প্রেমাতাল - পর্ব ৩, ৪, ৫, ৬ । Golpo Porun
প্রেমাতাল
(মৌরি মরিয়ম)
This Photo is from Pexels |
সারাপথ ভালই টুকটাক গল্প হয়েছিল ওদের। কিন্তু গল্প করতে করতে তিতির কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লো। মুগ্ধ অবাক হয়ে ভাবলো একটা মানুষ কিভাবে এত তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারে! তিতির কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছিল তার উত্তর দিয়ে খেয়াল করলো তিতির ঘুমাচ্ছে! খুব হাসি পাচ্ছিল মুগ্ধর। কিন্তু মেয়েটা বেশ! সহজ সরল, কিন্তু ভীষণ সাহসী। মুখটাও খুব মিষ্টি। অন্ধকার আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। ভোরের হালকা আলো এসে পড়েছিল তিতিরের মুখে। সত্যি অনেকদিন পর কোন মেয়েকে দেখে এতটা ভাল লাগছে। কাল রাতে যখন প্রথম দেখেছিল তখন কিন্তু কিছুই ফিল হয়নি। অন্যসব মেয়েদের মতই মনে হয়েছে কিন্তু এখন অন্যরকম লাগছে কেন জানি! হঠাৎ দোলার ফিসফিসানো গলা পাওয়া গেল,
-"হুম! ভাইয়া প্রেম কিন্তু এভাবেই হয়।"
মুগ্ধ আস্তে আস্তে বলল,
-"উফ তোরা না, এমনসব কথাবার্তা বলিস। যা ভাগ এখান থেকে।"
-"তাই? তাহলে ওর দিকে ওভাবে তাকিয়ে ছিলে কেন? অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছো দেখলাম। ভাল লেগে গেল বুঝি!"
-"হুম! প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখলে ট্রাভেলারদের ভাল লাগে।"
-"প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানে?"
-"তাকিয়ে দেখ ওর দিকে। তোদের মত এত রংচঙ মাখেনি, একদম ন্যাচারাল। আর তার উপর ভোরের আলো কিভাবে ভরিয়ে দিয়েছে ওকে দেখ।"
-"ওহ বাবা! আমি একটু সাজি বলে এভাবে বলতে পারলে ভাইয়া?"
-"তো এত আটা ময়দা মাখলে কি বলবো?"
-"হুহ!"
দোলা চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আচমকা তিতিরের মাথাটা মুগ্ধর কাধে পড়লো। মুগ্ধ অবাক হয়ে দেখলো তিতিরের মাথাটা ওর কাধে একটু বাকা হয়ে আছে। একটু নিচু হয়ে বসলো যাতে তিতিরের কষ্ট না হয়। তাতে তিতিরও আরাম করে মাথাটা রাখতে পারলো। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ এল ওর চুলের ভেতর থেকে। অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো মুগ্ধর। মনে হলো মেয়েটা যদি সারাজীবন এভাবে ওর কাধে শোয়, ব্যাপারটা মন্দ হয়না। কিন্তু মেয়েটা তো বড্ড বাচ্চা।
এভাবে প্রায় আধাঘণ্টা পার হয়ে গেল। মুগ্ধ কখনো বাসে ঘুমাতে পারে না। তাই পুরো বাস যখন ঘুমে বিভোর তখনও ও একা একা জেগে। হঠাৎ বাসটা নড়ে উঠলো। বোধহয় স্পিয়াদ ব্রেকার পার করলো। আর তিতিরের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখে ও মুগ্ধর কাধে শুয়ে আছে! লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি সরে গেল। বলল,
-"সরি। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"ইটস ওকে।"
তারপর থেকে কেমন যেন একটা জড়তা কাজ করছিল। কিছুই বলতে পারেনি আর। কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ বলল,
-"প্লিজ বি নরমাল, আমি কিছু মনে করিনি।"
তিতির তাকালো। ছেলেটার চোখের মধ্যে যেন কিছু আছে। কিন্তু কি সেটা!"
