প্রেমাতাল - পর্ব 31+32+33+34+35 । Golpo Porun

প্রেমাতাল

(মৌরি মরিয়ম)

Prematal
This Photo is from Pexels


প্রেমাতাল -  পর্ব ৩২

মৌরি মরিয়ম

কতক্ষণ পর তিতির ক্লান্ত হয়ে মাটিতে পা রাখলো। মাটিতে ভর দিতেই তিতির টের পেল ও সব শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে, দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। মুগ্ধর কোমরটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঢলে পড়লো মুগ্ধর বুকের উপর। নিঃশ্বাস পড়ছিল ঘন ঘন। মুগ্ধ তিতিরের মুখটা ধরে উপরে তুলল তারপর নিজের ঠোঁট দিয়ে চোখের পানিটুকু মুছে দিল। ইশ একি সুখ মুগ্ধ দিচ্ছে ওকে! এত সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছিল ও! আচ্ছা মুগ্ধকে কেমন দেখাচ্ছে এখন? দেখার জন্য তিতির চোখ খুলে তাকালো। মুগ্ধর চোখে চোখ পড়তেই তিতিরের লজ্জা লাগলো, চোখ নামিয়ে নিল। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,

-"কাঁদছিলে কেন?"

তিতির কিছু না বলে মুগ্ধর বুকে মুখ লুকালো। খুব ভাল লাগছে ওর, এত ভাললাগা কি করে বোঝাবে মুগ্ধকে? যেভাবেই হোক ও যে বোঝাতে চায়।

মুগ্ধ তিতিরকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে রইলো। এত ভাল অনুভূতি এর আগে কখনো হয়নি ওর। এর আগেও অসংখ্যবার চুমু খেয়েছে প্রাক্তন প্রেমিকাদের। কিন্তু আজ মনে হলো জীবনের প্রথম চুমু ছিল এটা। প্রথম অভিজ্ঞতা। তিতিরের আনাড়িপনা ও লজ্জা ব্যাপারটাতে অন্যরকম মাধুর্য এনে দিয়েছে। তিতির ভালই করেছে ওকে এতদিন অপেক্ষা করিয়ে। অপেক্ষার ফল সুমিষ্ট হয়!

প্রেমাতাল - সকল পর্ব

মুগ্ধ তিতিরকে কোলে তুলে নিল। তিতিরও গলা জড়িয়ে ধরল, কিন্তু তাকাতে পারলো না ওর দিকে। মুগ্ধ ওকে কোলে নিয়েই বারান্দায় রাখা সোফাটায় বসলো। তারপর বলল,

-"চুপ করে আছো যে? কথা বলবে না?"

তিতির নিচু স্বরে

-"কি বলবো?"

-"কেমন লাগলো সেটা বলো?"

-"তুমি তো সবই বোঝো। আমি আর কি বলবো?"

-"বুঝি তো কিন্তু আমার তিতিরপাখিটার মুখে কি শুনতে ইচ্ছে করে না?"

তিতির মুগ্ধর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-"সুখের সমুদ্রে ডুবে ছিলাম। মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। যদি এত সুখের মুহূর্ত আর না আসে?"

তিতিরের উষ্ণ নিঃশ্বাস কানে লাগতেই মুগ্ধ কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তিতিরকে বুকের উপর নিয়েই সোফাতে শুয়ে পড়লো। তিতির উপুর হওয়াতে ওর ভেজা চুলগুলো মুগ্ধর মুখের উপর পড়লো। মুগ্ধ চুলগুলোকে সরিয়ে বলল,

-"সুখের সমুদ্রে তো তোমাকে নিয়ে মাত্র পা ভেজালাম। এখনি মরতে চাও? যখন সাঁতার কাটবো তখন কি বলবে?"

''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন

একথা শুনে লজ্জায় তিতির আচমকাই উঠে পড়ল। মুগ্ধ আঁচল টেনে ধরতেই তিতির দাঁড়িয়ে পড়লো। মুগ্ধ কাত হয়ে সরে তিতিরকে বসিয়ে বলল,

-"আরে এখনি না তো! বিয়ের পরে। তুমি তো মাত্র ১৭। ১৮+ কাজ কি আমি তোমার সাথে করতে পারি বলো?"

তিতির কিছু বলল না, শুধু হাসলো। মুগ্ধ ওকে বুকে নিয়ে বলল,

-"ইশ একটু তাড়াতাড়ি বড় হও না, বিয়ে করি।"

-"বড় হওয়ার মন্ত্র থাকলে আজই পড়ে বড় হয়ে যেতাম।"

-"তাই? সাঁতার কাটার এত ইচ্ছে?"

তিতির মুগ্ধর বুকে কিল মারতে মারতে বলল,

-"তুমি এত খারাপ কেন?"

-"তুমি এত লক্ষী বলে।"

এমন সময় মুগ্ধর ফোন বাজল। বংশী ফোন করেছে। মুগ্ধ ফোন ধরলো। বংশী কি বলল তা তো তিতির শুনতে পেল না কিন্তু তারপর মুগ্ধ বলল,

-"হ্যা, হ্যা.. তুমি নিয়ে এসো।"

ফোন রাখতেই তিতির বলল,

-"কি নিয়ে আসতে বললে?"

মুগ্ধ হাসলো। তিতির বলল,

-"কি? হাসছো যে?"

-"না মানে একটা কথা মুখে চলে এসেছিল, বললে তুমি লজ্জায় আমার সামনেই আর আসতে না তাই গিলে ফেলেছি। ওটা ভেবেই হাসলাম।"

তিতিরের মনে মনে রাগ হলো। এহ সারাদিন রাজ্যের আজেবাজে কথা বলতে থাকে, এখন একদম তুলসী পাতা হয়ে গেছে! কথাটা জানার জন্য মনটা আকুপাকু করলেও আর জিজ্ঞেস করতে পারলো না তিতির। বংশী এসে দরজায় নক করতেই মুগ্ধ গিয়ে খুলে দিল। পিছন পিছন তিতিরও ঘরে ঢুকলো। তিতিরকে শাড়ি পড়া দেখেই বংশী বলল,

-"দেখলিজিয়ে সাহাব, বিবিজিকো আব ছোটা নেহি লাগতা।"

তিতির হাসলো।মুগ্ধও হেসে বলল,

-"হ্যা।"

-"সাহাব, ডিনারপে কেয়া খায়েগা আপ দোনো?"

মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল,

-"এই তুমি কি খাবে?"

তিতির বলল,

-"খেয়ে না এলাম? আমি আর কিছু খাব না।"

-"খেয়েছি তো সেই ৬/৭ টার সময়। এখন তো ১০ টা বাজতে চলল।"

-"হোক।"

বংশী বলে উঠলো,

-"নেহি বিবিজি.. ইয়ে সাহি বাত নেহি! রাত কা খানা বহত জারুরি হোতা হেয়।"

মুগ্ধ বংশীকে বলল,

-"তোমার বিবিজির কথা বাদ দাও.. ও খাবে কি খাবে না আমি দেখে নেবো। তুমি দুজনের জন্য নরমাল কিছু নিয়ে এসো ১১ টার দিকে। যেমন ধরো ভাত, মাছ, ভর্তা।"

-"সাহাব, চিকেন গুতাইয়া হেয়। ও ভি দিব?"

-"ওহ ওয়াও। অবশ্যই দিবে।"

বংশী চলে গেল। যাওয়ার সময় মুগ্ধর হাতে একটা বোতল দিয়ে গেল। তিতির জিজ্ঞেস করলো,

-"এটা কি?"

-"এটা দিতেই তো বংশী এসেছিল।"

-"হ্যা কিন্তু জিনিসটা কি?"

-"মহুয়া।"

-"সেটা কি? মদ?"

-"ছি, এভাবে বলো না। যদিও ওই টাইপেরই। কিন্তু মহুয়া ইজ মহুয়া। চরম একটা জিনিস। খাসিয়ারা বানায় ফল দিয়ে।"

-"মানে কি? মদ তো মদই। তুমি যদি ওটা খাও আমার ধারেকাছেও আসবে না। ছিঃ আর তুমি মদ খাও আমি ভাবতেও পারিনি। আমি জানতাম তোমার কোনো নেশা নেই।"

মুগ্ধ বোতলটা সোফার সামনের টি-টেবিলের উপর রেখে তিতিরের কাছে এসে বলল,

-"আরে বাবা, আমাকে একটু বলার সুযোগ দাও।"

তিতির সরে গিয়ে বলল,

-"কি সুযোগ দেব? ছিঃ তুমি মদ খাও ভাবতেই আমার গা গোলাচ্ছে।"

মুগ্ধ তিতিরকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-"শোনো তিতিরপাখি, আমার সত্যিই কোনো নেশা নেই উইদাউট ইউ। ইভেন অকেশনালিও এসব করিনা শুধু বান্দরবান আর কুয়াকাটা গেলে মহুয়াটা খাই। তাও প্রত্যেকবার না। এটা অন্যরকম স্বাদ। আমি প্রথমবার যখন খেয়েছিলাম তখনই ঠিক করে রেখেছিলাম যে বউয়ের সাথে একবার খাব। সেজন্যই বংশীকে দিয়ে আনিয়েছি।"

তিতির চোখ বড় বড় করে বলল,

-"আমি খাব?"

-"হ্যা, মানে অল্প।"

তিতির সরে গেল। বিছানায় বসে বলল,

-"অসম্ভব।"

মুগ্ধ তিতিরের পাশে বসলো। বলল,

-"এক চুমুক খেয়ে ট্রাই করো। ভাল না লাগলে খেয়ো না।"

তিতির হ্যা না আর কিছু বলল না। প্রসঙ্গ পাল্টালো,

-"বাদ দাও, আচ্ছা উনি না বলেছিল কোনো কটেজ খালি নেই, তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা করবে। তাহলে পরে আমরা কটেজ কিভাবে পেলাম?"

-"ওহ এই কটেজটা অলরেডি বুকিং দেয়া। যারা বুক করেছে তারা কাল আসবে। তাই আজ আমাদের দিতে পারলো।"

-"ও।"

মুগ্ধ তিতিরের একটা হাত ধরে বলল,

-"তুমি রাগ করেছো?"

-"কেন?"

-"মহুয়া আনালাম বলে?"

-"না তা না কিন্তু আমি এগুলো পছন্দ করি না।"

-"এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি নেশা জাতীয় কোন কিছুই আমি রেগুলার করি না।"

তিতির আহ্লাদ করে হাসলো। তারপর বলল,

-"আচ্ছা ঠিকাছে।"

মুগ্ধ হঠাৎই বলল,

-"সিরিয়াসলি তোমাকে শাড়ি পড়ায় বড় লাগছে। একদম বউ বউ।"

তিতির হাসলো। মুগ্ধ তিতিরের কোমর ধরে কাছে নিয়ে আসলো। তারপর বলল,

-"বিয়ের পর সবসময় আমার সাথে যখন থাকবে ফর সিওর তুমি খুব বিরক্ত হবে।"

-"কেন?"

-"এইযে, তোমাকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়বো না যে। বুকেই রাখবো।"

-"তখন আর এত আকর্ষণ থাকবে না।"

-"কে বলল তোমাকে?"

-"পুরোনো হয়ে যাব না?"

-"কিছু জিনিস কখনো পুরোনো হয়না তেমনি কিছু মানুষও কখনো পুরোনো হয়না। প্রতিদিন নতুন করে ভাললাগা জন্মায় তাদের প্রতি।"

-"সত্যি তো?"

-"সত্যি।"

ওদের গল্প চলতেই থাকলো। এক সময় বংশী খাবার দিয়ে গেল। তিতির বলল,

-"আমার না তোমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতে ইচ্ছে করছে, দিই?"

-"কি সৌভাগ্য! কি সৌভাগ্য! প্লিজ দাও।"

তিতির এলোমেলো চুলগুলোকে হাতখোঁপায় বেঁধে কোমরে আঁচল গুঁজে নিল। মুগ্ধ তাকিয়ে রইলো ভ্যাবলার মত। একদম গিন্নী গিন্নী লাগছে। এই সৌন্দর্য কোথায় ছিল এতদিন?

