুগ্ধ আবার ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলো,

-"একটা ঘর হবে?"

-"দুজনের জন্য?"

-"হ্যা।"

-"আপনাদের সম্পর্ক?"

-"আমরা স্বামী-স্ত্রী।"

তিতির অবাক হয়ে চাইলো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। ম্যানেজার বলল,

-"সব রুম বুকিং দেয়া আছে। দিব কিভাবে বলুন।"

-"আমরা রাতে থাকব না। জাস্ট গোসল করে ফ্রেশ হবো, খাবো এটুকু সময়।"

-"ওহ তাহলে একটা রুম দেয়া যাবে। যদিও বুকিং আছে কিন্তু ওনাদের আসতে বিকাল হবে।"

-"ওহ, থ্যাংকস।"

রুমে খুলে দিতে দিতে ম্যানেজার জিজ্ঞেস করলো,

-"নতুন বিয়ে করেছেন বুঝি?"

-"হ্যা। গত সপ্তাহে।"

-"হানিমুনে এলেন এই জঙ্গলে?"

-"আসলে আমাদের দুজনেরই পাহাড়, জঙ্গল পছন্দ!"

ম্যানেজার সবগুলো দাঁত বের করে বলল,

-"ভাবীর তো দেখি একদম কম বয়স।"

তিতিরের বলতে ইচ্ছে করছিল, 'তাতে তোর কিরে ব্যাটা!' কিন্তু বললনা। মুগ্ধ বলল,

-"হ্যা, এরেঞ্জ ম্যারেজ তো।"

-"ও। আচ্ছা ভাই ৩ টার মধ্যে রুম ছেড়ে দিতে হবে কিন্তু।"

-"হ্যা হ্যা নো প্রব্লেম।"

ম্যানেজার বেড়িয়ে যেতেই মুগ্ধ দরজা লাগিয়ে দিল। তিতির বলল,

-"এটা কি হলো?"

মুগ্ধ কাধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে বলল,

-"কি হলো?"

-"স্বামী-স্ত্রী বললেন কেন?"

-"তো? তোমাকে বউ বলেছি বলে কি তোমার জাত গেল?"

তারপর নিজের কলারটা একটু ঠিক করে বলল,

-"আমি কি ফেলনা নাকি?"

-"এসব বলার কি দরকার ছিল?"

-"না বললে রুম পেতাম না। আর তুমি রিয়াক্ট করছো কেন? বলেছি বলেই কি আমি রুমে ঢুকেই স্বামীদের মত বিহেভিয়ার শুরু করেছি?"

''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন

তিতির আর কথা বাড়ালো না। মুখে যাই বলুক কথাটা শুনে তো ওর ভালই লেগেছে। বরং কাজের কথা বলা যাক। বলল,

-"আচ্ছা আচ্ছা। এখন আমরা কি করবো?"

মুগ্ধ বিছানায় শুয়ে বলল,

-"গোসল করবো, খাব। তারপর বান্দরবান ফিরে যাব। আর তুমি যদি চাও তো রেমাক্রিও যেতে পারি। কারন, ওরা তো দুপুরে রেমাক্রি পৌঁছে ওখানকার গেস্ট হাউজে থাকবে। ভোরে নাফাখুমের উদ্দেশ্যে যাত্রা। আর আমরা এখন রওনা দিলে সন্ধ্যার মধ্যে পৌঁছে যাব।"

-"ফিরে যাওয়ার জন্য কি এত কষ্ট করে এসেছি নাকি? আমি নাফাখুম যাবই যাব।"

-"আচ্ছা। কিন্তু চিন্তা হচ্ছে কিভাবে যাব সেটা নিয়ে।"

তিতির চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,

-"কেন নৌকা ছাড়া অন্য কোনভাবে যাওয়া যায় নাকি?"

-"নাহ, একমাত্র উপায় নৌকা। কিন্তু দলছাড়া শুধু দুজন নৌকার জন্য রিস্কি হয়ে যায়। তার উপর একটা ছেলে একটা মেয়ের জন্য তো রিস্কটা আরো বেশি হয়ে যায়।"

-"এখানেও ডাকাত আছে?"

-"ডাকাতরা এদিকে আসেনা। এদিকটা জলদস্যুদের।"

-"ওমাগো! জলদস্যু!"

-"হুম, তবে জলদস্যুরা কাউকে ধরেছে এরকমটা কমই শোনা গেছে। ওরা সমুদ্রেই যায় বেশি। যখন ওখানে সুবিধা করতে পারেনা তখন এদিকে আসে। আর এদিকে এসে করবেই বা কি বলো? এদিকের মানুষের তো আর অত টাকা পয়সা নেই। ট্যুরিস্টও খুবই কম।"

-"ওরাও কি ডাকাতদের মত মেয়েদের প্রতি... ?"

থেমে গেল তিতির। তারপর মুগ্ধ বলল,

-"মেয়েদের প্রতি লোভ কার নেই বলো? ডাকাত, জলদস্যুরা না হয় বুঝলাম অশিক্ষিত, অভাবে বড় হওয়া। তাই শিক্ষা পায়নি, মানবিক বোধ জন্মেনি। কিন্তু আমাদের শিক্ষিত সমাজে এমন অমানবিক পিশাচ কি নেই? সব মুখোশ পড়ে ঘুরছে। সুযোগ পেলেই মুখোশটা টেনে খুলে ফেলছে।"

-"কই আপনার তো কোনো লোভ নেই।"

কথাটা বলে ফেলে কি যে ভাল লাগছিল তিতিরের! ইশ, সব ছেলেই যদি মুগ্ধর মত করে ভাবতো। মুগ্ধ হেসে বলল,

-"আসল ব্যাপারটা কি জানো?"

-"না তবে জানতে চাই।"

-"সব পুরুষ মানুষ খারাপ না। কিন্তু ওদের জন্য পুরো পুরুষ জাতটাকেই কুকুরের সাথে তুলনা করা হয়। ওদের জন্যই সবার খারাপ কথা শুনতে হয়। অথচ প্রোপরশন টা কিন্তু ওই এক বাটি দুধে একটা মাছির মতই।"

-"কিন্তু রাস্তায় বেরোলে তো স্টেপে স্টেপে ছেলেরা পাশ দিয়ে আয় আর খারাপ খারাপ কথা বলে। তাহলে প্রোপরশনটা কোথায় গিয়ে দাড়ায় ভাবুন তো?"

-"ওটা তো টিজিং। টিজিং তারাই করে যারা রাস্তায় রাস্তায় থাকে। ওদের সংখ্যা তো কমই। ওদের দেখছো কিন্তু যারা রাস্তায় নেই বাসায় আছে তাদেরকে কি দেখতে পাচ্ছো?"

-"তা অবশ্য দেখছি না।"

-"আর ওদের দেখলে মনে হবে ওরা ভদ্র ফ্যামিলির ছেলে। কিন্তু আদৌ তা না। আমি তো কখনো ১ মিনিট রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার টাইম পাইনি। আমার ছোটভাই দৌড়ের উপর থাকে স্কুল, কোচিং নিয়ে। সেও টাইম পায় না। আমরাও আড্ডা দেই তবে বাসায় কাজিনদের সাথে। বাইরে আড্ডা দেই স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে বন্ধুদের সাথে ক্লাসের ফাঁকে। রাস্তায় রাস্তায় টাইম পাস করার মত সময় আমাদের মত ফ্যামিলির ছেলেরা পায়না। আর আমাদের মত ফ্যামিলিই দেশে সবচেয়ে বেশি।"

মুগ্ধ ঘড়ি দেখে বলল,

-"দেরী হয়ে যাচ্ছে আমাদের। পরে গল্প করবো। এখন বাসায় একটা ফোন করো। তারপর গোসলে যাও।"

-"ও হ্যা। কিন্তু আপনি গোসল করবেন না?"

-"তুমি আগে করো।"

-"বাসায় ফোন করলে সবার সাথে কথা বলতে হবে আলাদা করে। তখন অনেক সময় লাগবে ততক্ষণে আপনি বোধহয় গোসল করে ফেলতে পারবেন।"

-"ও। ঠিকাছে তাহলে আমি আগে যাচ্ছি।"

তিতির মোবাইল বের করে দেখলো নেটওয়ার্ক নেই। মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,

-"নেটওয়ার্ক নেই তো। আমার বাবা তো টেনশনে হার্ট অ্যাটাক করবে।"

মুগ্ধ ব্যাগ থেকে কাপড় বের করছিল। তাকিয়ে বলল,

-"এয়ারটেল?"

-"হুম!"

-"কোন ভরসায় যে পাহাড়ে এয়ারটেল নিয়ে আসতে পারো!"

-"জানতাম না তো!"

-"আচ্ছা প্রব্লেম নাই আমারটা নাও।"

পকেট থেকে মোবাইল বের করে এগিয়ে দিল মুগ্ধ। তারপর গোসলে ঢুকে গেল। তিতির মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো সিম্পল লক। কোনো প্যাটার্ন নেই। বাবার নাম্বারে ডায়াল করলো। বাবা চিন্তায় ছিলো। বাবাকে বুঝিয়ে বলল যে ও ভাল আছে আর আগামী ৬/৭ দিন কথা হবে না। কারন, এদিকে নেটওয়ার্ক নেই। বাবা বলল ভাইয়া নাকি আগেই বলেছে এসব। তারপরেও মন কেমন করছিল, এখন কথা বলে ভাল লাগছে। মায়ের সাথেও হাই হ্যালো করে রেখে দিল।

ফোন রাখতেই তিতিরের কেন যেন ইচ্ছে করলো মোবাইলটা ঘাটতে। জানে এটা ঠিক না। তবু সোজা মেসেজ অপশনে চলে গেল। সব ফোন কোম্পানি আর মায়ের, বোনের, ভাইয়ের আর ফ্রেন্ডদের মেসেজ। সত্যিই কি ওর গার্লফ্রেন্ড নেই? তখন হঠাৎ একটা মেসেজে চোখ আটকে গেল। নাম্বারটা "প্যারা" দিয়ে সেভ করা। কনভারসেশন টা এরকম ছিল,

Pera: Mugdho, ami tor proti mugdho!