যখন বাস বান্দরবান পৌঁছল, ঘিড়িতে তখন ভোর ৬ টা। বান্দরবান ঢোকার মুখেই তিতির অবাক হয়ে দেখতে লাগলো আসেপাশের সব গাছপালা অনেক নিচে নিচে। যে রাস্তায় ওদের বাস চলছে রা অনেক উঁচুতে। আর ওদের বাস ক্রমশ উপরের দিকে উঠছে। অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ বোধ করলো তিতির। পাহাড়ী রাস্তায় ও এই প্রথম। হঠাৎ বাসটা বায়ে মোড় নিল। রাস্তার বাম পাশে একটা সার্কেল শেপের খাদ! আর তা পেরোতেই বান্দরবান বাসস্ট্যান্ড! বাসস্ট্যান্ডের উল্টোপাশে বড় একটা পাহাড়কে দেখতে দেয়ালের মত লাগছিল। সব মিলিয়ে বান্দরবানের ওকে এভাবে বরণ করে নেয়াটা ভালই লাগলো তিতিরের। বরণই তো, ও তো টিভিতে দেখেছিল বান্দরবান কে। এই বাসস্ট্যান্ড টাও দেখেছিল। সাধারণ মফস্বলের বাসস্ট্যান্ডের মতই মনে হয়েছিল। কিন্তু এটা আদৌ সাধারণ না।
''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন
গ্রুপের ২৮ জন মেম্বারের ফ্রেশ হওয়া আর চেঞ্জ করার জন্য সাধারণ একটা হোটেলে ৪ টা রুম বুক করা ছিল। সব মিলিয়ে ৬ জন মেয়ে আর ২২ জন ছেলে। একটা রুম মেয়েদেরকে দেয়া হলো আর বাকি ৩ টা ছেলেরা ভাগাভাগি করে ইউজ করলো। সবাইকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য সময় দেয়া হলো মাত্র ২ ঘন্টা। তিতির সেদিন মাত্র ৫ মিনিটে গোসল করেছিল। বাসায় থাকলে এই সময়ের মধ্যে জীবনেও গোসল করতে পারতো না।
ব্লু জিন্সের উপর ফুল স্লিভ হোয়াইট লেডিস শার্ট পড়লো তিতির। তার উপর ব্ল্যাক হুডি। চুলগুলোকে উপরে উঠিয়ে একটা ঝুটি করলো। তারপর ব্যাগ থেকে ওর প্রিয় ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট কেডস টা বের করে পড়ে ব্যাগপ্যাকটা গুছিয়ে নিল। তারপর সেটাকে কাধে নিতে নিতে রুম থেকে বের হতেই দেখতে পেল মুগ্ধকে। হোটেলের লম্বা প্যাসেজটা শেষ হয়েছে যেখানে সেখানটার দেয়াল বারান্দার মত খোলা। ওখানেই মুগ্ধ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল। কথা বলা শেষ হতেই ডাকলো মুগ্ধ,
-"এই তিতির?"
তিতির মুগ্ধর কাছে গেল। মুগ্ধ বলল,
-"বাহ, একদম ট্রেকার লুক!"
তিতিরে হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-"মেয়েরা এত তাড়াতাড়ি রেডি হতে পারে বলে আমার জানা ছিলনা।"
-"রেডি হতে অবশ্যই টাইম লাগতে পারে। মেয়েদের দোষ দেয়া যায়না। কিন্তু এখানে তো আর আমি বিয়ে খেতে যাচ্ছিনা যে সাজুগুজু করবো আর লেট হবে। আমি জাস্ট শাওয়ার নিয়েছি। ঘুরতে এসে আর কিছুর প্রয়োজন দেখছিনা।"
-"তোমাকে যতটা ছোট ভেবেছিলাম ততটা ছোট কিন্তু তুমি নও।"
-"ছোট ভেবেছিলেন? কেন?"