তিতির হাত ধুয়ে ভাত নিল প্লেটে। ভাত মেখে মুগ্ধর মুখে সামনে তুলে ধরলো। মুগ্ধ তখনও তাকিয়ে। তিতির বলল,

-"কি হলো? নাও খাও।"

মুগ্ধ হা করলো তিতির খাইয়ে দিল। মুগ্ধ বলল,

-"তুমিও খাও।"

-"তুমি খাও, আমার ইচ্ছে করছে না।"

-"ওকে আমিও খাব না, রাখো।"

-"আচ্ছা আচ্ছা খাচ্ছি, বাপরে বাপ! ব্ল্যাকমেইলর একটা।"

তিতিরও খেল। মুগ্ধ হেসে দিল। খাওয়াদাওয়া শেষ করে তিতির যখন হাত মুখ ধুয়ে প্লেটগুলো গোছাচ্ছিল। পিছন থেকে মুগ্ধ ওকে ধরে নিজের দিকে ফেরালো। কপালে একটা চুমু দিল। তারপর চোখে চোখ রেখে বলল,

-"তোমাকে যতটা বাচ্চা ভাবি ততটা বাচ্চা তুমি নও।"

-"একথা কেন বললে?"

-"এইযে এত সুন্দর করে খাইয়ে দিলে। তারপর এই খোঁপা! আঁচল কোমড়ে গোঁজা। সব মিলিয়ে পারফেক্ট বউ।"

-"আমার সবই তো তোমার পারফেক্ট লাগে। আমার খারাপটা বলোতো। ভাল শুনতে শুনতে আমি টায়ার্ড।"

-"তোমার খারাপটা হচ্ছে তুমি খুব কিপটা।"

-"কি কিপটামি করেছি?"

-"আদর করতে কিপটামি করো সবসময়। নিজে থেকে তো শুধু জড়িয়ে ধরো আর কিছুই না। আমাকেও করতে দাওনা।"

তিতির লাজুক মুখে বলল,

-"আজ তো দিয়েছি।"

মুগ্ধ তিতিরের শাড়ির ভেতর দিয়ে কোমরের কার্ভে হাত রেখে বলল,

-"তাই?"

তিতির একটু নড়ে উঠে বলল,

-"ছাড়ো সুড়সুড়ি লাগে।"

মুগ্ধ আস্তে আস্তে হাতটা উপরের দিকে ওঠাতে লাগলো। তিতির ছটফট করতে লাগলো। সরে যেতে চেয়েও পারলো না। মুগ্ধর একহাত ওকে ধরে রেখেছে। অবশেষে বলল,

-"দোহাই লাগে ছাড়ো। নাহলে মরে যাব।"

মুগ্ধ হাত সরিয়ে নিল, ছেড়ে দিল। তারপর বলল,

-"দেখেছো! আমি কিছু করতাম না জাস্ট দেখালাম তুমি কত কিপটা।"

তিতির নিচু স্বরে বলল,

-"আমার খুব সুড়সুড়ি লাগছিল।"

মুগ্ধ মুচকি হেসে বলল,

-"হুম জানি, আমি দুষ্টুমি করছিলাম।"

তিতির মুগ্ধর কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-"এটাতে কখনো কিপটামি করিনা আমি।"

মুগ্ধও ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-"হুম, আর এটাই আমাকে সবথেকে বেশি শান্তি দেয়। যতক্ষণ তুমি দূরে থাকো, উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের মত উথাল পাথাল করতে থাকে বুকের মধ্যে। তারপর যখন এসে জড়িয়ে ধরো সব ঠান্ডা হয়ে যায়। তখন আমার চেয়ে সুখী মানুষ পৃথিবীতে আর একটিও পাবে না।"

তিতির বলল,

-"আমারও একই অবস্থা হয়।"

কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ বলল,

-"এই চলো মহুয়া খাই, তুমি কখন ঘুমিয়ে পড়বে তার ঠিক নেই।"

-"আমি কিন্তু অল্প একটু খাব।"

-"হুম। অল্পই পাবে, বেশিটা পাবে কোথায় আমারই লাগবে ওটুকু।"

-"খেলে কি নেশা হয়?"

-"অল্প খাবেতো, নেশা হবে কোত্থেকে?"

-"তুমি তো বেশি খাবে।"

-"আমার তো অভ্যাস আছে রে বাবা। আরো বেশি খেয়েও নেশা হবে না। আর নেশা হলেও তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নেশা হলে আমি খুব ঠান্ডা হয়ে যাই। চুপচাপ বসে থাকি।"

-"ও।"

মুগ্ধ বংশীকে ফোন করে বরফ আনালো। বরফ, গ্লাস আর মহুয়ার বোতল নিয়ে ওরা বারান্দায় চলে গেল। মুগ্ধ গ্লাসে ঢেলে এগিয়ে দিতেই তিতির বলল,

-"পানি মেশাবে না?"

-"আরে এটা ওইটাইপ না বাবা। এটা মহুয়া। পানি মেশানো লাগে না। পানি মেশালে টেস্টই চলে যাবে।"

-"ও।"

মুগ্ধ এক গ্লাস খেয়ে ফেলেছে, তিতির তখনো একটু খানি হাতে নিয়ে বসে রয়েছে ওর পাশে, মুখে দেয়নি। মুগ্ধ তা দেখে বলল,

-"খেতে যদি একান্তই ইচ্ছা না করে জোর করে খেওনা।"

-"না, তেমন কিছু না।"

তিতির মুখে দিল। ঘ্রাণটা সুন্দর, খেতেও টেস্টি কিন্তু গলা দিয়ে নামার পর কেমন যেন লাগলো। কয়েক সেকেন্ড যাওয়ার পর তিতির বলল,

-"ওয়াও, গ্রেট!"

-"কি?"

-"টেস্ট টা! খাওয়ার কতক্ষণ পরে বেশি ভাল লাগে।"

মুগ্ধ হেসে বলল,

-"বলেছিলাম।"

গ্লাসের টুকু শেষ করে তিতির বলল,

-"আমি আরো খাব।"

-"পাগল? নেশা হয়ে যাবে তোমার।"

-"না না হবে না। প্লিজ আরেকটু দাও না।"

-"না বাবা, এমন করোনা। টেস্টটা অনেক ভাল বলে তোমাকে আমি টেস্ট করিয়েছি। তার মানে এই না যে আমি তোমাকে আরো দিতে পারি। এটা অনেক কড়া।"

মুগ্ধ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিতির বোতলে মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে খেতে লাগলো। তারপর মুগ্ধ টেনে নিয়ে নিল। বলল,

-"ইশ কেন যে আনতে গেলাম।"

-"কেন? খুব ভাল করেছো আনতে দিয়ে। খুব মজা তো।"

ততক্ষণে তিতিরের কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। মুগ্ধ আর খেলনা। তিতির সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুগ্ধ বুঝলো তিতির ঘুমিয়ে পড়েছে, যাক বাবা, বাঁচা গেল। নেশা হওয়ার আগে ঘুমিয়ে পড়লো। মুগ্ধ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তিতিরের ঘুমন্ত মুখটার দিকে। ইশ, পৃথিবীর সব সুখ যেন এই মুখটার মাঝে। মুগ্ধ এগিয়ে তিতিরের কপালে একটা চুমু দিল। চুমু দিয়ে আর উঠতে পারলো না তিতির ওর শার্টের কলার ধরে ফেলেছে কখন যেন। ছাড়াতে যেতেই তিতির চোখ খুলে বলল,

-"আগে বলো খুলবে?"

মুগ্ধ অবাক,

-"কি খুলবো?"

-"এই পচা শার্ট টা।"

-"পচা? এটা তো তোমারই পছন্দের শার্ট। তুমিই দিয়েছিলে।"

-"নাহ এটা খুব পচা। এটা তোমার বুকের লোমগুলোকে ঢেকে রেখেছে, আমি কিসসি করতে পারছি না।"

মুগ্ধর বুঝে গেল, নেশা ভাল ভাবে হয়েছে। হবেই তো, বোতলে মুখ লাগিয়ে গিলেছে! পাগলী একটা। ওকে তারাতারি ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে। মুগ্ধ ওকে কোলে নিতে যাচ্ছিল। তিতির বলল,

-"খবরদার, এভাবে কোলে নিবে না। শার্ট খোলো আগে।"

মুগ্ধ অগত্যা শার্ট খুললো। তিতির সেটাকে ছুড়ে ফেলে দিল, শার্ট টা ঘরের দরজায় লেগে মাটিতে পড়লো। মুগ্ধ বলল,

-"খুশি?"

তিতির সেকথার উত্তর না দিয়ে মুগ্ধকে ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে দিল সোফার উপর। ওর বুকে মধ্যে মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিল কতক্ষণ, তারপর অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিল মুগ্ধর বুকটা। মুগ্ধর তখন পাগলপ্রায় অবস্থা। চুমু দিতে দিতে একসময় তিতির ওর গলাতেও চুমু দিল, তারপর গালেও দিল। মুগ্ধ ওর মুখটা ধরে বলল,

-"শোনো তিতির, তোমার নেশা হয়ে গেছে, চলো ঘরে গিয়ে ঘুমাবে।"

-"উফফফো! এমন পূর্ণিমারাতে এত সুন্দর পরিবেশে কেউ ঘুমায়?"

-"হুম, ঘুমায়।"

-"জানো, কেন আজকে থাকতে চেয়েছিলাম?"

-"কেন?"

-"তুমি আমাকে যতবার কিসসি করতে চেয়েছো আমি দিইনি। পরে খারাপ লেগেছে। আমি জানতাম থাকলে একসাথেই থাকবো আর তুমি আমাকে কিসসি করতে চাইবে, তখন আমি আর বাধা দিবনা। সেজন্য থাকতে চেয়েছি।"

-"হুম, আমি যদি সুযোগ নিয়ে আরো অনেক কিছু করে ফেলতাম তখন?"

উত্তর দিল না তিতির। বলল,

-"জানো তুমি যখন কিসসি করেছিলে তখন আমি কেন কেঁদেছিলাম?"

-"জানতে তো চেয়েছিলাম, তুমি বলোনি।"

-"তুমি এত সুন্দর আদর করে ধরেছিলে আমাকে আর এত সুন্দর করে কিসসি করেছিলে যে আমার বুকের ভেতর কেমন যেন অস্থির অস্থির করছিল। আমি সেই অস্থিরতাটা সহ্য করতে পারছিলাম না। কেমন যেন! সেজন্যই কান্না এসে গিয়েছিল আর আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।"

মুগ্ধ তিতিরের মুখটা নিজের বুকে রেখে বলল,

-"ওহ, আহারে!"

তিতির মুখটা আবার তুলল। মুগ্ধর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

-"এই শোনোনা, তখন আমি আবেশে কোনো এক অন্য দুনিয়ায় চলে গিয়েছিলাম। কিছুতেই বুঝতে পারিনি তুমি কিভাবে আমাকে কিসসি করেছিলে! আর আমার কেমন অনুভূতি হয়েছিল, শুধু অস্থির অস্থির লাগাটা বুঝতে পেরেছিলাম। আমাকে আরেকবার ওভাবে কিসসি করবে?"