Mugdho: Being mugdho is good for health.

Pera: I love you!

Mugdho: So? What can I do for u?

Pera: You should love me too.

Mugdho: Ken ami ki tor kase matha bandhaisi?

Pera: Emn korish kn always?

Mugdho: Ami men e.

Pera: Eto van kisher tor?

Mugdho: Tui e ajaira msg diya vab baraisos.

Pera: kauke valobasha ki dosh?

Mugdho: Na onk boro gun. ei onk boro gun onno kono channel e dekha ga.. kame dibo! Amr piche somoy noshto korish na amma.. khema de!

Pera: Amare amma boltesish kn tui? amare to amma koibo tor polapain.

Mugdho: Amr polapainer ki theka porseni tore amma koibo?

Pera: Ami jonmo dimu tyle ki arek betire amma koibo?

Mugdho: U are mad.. chaogol ekta.

Pera: Chagol pagol ja mon chay ko.. kintu ami shotti tor bacchar ma hoite chai

Mugdho: Tar mane tui amar loge s*ex korte chash?

Pera: s*ex, biya, baccha shob korte chai.

Mugdho: Biye to 100 miles dure.. tor moto behayar loge ami s*ex o korina.

বাথরুমের দরজা খোলার শব্দে তিতির তাড়াতাড়ি ব্যাকে গিয়ে গিয়ে কাটল। যাতে হাইলাইটসে মেসেজ অপশনটা এসে না থাকে। ভাগ্যিস মুগ্ধ দরজাটা খুলে বের হওয়ার আগেই তিতির ফোনটা হাত থেকে রাখতে পেরেছিল।

মুগ্ধ শুধু জিন্স পড়ে বেড়িয়ে এসেছে খালি গায়ে। এটা কোন কথা? সদ্যভেজা লোমগুলো প্রথমবারের মত দেখে তিতির চোখ ফেরাতে পারছিল না। মুগ্ধ তাকাতেই চোখ ফিরিয়ে নিল।

মুগ্ধ শার্ট পড়তে পড়তে বলল,

-"তিতির তুমি গোসলে যাও। আমি খাবার কিনে নিয়ে আসি। আর আমাদের তো রেমাক্রি পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। দুপুরে নৌকায় রান্না করার জন্য কিছু বাজার করতে হবে। ওটাও করে নিয়ে আসি।"

-"নৌকায় রান্না কিভাবে সম্ভব?"

-"এখানের নৌকাগুলো তো অনেক দূরে দূরে যায়। নৌকাতেই রান্নার সব ব্যবস্থা থাকে। চুলা, হাড়ি, বটি, ইভেন মশলা বাটার পাটা সব থাকে মাঝিদের কাছে।"

কথা শেষ করেই একটা হাসি দিল মুগ্ধ। তিতির বলল,

-"ওহ।"

-"এখন কি খাবে সেটা বল?"

-"ভাত। যা দিয়ে হোক ভাত হলেই হবে। খুব ক্ষিদে পেয়েছে।"

-"একদম মনের কথা বলেছো। আমার মনটাও এখন ভাত চাইছিল।"

-"সকালে ভাত খেতে পারিনা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভাত না খেতে পেলে মরেই যাব।"

-"এক্সাক্টলি! আচ্ছা এখন তো সাড়ে নয়টা বাজে। আমি আধা ঘন্টার মধ্যে ফিরবো। তুমি গোসল করে একেবারে রেডি হয়ে নেবে। আর হ্যা, সালোয়ার-কামিজ পড়বে।"

-"আচ্ছা।"

বের হতে গিয়ে আবার ফিরলো মুগ্ধ। জিজ্ঞেস করলো,

-"আচ্ছা তোমার কি কোনো স্কিন প্রব্লেম আছে? মানে এলারজি কিংবা অন্যকিছু?"

-"নাহ। কেন বলুন তো?"

-"এসে বলছি। দরজা লাগাও। আর কেউ আসলে দরজা খোলার আগে জিজ্ঞেস করবে কে? আমি না হলে দরজা খুলবে না। যেই হোক। ম্যানেজার আসলেও না, কোন অজুহাত দিয়ে দেবে।"

-"আচ্ছা।"

মুগ্ধ বেড়িয়ে যেতেই তিতিরের মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। যেই ছেলেটা অন্য মেয়েদের সাথে ওইভাবে কথা বলে সেই ছেলেটাই ওর এত খেয়াল রাখছে! সেটা কি শুধুই ওর সাথে আছে বলে নাকি অন্য কিছু!

মুগ্ধ বাইরে যেতে যেতে মাকে ফোন করে কথা বলল। বাবাকে ফোন করে ৫ হাজার টাকা বিকাশ করতে বলল ইন্সট্যান্ট। কখন কিসে লাগে বলা যায়না। এরপর সামনে কি আছে কে জানে! কিন্তু আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া জানালো মুগ্ধ! ভাগ্যিস সাফিদের হারিয়েছিল। নাহলে হয়তো এসব কিছুই হতোনা। গতকাল সারাদিন আর সারারাত.. ভয় ছিল, বিপদ ছিল তবু জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ের অন্যতম একটা সময় ছিল। তিতিরের জন্য অন্যরকম একটা ফিলিং হচ্ছে যা কখনো অন্য কারো জন্য হয়নি! কিন্তু তিতিরেরও কি কোনো ফিলিং হচ্ছে? নাকি হচ্ছে না? ফিলিং না হলে কি কাল রাতে ওভাবে পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতো? ফিলিং না হলে কি জিজ্ঞেস করতো কিরকম মেয়ে ওর পছন্দ? মুগ্ধ সিওর যে তিতিরেরও কিছু ফিল হচ্ছে। যদি না হয় তাহলে ও বুঝবে ভালবাসার কিছুই বোঝেনা ও। ব্যাপারটা আরেকটু ঘাটিয়ে দেখতে হবে ১০০% সিওরিটির জন্য।

কেনাকাটা শেষ করে এসে মুগ্ধ দরজায় নক করলো। তিতির জিজ্ঞেস করলো,

-"কে?"

মুগ্ধর মাথায় দুষ্টুমি চাপলো তাই কিছু বলল না। আবার নক করলো। তিতির বলল,

-"কে?"

এবারও মুগ্ধ কথা বলল না। নক করলো। তিতির বলল,

-"না বললে খুলবো না তো!"

-"আরে বাবা খুলো।"

তিতির দরজা খুলে বলল,

-"ঢং তো ভালই করতে পারেন।"

মুগ্ধ কিছু বলতে পারলো না। ওর চোখ আটকে গেছে। তিতির গোসল করে হালকা বেগুনী মানে জারুল ফুলের রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পড়েছে। ওর গায়ের হালকা গোলাপী রঙের সাথে মিশে যাচ্ছে সব। কোনো প্রসাধনী নেই মুখে। চুলগুলো এখনো আঁচড়ায়নি। এলোমেলো চুল বেয়ে বেয়ে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে। এত স্নিগ্ধ রূপ কেবল বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর প্রকৃতিতেই দেখেছে ও, কোনো মানুষের মাঝে দেখেনি। এক ফোটা পানিকেই তখন খুব হিংসে হচ্ছিল। কারন সেটা ছিল তিতিরের চোখের বরাবর গালের উপর।

মুগ্ধকে এভাবে হা করে চেয়ে থাকতে তিতির অপ্রস্তুতবোধ করছিল। আবার কেন জানি ভালও লাগছিল খুব। কত মানুষই তো ওকে হা করে চেয়ে দেখেছে। এত ভাল তো লাগেনি কখনো।

কিছুক্ষণ কারো মুখে কোনো কথা ছিলনা। মুগ্ধর হঠাৎ খেয়াল হলো ও বেহায়ার মত অপলক দৃষ্টিতে দেখছে তিতিরকে। স্বাভাবিক হয়ে বলল,

-"চলো খেয়ে নেই। ভাত পাইনি। রুটি-ভাজি চলবে তো?"

-"হ্যা, ঠিক আছে।"

-"বাজার করে এনেছি। নৌকায় উঠেই ভাত রান্না করবো।"

-"আচ্ছা।"

খেয়েদেয়ে সব গুছিয়ে ফেলার পর মুগ্ধ বলল,

-"তুমি কি সুতির ওড়নাওয়ালা কোন সালোয়ার-কামিজ এনেছো?"

-"হ্যা কেন?"

-"আসলে ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিতে হবে। জর্জেট দিয়ে দিলে তো আর লাভ নেই। কিছু মনে করোনা এভাবে বলছি বলে। এই যায়গাগুলো দুজনের জন্য রিস্কি। একবার যে বিপদে পড়েছি তাতে আবার পড়তে চাইনা।"

-"বুঝেছি। আচ্ছা চেঞ্জ করতে হবেনা আমি ওড়নাটা রেখে শাল নিয়ে নিচ্ছি।"

তিতির একটা শাল বের করে মাথায় ঘোমটা দিল। মুগ্ধ শালটা মাথা থেকে খুলে ওর গায়ে পেঁচিয়ে দিয়ে বলল,

-"মাথা ঢাকা কম্পলসারি না। গা ঢাকাটা কম্পলসারি, সরাসরি না বললে কিছুই বোঝোনা দেখছি।"

তিতির লজ্জা পেয়ে গেল। মুগ্ধ বাজারের ব্যাগ থেকে একটা কাজলের কৌটা বের করে তিতিরের হাতে দিল। তিতির অবাক হয়ে বলল,

-"কাজল লাগাবো? কিন্তু আমি তো পেনসিল কাজল ছাড়া দিতে পারিনা।"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"মুখে আর হাত পায়ে যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে এই কাজলটা ভাল করে ব্লেন্ড করে লাগাবে।"

-"মানে মুখে কালি মেখে কালো সাজব?"