-"তুমি আমার থেকে তো অনেক ছোটই, আর দেখতেও তুমি ছোট, তাই আর কি! বাট তুমি ম্যাচিওর।"
তিতির হেসে বলল,
-"আজকাল মেয়েরা ১৪,১৫ বছর বয়সে ম্যাচিওর হয়ে যায়।"
-"তাই নাকি? তা হতে পারে অবশ্য।"
মুগ্ধই আবার বলল,
-"বাই দ্যা ওয়ে, শুনেছিলে তো বলা হয়েছিল ফ্রেশ হয়ে হোটেলের রেস্টুরেন্টে নাস্তা করে নিতে?"
-"হ্যা"
-"চলো নাস্তা করে আসি। আমি আবার একা খেতে পারিনা, তাই সঙ্গী খুঁজছিলাম আই মিন সাফির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, অন্যদের কাউকে তো চিনিনা। কিন্তু ওর কোন খবর নেই, তুমি যখন চলে এসেছো ভালই হলো তুমিও একা।"
-"কিন্তু সবার তো হয়নি। সবাই একসাথে খেতে যাবেনা?"
-"আরে নাহ! যার আগে হবে সে আগে খেয়ে নেবে তাতে চাপ কম থাকবে, এজন্যই তো রেস্টুরেন্ট ঠিক করে রেখেছে আগে থেকে।"
-"ওহ, ঠিকাছে তাহলে চলুন"
দুজনেই চুপচাপ খাচ্ছিল। হঠাৎ মুগ্ধ খেতে খেতেই বলল,
-"বাঁশ কুরুইল খেয়েছো কখনো?"
-"সেটা আবার কি?"
-"বাঁশ।"
বলেই মুগ্ধ হেসে দিল। তিতির অবাক হয়ে চেয়ে রইল। বলল,
-"বাঁশ আবার কিভাবে খায়?"
-"বাঁশ যখন খুব কচি থাকে তখন ওটাকে মাটির হাড়ি দিয়ে ঢেকে রাখে। তারপর ওই কচি বাঁশ কুচি করে কেটে চিংড়িমাছ অথবা মুরগী দিয়ে রান্না করে। পৃথিবীর অন্যতম সুস্বাদু খাবার। গ্রামঞ্চলে মানুষ খায় তবে কম। কিন্তু পাহাড়িদের এটা নিত্যখাবার।"
-"ওহ! বাট বাঁশ কিভাবে ভাল লাগতে পারে আমি বুঝতে পারছি না।"
-"এখানে কয়েকটা রেস্টুরেন্টে রান্না করে তবে এখন পাওয়া যাবে না। দুপুরে হয়। থানচি বাজার থেকে বাঁশ কুরুইল কিনে নিবনে। তারপর রান্না করে খাওয়াব। তখন দেখো কেমন লাগে!"
-"আপনি রান্না করতে পারেন?"
-"না পারার কি হলো? ব্যাচেলর তো।"
-"ওহ!"
মুগ্ধর খাওয়া শেষ। উঠে হাত ধুতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে তিতিরেরও খাওয়া শেষ হয়ে গেল। ওরা হোটেলের বাইরে গেল। হাঁটতে হাঁটতে তিতির বলল,
-"ব্যাচেলর তো বুঝলাম কিন্তু ফ্যামিলি? আই মিন বাবা মা?"
-"ওহ, ওনারা চিটাগাং থাকে।"
-"আপনাদের বাড়ি চিটাগাং এ?"
-"না না। বাবার পোস্টিং ওখানে।"
-"ওহ। আপনার ভাইবোন নেই?"
-"একটা ছোট বোন আর একটা ছোটভাই। বাবা মায়ের সাথে থাকে। ভাই স্কুলে আর বোন কলেজে পড়ে। তোমার?"
-"বড় ভাই একটা।"
-"ওহ!"
-"আর আপনি ঢাকায় কোথায় থাকেন?"
-"ধানমন্ডি।"
-"ধানমন্ডি? কত নাম্বারে?"
-"১১/এ, তুমিও কি ধানমন্ডিতে নাকি?"