মুগ্ধ হাসলো আর ভাবলো, ইশ কি ইনোসেন্ট! নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ বলে মনে হচ্ছিল। তিতির ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল,

-"ভাবছো তো নিজে না করে তোমার কাছে চাইছি কেন? আমি তো জানিনা কিভাবে করতে হয়। তখন তো বুঝতে পারিনি। আমাকে একটু শিখিয়ে দাও না। আমিও তোমার মত করে তোমাকে আদর দিতে চাই।"

মুগ্ধ তিতিরকে সরিয়ে উঠে বসলো। তারপর দাঁড়াল। তিতির বলল,

-"দাও না, প্লিজ। আর কখনো তোমাকে ফিরিয়ে দেব না।"

মুগ্ধ হেসে তিতিরকে কোলে তুলে নিল। তারপর ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তিতির বলল,

-"কিসসি না করে ঘুমাবো না।"

তিতির তখনো মুগ্ধর গলা ধরে আছে। মুগ্ধ বলল,

-"জানি।"

মুগ্ধ তিতিরের কানের নিচ দিয়ে চুলের ভেতর হাত গলিয়ে ওর মুখটা কাছে নিয়ে এল। তারপর তিতিরের ঠোঁটে চুমু খেল। তিতিরও একসময় মুগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধ যখন ছাড়তে চাইলো তিতির ছাড়লো না। পারলে ও মুগ্ধর গলায় ঝুলেই উঠে আসে। মাঝে মাঝে আবার কামড়ও দিচ্ছিল।

কিছুক্ষণ পর তিতির মুগ্ধকে ছেড়ে হাঁপাতে লাগলো। মুগ্ধ উঠে যাচ্ছিল। তিতির ধরে রাখলো। মুগ্ধ হেসে জিজ্ঞেস করলো,

-"কি? আরো?"

''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন

তিতির এক্সাইটমেন্টে, নেশা আর ঘুমের মধ্যে কি যে বলল বুঝতে পারলো না মুগ্ধ। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,

-"বুঝিনি কি বললে! আবার বলবে?"

-"তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ডদের কি এভাবেই কিসসি করতে?"

-"আরে নাহ!"

-"তাহলে কিভাবে করতে?"

-"কেন এসব জিজ্ঞেস করছো?

তিতির কান্না করে দিল,

-"বলোনা.."

-"এভাবে করতাম না। তুমি আবার কাঁদছ কেন?"

-"এভাবে চুলের ভেতর হাত দিয়ে ধরতে?"

-"নাহ।"

-"ওইভাবে কোমরে ধরতে?"

-"না।"

-"উপরের ঠোঁটটায় কি....."

মুগ্ধ তিতিরের মুখ চেপে ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

-"শোন পাগলী! আমি কখনো কাউকে এভাবে আদর করিনি। যতটা ভালবাসলে এভাবে আদর করা যায় ততটা ভাল শুধু তোকেই বেসেছি। আর তোর পরেও আমি অন্য কোনো মেয়েকে স্পর্শ করবো না। মাথায় কিছু ঢুকেছে?"

তিতির মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-"উফফফ, বাঁচালে!"

তিতিরের পাগলামি দেখে মুগ্ধর নিজেরই মাথা ঘুরছিল। ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল মুগ্ধ। একসময় ঘুমিয়েও পড়লো তিতির। হয়তো কাল ঘুম থেকে উঠে তিতিরের কিছুই মনে থাকবে না। কিন্তু মুগ্ধর জীবনে তিতিরের সাথে বিয়ে, সংসার আরো আরো যতকিছুই হোক না কেন আজকের এই স্পেশাল রাতটা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে!

To be continued.

প্রেমাতাল -  পর্ব ৩২

মৌরি মরিয়ম

সেই পাগলী তিতির আর আজকের তিতিরের মধ্যে অনেক পার্থক্য। ৪ বছর পর্যন্ত সত্যি কোনো পার্থক্য ছিল না। গত সাত মাসে যেন হঠাৎই বড় হয়ে গেল।

তিতির ডানদিকে কাত হয়ে নিজের হাতের উপর মাথা শুয়ে আছে। এই বিছানায় ওর বউ হয়ে শোবার কথা ছিল, আর আজ অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছে। ভাগ্যে বিশ্বাসী ছিলনা মুগ্ধ। তাই বোধহয় ভাগ্যবিধাতা বুঝিয়ে দিল তিনি চাইলে কি থেকে কি হয়ে যেতে পারে।

৭ মাস আগে তিতির না, মুগ্ধ শুয়ে ছিল এখানে। কপালে তিতিরের হাতের স্পর্শ পেতেই চোখ খুলে ওকে দেখতে পেয়েছিল মুগ্ধ। আজকালও খানিকটা এরকম ব্যাপার ঘটে, ও কপালে স্পর্শ পায় কিন্তু চোখ খুললেই বুঝতে পারে সবটা স্বপ্ন ছিল। সেদিন চোখ খুলে দেখছিল সবুজ পাড়ের হালকা কলাপাতা রঙের শাড়ি পড়ে মাথার কাছে বসে আছে তিতির। চুলগুলো খোলা। আহ কি অপূর্ব লাগছে। কোনো অকেশন ছাড়া শাড়ি পড়লে বুঝতে হবে কোন সুখবর আছে। তাই বুঝেই মুগ্ধ তিতিরের হাতটা কপালের উপর থেকে সরিয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে বলল,

প্রেমাতাল - সকল পর্ব

-"আমার বউটা আজ কি সুখবর দেবে?"

তিতির হাতটা ছাড়িয়ে নিচ্ছিল। মুগ্ধ ছাড়ছিল না। উলটো দুলাইন গান শুনিয়ে দিল,

"ছেড়োনা ছেড়োনা হাত

দেবোনা দেবোনা গো যেতে

থাকো আমার পাশে..."

তিতির বলল,

-"উফ কেন ছাড়ছি সেটাও তো বুঝতে হবে।"

মুগ্ধ ছাড়লো। তিতির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে উঁকি মারলো না কেউ নেই। দরজাটা আস্তে করে লাগিয়ে দিল। তারপর মুগ্ধর পাশে এসে শুয়ে পড়লো। মুগ্ধ তিতিরকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রাখলো। তিতির মুগ্ধর গালে হাত বুলিয়ে বলল,

-"অনেক বড় কোনো সুখবর দেব আজ। যা আগে কখনো দেয়নি। এর চেয়ে বড় সুখবর আর হতেই পারে না।"

-"হোয়াট? কিভাবে সম্ভব?"

-"তুমি বুঝতে পেরেছো আমি কিসের কথা বলছি?"

-"হ্যা, তুমি প্রেগন্যান্ট! এর চেয়ে বড় সুখবর আর কিছু হতে পারেনা কিন্তু কিভাবে সম্ভব। আমি তো কিছুই করিনি।"

তিতির ওকে সরিয়ে দিল,

-"ধ্যাত, মুডটাই নষ্ট করে দিলে।"

-"এই না না বলো বলো। দুষ্টুমি করছিলাম তো।"

তিতির তবু মুখ ঘুরিয়ে রইল। মুগ্ধ তিতিরের কান ধরে বলল,

-"এই কান ধরছি, সরি। এবার বলোনা কি হয়েছে?"

তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলো। তারপর বলল,

-"তোমার এই বিছানায় আমার জন্য পার্মানেন্টলি জায়গা করো। শিগগিরই আসছি।"

-"মানে কি? বিয়ের কথা বলছো?"

-"হ্যা... কাল বাসায় একটা প্রোপোজাল এসেছিল। বাবা ওটার কথা আমাকে বলতেই আমি তোমার কথা বাবাকে বলে দিয়েছি।"

মুগ্ধ লাফিয়ে উঠে বসলো। বলল,

-"আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছেন! তারপর কি হলো?"

তিতিরও উঠে বসেছে ততক্ষণে। বলল,

-"তারপর সব জিজ্ঞেস করলো তোমার ব্যাপারে আমি বললাম। তারপর মা আর ভাইয়া, ভাবীকে ডেকে সবটা বলল বাবা। সব শুনে বোধহয় সবারই পছন্দ হয়েছে। তাই বলেছে প্রোপোজাল পাঠাতে। উফ বিশ্বাস করো এত সহজে সবাই মেনে নেবে ভাবিনি।"

-"ওয়াও, গ্রেট!"

-"জানো, ভাইয়া তো হাসছিল আর বলছিল তুই এতদিন প্রেম করেছিস টেরই পাইনি। ছোটবেলায় তুই এত শান্ত থাকতি যে বাসায় কোনো বাচ্চা আছে বোঝা যেত না। সেরকমই হলো ব্যাপারটা।"

-"বাহ।"

-"হুম।"

মুগ্ধ তিতিরের কপালে চুমু দিয়ে বুকে টেনে নিল। তারপর বলল,

-"তিতির কি যে ভাল লাগছে তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। অবশেষে আমার এতদিনের অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে।"

তিতির হেসে বলল,

-"আর আমারও। এবার বাইরে চলো.. পিউ, স্নিগ্ধ সবাই বাসায়। আর তোমারও তো অফিসে যেতে হবে।"

-"ও হ্যা, তুমি যাও। আমি একবারে রেডি হয়ে বের হচ্ছি।"

পরের শুক্রবারই মুগ্ধ ফুল ফ্যামিলিসহ প্রোপোজাল নিয়ে গেল তিতিরের বাসায়। শুধু বাবা ছাড়া কারন, মুগ্ধর বাবা দুবছর আগে একটা অপারেশনে গিয়ে মারা যায়। কথাবার্তা বলে দুই ফ্যামিলিই দুই ফ্যামিলিকে পছন্দ করলো। মুগ্ধর মা চাইলো আগামী মাসের মধ্যেই বিয়ের কাজ সেড়ে ফেলতে তিতিরের বাবা-মাও রাজী হয়ে গেল। ডিনারও সেড়ে ফেলল। তারপর হঠাৎ তিতিরের বাবা বলল,

-"কীরে তান্না কখন আসবে? আজ ও বাইরে গেল কেন?"

ভাবী বলল,

-"বাবা, ওর বন্ধুর বাবা হঠাৎই মারা গেছে, তাই গিয়েছিল। চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। ও ঝিগাতলা পর্যন্ত চলে এসেছে, কথা হয়েছে।"

মুগ্ধর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো তান্না নামটা শুনে। তান্না! কোন তান্না? ৩/৪ বছর আগে যাকে মেরে এই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল সেই তান্নাই কি তিতিরের ভাই? সর্বনাশ! তাহলে তো সব শেষ। মুগ্ধ তরতর করে ঘামছিল। সেই তান্না যেন না হয়। সেই তান্নাই যদি হয় তাহলে সারাজীবনের জন্য ও হারাবে তিতিরকে। আল্লাহ কি এতটা নিষ্ঠুর হবে? হঠাৎ লাল শাড়ি পড়া তিতির এসে দাঁড়াল ওর পাশে। বলল,

-"তোমার কি হল? মুখটা এমন লাগছে কেন?"

-"নাহ, কিছুনা।"

তিতিরকে যে মুগ্ধ কি বলবে তা ও বুঝতে পারছিল না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তান্না চলে এল। ড্রইং রুমে ঢুকে কি অমায়িক ভঙ্গিতে মুগ্ধর মাকে সালাম দিয়ে বলল,

-"সরি আন্টি, আমি অনেক দেরী করে ফেললাম।"

তারপর মুগ্ধর দিকে চোখ পড়তেই তান্না দাঁড়িয়ে পড়লো, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ প্রাণপণে আল্লাহ কে ডাকছিল যেন এই মুহূর্তে ওর মৃত্যু হয়। কারন এরপরই যেভাবে তিতিরকে ওর জীবন থেকে কেড়ে নেয়া হবে তা ও সহ্য করতে পারবে না। শেষবারের মত তিতিরের হাসিমুখটা দেখে নিল। এরপর থেকে তো তিরিরের জীবন থেকে সবহাসি শেষ হয়ে যাবে।

চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই দিনটি। সেদিনও ছিল শুক্রবার। মুগ্ধ নিজের রুমে বসে তিতিরের সাথে ফোনে কথা বলছিল। হঠাৎই কলিং বেল বেজে উঠলো। মুগ্ধ পাত্তা দিল না, আবার বাজতেই তিতির বলল,

-"কি হলো? দরজা খুলছ না যে?"

-"আরে বাসায় তমাল, সম্রাট ওরা আছে। কেউ নিশ্চই খুলবে, অযথা আমি আমার বউকে রেখে দরজা খুলতে যাব?"

তিতির বলল,

-"যেন আমি কাছে আছি?"