-"জানি এখন তুমি আমাকে অনেক খারাপ ভাববে। সন্দেহবাতিক ভাববে বাট আমি তোমার সেফটির জন্য এটা করতে বলছি। পাহাড়ে লুকানোর যায়গা ছিল লুকিয়েছিলাম। নদীতে কিন্তু চারপাশে পানি বিপদ এলে কোথাও যেতে পারবো না।"

তিতিরের বুকের মধ্যে হু হু করে লিলুয়া বাতাস বয়ে গেল। এতটা ভাবে মুগ্ধ ওকে নিয়ে! তিতির মুগ্ধর কথা মতই কাজলের কালি দিয়ে মুখ, হাত, পা, সব কালো করে ফেললো। তারপর মুগ্ধর দিকে ফিরে বলল,

-"ঠিক আছে?"

মুগ্ধ এগিয়ে এসে একটু কাজল নিজের দুহাতের অঙুলে ব্লেন্ড করে তিতিরের সামনে দাঁড়িয়ে হেসে বলল,

-"কানে লাগাবে কে সুন্দরী?"

তারপর মুগ্ধ তিতিরের দুই কানে কালি লাগালো। ওর ছোঁয়া পেয়েই তিতির শিউরে উঠলো। তা দেখেই মুগ্ধর ভেতরে কি যেন হলো। সরে গিয়ে বলল,

-"তুমি নিজেই লাগাও।"

To be continued...

প্রেমাতাল - পর্ব ১৩

মৌরি মরিয়ম

গেস্ট হাউজের বিল মিটিয়ে, আর্মি ক্যাম্পে এন্ট্রি করে তারপর নৌকার ঘাটে গেল ওরা। নৌকা খুঁজছিল মুগ্ধ। হঠাৎ কোত্থেকে এক ছেলে দৌড়ে মুগ্ধ দাদা মুগ্ধ দাদা করতে করতে এল। তাকে দেখেই মুগ্ধর সেকি আনন্দ। তিতির বুঝলো না এই পাহাড়ী ছেলেটার সাথে এমন কি সম্পর্ক মুগ্ধর! কাছে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-"মংখাই, তোমাকে পেয়ে যে কি আনন্দ হচ্ছে কি বলবো! ঢাকা থেকে আসার আগেই তোমাকে ফোন করেছিলাম। তোমার ফোন বন্ধ ছিল। ভেবেছি পাহাড়ে আছো বোধহয়। তারপর আবার থানচি এসে থেকে তোমাকে ফোন করছি। তোমার ফোন বন্ধ বলছিল। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল।"

-"দাদা, ফোন বন্দু না। আমি ইক্ষন রেমাক্রি তিকা আসলাম। উখানের নেটওয়াক তো জানেন।"

-"আচ্ছা আচ্ছা ঠিকাছে, আল্লাহ মিলিয়ে দিয়েছেন।"

মংখাই নামের পাহাড়ী ছেলেটি দাঁত কেলিয়ে হাসলো। মুগ্ধ বলল,

-"শোনো, জানি তুমি মাত্র এসেছো। কিন্তু কিছু করার নাই, তোমাকে রেস্ট নেয়ার টাইম দিব না। তোমাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।"

মংখাই হেসে বলল,

প্রেমাতাল - সকল পর্ব

-"দাদা আমার পা যদি বাংগাও তাকে তাও আমি যাব আপনের সাতে। আপনি না নিলেও জোড় করি যাব। নৌকা ঠিক করিচেন?"

-"না। তুমি যখন এসে পড়েছো তুমিই ঠিক করো। আর ইঞ্জিন নৌকা নিও।"

-"ইঞ্জিন নৌকায় তো ম্যালা শব্দ। আপনের না বাল্লাগেনা।"

-"হ্যা। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেতে চাই। কাল যে কি বিপদে পড়েছিলাম ভাই। আর কোনো বিপদ চাইনা।"

মংখাই এতক্ষণে তিতিরকে খেয়াল করলো। বলল,

-"ভাবী?"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"আরে না না, আমরা এক দলে ট্রিপে এসেছি। পরে ওদের হারিয়ে ফেলেছি। দুদিন আগেও কেউ কাউকে চিনতাম না কিন্তু এখন আমরা ভাল বন্ধু হয়ে গেছি।"

তিতিরের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ভাবী কিনা জিজ্ঞেস করলো আর ও না বলে দিল! হ্যা বললে কি এবার ওর জাত যেত? মুগ্ধ তিতিরের দিকে ফিরে বলল,

-"ও হচ্ছে আমার এক ছোটভাই মংখাই। ও পাহাড়ী। কিন্তু দেখেছো কি সুন্দর বাংলা বলে?"

ছেলেটি হাসলো। হাসলো তিতিরও। মুগ্ধ বলল,

-"ও হলো এখানকার গাইড। ও সাথে থাকলে কোন চিন্তা নেই।"

মংখাই তো মুগ্ধর এমন কথায় ব্যাপক লজ্জা পাচ্ছিল। বলল,

-"দাদা, আমি নৌকা ঠিক করি?"

-"হ্যা হ্যা, আর প্লিজ একটা ছইওয়ালা নৌকা ম্যানেজ করো ভাই, আপু আছে তো।"

-"আচ্ছা আচ্ছা।"

যে সুন্দর সে সুন্দরই। নৌকার গুলুইয়ের উপর ঘোমটা মাথায় বসে থাকা কুচকুচে কালো তিতিরকে মুগ্ধর কাছে অপূর্ব রুপবতী লাগছে। তিতির তাকিয়ে নদীর চারপাশ দেখছে। ওর চোখ দুটো যেন নদীর সৌন্দর্যের তালে তালে তা তা থৈ থৈ করে নাচছে। নদীটা খুব বেশি প্রশস্ত না। তবে খুব কর্মচঞ্চল। নৌকায় নৌকায় মাঝিরা মাছ ধরছে। নদীর পাড়ে পাহাড়ী মহিলারা তাদের নিত্য কাজ করছে। কেউ কেউ কলসি কাখে হেটে যাচ্ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পাহাড় থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার খেলায় মেতেছে। পুরো নদীতেই ভেলার মত লম্বা লম্বা কি যেন! দেখেই বোঝা যাচ্ছে এগুলো ইচ্ছে করে ভাসিয়ে রাখা হয়েছে। এগুলো কি মুগ্ধকে জিজ্ঞেস করতে হবে, কিন্তু এখন না পরে। এখন কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। শুধু সৌন্দর্য উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে।

''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন

মুগ্ধ নৌকার মাঝখানে শুয়ে ছিল। নৌকায় শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখার মজাই আলাদা। মাঝিকে বলল,

-"ও মাঝি ভাই তোমার নাম কি?"

-"জ্বী আমার নাম লোকমান।"

-"এই তুমি বাঙালী! বাড়ি কই তোমার?"

-"ময়মনসিংহ।"

-"ও, তা এইখানে যে?"

-"পেট চালানের লাইগা আব্বায় আইসিলো।"

-"ও। বিয়াসাদি কি কইরালছ?"

-"হ, কইরলাছি।"

-"ও যাই হোক, আমরা তিনজনের একজনও বিয়াসাদি করিনাই। সাবধানে নৌকা চালাইয়ো কিন্তু। তোমার যেমন বউ আছে আমাদেরও কিন্তু হবু বউ আছে। ওই যে আপুরে দেখতেসো ওনারও কিন্তু হবু জামাই আছে, তো সবারই এখন জীবনের দাম অনেক। এখন তাড়াতাড়ি চালাও যাতে তিন্দুর পর আস্তে চালাইলেও সময়ের অভাব না পরে। বুঝলা রাত্রে নৌকায় থাকা যাবে না। সন্ধ্যার মধ্যে রেমাক্রি পৌঁছাতে হবে।"

লোকমান হাসতে হাসতে বলল,

-"কুনো চিন্তা কইরেন না বাইজান। এক্কেরে টাইমের মইধ্যে লইয়া যাইবাম।"

মংখাই বলল,

-"দাদা, ও ছোটকাল তেকেই এই সাংগুতে নৌকা চালায়। চিন্তা করিয়েন না। খুব অবিজ্ঞ।"

-"ভাল কথা মনে করসো।"

তারপর মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকিয়ে ডাকলো,

-"তিতির.."

তিতির বলল,

-"হ্যা বলুন।"

-"আমরা যে নিলগিরি থেকে অনেক নিচে নদী দেখেছিলাম না? এটা কিন্তু সেই নদী, সাঙ্গু। সুন্দর না?"

-"হ্যা, সুন্দর। কিন্তু আমরা তো পাহাড়ি রাস্তায়ই এলাম। নদী তো অনেক নিচে ছিল। এত নিচে কিভাবে এলাম?"

-"কেন খেয়াল করোনি নিলগিরির পর খালি ডাউনহিল ছিল। তারপর থানচি বাজার থেকেও তো ঘাট অনেক নিচে।"

-"ও।"

হঠাৎ মনে পড়লো তিতির ভাত খেতে চেয়েছিল। উঠে বসে মংখাইকে বলল,

-"আমাদের রান্না করতে হবে বুঝলে? নৌকায় সব ব্যবস্থা আছে তো?"