এরপর পরপর কয়েকবার বেল বাজতেই মুগ্ধ বলল,

-"আচ্ছা, আমি পরে কল দিচ্ছি।"

-"হুম, ঠিকাছে।"

দরজা খুলতেই দেখলো ওদের বাসার বাড়িওয়ালার ছেলে মিথুন আর মিথুনের ফ্রেন্ড তান্না দাঁড়িয়ে। দুজনই মুগ্ধর চেয়ে দুএকবছরের ছোট। মুগ্ধ বলল,

-"আরে, তোমরা যে! এসো এসো।"

ভেতরে ঢুকেই মিথুন বলল,

-"মেহবুব ভাই, আপনারা বাসা নেয়ার সময় যে কন্ডিশনগুলো দেয়া হয়েছিল তা কি আপনারা ভুলে গেছেন?"

মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,

-"না তো ভুলব কেন? কি হয়েছে?"

-"একটু আগে আপনাদের ফ্ল্যাটে একটা মেয়ে ঢুকেছে।"

-"এটা হতেই পারে না। প্রথমত, কেউ মেয়ে নিয়ে আসবে না, দ্বিতীয়ত, আমি আজ সারাদিন বাসায় কেউ এলে আমি জানতাম।"

তান্না বলল,

-"ভাইয়া আমি যখন উঠছিলাম আমি নিজে দেখেছি।"

-"বলো কি!"

-"জ্বী।"

মুগ্ধ বলল,

-"আচ্ছা আমার কথা বিশ্বাস না হলে তোমরা বাসা সার্চ করতে পারো।"

মিথুন বলল,

-"তাই করতে হবে।"

মুগ্ধ বলল,

-"এসো।"

মিথুন বলল,

-"তান্না তুই যা, আমি দরজার সামনেই থাকি, যাতে এদিক দিয়ে পাচার করতে না পারে।"

মুগ্ধ তান্নাকে নিয়ে গেল। প্রথমে সম্রাটের রুমে ঢুকে দেখলো কেউ নেই। মুগ্ধ ভাবল, 'সম্রাট কি বাইরে গেল? কখন গেল? না বলেই গেল?'

এরপর মুগ্ধর রুম খুঁজে ওরা তমালের রুমে যেতে নিয়ে দেখলো দরজা ভেতর থেকে লাগানো। তান্না বলল,

-"কি বুঝলেন?"

মুগ্ধ দরজায় নক করলো,

-"তমাল? এই তমাল? দরজা খোল।"

কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তান্না কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিল। ততক্ষণে মিথুন চলে এসেছে তমালের দরজার সামনে। তারপর আরো কয়েকবার নক করার পর ভেতর থেকে দরজা খুলে বেড়িয়ে এল তমাল। পেছনে ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা একটা মেয়ে। মেয়েটাকে চিনতে কষ্ট হলোনা মুগ্ধর। তমালের গার্লফ্রেন্ড সুপ্তি। কিন্তু তমাল ওকে বাসায় নিয়ে আসার মত বোকামিটা কেন করলো? আর যদি আনেও মুগ্ধকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করল না? এতবড় মুখ করে বলা কথা এখন কোথায় যাবে মুগ্ধর! মিথুন বলল,

-"এই মেয়ে ব্যাচেলর বাসায় আসতে পারছো আর মুখ দেখাইতে শরম? ঘোমটা দিয়া তো ঘোমটার অসম্মান করলা! দেখি মুখ দেখাও।"

তমাল বলল,

-"ভাই আমার ভুল হয়ে গেছে, ওকে ছেড়ে দেন। আমাকে যা বলার বলেন।"

তান্না বলল,

-"শালার চোরের মার বড় গলা।"

তারপর মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,

-"এইযে, মেহবুব ভাই।এইবার কি বলবেন? খুব তো বলসিলেন মেয়ে আনেন না বাসায়। এটা কি বের হলো রুম থেকে?"

মুগ্ধ কিছু বলার আগেই মিথুন বলল,

-"আরে এগুলা মেয়ে নাকি সস্তা ** কতগুলা।"

মুগ্ধ বলল,

-"এবার বেশিবেশি হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটাকে যেতে দাও। বাকীটা আমরা বুঝে নিচ্ছি।"

মুগ্ধ জানে সুপ্তি এলাকারই মেয়ে। ওর মুখটা কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হবে। মিথুন বলল,

-"আপনাদের সাথে তো বুঝবো আসল বোঝা। আগে এই **টার সাথে বুঝে নেই।"

সুপ্তির গায়ে ধাক্কা মেরে বলল,

-"চুলকানি বেশি না? তাই ব্যাচেলর বাসায় আসো?"

একথা শুনেই তমাল মিথুনের মুখে একটা ঘুষি বসিয়ে দিল। সেই ফাঁকে মুগ্ধ সুপ্তিকে ফ্ল্যাট থেকে বের করে দিল। সুপ্তি দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। তান্না দৌড়ে ধরতে চাইল, মুগ্ধ ওকে ধরে আটকে রাখলো। তান্না বলল,

-"মিথুন তরে আমি কইসিলাম সবগুলার গুরু এইটা। দেখ মেয়েটারে কেম্নে বাইর কইরা দিল।"

মিথুন তখন ব্যস্ত ছিল তমালের ঘুষির জবাব দিতে। মুগ্ধ বলল,

-"তোমরা যা ইচ্ছা ভাবতে পারো কিন্তু ও একটা মেয়ে, ভুল করে ফেলেছে হয়তো একটা। তাই বলে ওকে এভাবে অপমান করাটাও ঠিক না। ও তো তোমার আমার মতই কারোর বোন তাই না?"

মিথুন উঠে এসে মুগ্ধর কলার ধরলো। তান্না বলে উঠলো,

-"শালা বানী দেয়া বন্ধ কর। তোর এত লাগে ক্যান? সব একেই চক্র না? তোর গার্লফ্রেন্ড ও নিশ্চই আসে! আসে দেখেই বন্ধুর টারে সাপোর্ট দিচ্ছিস যাতে তুই ধরা খাইলে বন্ধু সাপোর্ট দেয়। সবগুলা **বাজ।"

মুগ্ধ বলল,

-"তান্না মুখ সামলে কথা বলো। আমার গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে আরেকটা কথা বলার সাহস দেখিওনা। তাহলে কপালে দুর্ভোগ আছে।"

তান্না বলল,

-"ক্যান তোর গার্লফ্রেন্ডের রেট কি দুইটাকা বেশি নাকি?"

এরপর মুগ্ধ আর ধরে রাখতে পারেনি নিজেকে। উন্মাদের মত মেরেছিল সেদিন তান্নাকে। কোনো হুঁশজ্ঞান ছিল না। মিথুন শত চেষ্টা করেও থামাতে পারেনি। মার খেয়ে তান্না দৌড়ে সিঁড়িতে চলে গেল নামার জন্য। মুগ্ধও দৌড় দিয়ে ধরে ফেলেছিল। মারতে মারতে নামিয়েছিল সিঁড়ি দিয়ে। পুরো সিঁড়ি রক্তে মেখে গিয়েছিল। তারপর রাস্তায় ফেলে কি মারটাই না মেরেছিল মুগ্ধ ওকে। সাথে মুগ্ধ শুরু করেছিল বাপ মা তুলে কি অকথ্য ভাষায় গালাগালি! রাস্তায় মানুষের ভীর হয়ে গিয়েছিল। একজন থামাতে যেতেই মুগ্ধ তাকে এমনভাবে ধাক্কা দিয়েছিল যে তা দেখে কেউ আর আগানোর সাহস করেনি। তারপর একসময় মার খেতে খেতে যখন তান্না অজ্ঞান হয়ে যায় তখন ওকে ছাড়ে মুগ্ধ।

To be continued...

প্রেমাতাল - পর্ব ৩৩

মৌরি মরিয়ম

হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠতেই মুগ্ধর ভাবনায় লাগাম পড়লো। উঠে গিয়ে দরজা খুলল, মা এসেছে। ভেতরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলো,

-"তিতির কোথায়?"

-"আমার ঘরে।"

মা সোজা মুগ্ধর ঘরে চলে গেল। মুগ্ধ দরজা লাগিয়ে ঘরে ঢুকতেই মা বলল,

-"একি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার!"

মা বিছানায় তিতিরের পাশে বসেছে। মুগ্ধ চেয়ার টেনে বসে বলল,

-"তুমি জানলে কিভাবে যে ও এসেছে?"

-"পিউ ফোন করেছিল।"

-"ও।"

মা আবার বলল,

-"মেয়েটার চোখদুটো গর্তে ঢুকে গেছে। চেহারার মাধুর্যটাই চলে গেছে। ডাকাত ফ্যামিলি একটা।"

-"বাদ দাও না মা।"

-"কেন বাদ দিব? ওর ওই ডাকাত ফ্যামিলির জন্যই আজ আমার সংসারে কোন শান্তি নেই, সুখ নেই, আনন্দ নেই। যতটুকু ছিল তাও শেষ করে দিয়েছে। এতদিনে তোর বউ এসে নাতি নাতনীতে ঘর ভরে যাওয়ার কথা ছিল। ওর জন্য বিয়ে করলি না। ৪ বছর অপেক্ষা করলি ওর স্টাডির জন্য। লাভ কি হলো? উলটো অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হলো। এখনও বিয়ে করছিস না। বয়স চলে যাচ্ছে। তুই শুধু শুধুই ওর জন্য অপেক্ষা করছিস। দুনিয়া উলটে গেলেও ওর ফ্যামিলি কোনদিনও মানবে না। আর ও পারবেও না ওর ফ্যামিলি ছেড়ে আসতে।"

-"মা এখন কি এসব কথা বলার সময়?"

-"অবশ্যই। ইভেন এখনই পারফেক্ট সময়। দেখ ওর অবস্থা, এসব দেখেও যে ফ্যামিলি ইগো নিয়ে বসে থাকতে পারে তারা বিবেকহীন। তাই ওর আশা এবার চিরদিনের জন্য ছেড়ে দে। তুই বুদ্ধিমান ছেলে, জানি এর বেশি কিছু আর তোকে বলতে হবেনা।"

মুগ্ধ চুপ, মা এবার প্রসঙ্গ পালটালো,

-"ওকে নাকি ঘুমের ওষুধ দিয়েছে?"

-"ঘুমের ইঞ্জেকশান।"

-"তাহলে? বাসায় যাবে কি করে? দেখ তুই ওকে বাসায় এনেছিস এটা নিয়ে না ওর ভাই আবার ঝামেলা করে।"

-"না মা। ডাক্তার বলে দিয়েছে জাস্ট ৩/৪ ঘন্টা ঘুমাবে। তারপরও না উঠলে ডেকে উঠিয়ে দিয়ে আসব।"

মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

-"এর চেয়ে অনেক ভাল হত ইকরা কে যদি বিয়ে করতি। এসব আমার আর ভাল লাগেনা।"

-"মা ইকরাকে আমি পছন্দ করিনা।"

-"যাকে পছন্দ করো তার কাছে তো তোমার ভালবাসার দাম নেই। তাই যে তোমাকে পছন্দ করে তাকেই তোমার বিয়ে করা উচিৎ। ইকরার মত লক্ষী মেয়ে কতটা চায় তোকে! ও তোর বউ হলে সারাজীবন তোর পায়ের কাছে পড়ে থাকতো।"

-"বউ কি পায়ের কাছে পড়ে থাকার মত জিনিস মা?"

মা মেজাজ খারাপ করে তাকিয়ে রইল। মুগ্ধ বলল,

-"তিতিরের কাছে আমার ভালবাসার দাম নেই এটাও তুমি ভুল বলেছ মা।"

-"হ্যা দাম আছে কিন্তু ওর কাছে ওর ওই ডাকাত ফ্যামিলির ভালবাসার দাম তার চেয়েও বেশি।"

-"সেটাই কি স্বাভাবিক না?"

-"না স্বাভাবিক না, আমি যে ফ্যামিলি ছেড়ে তোর বাপের সাথে চলে এসেছিলাম, তার মানে কি এই যে আমি আমার ফ্যামিলিকে ভালবাসতাম না?"

-"তা বলিনি মা, সবার তো আর সেই সাহস টা থাকে না।"

-"শোন মুগ্ধ, বিয়ে করে ফেললে সব ফ্যামিলিই একসময় মেনে নেয়। আমাদের ফ্যামিলি কি মানেনি? তুই হওয়ার পর মেনেছে কিন্তু মেনেছিল ঠিকই। তিতির যদি চলে আসতো তোকে বিয়ে করতো ওর ফ্যামিলিও এক সময় মেনে নিতো।"

-"মা তোমাদের সময়ে পালিয়ে বিয়ে করার একটা ট্রেন্ড ছিল। যা এখন নেই।"

কতক্ষণ রক্তচক্ষু নিয়ে মা তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল,

-"যা ইচ্ছে কর, এত মানুষ মরে আমি মরি না কেন কে জানে।"

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিতিরের দিকে তাকালো মুগ্ধ। মায়ের উপর রাগ হচ্ছে না মুগ্ধর। হচ্ছে না তিতিরের উপরেও। দুজনই হয়তো তাদের যার যার যায়গা থেকে ঠিক। শুধু মুগ্ধই ভাঙা সেতুর রেলিং ধরে ঝুলে আছে।

সেদিন তান্না খুব স্বাভাবিকভাবে মুগ্ধর সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল হ্যান্ডশেক করার জন্য। তিতিরের বাবা বলেছিল,

-"এই আমার ছেলে।"

মুগ্ধ হ্যান্ডশেক করলো। তান্না বলল,

-"বাবা পরিচয় করাতে হবে না, উনি আমাকে ভালভাবেই চেনেন।"

তিতির বলে উঠলো,

-"তোমরা একে অপরকে চেনো?"

তান্না বলল,

-"হ্যা, চিনি। খুব ভালভাবেই চিনি। তো ভাইয়া, আপনি আমার বোন কে বিয়ে করতে চান? সত্যি আমি অবাক! কেন আপনার সেই গার্লফ্রেন্ডের খবর কি?"

সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে ওদের দুজনকে। মুগ্ধ এতটা ভয় আগে কোনদিন, কোনো সিচুয়েশনে, কাউকে পায়নি যতটা ভয় পাচ্ছে আজ তান্না কে। খুব অসহায় লাগছে। কোনরকমে বলল,

-"তখনও তিতিরই আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল।"

তান্না বলল,

-"রিয়েলি? গল্পটা বেশ।"

তিতিরের বাবা এতক্ষণে কথা বলল,

-"ব্যাপারটা কি কিছুই তো বুঝতে পারছি না। তান্না তুই ওকে কিভাবে চিনিস?"

-"বাবা উনিই মেহবুব। মিথুনদের বাসার দোতলায় থাকতো। বুঝতে পেরেছো কার কথা বলছি?"

বাবা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধর সত্যিই সেই মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। বাবা মুগ্ধর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল,

-"তিতির আংটিটা ফেরত দিয়ে দাও।"

তিতির অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। বুঝতে পারছিল না কি হচ্ছে! মুগ্ধর মা বলল,

-"কেন ভাই? কি হয়েছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ওদের পরিচিত হওয়ার সাথে তিতিরের আংটি খুলে ফেলার কি সম্পর্ক রয়েছে?"

তিতিরের বাবা বলল,

-"এ বিয়ে সম্ভব নয়। আমি কোনো গুন্ডা ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেবনা।"

তিতির কিচ্ছু বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে! কিন্তু এটা বুঝতে পারছে সমস্যা বিরাট কিছু কারন মুগ্ধ প্রচন্ড নার্ভাস। মুগ্ধকে খুব কঠিন সময়েও নার্ভাস হতে দেখেনি তিতির। তাই ভয়ে তিতির আর কোনো কথা বলতে পারছিল না। কিন্তু যা দেখছে তাতে বুক ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসতে লাগলো। চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি পড়ছে, মুখে আঁচল চেপে ধরে আছে তিতির। মুগ্ধর মা বলল,

-"গুন্ডা মানে? আমার ছেলেকে গুন্ডা কেন বলছেন? ও কি করেছে?"

-"আন্টি সেসব কথা বাচ্চাকাচ্চা আর মুরুব্বিদের সামনে আমি মুখে আনতে পারবো না। তাই ভাল হয় আপনি মেহবুব ভাইয়ার কাছ থেকেই এসব জেনে নিয়েন। উনি সত্যি ঘটনাটাই বলুক আর রঙচঙ মিশিয়েই বলুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না।"

তিতিরের বাবা হাতজোড় করে বলল,

-"মাফ করবেন, এ বিয়ে সম্ভব না। আপনারা এখন আসতে পারেন।"

একথা শুনে মুগ্ধর কি যে হলো সাথে সাথে তিতিরের বাবার সামনে দুই হাটু মুড়ে বসে পা ধরে বলল,

-"অাঙ্কেল, একথা বলবেন না প্লিজ। আমি যা করেছিলাম ভুল করেছিলাম। আজ আপনার পা ধরে ক্ষমা চাচ্ছি আমাকে প্লিজ ক্ষমা করুন।"

তিতিরের বাবা আর একটি কথাও না বলে চলে গেল নিজের ঘরে। পেছন পেছন তিতিরের মাও গেল। বাবার পাশেই তান্না দাঁড়িয়ে ছিল। মুগ্ধ তান্নার পা ধরে বলল,

-"তান্না তুমি আমার ছোটই হবে তবু যে হাতে তোমাকে মেরেছিলাম সে হাতেই আজ তোমার পা ধরে ক্ষমা চাইছি। প্লিজ ক্ষমা করো, তিতিরকে আমার থেকে আলাদা করোনা।"

এই দৃশ্য দেখে পিউয়ের চোখে পানি এসে গেল। স্নিগ্ধ্বও তাকিয়ে ছিল অবাক হয়ে। এটা কি ওদেরই বড়ভাই? যে কোনদিন কারো সামনে মাথা নিচু করেনি সে আজ একজনের পর একজনের পা ধরে মাফ চেয়ে যাচ্ছে!

তান্না সরে গিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিয়ে বলল,

-"নিচে দারোয়ানকে বললে গেট খুলে দেবে।"

তখনও মুগ্ধ ফ্লোরে বসা। ওর মা ওকে তুলে বলল,

-"চল।"

মুগ্ধ নির্বিকার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো। মুগ্ধ,পিউ,স্নিগ

্ধকে নিয়ে ওদের মা তিতিরদের বাসা থেকে বেড়িয়ে এল। বের হওয়ার আগে একবার মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকালো। তিতির ওর ভাবীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আর কোনদিন মুগ্ধ তিতিরের চোখের জল মুছে দিতে পারবে না। ওর আজকের এই যত্ন করে পড়া লাল শাড়ি, চোখের কাজল সব মিথ্যে হয়ে গেল।

মুগ্ধ খুব ভেঙে পড়েছিল। পিউ, স্নিগ্ধ, মা সবার মনেই কৌতূহল ছিল আসলে কি এমন হয়েছিল তান্না আর মুগ্ধর মধ্যে? মা জিজ্ঞেস করতেই মুগ্ধ পুরো ঘটনাটা বলল। মা বলল,

-"ওদের আশা তাহলে ছেড়ে দে। তিতিরকে বল একদম খালি হাতে চলে আসতে।"

ওদিকে ওরা চলে যাওয়ার পর তান্না গিয়ে বাবার ঘরে ঢুকলো। তিতির ভাবীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। তান্নাকে বাবার ঘরে যেতে দেখে তিতিরও গেল। আসল ঘটনাটা কি সেটা ওর জানতেই হবে। ঘরের দরজায় পা রাখার আগেই তিতির শুনতে পেল তান্না বাবা-মাকে বলছে,

-"তিতির হয়তো কান্নাকাটি করবে তোমরা আবার গলে যেওনা।"

-"তান্না এসব কিছুই আমাকে বলতে হবে না। আমার খুব ভালভাবেই মনে আছে তুই এক সপ্তাহ হসপিটালে ছিলি। কয়েক মাস লেগেছিল সুস্থ্য হতে।

-"ওই ছেলে যদি ভাল হতো আমাকে মারার জন্য ওদের বিয়ে আটকে থাকতো না বাবা। ও একটা ক্যারেক্টারলেস। ব্যাচেলর ফ্ল্যাটে মেয়ে নিয়ে আসতো ভাড়া করে। চিন্তা করো একবার। আর আমাকে মারার সময় কি বাজে বাজে গালি যে দিচ্ছিল বাবা তার একটাও যদি তিতির শোনে ও ঘৃনায় মরে যাবে। আমার নাকি কোন জন্মের পরিচয় নেই, মাকে নিয়ে কতটা বাজে কথা বলেছিল বাবা আমি কিছুই ভুলিনি! তার সাথে আমি আমার বোনের বিয়ে তো কিছুতেই মানব না বাবা।"

তিতির বিস্ময়ে আঁচলে মুখ চেপে ধরে ছিল তান্নার কথা শুনে। মুগ্ধ ভাড়া করে মেয়ে নিয়ে আসতো! অসম্ভব.. তিতির চেনে মুগ্ধকে। মুগ্ধ কখনোই ওরকম না। কিন্তু মার আর গালাগাল! সেটা তো তিতির নিজেই চোখেই দেখেছে কতবার! তবু সবটা জানতে হবে। বাবা-ভাইকে পরে ফেস করবে। আগে পুরোটা মুগ্ধর কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। তিতির নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর ফোন করলো মুগ্ধকে। ওপাশ থেকে ভেসে এল,

"আপনার ডায়ালকৃত নামারটি এখন বন্ধ আছে। দয়া করে আবার চেষ্টা করুন।"

তিতির অবাক হলো, মুগ্ধর মোবাইল তো কখনো বন্ধ থাকেনা। আজ তবে বন্ধ কেন? চোখে পানি যেন আজ আটছেই না। উপচে উপচে পড়ছে।

To be continued...

প্রেমাতাল - পর্ব ৩৪

মৌরি মরিয়ম

কাঁদতে কাঁদতে তিতিরের নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিল। বার বার মনে একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল যে, মুগ্ধকে আর ও পাবেনা। আর ঠিক তখনই ওর চোখে ভেসে উঠছিল মুগ্ধর সাথে কাটানো দিনগুলো, ওদের সব স্পেশাল মুহূর্তগুলো! কত স্বপ্ন, কত প্ল্যানিং, কত কথা দেয়া নেয়া সব এভাবে শেষ হয়ে যাবে? এসব ভাবনার অবসান ঘটালো একটি ফোনকল। রিংটোন শুনে তাকাতেই তিতির দেখলো স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে, Mugdho is calling..

লাফিয়ে উঠে ফোন ধরলো তিতির। মুগ্ধর গলায় হ্যালো শুনতেই কান্নাটা আরো বেড়ে গেল। মুগ্ধ বলল,

-"আরে পাগলী এত কাঁদছ কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে।"

তিতির কাঁদতে কাঁদতেই বলল,

-"আই লাভ ইউ।"

-"আই লাভ ইউ টু মাই তিতিরপাখি।"

-"তোমার সাথে থাকতে না পারলে আমি মরে যাব। প্লিজ কিছু একটা করো। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।"

-"হ্যা, অবশ্যই করবো। তুমি আর কান্না করোনা প্লিজ। দেখো সব ঠিক করে দেব।"

-"জানো কতবার তোমাকে ফোন করেছি! কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ ছিল।"

-"হ্য ফোন আছাড় মেরেছিলাম, ভেঙে গেছে, পিউ কুড়িয়ে দিয়েছে অবশ্য কিন্তু অন হচ্ছিল না। অথচ তোমার খোঁজটাও নিতে পারিনি তাই আগের ফোনটা আলমারির চিপা থেকে খুঁজে বের করেছি। যাই হোক তোমার বাসার পরিস্থিতি কি? তান্না তোমাকে স্পিচ দিয়ে দিয়েছে না একটা আমার বিরুদ্ধে?"

-"না, আমি তখনই ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়েছি। কিন্তু তুমি ফোন কেন ভেঙেছো?"