-"জ্বী দাদা, সব ব্যবস্তাই আছে।"

তিতির জিজ্ঞেস করলো,

-"কি রান্না হবে?"

-"ভাত, মুরগি, ডাল, আলুভর্তা। চলবে তো?"

-"দৌড়োবে! আচ্ছা রান্নাটা আমি করি?"

-"তুমি! রান্না করতে পারো?"

-"সব পারিনা। তবে এসব পারি।"

-"কিন্তু তুমি পারবেনা তো। কেরোসিনের স্টোভে রান্না করতে হবে। করেছো কখনো? স্টোভ সামলানো অনেক ঝামেলার কিন্তু।"

-"না করিনি কখনো।"

-"তাহলে থাক, আমিই করি।"

-"আচ্ছা দুজনে মিলেই করি? আপনি চুলাটা সামলাবেন, আর আমি রান্না।"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"আচ্ছা আচ্ছা।"

মংখাই বলল,

-"দাদা, আমিও আছি কিন্তু।"

মুগ্ধ বলল,

-"ও হ্যা হ্যা, মংখাই কিন্তু অনেক ভাল রান্না করে।"

-"দাদা, কুনোদিন রানতে দিননাই তো। নিজেই করিচেন।"

-"তা করেছি। কিন্তু তুমি তো পারো।"

মংখাই আর কথা বাড়ালো না।

নৌকা থানচি ছাড়তেই আস্তে আস্তে জনবসতি কমে যেতে লাগলো। ২০-২৫ মিনিট যেতেই তিতিরের মনে হলো নদীটা গহীন কোনো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভয় পাওয়ারও সময় নেই। রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে।

রান্না করতে গিয়ে তিতির সত্যিই ঝামেলায় পড়লো। একটা ধার ছাড়া বটি যা দিয়ে কিছুই কাটা যাচ্ছেনা। তার উপর আস্ত মুরগি তিতির জীবনে কাটেনি। সব সময় তো মায়ের কেটে রাখা মুরগি রান্না করেছে। এখন কি হবে! তিতির মুরগিটা হাতে নিয়ে অনেক চিন্তা করলো। কোনদিক দিয়ে যে কাটা শুরু করবে তা বুঝতেই পারছেনা। এজন্যই সব কাজ শিখে রাখতে হয়। মাছ মুরগি কাটা শিখতে গেলে বাবা সবসময়ই বলে এসব শিখে তুই কি করবি? তুই কি এসব করবি নাকি? তোকে রাজপুত্রের সাথে বিয়ে দেব। সে কি তোকে দিয়ে মাছ-মাংস কাটাবে? কাজের লোকেরাই তো সব করে দেবে। কিন্তু বাবা কি জানে ট্যুরে গেলে কেউ কাজের লোক নিয়ে যায়না! তাও ভাল জোর করে কয়েকটা রান্না শিখেছিল। ইশ মুরগিটা যদি কাটতে না পারে তো প্রেস্টিজের বারোটা বেজে যাবে। হঠাৎ মুগ্ধ ওর হাত পাতলো। বলল,

-"মুরগিটা আমাকে দাও। দেশী মুরগি তো, অনেক শক্ত। তুমি কাটতে পারবে না।"

তিতির দিয়ে দিল। মুগ্ধ বুঝতে পেরেছে যে ও মুরগি কাটতে পারেনা। তাই সরাসরি বলে লজ্জা না দিয়ে দেশী মুরগির দোহাই দিয়ে নিজে কাটতে নিল। মংখাই বলল,

-"দাদা, আমাকে দেন আমি কেটে দি।"

-"না না তুমি আপুর রান্নায় হেল্প করো। আমার সময় লাগবে না।"

তিতির চাল ধুয়ে ভাত বসিয়ে দিল। তাতে আলুসেদ্ধও দিয়ে দিল। মংখাই চুলাটা কন্ট্রোল করছে। মুগ্ধ মুরগিটা হাতে নেয়ার পর থেকে তিতির মুগ্ধ হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিভাবে মুরগি কাটে সেটা এখনি শিখে নেবে ও। মুগ্ধ প্রথমে মুরগিটা হাতে নিয়ে পাঁজরার হাড়দুটো আলাদা করে একহাতে গলা আরেক হাতে পাঁজর ধরে টান দিয়ে দুভাগ করে ফেলল। মাগো এই টানটা কি করে দেবে তিতির! এত জোড় আছে নাকি ওর। তারপর ভাবলো সব মেয়েরা পারলে ও অবশ্যই পারবে। তারপর রান, থান আলাদা করে টুকরো করে কেটে নিল। তারপর বুকের মাংসটা কিভাবে কাটলো সেটাও দেখে নিল। এরপর মাথাটা কেটে নিল। তিতিরের মনে হলো মাথা কাটাটা আরো বেশি ডিফিকাল্ট। তারপর দেখলো মুগ্ধ মুরগিটার নাড়িভুঁড়ির মধ্যে থেকে গিলা, কলিজা বের করে আনলো। গিলাটা লম্বালম্বি একটু কেটে আংগুল দিয়ে টেনে টেনে ভেতরের ময়লাটা বের করে ফেলে দিল। এএএহ! এভাবে গিলা পরিস্কার করে। আর ভেতরে এত বিচ্ছিরি ময়লা থাকে! ইয়াখ.. ও আর জীবনে গিলা খাবেনা। সবশেষে মুরগির পা দুটো চুলায় পুড়িয়ে পুড়িয়ে চামড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছিঁড়ছিল মুগ্ধ। পায়েও এত কাহিনী করা লাগে! তিতির জিজ্ঞেস করলো,

-"পা কে খাবে?"

-"কেন খাওনা?"

-"না।"

-"আমি খাই, মংখাই খাও?"

-"জ্বী দাদা, খাই।"

-"হয়ে গেল! তুমি আর পাচ্ছো না।"

একথা বলেই মুগ্ধ হাসলো। তিতিরও হাসলো। তারপর মুরগিটা ধুয়ে এগিয়ে দিল। বলল,

-"নাও এবার রান্না করো।"

-"আপনি এত সুন্দর মুরগি কাটা শিখলেন কোত্থেকে?"

-"কেন মায়ের কাছ থেকে!"

-"ওহ।"

-"মা কি বলতো জানো?"

-"কি?"

-"বলতো, 'মুগ্ধ মুরগি কাটা শেখ, মাছ কাটা শেখ, রান্না শেখ। তোর জন্য তো রাজকুমারী নিয়ে আসবো। সে যদি না পারে তোকে তো পারতে হবে। তাড়াতাড়ি শিখে নে।' আর জানো আমিও দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে আগ্রহ নিয়ে শিখতাম। যাতে বউকে এসব করে দিতে পারি.. হা হা হা।"

তিতির ওর বাবার কথাগুলো আর মুগ্ধর মায়ের কথাগুলো মিলিয়ে নিল। এটা কি শুধুই কো-ইন্সিডেন্স নাকি কোনো ইশারা! খুশি যেন উপচে পড়ছিল তিতিতের। তিতির খুব যত্ন করে ভাত, আলুভর্তা, ডাল করে ফেললো। মুগ্ধও হেল্প করলো। কিন্তু প্রব্লেম হলো মুরগি রান্নার সময়। কিছুতেই তিতির মশলা বাটতে পারছিলনা। জীবনে প্রথম পাটায় হাত দিয়েছে। বাটছে ঠিকই কিন্তু কোনো কিছু আর এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছেনা। মুগ্ধ তাকিয়ে ছিল তাই তিতির খুব লজ্জা পেয়ে গেল। মুগ্ধ নিশ্চই এখন এটাও এর হাত থেকে নিয়ে নিজেই বেটে দেবে! হায় খোদা! কেন ও এসব পারেনা। মুগ্ধ বলল,

-"কখনো পাটায় হাতও দাওনি বোধহয়?"

-"না।"

-"বুঝেছি। আচ্ছা রেখে দাও। আমি ব্যবস্থা করছি।"

তিতির মন খারাপ করে বলল,

-"আপনি বাটবেন এখন?"

মুগ্ধ বলল,

-"আরেনা। মা আবার এটা শেখায়নি। বলেছে বউকে ব্লেন্ডার কিনে দিতে। হা হা হা।"

তিতিরও হেসে দিল। মুগ্ধ আদা রসুন গুলো নিয়ে বটি দিয়ে কুচি কুচি করে কাটলো। তিতির বলল,

-"এগুলো কি করবেন?"

-"এভাবেই দেব মুরগিতে।"

-"আস্ত আস্ত?"

-"আস্ত কই? দেখোনা কুচি কুচি।"

-"কেমন যে লাগবে!"

-"আমি নিজের মত রান্না করি। খাওয়ার সময়েই দেখো কেমন লাগে!"

মুগ্ধ নিজ হাতে রান্না করলো মুরগিটা।

সত্যি মুরগিটা কতটা যে মজা হয়েছিল তা খাওয়ার সময় টের পেল সবাই। নৌকা একটা তীরে ভিড়িয়ে ওরা খেয়ে নিয়েছিল। খাওয়া শেষে মুগ্ধ বলল,

-"তিতির, তুমি এখন ছইয়ের মধ্যে চলে যাও, রেস্ট নাও। আমি না বললে বের হয়ো না।"

-"আচ্ছা।"

একথা বলেই ভেতরে ঢুকে গেল তিতির। মুগ্ধ ছইয়ের পর্দা টেনে দিল। তারপর ছইয়ে হেলান দিয় বাইরে বসে রইলো। হঠাৎ ভেতরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল তিতির ঘোমটা ফেলে ছোট একটা আয়না হাতে নিয়ে নিজের মুখ ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে দেখছে। মুগ্ধ আস্তে করে পর্দাটা সড়িয়ে গান ধরলো,

"কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি..

কালো তারে বলে গায়ের লোক।

মেঘলা দিনে.. দেখেছিলেম মাঠে,

কালো মেয়ের কালো হরিন চোখ!

ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটে..

মুক্ত বেনী পিঠের ওপর লটে।

কালো!!!

তা সে যত কালোই হোক

দেখেছি তার কালো হরিন চোখ!

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি।"

এটুকু গেয়েই মুগ্ধ আবার পর্দা টেনে দিল। তিতিরের এই প্রথম আফসোস হলো, "ইশ কালো কেন হলাম না।"

থানচির পর তিন্দুতে এসে কিছু জনবসতি দেখা গেল। কিন্তু সেটা খুবই কম। ১৫/২০ ঘরের বেশি হবেনা। এখানটায় প্রচুর স্রোত। ওদেরকে নেমে নদীর তীর ধরে হাটতে হলো। আর লোকমান, মংখাই মিলে নৌকায় দড়ি বেধে টেনে টেনে স্রোতের অংশটা পার করলো। তারপর ওরা আবার নৌকায় উঠলো। কিছুদূর পর আবার সেই স্রোত। আবার নামলো, আবার হাটলো। এভাবে অনেকবারই নামতে হলো। হাটতে হাটতে অনেক গল্পই হয়েছিল। তার মধ্যেই একবার তিতির বলল,

-"সাফি ভাইয়াদের হারিয়ে ফেলে ভালই হয়েছে বলুন। নাহলে এত এত এডভেঞ্চারের কিছুই হতো না। যদিও কাল ভয় পেয়েছিলাম বিপদে পড়ে কিন্তু আজ মনে হচ্ছে যারা দলেই আছে তারা তো এরকম পরিস্তিতিতে পড়েনি, তারা খুব মিস করলো।"

মুগ্ধ হাসলো। তিতির বলল,

-"হাসছেন যে?"

-"আমরা কিন্তু এখনো বিপদ থেকে বের হতে পারিনি।"

-"নাহলে না পেরেছি, আমার আর ভয় করছে না। আপনি আছেন তো!"

কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা চলে এল বড়পাথর। এলাকার নামই বড়পাথর। এখানে কোন জনবসতি নেই। আছে শুধু বড় বড় পাথর। তাও আবার পানির মধ্যে। একতলা দোতলা বাড়ির সমান উঁচু বিশাল বিশাল পাথর। যার কিছু অংশ পানির নিচে, কিছু অংশ পানির উপরে। ছোট, বড়, মাঝারি বিভিন্ন সাইজের পাথর। তার মধ্য দিয়েই নৌকা চালাচ্ছে লোকমান। সোজা তো আর চালানো যায়না। এঁকেবেঁকে প্রকান্ড পাথর গুলোকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। পানির নিচে আবার আছে ডুবোপাথর। নৌকা যদি কোনক্রমে একটা ডুবোপাথরের সাথে ধাক্কা লাগে তাহলে পুরো নৌকাই উল্টেপাল্টে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তিতিরের বোধহয় এসব দেখে ভয় করছিল। কিন্তু কিছু বলছিল না। ছইয়ের ভেতর থেকেই এসব দেখছিল। মুগ্ধ ওর ভয় কাটানোর জন্য ওর সাথে টুকটাক গল্প করছিল।

-"জানো তিতির, এখানকার স্থানীয় মানুষেরা মানে পাহাড়ীরা এই বড়পাথরের সবচেয়ে বড় পাথরটাকে পুজো করে।"

-"কেন?"

-"সবচেয়ে বড় পাথরটাকে ওরা রাজা বলে মানে। ওদের বিশ্বাস বহুকাল আগে তিন্দু রাজা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তার পুরো পরিবার ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে সাঙ্গু নদীর এই যায়গায় ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তারপর তারা সবাই পাথর হয়ে যায়। তাই স্থানীয়রা এটাকে ধর্মীয় স্থান বলে মানে, পুজো দেয়।"

রেমাক্রির দিকে যেতেই মুগ্ধ ছইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল,

-"লোকমান ভাই আমাদের একটু রেমাক্রি ফলসের দিকে নিয়ে চলো। তুমি অনেক তাড়াতাড়ি আর সেফলি এনেছো, আলহামদুলিল্লাহ। এখনো হাতে সময় আছে। এত সুন্দর একটা যায়গা তোমার এই আপুর মিস করা কি ঠিক হবে? দুদিন পর বিয়ে হয়ে যাবে তো, ওর হাসবেন্ড কেমন না কেমন হয় বলা তো যায়না বলো? সে যদি যদি ওকে নিয়ে এখানে না আসে?"

লোকমান হেসে বলল,

-"আচ্ছা ভাই।"

তিতির মনে মনে বলল, 'আপনিই আমার হাসবেন্ড হয়ে যাননা।' কিন্তু মুখে বলল,

-"রেমাক্রি ফলস আবার কোনটা?"

মুগ্ধ বলল,

-"এই যে সাংগু নদী, এটা রেমাক্রি খালের সাথে মিশে শেষ হয়ে গেছে। রেমাক্রি ফলস হলো রেমাক্রি খালের উৎপত্তিস্থল। ছোট ছোট পাহাড়ের কারনে ওখানে একটা ন্যাচারাল জলপ্রপাত তৈরী হয়েছে। অসম্ভব সুন্দর একটা জলপ্রপাত। রেমাক্রি যাওয়ার পথে পড়েনা। একটু ঘুরে যেতে হয় তাই অনেকেই ওখানে যায়না। ইভেন অনেকে জানেও না।"

-"ও।"

রেমাক্রি ফলসের দিকে যেতে যেতে দূর থেকেই যখন তিতির জলপ্রপাতটা দেখতে পেল তখন ও নিজের দুই গালে দুই হাত দিয়ে চোখগুলো বড় বড় করে অজান্তেই বলল,

-"ওয়াও। এটা কি? আমি কি সত্যি দেখছি, নাকি স্বপ্ন।"

মুগ্ধ মিটিমিটি হাসছিল আর মনে মনে বলছিল, 'আমি জানি তুমি তোমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর যায়গাগুলোর একটাতে যেতে চলেছো। তুমি খুশি হয়েছো। জানি তুমি আরো অনেক অনেক বেশি খুশি হবে যখন তুমি জলপ্রপাতের বাঁধনহারা পানিতে পা রাখবে। তুমি যেমন জলপ্রপাতটায় যাওয়ার অপেক্ষায় আছো, আমিও তেমন তোমার ওই সময়ের খুশিটা দেখার অপেক্ষায় আছি। হ্যা, আজ আমি আর জলপ্রপাতটা দেখবো না, তোমার খুশি দেখবো.. তোমাকে দেখবো। তুমি প্রকৃতির চেয়ে কোনো অংশে কম নও।'

নৌকা রেমাক্রি ফলসের যত কাছে যাচ্ছে পানির শব্দ বাড়ছে। তিতির বিস্ময়ে কি করবে বুঝতে পারছিলনা। সেটা বোঝা গেল যখন ও নৌকায় বসা থেকে উঠে এসে দুহাতে মুগ্ধর বাহু জড়িয়ে ধরে নৌকার মধ্যেই লাফাতে শুরু করে দিল। আর বলল,

-"উফ, বলেন না কখন যাব? আমি কিন্তু নামবো।"

মুগ্ধও এক্সাইটেড হয়ে যাচ্ছিল তিতিরের আনন্দ আর উচ্ছলতা দেখে। এ যেন অন্য তিতির। বলল,

-"হুম নামবে।"

তিতির বলল,

-"লোকমান ভাই তাড়াতাড়ি চালান না।"

যখন ওরা রেমাক্রি ফলসে পৌঁছলো তখন পড়ন্ত বিকেলের আলো যেন জলপ্রপাতে একটা মায়াবী সৌন্দর্য যোগ করেছিল। হয়তো প্রকৃতির এই আয়োজন প্রথমবার তিতিরকে মুগ্ধ করার জন্যই। প্রথমে মুগ্ধ নামলো রেমাক্রি ফলসের পানিতে। তারপর তিতিরের হাত ধরে ওকে নামালো। তিতির স্যান্ডেল খুলে নামছিল। মুগ্ধ বলল,

-"ওটা পড়ে থাকো। পাথর অনেল পিচ্ছিল আর অনেক ধার!"