-"আরে ইকরা**টা ফোন করে পিঞ্চ করছিল তোমাদের বাসা থেকে আমাকে রিজেক্ট করেছে সেটা নিয়ে। আমি তো ওর ফোন ধরিনা। তাই আননোন নাম্বার থেকে ফোন করেছে, বোঝো কি পরিমাণ বেয়াদব একটা।"

-"ছিঃ প্লিজ তুমি স্ল্যাং ইউজ করোনা তো।"

-"আমি তো এমনই, খারাপ।"

-"উফ, আজাইরা কথা বলোনা। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না ইকরা আপু এত তাড়াতাড়ি জানলো কি করে?"

-"কিভাবে আবার মা বলেছে। মাঝে মাঝে মা যা করে।"

এতক্ষণে তিতিরের কান্না থেমে এসেছে। বলল,

-"মায়ের উপর কখনো রাগ করোনা। মা তো একটু সহজ সরলই। দুনিয়ার কোন প্যাঁচই বোঝেনা।"

-"না, মায়ের উপর রাগ করিনি।"

-"আচ্ছা, এবার আমাকে বলোতো তোমার আর ভাইয়ার মধ্যে কি হয়েছিল?"

মুগ্ধ কোনো ভনিতা না করে সব বলল। যা ঘটেছিল তার এক বর্ণও চেঞ্জ বা লুকায়নি। উলটো তান্না কি কি বলেছিল আর ও কিভাবে মেরেছিল কি কি গালি দিয়েছিল তার সবটা বলল। মুগ্ধ যতক্ষণ বলছিল তিতির ততক্ষণ একটা কথাও বলেনি। মুগ্ধর বলা শেষ তখনো তিতির চুপ করে রইলো। তারপর মুগ্ধ বলল,

-"তিতির? চুপ করে আছো কেন? কিছু তো বলো।"

তিতির এখন আর মোটেও কাঁদছে না। রাগ হচ্ছে। মুগ্ধর উপরও যেমন রাগ হচ্ছে, ওর ভাইয়ের উপরও রাগ হচ্ছে। বলল,

-"আমাকে ভুলে যাও।"

-"মানে? তিতির আমি জানি আমি যা করেছিলাম ঠিক করিনি কিন্তু তোমার ভাই যেটা করেছিল সেটাও কিন্তু ঠিক করেনি। তুমি এরকম কথা বলোনা তিতির। এতবড় শাস্তি আমাকে দিওনা।"

-"আমি কিছুই করছি না। এতকিছু যখন ঘটে গেছে আমার ফ্যামিলি কখনোই রাজী হবেনা তাই বললাম আমাকে ভুলে যাও।"

-"সব ফ্যামিলি এরকম বলে। আমরা বোঝাব তিতির। দেখো বোঝালে ঠিকই বুঝবে।"

-"কি বুঝবে বলো? তুমি আমার ভাইকে কিসব গালি দিয়েছো চিন্তা করে দেখো একবার।"

-"তিতির রাগ উঠলে যখন মানুষ গালি দেয় তখন এতকিছু মিন করে দেয়না, মুখে যা আসে তাই বলে গালি দেয়।"

-"তুমি আমার ভাইয়ের জন্ম পরিচয় নিয়ে কথা বলেছো। আমার মা কে নিয়ে বাজে কথা বলেছো তোমার মনে হয় এরপরেও আমার বাবা, আমার ভাই তোমার সাথে আমার বিয়ে দেবে?"

-"আমি কি জানতাম তান্না তোমার ভাই? সবসময় তো ভাইয়া ভাইয়া বলেছো। একদিনও নামটা বলেছো?"

-"মারামারি আর গালাগালি তোমার স্বভাব। রাগ কন্ট্রোলের আর যেন কোনো উপায় নেই তোমার। আমি তো আগেও কতবার দেখেছি।"

-"তোমাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে আমার সহ্য হয়না।"

-"বাহ! ভাল তো। কি বীরপুরুষ আমার।"

-"তিতির, তোমার ভাই যে তোমার রেট জিজ্ঞেস করেছে তাতে কি ওর কোনো দোষ নেই? তুমি তো ওর নিজের বোন।"

-"ও যদি এটা বলেও থাকে তো জানতো না যে ও ওর বোনের সম্পর্কে বলছে।"

-"ভাইয়ের বেলায় এখন 'যদি' বলছ? তার মানে আমাকে বিশ্বাস হচ্ছে না? আর হবেই বা কিভাবে! তোমার ভাইয়ের যা এক্টিং দেখলাম আজ। বলে কিনা বাচ্চাকাচ্চা আর মুরুব্বিদের সামনে বলতে পারবে না কি হয়েছে! আরে ও তো দুমুখো সাপ ওর মুখ কি সোনা দিয়ে বান্ধানো নাকি! যে ওর মুখ দিয়ে ভাল কথা ছড়াবে! -"মুখটাকে একটু সামলাও।"

-"তোমার ভাই বুচ্ছো বাসার মধ্যে ভেজাবিড়াল হয়ে থাকে। সেটা নিশ্চই ফ্যামিলিতে গুডবয় হয়ে থাকার জন্য?"

-"দেখা তিতির, আমি সত্যি জানতাম না যে ও তোমার ভাই। কিন্তু বিশ্বাস করো ও শুরু না করলে আমিও ওকে কিছুই বলতাম না।"

-"নাইবা জানলে, তুমি না সবসময় সবাইকে বলো একটা মেয়েকে বাজে কথা বলার আগে ভাবা উচিৎ সেও তোমার বোনেরই মত কারো বোন। তাহলে কারো মাকে নিয়ে বলার আগে এটা ভাবলে না সেও কারো মা।"

-"দেখো আমি তো চাইলে তান্নাকে গালাগাল করার ব্যাপারটা তোমার কাছে গোপন করতে পারতাম। আমিতো করিনি তিতির। পুরোটাই বলেছি তোমাকে। আর প্লিজ আল্লাহর দোহাই লাগে তিতির, একটু বোঝো.. কাউকে কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দেয়ার মানে এটা না যে তার মা কুত্তা। মানে হলো গিয়ে সে একটা বাবু কুত্তা। তেমনি অন্য গালিগুলোও অমনই।"

এভাবেই অনেক তর্কাতর্কি হয়েছিল সেদিন। অনেক রাতে ভাইয়া দরজায় নক করলো। অনেকবার নক করার পর তিতির দরজা খুলল। বাবা-মা, ভাইয়া দরজায় দাঁড়িয়ে। ভেতরে ঢুকেই তিতিরের মা বলল,

-"তিতির, ওই ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হওয়া কখনো সম্ভব না। তোমার কি কিছু বলার আছে?"

তিতির দেখলো বাবা ওর দিকে তাকাচ্ছে না। রুমে ঢুকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তান্নাও কোনো কথা বলছে না।

-"মা, তোমরা ওকে যেমন ভাবছ ও তেমন নয়। ওই ঘটনাটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। আমি ওকে চার বছর ধরে চিনি। ও আসলে খারাপ না। আমার সম্পর্কে কেউ কোন আজেবাজে কথা বললেই শুধু রেগে যায় ও। তখন রাগারাগি, গালাগালিটা ওর চলে আসে। সবার তো আর ১০০% ভাল দিক থাকে না।"

মা অবাক হয়ে বলল,

-"এতকিছুর পরেও একথা বলছিস? মা, ভাইয়ের সম্মানের কোন দাম নেই তোর কাছে?"

তান্না বলল,

-"তোর মতামত জানতে চেয়েছিলাম।"

তিতির বলল,

-"আমি মুগ্ধকেই বিয়ে করবো। ও ভাল খারাপ যেমনই হোক না কেন ওর সাথে আমি হ্যাপি থাকবো।"

এতক্ষণে বাবা বলল,

-"তিতির তুমি যদি মনে করো তুমি এডাল্ট, তোমার নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত তুমি নিজেই নিতে পারবে তাহলে জেনে রাখো আমরা তোমার বাবা-মা, তোমাকে জন্ম দিয়েছি, লালনপালন করেছি, যত্ন করেছি, ভালবাসা দিয়েছি তাই তোমার উপর আমাদের অধিকার আছে। আমরা কোনোভাবেই তোমাকে আগুনে ফেলে দিতে পারব না। যাই হোক, আমরা কখনো এই ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দেব না। তারপরেও যদি করতে চাও তাহলে এ বাড়ি ছেড়ে চিরতরে চলে যাও। কখনো আর ফিরে আসবে না। তুমি ভুলে যেও তোমার বাবা মা আছে। আমরাও ভুলে যাব আমাদের একটা মেয়ে ছিল। সব সম্পর্ক সেদিনই শেষ হয়ে যাবে যেদিন তুমি ওর সাথে নতুন সম্পর্কে বাধা পড়বে।"

একথা বলে বাবা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। তান্নাও বলল,

-"রক্তের সম্পর্কের প্রতিদান, ছোটবোনকে ঘুম পাড়ানোর জন্য রাতের পর রাত জেগে কাধে নিয়ে হাটার প্রতিদান, অসুস্থ বোনের বিছানার পাশে বসে কাঁদার প্রতিদান, বোনের আবদার পূরণ করার জন্য দিনরাত এক করে বাবা-মাকে রাজী করানোর প্রতিদান, বোনের পরীক্ষার সময় অযথা জেগে থেকে বোনকে সঙ্গ দেয়ার প্রতিদান! সব প্রতিদানগুলো এতসুন্দর করে পাব ভাবিওনি কোনদিন। থ্যাংকস।"

একথা বলে ভাইয়া বের হয়ে গেল। ভাইয়ার চোখে পানি দেখে মা বলল,

-"আগে যদি জানতাম, তুই জন্মানোর পরই তোর মুখে বালিশচাপা দিয়ে মেরে ফেলতাম।"

তারপর মাও ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তিতির ফ্লোরে বসে পড়ে অঝর ধারায় কাঁদতে লাগলো।

To be continued...

প্রেমাতাল - পর্ব ৩৫

মৌরি মরিয়ম

প্রত্যেকটা মানুষই সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট স্টক নিয়ে পৃথিবীতে আসে। সেই স্টক শেষ হয়ে গেলে যেমন আর পাওয়া যাবে না তেমনি শেষ না হলেও মৃত্যুর আগে যেভাবেই হোক শেষ হতে হবে। তিতিরের সুখের স্টক শেষ বোধহয়। আর কষ্টের স্টকে তো হাতই পড়েনি এতদিন। ছোটবেলা থেকে কেঁদেছে অনেকবারই তবে সেটা শুধুই সুখে,আবেগে। আজ থেকে যে কষ্টের কান্না শুরু, বুঝতে অসুবিধা হলো না তিতিরের। এটাও বুঝতে পারছে মুগ্ধকে ও কখনোই পাবে না। তবু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবে।

মাঝরাতে আবার ফোন করলো মুগ্ধ। তিতির বলল,

-"ঘুমাওনি কেন? সকালে অফিস নেই?"

-"কাল শনিবার।"

-"ও হ্যা। খেয়াল ছিল না।"

-"তোমাকে বাসা থেকে এখনো কিছুই বলেনি?"

-"বলেছে।"

-"কি বলেছে?"

কে কি বলেছে সবটা মুগ্ধকে খুলে বলল তিতির। সব শুনে মুগ্ধ বলল,

-"সো নাও ইউ হ্যাভ জাস্ট 2 অপশনস টু পিক ওয়ান।"

তিতির চুপ করে রইল। মুগ্ধ বলল,

-"তো কি ডিসিশান নিলে?"

তিতির চুপ, মুগ্ধও কিছু বলল না.. সময় দিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিতির বলল,

-"তোমাকে বিয়ে করলে আমার ফ্যামিলি ছাড়তে হবে। সেটা তো পারব না আমি।"

-"জানতাম আমি।"

-"আমি তোমাকেও অনেক ভালবাসি কিন্তু বাবা-মা ছোটবেলা থেকে কত কষ্ট করেছে আমার জন্য তাদের আমি কষ্ট দিতে পারব না।"

-"হুম। কিন্তু তিতির তুমি যদি চলে আসো, আমরা বিয়ে করে ফেলি তারপর এক সময় তোমার ফ্যামিলি ঠিকই মেনে নেবে। এখন কষ্ট পেলেও তখন তো সব ঠিক হয়ে যাবে তাইনা?"