তিতির তাই করলো। বিশাল জলপ্রপাত তবে প্রশস্তে, উচ্চতায় খুবই সামান্য। প্রায় ৮/৯ টি ধাপ একেবারে সিড়ির মত। কিন্তু একেকটা ধাপে অনেক যায়গা। একেকটা ধাপ যে কতটা ধারালো তা এর উপর থেকে পড়া পানির আকার দেখলেই বোঝা যায়। শেষ ধাপের পরই রেমাক্রি খাল। তিতিরকে হাত ধরে ধরে প্রত্যেকটা ধাপে নিয়ে গেল মুগ্ধ। তিতির পথরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির উপর দিয়ে হাটছিল আর খিলখিল করে হাসছিল। একেবারে উপরের ধাপে সবচেয়ে বেশি যায়গা। তিতিরকে নিয়ে মুগ্ধ সেখানে চলে গেল। সেখানে পানি ছিল অন্য সব ধাপের চেয়ে বেশি। এত পানি পায়ের নিচে পেয়ে তিতির লাফাতে শুরু করে দিল। মুগ্ধ বলল,

-"এত লাফিও না। পা কেটে যাবে।"

জলপ্রপাতের পানি পড়ার শব্দে শুনতে পেল না তিতির। যদিও হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে তবু চিৎকার করে বলল তিতির,

-"কি বলছেন? শুনতে পাচ্ছিনা.. জোড়ে বলুন, চিৎকার করে বলুন। আমার মত করে।"

তারপর আবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। মুগ্ধ হেসে তিতিরের মতই চিৎকার করে কথাটা আবার বলল। তিতির আবার চিৎকার করে উত্তর দিল,

-"যাক, পা কেটে যাক, সময় কেটে যাক। সারা জীবন কেটে যাক। আমি এখানেই থাকবো আর লাফাবো।"

তারপর আবার খিলখিলিয়ে হাসলো। আবার লাফাতে লাগলো। মুগ্ধ কিছু বলল না। শুধু শক্ত করে তিতিরের হাত ধরে রাখলো। পানির যেই স্রোত। ও ধরে না থাকলে এতক্ষনে তিতির রেমাক্রি খালে থাকতো। লাফাতে লাফাতে তিতির হঠাৎ পড়ে গেল। পড়ে যেয়ে ওর হাসি আরো বেড়ে গেল। মুগ্ধ তাড়াতাড়ি ওর হাত ধরে ওঠানোর চেষ্টা করলো। ও নিজে তো ওঠার চেষ্টা করলোই না বরং মুগ্ধর হাত ধরে টান দিয়ে ওকেও ফেলে দিল। মুগ্ধ পড়ে যেতেই তিতির আরো জোড়ে জোড়ে হাসতে লাগলো। আচমকা পড়ে যাওয়ায় মুগ্ধ ব্যালেন্স না রাখতে পেরে পানির স্রোতের সাথে ভেসে যাচ্ছিল। আর তিতিরের তো কোন ব্যালেন্স ছিলই না। দুজনেই ভেসে ভেসে যাচ্ছে। তিতির খিলখিল করে হাসছে। কিন্তু মুগ্ধ ভয় পাচ্ছিল। কি হবে এখান থেকে প্রথম ধাপে পড়লেই তো একে একে প্রত্যেকটা ধাপে পড়বে। তারপর সোজা উপড়ে! কি করবে! পা হাতড়ে খুজছিল, যদি কিছু একটা পাওয়া যায়। এখানে তো কত উঁচু নিচু পাথর আছে। যদি একটা উঁচু পাথরে পা টা আটকে যেত! তাহলে দুটো জীবন বেঁচে যেত!

একটা পাথর না হলেও একটা ছোট গর্তে পা আটকাতে পারলো মুগ্ধ। তিতির তখনও খিলখিলিয়ে চলেছে। মুগ্ধ একটা হাতে ধরে রাখতে পারছিলনা ওকে। তাই দুই হাত দিয়ে ধরে নিজের কাছে না এনে নিজেই কাছে চলে গেল। ওকে কাছে আনতে গেলে হয়তো পাথরের ঘষায় ও আঘাত পেতে পারে। পানির স্রোতে তিতির মুগ্ধর বুকের মাঝে এসে ধাক্কা খেল। তাতেও হাসি। খুশিতে মেয়েটার মাথার তার একটা ছিড়ে গেছে বোধহয়।

ওদের এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করলো মংখাই আর লোকমান।

যখন ওরা রেমাক্রি পৌঁছল, সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। লাল আলোর আভায় ভরে গেছে চারপাশ। যায়গাটা বেশ পছন্দ হলো তিতিরের। থানচি ছিল সাধারন মফস্বলের বাজার এলাকার মত, তিতিরের একটুও পছন্দ হয়নি। কিন্তু এখানে নৌকার ঘাট থেকেই রেমাক্রি গ্রাম শুরু। ৩০/৪০ পাহাড়ী পরিবারের বসতি হবে। পুরো গ্রামটাই পাহড়ের উপর। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। গ্রামের একপ্রান্তে দেখা গেল একটা কাঠের ব্রিজ। ব্রিজ পার করে ওপাশে ছোট্ট একটা পাহাড়। মুগ্ধ বলল,

-"ব্রিজের ওপাশে পাহাড়টার উপর যে বড় ঘর দেখতে পাচ্ছো সেটাই রেমাক্রির একমাত্র গেস্ট হাউজ। পুরোটাই কাঠের তৈরী, ইভেন ফ্লোরও কাঠের।"

-"ও। আচ্ছা, একটা ঘর এত বড় কেন?"

-"আরে না না বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে একটা ঘর। কিন্তু ওর ভেতরে কয়েকটা ঘর আছে।"

কাঠের ব্রিজটা পার হয়ে গেস্ট হাউজে গিয়েই মুগ্ধর আক্কেলগুড়ুম! রেমাক্রি গেস্ট হাউজ পুরোটাই খালি। ২৬ জনের কোন দলই আজ আসেনি। সাফিরা আজ ভোরে রওনা দিল অথচ এখনো পৌঁছতে পারেনি! কি হলো! এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সন্ধ্যার পর ডুবো পাথরের জন্য নদীতে নৌকা চলা একেবারেই নিষিদ্ধ।

To be continued...

প্রেমাতাল - পর্ব ১৪

মৌরি মরিয়ম

গেস্ট হাউজটা আসলে একটা কটেজের মত। চারদিকে ঘিরে আছে একটা বারান্দা। কটেজে মোট ৪ টি ঘর। প্রত্যেকটি ঘরে দুটো করে বিছানা। আর দুই বিছানার মাঝেও অনেক যায়গা। ফ্লোরিং করার প্ল্যান ছিল বাকিদের। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল। কোথায় চলে গেল সাফিরা। এতজন একসাথে থাকলে তো কোথাও কোন বিপদ হওয়ার কথা না। ওদের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে মুগ্ধর। ৪ টা ঘরের একটাতে তিতির, একটাতে মুগ্ধ। আরেকটাতে যায়গা হলো মংখাই আর লোকমানের। যে যার ঘরে চলে গেল। মুগ্ধ ভেজা শার্টটা খুলে ফেলল। নদীতে গোসল করতে যাবে। গামছা আর টাউজার কাধে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হলো। হঠাৎ পিছন থেকে সেই মিষ্টি ডাক,

-"এইযে শুনছেন?"

মুগ্ধ ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল,

-"হুম শুনছি তো, বলো।"

তিতির হেসে বলল,

-"গোসলের কি ব্যবস্থা এখানে?"

-"নদীতে গোসল করতে হবে।"

তিতির অবাক হয়ে বলল,

-"নদীতে!"

-"কেন সাঁতার জানোনা?"

-"তা জানি।"

-"তাহলে?"

-"মানে খোলা যায়গায় সবার সামনে গোসল করতে হবে?"

প্রেমাতাল - সকল পর্ব

-"খোলা যায়গায় তবে সবার সামনে নয়। কারন, এই গেস্ট হাউজের পাশ দিয়ে নদীতে নেমে পড়বে। গ্রামের কেউ তো আর এই সাইড টাতে আসবে না। ওইযে টয়লেট টা দেখতে পাচ্ছো ওটা বড় ভাগ্যের জোড়ে পেয়েছো। আমি আগের বার যখন এসেছিলাম তখন ওটা ছিলনা।"

-"ও। তাহলে কি করবো?"

-"গোসল করে আর কি করবে? গোসল তো রেমাক্রি ফলসে হয়েই গেছে।"

-"না, ওখানে তো শুধু ভেজা হলো।"

-"বাই দ্যা ওয়ে, সকালে না গোসল করে এলে?"

-"হুম, কিন্তু এই কালি গায়ে নিয়ে ঘুমাবো? স্কিন ভারী ভারী লাগছে। গোসল না করে বাঁচবো না। "

-"আচ্ছা, তাহলে যাও করে এসো। কেউ যাবেনা ওদিকে। আর গোসল করে চলে আসবে। ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করবে।"

-"আপনিও চলুন না আমার সাথে।"

মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,

-"এই প্রথম শুনলাম কোনো মেয়ে গোসল করতে যাওয়ার সময় অপরিচিত কোনো পুরুষ মানুষকে সাথে ডাকে।"

-"উফ আপনি না একটা যাচ্ছেতাই।"

মুগ্ধ হেসে ফেলল। তিতির বলল,

-"আমি তো বলেছি শুধু আপনি পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন একটু। অপরিচিত যায়গা, তার উপর আলো কমে আসছে। আমার একা যেতে ভয় করছে।"

''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন

-"তাহলে বলছো যে মেয়েরা ছেলেদের উপর মাঝে মাঝে ডিপেন্ডেন্ট হয়?"

তিতির কপাল কুঁচকে বিরক্ত চোখে তাকালো। মুগ্ধ হেসে বলল,

-"ওহ সরি। তোমাকে তো আবার খোঁটা দেয়া যাবেনা। চলো চলো।"

-"আপনার কাধে দেখি কাপড়! আপনিও কি গোসলে যাচ্ছিলেন?"

-"হুম!"

-"ও। তাহলে তো হলোই।"

তিতির নদীর পাড়ে গিয়েই অবাক হয়ে গেল। এদিকটায় তীরটা একটু অন্যরকম। সিবীচে যেমন বালুর তীর থাকে এখানে ঠিক সেরকমই কিন্তু পাথরের তীর! অসংখ্য ছোট ছোট পাথর এখানে। পানিতে নেমেও পায়ের নিচে পাথর ছাড়া আর কিছু পেলনা। যায়গাটা কি যে ভাল লাগছিল তিতিরের! তিতির যখন গোসল করছিল মুগ্ধ তখন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে মোবাইলে গেমস খেলছিল। কাজলের কালি উঠাতে বেশ কসরত করতে হলো তিতিরের। সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে তুলল। পায়ের কয়েকটা যায়গা আর ঘাড়ের পেছনের দিকটায় সামান্য জলছিল। জলপ্রপাতের পাথরের ধারে কেটে গেছে কিনা কে জানে! গেলে যাক। কি আর করা.. তিতির গোসল শেষে সেই শালটা গায়ে জড়িয়েই উঠলো। তারপর বলল,

-"তাড়াতাড়ি গোসল করতে যান। আমি কি দাঁড়াবো?"

-"পাগল! তুমি যাও চেঞ্জ করে নাও গিয়ে।"

তিতির চলে যাচ্ছিল। মুগ্ধ ডাক দিল,

-"শোনো.."

-"হ্যা বলুন।"

-"আমার মোবাইল আর ওয়ালেট টা একটু নিয়ে যাবে? তুমি না এলে পাড়েই রেখে নামতাম। কেউ তো আর আসবে না। তারপরেও তুমি যখন যাচ্ছোই তখন নিয়ে যাও।"

-"হ্যা, দিন।"

মোবাইল ওয়ালেট পকেট থেকে বের করে দিল। ওগুলো নিয়ে তিতির হাটা ধরলো। মুগ্ধ বলল,

-"দাড়াও দাড়াও.."

মুগ্ধ পকেটে কি যেন খুঁজছে। তারপর তিতির দেখলো মুগ্ধ কতগুলো ভেজা টাকা বের করলো। তিতির বলল,

-"রেমাক্রি ফলসে নামার সময় আপনি না মোবাইল ওয়ালেট সব মংখাই এর কাছে রেখে গিয়েছিলেন? তাহলে এগুলো ভিজলো কি করে?"

-"হ্যা, কিন্তু এই টাকাগুলো পকেটে ছিল খেয়াল করিনি।"

-"ও। ইশ কিভাবে আপনাকে ফেলে দিয়েছিলাম! ব্যাথা পেয়েছিলেন?"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"নাহ, তুমি যাও। এ বিষয়ে পরে কথা হবে।"

তিতির চলে গেল। ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়ে ভাবলো, 'এ যে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি!' এবার নিশ্চিন্তে "প্যারা" মেয়েটার মেসেজ পড়া যাবে। কত বড় সাহস মেয়েটার! মুগ্ধকে ওসব মেসেজ পাঠায়!

তিতির যত দ্রুত সম্ভব গা মুছে চেঞ্জ করে নিল। তারপর মেসেজ পড়া শুরু করলো। যেখানে রেখেছিল সেখান থেকেই শুরু করলো,

Mugdho: Biye to 100 miles dure.. tor moto behayar loge ami s*ex o korina.

Pera: Meyeder ke ektu to respect korbi mugdho!

Mugdho: Nijer somman nijeke dhore rakhte hoy. tui rakhte parish nai. prostitute der respect kori kintu toke na. cz ora nijer shorir sell kore r tui free te bilash.

Pera: Cox's Bazar er ghotonar jonno I'm really sry.. Shotti amr matha thik chilo na. Maf kore de na, jibon thakte ei dhoroner kono kaj r ami korbo na.

তিতির বসে পড়লো! মুগ্ধ এই মেয়েটাকে নিয়ে কক্সবাজার গেছে! এই মেয়েটা কি ওর কোনো এক্স? কষ্ট হচ্ছিল! কেন জানি খুব কষ্ট হচ্ছিল তিতিরের। ফোনটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলল তিতির। কয়েক সেকেন্ড পর মনে হলো বাংলা সিনেমার মত অর্ধেক টা পড়ে রিয়াক্ট করাটা কি ঠিক হবে? না পুরোটাই পড়বে তিতির। হয়তো ও যা ভাবছে তেমন কিছুনা। আবার ফোনটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো,

Mugdho: Campus er je tour e tui jabi oi tour e ami r jibon thakte jabo na..

Pera: Ami shotti toke valobashi re.. amr ekta second jayna toke na vebe!

Mugdho: Allah'r waste r msg dish na. onk koshte etokkhon natha thanda rakhsi. r partesi na.

Pera: Msg dibo na to ki korbo? Etobar call dilam ekbar to dhorli na!

এরপর মুগ্ধ কোন রিপ্লাই দেয়নি। বোধহয় ফোন করেছিল কারন অনেক্ষণ পর মেয়েটাই আবার আরেকটা মেসেজ দিয়েছিল,

Pera: Tui etota kharap bhv korbi vabte parini.

আর কোনো মেসেজ নেই। তিতিরের আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছিল। আহ আহ কি শান্তি!

চারপাশ পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল। বারান্দায় একটা বাল্ব জ্বালানো ছিল। মুগ্ধ কটেজের বারান্দায় বসে লাল রঙের ছোট ছোট কিছু খাচ্ছিল। লোকমান আর মংখাই বাজারে গেছিল। দরজা খোলার শব্দে মুগ্ধ তাকাতেই দেখতে পেল ভেজা কাপড় হাতে বেড়িয়ে এল তিতির। ওর পড়নে সাদা লং স্কার্ট আর নীল টপস। বাল্বের হালকা আলোয় মুগ্ধ দেখছিল তিতিরকে। এই রঙ দুটো বেশ মানিয়েছে তিতিরকে। বারান্দার একপাশে দড়ি টানানো ছিল। সেটাতে ভেজা কাপড় মেলার জন্য হাত উঠাতেই টপস টা উঠে গেল, আর তাতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওর নাভি দেখা গেল। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিল মুগ্ধ। ওর সারা শরীরে যেন ইলেক্ট্রিক শক লাগলো! কক্সবাজার ট্যুরে ইকরা যখন ওকে ইমপ্রেস করার জন্য ওর সামনে এসে কাপড় খুলে ফেলেছিল তখনও তো এরকম কোনো ফিলিং হয়নি। তিতির অবশ্য সুন্দরী কিন্তু ইকরাও তো তিতিরের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলনা। তবু তো ইকরার সৌন্দর্য ওকে টানেনি উল্টো অনীহা এসেছিল। তাহলে এখন ওর এরকম কেন লাগছে। অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো ভালবাসা কি সত্যিই হয়ে গেল!

হঠাৎ ঘোর কাটলো সেই মিষ্টি স্বরে,

-"বসবো?"

-"হ্যা হ্যা বোসো।"

তিতির মুগ্ধর উল্টোপাশে মুগ্ধর দিকে ফিরে বসলো। মুগ্ধ তিরিরের দিকে না তাকিয়েই বলল,

-"খাবে?"

-"কি এগুলো?"

-"ডুমুর! পাহাডী ডুমুর, একদম পাকা। খেয়ে দেখো অনেক মজা।"

তিতির একটা ডুমুর হাতে নিয়ে বলল,

-"এটা কিভাবে খায়?"

মুগ্ধ দেখিয়ে দিল প্রথমে ডুমুরকে দুহাতের আঙুল দিয়ে টেনে দুভাগ করতে হয়। তারপর একেকটা ভাগ উল্টে চুষে চুষে খেতে হয়। তারপর তিতির ডুমুর নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। তিতিরের দিকে চোখ পড়তেই মুগ্ধ আর চোখ ফেরাতে পারছিল না। তিতির বোধহয় ভাল করে চুল মুছতে পারেনা। তাই গোসলের পর ওর চুল থেকে টপটপ করে ফোটা ফোটা পানি পড়তে থাকে। তখনও তাই হচ্ছিল। তিতিরের বড় বড় চোখগুলো ছিল ডুমুরের দিকে। আর ওর আলতো আলতো গোলাপি ঠোঁট দিয়ে চুষে চুষে খাচ্ছিল সেই ডুমুর! সেই পরিবেশে সেই দৃশ্য যে কতটা ভয়ঙ্কর, মারাত্মক আর নেশাতুর হতে পারে তা যে না দেখেছে সে কোনদিনও বুঝবে না।

নাহ এটেনশন অন্যদিকে নিতে হবে! কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? তার চেয়ে অন্তত এই ডুমুর খাওয়াটা বন্ধ করা যাক। মুগ্ধ বলল,

-"বেশি খেয়োনা। পেট ব্যাথা করতে পারে।"

-"উম্মম্মম্মম্ম! অস্থির ফল একটা। এত মজা কেন? পেটে ব্যাথা হলে হবে। তাও আমি খাবো!"

-"নাহ। ঢাকা যাওয়ার সময় কিনে দিব। বাসায় গিয়ে খেয়ো।"

ঝুড়িটা সড়িয়ে রাখলো মুগ্ধ। তারপর বলল,

-"কদিন আমাকে অনেক জ্বালিয়েছো। এবার একটু সেবা করো তো।"

-"সেবা! কি সেবা?"

-"আমার পিঠে খুব জ্বলছে। বোধহয় ছিলে টিলে গেছে, একটু স্যাভলন লাগিয়ে দাও। মংখাই কে দিয়ে লাগাবো ভেবেছিলাম। কিন্তু সেই যে বাজারে পাঠালাম আর তো খবর নেই।"

-"আমি লাগিয়ে দিচ্ছি। কোনো প্রব্লেম নেই।"

-"আচ্ছা, বোসো আমি স্যাভলন ক্রিমটা নিয়ে আসছি।"

তিতির এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

-"আপনি চুপ করে বসুন। আমি নিয়ে আসছি। স্যাভলন আমার কাছেও আছে।"

তারপর চলে গেল ওর ঘরে। জীবনেও এটুকুতে স্যাভলন লাগায়নি মুগ্ধ। কিন্তু আজ লাগাতে চাইছে। ব্যাথা কমানোর জন্য না। তিতিরের একটু স্পর্শ পাওয়ার জন্য!