-"যারা পালিয়ে বিয়ে করে তাদের সবারই ফ্যামিলি এক সময় না এক সময় মেনে নেয়। তাই আমরা ভাবি সব ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু আসলে কি ঠিক হয়? কতটুকু ঠিক হয় বলো তো? বাবা-মায়ের মনে যে ক্ষতর সৃষ্টি হয় সেটা কি কখনো মিলিয়ে যায়? যায়না, হয়তো সন্তানের মুখ চেয়ে মেনে নেয় একসময়। কিন্তু ক্ষতটা ভেতরে রয়েই যায়।"

মুগ্ধ ভাবলো, বাহ তিতির বড় হয়ে গেছে! এই চিন্তাটা মুগ্ধর মাথায় আসা উচিৎ ছিল, কিন্তু আসেনি। আসলো তিতিরের মাথায়। তিতির ওকে চুপ থাকতে দেখে বলল,

-"কিছু বলো?"

-"আমার আর কিছু বলার নেই। যা ভাল মনে হয় করো।"

এভাবেই চলতে থাকলো, তখন প্রতিদিন ওদের কথা হত। কেমন আছো কি করোর পর ওদের কথা ফুরিয়ে যেত। তারপর শুধু শুধু কতক্ষণ ফোন কানের কাছে ধরে রেখে তারপর রেখে দিত। মুগ্ধ কোনো ফাজালামো করতে পারতো না। তিতিরও তেমন কথা খুঁজে পেত না। ওরা একসাথে থাকলেও ওদের জীবনে কোন সুখ ছিল না। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর কথায় কথায় হুট করে একদিন মুগ্ধ রেগে গিয়ে বলল,

-"যেইনা ফ্যামিলি তার জন্য আবার জান দিয়ে দিচ্ছে। আমার জীবনে আমি এত ফালতু ফ্যামিলি দেখিনি।"

তিতির অবাক হয়ে বলল,

-"কি বললে তুমি?"

-"যা বলেছি একদম ঠিক বলেছি। তোমার ফ্যামিলির কাছে নিজেদের ইগোর মূল্য সবচেয়ে বেশি। তোমার সুখ কিচ্ছু না।"

তিতির কিছু না বলে ফোন কেটে দিল। হঠাৎই পায়ের তলা থেকে একদল কীট যেন ঢুকে গেল পায়ের ভেতর। পা থেকে সমস্ত শিরা,উপশিরা বেয়ে বেয়ে রকেটের গতিতে বুকের মধ্যে উঠে এসে একটা মোচড় দিয়ে আবার বেয়ে বেয়ে উঠে গেল মাথায়। তারপর আবার একটা মোচড় দিয়ে পানির রূপ ধরে বেড়িয়ে এল চোখ দিয়ে! মুগ্ধ এভাবে কথা বলল ওর সাথে? তিতির জানে ওকে ছাড়া থাকতে মুগ্ধর কষ্ট হয়। ওর কি কষ্ট হয়না? এতবড় পৃথিবীতে একমাত্র মুগ্ধই তো ছিল ওকে বোঝার মানুষ। এখন সেও বুঝতে পারছে না!

মুগ্ধ সাথে সাথেই আবার কল দিল। কয়েকবার ধরলো না তিতির। কিন্তু মুগ্ধ একের পর এক কল করেই যাচ্ছে। অবশেষে না ধরে থাকতে পারলো না। তিতির ভেবেছিল মুগ্ধ সরি বলার জন্য ফোন করছে। কান্নাটা কোনভাবে থামিয়ে, চোখ মুছে ফোনটা ধরলো। মুগ্ধকে কিছুতেই বুঝতে দেয়া যাবে না যে ও কাঁদছিল। কিন্তু ফোন ধরতেই মুগ্ধ ঝাড়ি দিয়ে বলল,

-"কথা বলছি তার মধ্যে না বলে ফোন কাটলে কেন?"

-"এমনি।"

-"এমনি মানেটা কি? ফ্যামিলি তোমার একলারই আছে? আর কারো নেই?"

-"সবারই ফ্যামিলি আছে আর সবার ফ্যামিলির প্রতিই তাদের দূর্বলতা আছে। তাই আমার ফ্যামিলি নিয়ে আর আজেবাজে কথা বলোনা।"

-"কেন বলবো না? তোমার তোমার ভাই ইচ্ছেমত বাবা-মার ব্রেইন ওয়াশ করবে আর তারা কিছু যাচাই না করেই ওয়াশড হবে। তোমার ভাই তাদের ছেলে আর তুমি কি কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে যে তোমার দিকটা দেখবে না?"

-"তোমার সাথে কথা বলার আর কোন ইচ্ছে আমার নেই।"

-"তোমার সাথে কথা বলার জন্য লাগে আমি বসে আছি? ফোন রাখো!"

শেষের 'ফোন রাখো' টা মুগ্ধ প্রচন্ডভাবে ধমকে বলল। তিতির বলল,

-"তুমি রাখো।"

-"আর একটা কথা বললে তোমার ভাইরে আমি খুন করবো। এক্ষুনি ফোন রাখো।"

-"আমি ফোন দিয়েছি মনে হয়? তুমি ফোন দিয়েছো, তুমিই ফোন রাখবে।"

-"ধুর বা*।"

একথা বলেই ফোন রেখে দিল মুগ্ধ। আবার কান্নায় ভেসে গেল তিতির। আচ্ছা ঠিকাছে এই ব্যাবহার করলো তো মুগ্ধ? মনে থাকবে।

আশ্চর্যজনকভাবে তিন চারদিন চলে গেল অথচ মুগ্ধ একবারও ফোন করলো না। থাকতে না পেরে তিতিরই কল করলো। ওই নাহয় প্রথমে সরি বলবে। কিন্তু কল ঢুকছে না। তিতির অবাক হলো। অনেকবার ট্রাই করলো। কিন্তু কল ঢুকছেই না! ভাবীর রুমে গিয়ে ভাবীর ফোন থেকে কল করতেই কল ঢুকলো। এবং মুগ্ধ সেই কল রিসিভও করলো। কথা না বলে কেটে দিল তিতির। ভাবীকে বলল,

-"যদি কল ব্যাক করে তো বলবে নাম্বার টাইপ করতে গিয়ে ভুল করে ফেলেছিলে। পরে অপরিচিত গলা শুনে কেটে দিয়েছো।"

-"কে মুগ্ধ ভাইয়া?"

তিতির দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,

-"হ্যা।"

-"রাগারাগি হয়েছে?"

তিতির ম্লান হেসে বলল,

-"সব তো শেষই, এখন রাগারাগি হলেই কি আর না হলেই কি!"

ভাবী অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তিতির নিজের ঘরে চলে এল। তার মানে মুগ্ধ ওকে ব্লক করে রেখেছে। ফেসবুকে ঢুকলো ম্যাসেজ করার জন্য। কিন্তু মেসেজ গেল না। মুগ্ধ ওকে ফেসবুকেও ব্লক করে দিয়েছে! কতক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। ও পারে পিউ বা মা কে কল করতে। কিন্তু করবে না। কেন করবে? মুগ্ধ তো ইচ্ছে করেই সবকিছু থেকে ব্লল কিরেছে যাতে ওর সাথে আর কথা বলতে না হয়। ঠিকাছে মুগ্ধ পারলে ও অবশ্যই পারবে। তিতির সিদ্ধান্ত নিল কোনভাবেই আর মুগ্ধর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। যেদিন মুগ্ধ নিজ থেকে যোগাযোগ করবে সেদিন মুখ ঘুরিয়ে থাকবে, খুব কথা শুনিয়ে দেবে সেদিন।

সারাটা দিন মাস্টার্সের ক্লাস আর ফ্রেন্ডস নিয়ে ব্যস্ত থাকতো তিতির। কিন্তু রাতটা কাটতেই চাইতো না। একটা রাতও শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি তিতির। ঘুম তো আসতোই না, কোনভাবে ঘুমিয়ে পড়লেও দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যেত। আগে এত স্বপ্ন দেখতো না। ইদানিং বেড়েছে। মানুষের মন যত বেশি অশান্তিতে থাকে তত বেশি স্বপ্ন দেখে একথা বুঝি আসলেই সত্যি।

৫ মাস পর যেদিন মুগ্ধ ফোন করলো তিতিরকে কোনো কথাই শোনাতে পারেনি সেদিন ও। পারেনি কোনো অভিমান করতে, পারেনি আহ্লাদ করতে, এমনকি পারেনি ওর সামনে কাঁদতেও। যেন অনেক দূরের মানুষ। কঠিন হয়ে থাকতে পেরেছিল শুধু। সেদিন মুগ্ধ বলেছিল,

-"সরি তিতির, লাস্ট যেদিন আমাদের কথা হয়েছিল সেদিন আমি তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যাবহার করেছি।"

তিতির বলেছিল,

-"৫ মাস পর সরি ফিল করলে?"

-"নাহ, ২/৩ দিন পরেই সরি ফিল করেছিলাম কিন্তু ইচ্ছে করেই ফোন করিনি। তোমাকেও ব্লক করে রেখেছিলাম কারন যেহেতু দূরেই থাকতে হবে তাই অভ্যাস করছিলাম।"

-"বাহ ভালই তো। তা অভ্যাস ভেঙে ফোন করতে গেলে কেন?"

-"আসলে আমার মোবাইলে তোমার যে ছবিগুলো ছিল ওগুলো পিসিতে রেখে ডিলিট করে দিয়েছিলাম। যাতে সবসময় সামনে না পরে। সামনে পড়লেই তো দেখতে থাকি আর মায়া বাড়ে। নিজেকে কন্ট্রোলে রাখার জন্যই এসব করেছিলাম। আজ হঠাৎই তোমার একটা ছবি সামনে পড়লো। তারপর লোভ হলো অন্য ছবিগুলো দেখার, দেখলাম। তারপর লোভ আরো বাড়লো তোমার ভয়েস রেকর্ডিং গুলোও শুনলাম। তারপর তোমাকে লাইভ শোনার লোভ হলো। আর থাকতে না পেরে কল করলাম। এখন তোমাকে লাইভ দেখার লোভ হচ্ছে।"

-"এতদিন যখন কন্ট্রোলে রাখতে পেরেছো তো এখনো পারবে, বাকী জীবনটাও পারবে।"

-"হুম, কন্ট্রোল করার চেষ্টা করেছি, করতে তো আর পারলাম না। অনেক কষ্ট হয়েছে এই ৫ টা মাস। জানি তোমারও কষ্ট হয়েছে। অনেক কষ্ট দিয়েছি, ক্ষমা করো।"

-"না না একদম ঠিকই করেছো তুমি। ৫ মাস যে পারে সে সারাজীবনও পারবে।"

-"ওকে বাট, এটলিস্ট স্কাইপে তে আসো?"

তিতিরের বুক ফেটে কান্না পাচ্ছিল তখন কিন্তু কান্নাটা চেপে রাখলো। বড্ড অভিমান হলো। ইশ ৫ টা মাস একটা কথা না বলে থেকেছে আর এখন এসেছে চেহারা দেখতে! চিন্তা করলো বেঁচে থাকতে এ চেহারা আর দেখাবে না মুগ্ধকে। বলল,

-"না স্কাইপে তে আসতে পারবো না। ইন্টারনেট নেই।"

তারপর থেকে গত দুই মাসে মুগ্ধ অনেকবারই ফোন করেছে। প্রথম কয়েকবার ফোন ধরেনা তিতির, তারপর ঠিকই ধরে, না ধরে পারেনা। কিন্তু দুজনের কথাবার্তা যতক্ষণ হয় এধরণের কথাই হয়। তিতিরের অভিমানটা একসময় চলে যায় কিন্তু তবু শক্ত থাকে কারন ও জানে ওর ফ্যামিলি মানবে না। তাই আর জড়াতে চায় না। যত জড়াবে কষ্ট তত বাড়বে। মুগ্ধ জানে তিতির কেন এত স্ট্রং হয়ে থাকে, ও জানে তিতির যত কাটা কাটা কথাই বলুক না কেন ওর বুকের মধ্যে মুগ্ধর জন্য যে ভালবাসা ছিল তা আজও আছে। সেখানে অনেক বরফ জমিয়ে ফেলেছে মুগ্ধ, এখন গলাতেও হবে ওরই। তাই হাল ছাড়েনি।

সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। তিতির এখনো ওঠেনি। এরপর না গেলে ওর বাপ-ভাই খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেবে। তখন আরেক অসান্তি হবে। মুগ্ধ তিতিরের মাথার কাছে বসে চুলের ভেতর হাত বুলিয়ে ডাকলো,

-"তিতির? এই তিতির?"