তিতির স্যাভলন এর সাথে মুগ্ধর ফোন আর ওয়ালেটও নিয়ে আসলো। বলল,

-"এই নিন ফোন আর ওয়ালেট! ভেজা টাকাগুলো টেবিলের উপর শুকোতে দিয়েছি।"

মুগ্ধ ওগুলো নিল তিতিরের হাত থেকে। তিতির ওর পাশে বসে বলল,

-"ওদিকে ঘুরুন আর শার্টটা খুলুন।"

মুগ্ধ শার্টটা খুলে ঘুরে বসতেই তিতির ওর পিঠে হাত রেখে আঁৎকে উঠলো,

-"ওমাগো! পুরো পিঠ ছিলে গেছে! লাল হয়ে গেছে। ইশ এটা রেমাক্রি ফলসে আমার ওই বোকামির জন্য হয়েছে না?"

-"সুন্দরীর হাতের ছোঁয়া দেখছি স্যাভলনের চেয়েও বেশি কাজে দিচ্ছে! হাতটা সরিওনা কিন্তু।"

একথাটা মুগ্ধ শুধু মজা করে বলেনি। মন থেকে বলেছে। তিতির ফাজলামো ভেবে ওর পিঠে আলতো করে স্যাভলন লাগাতে লাগাতে বলল,

-"আপনি পারেনও।"

স্যাভলন লাগানো শেষ হতেই মুগ্ধ আবার ঘুরে বসলো। আর সাথে সাথে দেখতে পেল রিতিরের বাহুতে আর ঘাড়েও ছিলে গেছে। মুগ্ধ বলল,

-"এই পাক্নি! তোমার ঘাড়ে আর হাতেরও তো একই অবস্থা!"

-"তাই নাকি? এজন্যই বোধহয় জ্বলছিল গোসলের সময়!"

-"ওখানে স্যাভলন লাগাও।"

তিতির বাহুর ক্ষততে নিজেই স্যাভলন ক্রিম লাগালো। তারপর স্যাভলনের টিউবটা মুগ্ধর দিকে এগিয়ে দিয়ে হেসে বলল,

-"নিন এবার আপনি একটু সেবা করুন।"

মুগ্ধ ওটা তিতিরের হাত থেকে নিতেই তিতির সব চুলগুলোকে ভাল করে সরিয়ে নিল একপাশে। তারপর ক্ষতর সাইডটা মুগ্ধর দিকে ধরলো। মেয়েটা কি পাগল! এমনটা কেউ করে? ও কি জানে মুগ্ধর ইচ্ছে করছিল ওই ভেজা চুল সরানো ঘাড়ে একটা গাঢ় চুমু খেতে! কিন্তু মুগ্ধর বিবেক খুব সহজেই সে লোভ সংবরন করলো। অঙুলের মাথায় স্যাভলন নিয়ে তা তিতিরের ঘাড়ে লাগিয়ে দিল। তিতির আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কালও তো ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরেছিল মুগ্ধকে। কিন্তু তখন তো এমন অনুভূতি হয়নি! খুব স্বাভাবিক লেগেছিল তিতিরের। আর আজ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে কি অমূল্য সম্পদ যেন পেল। মনে মনে বলল, 'কোন পুরুষের স্পর্শ আমি আজও লাগতে দিইনি আমার শরীরে। আপনিই প্রথম। আমি জানতাম আপনার স্পর্শ এতটাই মধুর হবে। আমি এ স্পর্শ সারাজীবনের জন্য চাই। ভাগ্যিস ঘাড়ে আঘাতটা পেয়েছিলাম।'

এর মধ্যেই মংখাই আর লোকমান চলে এলো। মংখাই বলল,

-"দাদা, হাঁস খুঁজতে খুঁজতে দেরী হয়ে গেল।"

কথা শেষ করে তিতরের দিকে তাকিয়েই মংখাই চমকে উঠলো,

-"আপু না কালা ছিলো?"

তিতির হেসে দিল। মুগ্ধও হেসে বলল,

-"ওইটা ছিল, প্রোটেকশন! বেশী রূপবতী মেয়েদের নিয়ে এই হলো প্রব্লেম। বুজলে মংখাই?"

-"জ্বী দাদা, বুজছি।"

তিতির লজ্জায় কি বলবে বুঝতে পারছিলনা। কথা ঘুড়িয়ে বলল,

-"আচ্ছা হাঁস কেন আনালেন?"

-"বার-বি-কিউ করবো। কাল মিস করেছিলাম মনে নেই?"

-"আপনার এত এনার্জি? এখন রান্না করবেন? কেন রেমাক্রি বাজারে না দেখলাম কত দোকান? ওখান থেকে কি খাওয়া যেত না?"

-"হ্যা, আমার এনার্জি একটু বেশি।"

গেস্ট হাউজের পাশেই আগুন জ্বালিয়ে বার-বি-কিউ এর ব্যবস্থা করেছে ওরা। হাঁস বার-বি-কিউ করতে করতে মুগ্ধ বলল,

-"এনার্জি কিন্তু তোমারও কোনো অংশে নেহাৎ কম না। এতদূর এসে পড়লে এখনো তোমার চেহারায় টায়ার্ডের ছাপ পড়েনি। এখনো কতটা প্রানোচ্ছল! ম্যাক্সিমাম মেয়েরা এই পর্যন্ত এসে হাল ছেড়ে দেয় আর মাফাখুম যাবেনা।"

তিতির হাসলো শুধু কিছু বলল না।

হাঁস বার-বি-কিউ টা এত টেস্টি হয়েছে! তিতির কখনো এত মজার বার-বি-কিউ খায়নি! খাওয়ার পর পরই সবাই শুয়ে পড়েছে।

মুগ্ধর ঘুম পাচ্ছিলনা। বার বার তিতিরের সেই ভেজা চুলের মুখটা ভেসে উঠছিল চোখের পাতায়। কি অদ্ভুত! কখনো কোনো মেয়ের জন্য তো ও এতকিছু করেনি। কখনো কোনো মেয়ের জন্য এতটা ফিলও করেনি ও। পাশের রুমেই আছে অথচ ওর জন্য কি অস্থিরতা! বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রাখলে হয়তো এ অস্থিরতা কমবে। ও কি তিতিরকে প্রোপোজ করবে নাকি আরেকটু টাইম নেবে! মাত্র দুদিনের পরিচয়ে এতো সিরয়াস একটা ডিসিশান নিয়ে নেবে! আগের সম্পর্কগুলোর মত কোনো ভুল সম্পর্কে আর জড়াতে চায়না ও। কারন এখন আর সময় নেই, মা ইমিডিয়েটলি ওর বিয়ে দিতে চান?

পাশের ঘরে কুম্ভকর্ণ তিতিরেরও কিনা ঘুম পাচ্ছিল না! ও খালি কাল থেকে মুগ্ধর সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা ভাবছিল। ইশ কাল রাতে এমন সময় ও আর মুগ্ধ পাশাপাশি শুয়ে ছিল। আর আজ দুজন পুরো দুঘরে! এটা কোনো কথা হলো! আচ্ছা ও কি করবে? ও কি মুগ্ধকে বলবে ওর ভালবাসার কথা? নাকি মুগ্ধর বলার জন্য অপেক্ষা করবে? মুগ্ধর ভেতর যদি ভালবাসা না জাগে মুগ্ধ কেন বলবে! ফোনের ওই প্যারা মেয়েটা প্রোপোজ করেছিল বলেই তো মুগ্ধ ওর উপর বিরক্ত। বেহায়া ভাবে। ও ভালবাসার কথা বললে যদি ওকেও বেহায়া ভাবে! ঘরের ভেতর পায়চারী করছিল। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়লো। প্রায় সাথে সাথেই মুগ্ধর গলা,

-"এই তিতির?"

তিতির দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। বলল,

-"কিছু বলবেন?"

-"ঘুমাওনি দেখলাম। মানে পায়ের আওয়াজ পেলাম। আমারও ঘুম আসছেনা। তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে একটু বারান্দায় বসি?"

-"গান শোনাবেন?"

-"সিওর!"

তিতির বারান্দায় এসে বসলো। মুগ্ধ বলল,

-"দেখেছো পাহাড়ের পূর্নিমা কত অসাধারণ!"

-"হ্যা এত সুন্দর পূর্নিমা আমি আগে কখনো দেখিনি। কাল তো জঙ্গলে এত ভাল দেখাও যায়নি। তাছাড়া এই পুরো যায়গাটাই অসাধারণ। বান্দরবান আসার পর থেকে যতগুলো যায়গায় গিয়েছি তার মধ্যে এটা বেস্ট।"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"আর নিলগিরি?"

-"দুটোর তুলনা চলেনা। দুটোই দুটোর মত সুন্দর।"

-"এখানে আসতে আসতে তো প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছিল। আসল সৌন্দর্য দেখতে আলো লাগবে। কাল সকালে দেখো, তখন বুঝবে কি সুন্দর যায়গা!"

-"তা নাহয় দেখবো কিন্তু এখন গান শুনতে চাচ্ছি। মনটা আকুপাকু করছে গানের জন্য।"

মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে গান ধরলো...

"আবার এলোযে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে।

চলোনা ঘুরে আসি অজানাতে

যেখানে নদী এসে থেমে গেছে...

ঝাউবনে হাওয়াগুলো খেলছে,

সাঁওতালি মেয়েগুলো চলছে।

লাল লাল শাড়ী গুলো উড়ছে,

তার সাথে মন মোর দুলছে।

ওই দূর আকাশের প্রান্তে,

সাতরঙা মেঘগুলো উড়ছে।

এই বুঝি বয়ে গেল সন্ধ্যা,

ভেবে যায় কি জানি কি মনটা!

পাখিগুলো নীড়ে ফিরে চলছে,

গানে গানে কি যে কথা বলছে!

ভাবি শুধু এখানেই থাকবো,

ফিরে যেতে মন নাহি চাইছে!

আবার এলোযে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে।

চলোনা ঘুরে আসি অজানাতে

যেখানে নদী এসে থেমে গেছে..."

To be continued...

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url