তিতির উঁ করে নড়ে উঠলো। মুগ্ধ বলল,

-"উঠবে না?"

-"না।"

তিতিরের সেই ঘুমন্ত কন্ঠস্বর যা শুনলে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায় মুগ্ধর। ও তিতিরের মাথাটা বালিশ থেকে উঠিয়ে নিজের কোলে নিল। তারপর আবার ডাকলো,

-"ওঠো না বাবা, বাসায় যেতে হবে তো।"

-"না আজকে যাব না, তুমি টিকেট ক্যান্সেল করে দাও। আজও আমি তোমার আদর খাব।"

মুগ্ধর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। শরীরে কাঁপন ধরলো। অনেকদিন পর সেই পুরোনো অনুভূতি। যেন আবার ওরা কোথাও বেড়াতে গিয়েছে। তিতির ঘুমের মধ্যে আহ্লাদ করছে। মুগ্ধ তিতিরকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-"পাগলী, এত ভালবাসা লুকিয়ে কেন রাখো?"

কিন্তু তিতির তখনো ঘুমে। মুগ্ধ আরো কয়েকবার ডাকার পর চোখ মেলে তাকালো ওর দিকে। কয়েক সেকেন্ড পর লাফিয়ে উঠে সরে গেল তিতির। মুগ্ধ কিছু বলল না। তিতির ভাবতে লাগলো ও তো ছিল রাস্তায়! মুগ্ধর বাড়িতে এল কি করে? আর ওর বুকের উপরই বা পড়ে ছিল কেন? ইশ বুকটা ধকধক করছে। কতদিন পর মুগ্ধ ওর সামনে! মুগ্ধ বুঝতে পারলো বোধহয় তাই বলল,

-"তুমি রাস্তায় সেন্সলেস হয়ে পড়ে গিয়েছিলে। একটা ছেলে তোমার ফোনের ইমারজেন্সি কললিস্টে আমার নাম্বার পেয়ে আমাকে ফোন করে। তারপর আমি সেখান থেকে তোমাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাই, সেখানে তোমাকে ঘুমের ইঞ্জেকশান দেয়া হয়। তারপর আমি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি ঘুমানোর জন্য। ওই অবস্থায় তোমার বাসায় দিতে গেলে আমাকে ভেতরে ঢুকতে হতো। তখন তো আরেক গ্যাঞ্জাম লাগতো। তাই এখানে এনেছি।"

তিতিরের মনে পড়ে গেল। বলল,

-"কোন রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম?"

-"চেয়ারম্যান বাড়ি।"

-"চেয়ারম্যান বাড়ি কি করে আসলাম? আমি তো ছিলাম ধানমন্ডি। লেকের ধার ধরে হাটছিলাম।"

-"মানে কি? তুমি হাটতে হাটতে ধানমন্ডি থেকে বনানী এসেছো?"

তিতিরের মাথাটা ঝিমঝিম করছে। তিতির দুহাতে মাথা চেপে ধরলো। মুগ্ধ ওর হাত ধরে বলল,

-"কি হয়েছে? খারাপ লাগছে?"

তিতির বলল,

-"না ঠিকাছে।"

-"আগে কখনো এমন হয়েছে?"

-"নাহ। আর আমি বাসায় যাব, অনেক দেরী হয়ে গেছে।"

-"আচ্ছা, চলো। তার আগে একটু হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। ভাল লাগবে।"

হাতমুখ ধুয়ে বের হতেই তিতির দেখলো মুগ্ধর মা বসে আছে একটা ট্রে নিয়ে। ট্রে ভর্তি দুনিয়ার খাবার-দাবার। তিতিরকে দেখেই উনি উঠে এলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন,

-"ইশ, মা কি চেহারা করেছো? খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করোনা না?"

তিতির একটু হাসার চেষ্টা করল,

-"না না আন্টি খাই তো। আসলে বয়স বাড়ছে তো, আগের মত অত ছোট তো নেই।"

-"এহ আমার কাছে বয়সের কথা বলছো? বলোনা। এই অবস্থা কেন হয়েছে জানিনা ভাবছো? এত ভেঙে পড়োনা মা। তোমার ফ্যামিলি যখন মুগ্ধকে মেনে নেবেই না আর তুমিও যখন পারবে না ফ্যামিলি ছেড়ে আসতে তাহলে সেটাই বাস্তবতা ভেবে মেনে নাও। সুখী হবে।"

তিতির কিছু বলল না, মাথা নিচু করে রইলো। মা বলল,

-"এসো মা একটু ভাত খেয়ে নাও।"

-"নাহ, আন্টি আমি এখন খাব না।"

-"একটা মাইর দিব ধরে। আমি খাইয়ে দিচ্ছি তোমাকে। খাব না বললে তো হবে না।"

মুগ্ধর মা তারপর জোর করে খাইয়ে দিল তিতিরকে। মুগ্ধ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। মা বলল,

-"মুগ্ধ, তুইও তো খাসনি। একটু প্লেটে নিয়ে খেয়ে নে না বাবা।"

মুগ্ধ একটা প্লেটে অল্প একটু ভাত নিয়ে খেল। তারপর তিতিরকে নিয়ে বের হলো।

তিতির পাশে বসে আছে। মুগ্ধ ড্রাইভ করছে। মুগ্ধর নিজের গাড়ি। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় নিজেই ড্রাইভ করে যায়। তারপর ড্রাইভার গিয়ে গাড়ি নিয়ে আসে। মা,পিউ,স্নিগ্ধ ব্যবহার করে। সন্ধ্যায় ড্রাইভার আবার গাড়ি মুগ্ধর অফিসে দিয়ে আসে। মুগ্ধ ডাইভ করে ফেরে। প্রথমবার যখন মুগ্ধর প্রমোশন হয় তার পরপরই বাবা মারা যায়। লোন নিতে সাহস পায়নি তখন। পুরো ফ্যানিলির দায়িত্ব যে এখন ওর উপর! তারপরের বছর আবার প্রোমোশন হয় তখন মুগ্ধ কারলোন নিয়ে গাড়িটা কেনে। গাড়িতে বসতেই তিতিরের মনে পড়ে গেল এই গাড়িটা নিয়েও ভাইয়া কত কিছুই না বুঝিয়েছে বাবাকে। এত তারাতারি গাড়ি কিনলো কি করে? কি এমন চাকরী করে? নির্ঘাত অসৎ পথে আয় করেছে। বাপ পুলিশ ছিল না? ম্যাক্সিমাম পুলিশরাই তো দুই নাম্বার হয়। দুই নাম্বারের ছেলেও হয়েছে দুই নাম্বার। আঙ্কেলের মত অমন মানুষ সম্পর্কে ওসব কথা শুনে তিতির কান্না করে দিয়েছিল। নিজের ভাইকে বলতে ইচ্ছে করছিল, 'সবাই তোর মত দু'মুখো সাপ না। তোর যোগ্যতা নেই বলে তুই চাকরীতে উন্নতি করতে পারিসনি। বাপের টাকায় ফুটানি মারছিস। মুগ্ধর যোগ্যতা আছে তাই মুগ্ধ উন্নতি করতে পেরেছে।' কিন্তু বলতে পারেনি তিতির। ছোটবেলা থেকেই ও কখনো বাসায় কারো মুখের উপর কথা বলেনি। এখনো বলেনা তবু ওকে পদে পদে শুনতে হয় ও বেয়াদব। কারন ও ফ্যামিলির সবার সামনে দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাবে বলতে পারে, 'আমি মুগ্ধকে ভালবাসি।'

জ্যামে পড়লো ওরা। গাড়িতে ওঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত দুজনের একজনও কোন কথা বলেনি। মুগ্ধ একটা গান প্লে করলো,

"আমার আকাশ জুড়ে

বিশাল পাখির ডানা

তোমার ভেতর দিয়ে আমার আনাগোনা

তোমার ধমনীতে আতুর হয়ে যখন

চাঁদের আলোয় ভিজে সামিলে মন যখন

মাঝে মাঝে একা লাগে..

ভীষন সুখেও একা লাগে..

এ অসময়ে একা লাগে..

এ বালির পথ একা লাগে..

রাত পেড়িয়ে দিন আসে

দিন পেরিয়ে রাত

প্রত্যেকদিন বাড়ছে শুধুই এই অজুহাত।

তোমার ধমনীতে আতুর হয়ে যখন

চাঁদের আলোয় ভিজে সামিলে মন যখন

মাঝে মাঝে একা লাগে..

ভীষন সুখেও একা লাগে..

এ অসময়ে একা লাগে..

এ বালির পথ একা লাগে..

সব বুঝতে সময় লাগে

ভুল বুঝতে নয়।

কার সাধ্য ঘোচাবে

আমাদের সংশয়?

তোমার ধমনীতে আতুর হয়ে যখন

চাঁদের আলোয় ভিজে সামিলে মন যখন

মাঝে মাঝে একা লাগে..

ভীষন সুখেও একা লাগে..

এ অসময় একা লাগে..

এ বালির পথ একা লাগে।"

হঠাৎ তিতির গানটা বন্ধ করে দিল। মুগ্ধ বলল,

-"কি হলো গানটা বন্ধ কেন করলে?"

-"গানটা খুব বাজে ছিল।"

মুগ্ধ মৃদু হেসে চোখ ফিরিয়ে নিল। বাকী রাস্তাও তিতির আর একটা কথাও বলল না। বিজয় স্মরনী থেকে ধানমন্ডির দিকে না গিয়ে তেজগাঁর দিকে যেতেই তিতির জিজ্ঞেস করলো,

-"ওদিকে কোথায় যাচ্ছো?"

-"এখন কথা কেন বলছো? এতক্ষন যেমন কথা বলার প্রয়োজন মনে করোনি তেমন এখন ও করার দরকার নেই।"

তিতির বলল,

-"বাসায় যেতে দেরী হলে প্রব্লেম হবে।"

-"কোন প্রব্লেম হবে না। সারাদিন তো বাসার বাইরে, কেউ তো একবার ফোন করে খবরও নিল না! আর যদি প্রব্লেম হয়ও তাতে আমার কি?"

তিতির আর কোন কথা বলল না। আসলেই রাত ১০ বাজলে হয়তো কেউ ফোন করবে তার আগে ইদানিং কারোর সময়ই হয়না ওকে নিয়ে চিন্তা করার। হাতিরঝিল গিয়ে লেকের ধারে গাড়ি থামালো মুগ্ধ। তারপর জিজ্ঞেস করলো,

-"সমস্যা কিরে বাবা তোমার? প্ল্যান করে দেখা তো করিনি। হঠাৎই দেখা হয়ে গেছে। এখন একটু স্বাভাবিকভাবে কথা বলতেও তোমার সমস্যা?"

-"হ্যা, অনেক সমস্যা।"

একথা শুনে রাগ ধরে রাখতে পারলো না মুগ্ধ। আচমকা তিতিরের কোমড় জড়িয়ে ধরে তিতিরের ঠোঁটে চুমু খেল। প্রথমে তিতির ওকে সরিয়ে দিতে চাইছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পরেও এক ইঞ্চি সরাতে পারলো না মুগ্ধকে। তারপর কি যেন হলো তিতিরের, তখন ও নিজেও মুগ্ধর গলাটা জড়িয়ে ধরে সাড়া দিল।

To be continued...

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url