তিতির হেসে ফেলল,
-"আমার বাসাও ১১/এ তে। আপনার কত নাম্বার বাসা?"
-"৩১২"
-"হোয়াট এ কো-ইন্সিডেন্স!"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"তুমিও কি ৩১২ তে?"
-"নাহ। ৩১০ নাম্বার টা আমাদের বাসা।"
মুগ্ধ এবার হো হো করে হেসে দিল। তারপর বলল,
-"এত কাছাকাছি থাকি আর পরিচয় হলো কিনা এই পাহাড়ে এসে!"
তিতিরও হাসছিল।
-"আপনি ওখানে কতদিন ধরে থাকেন?"
-"৫ বছর ধরে। ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর থেকে। তুমি?"
-"ছোটবেলা থেকেই।"
-"ওহ।"
-"আচ্ছা, আপনি কি এধনের ট্রিপে আগেও এসেছেন?"
-"আমি টিওবি'র সব ট্রিপে থাকি।"
-"টিওবি?"
-"ওহ! ট্রাভেলারস অফ বাংলাদেশ।"
-"ওহ।"
-"তবে সাফিদের সাথে ছোটখাটো ট্রিপে গিয়েছি। বড় ট্রিপে এই প্রথম।"
-"মানে? টিওবি আর সাফি ভাইরা কি আলাদা?"
-"আলাদা বলতে সাফি অথরিটির কেউনা। বাট প্রায়ই এরকম ট্যুর এরেঞ্জ করে। গ্রুপে ইভেন্ট খুলে। গ্রুপের মেম্বাররাও ভালই এটেন্ড করে।"
তার মানে এটা কোন অফিসিয়াল ট্যুর না। তিতিরের মনের মধ্যে এবার একটু ভয় ঢুকলো। মুগ্ধ বলল,
-"ভয় পাচ্ছো?"
তিতির ভাঙবে তবু মচকাবে না টাইপ মেয়ে তাই বলল,
-"ভয়ের কি আছে?"
-"ভয় পেতেই পারো। যেহেতু তুমি ভেবেছিলে এটা টিওবি'র অফিসিয়াল ট্যুর!"
তিতির অবাক! হায়রে! এই ছেলে কি মনের মধ্যে ঢুকে ওর ভালনাটাও পড়ে ফেলল নাকি!
-"হ্যা তা ভেবেছিলাম কিন্তু তার সাথে ভয় পাওয়ার কি সম্পর্ক?"
-"না মানে, ওদের অভিজ্ঞতা তো আর টিওবি'র অথরিটির মত না। আর সাফির ট্যুরগুলো খুব অল্প খরচে হয় আর মনের মত ঘোরা যায় ঠিকই তবে ম্যানেজমেন্টে কিছু কিছু প্রব্লেম থাকে। একটা মানুষের পক্ষে এতদিক সামলানো ডিফিকাল্টও বটে। তবে এবার তো সাথে দোলা আছে। হোপফুলি আগের গুলো থেকে এটা বেটার হবে।"
তিতিরের বুকটা দুরুদুরু করতে লাগলো। জীবনে পাহাড়ে আসেনি ও, ঘুরাঘুরি বলতে ফ্যামিলি ট্যুরে কক্সবাজার আর ফ্রেন্ডদের সাথে সিলেট। এছাড়া ঢাকার বাইরে কোথাও তো তেমন যাওয়া হয়নি। কি যে আছে কপালে! বলল,
-"আমরা হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে এসেছি। চলুন ফিরে যাওয়া যাক।"
-"ও হ্যা, চলো।"
ওদের দুটো জিপ ঠিক করা ছিল। বাসস্ট্যান্ড থেকে ছাড়ার কথা আরো ১০ মিনিট পরে। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখলো ওদের ঠিক করা জিপ দুটো নেই। লোকজনকে জিজ্ঞেস করতেই বলল সেখান থেকে কোন জিপ এখনো ছাড়েনি আজ। ওরা নিশ্চিন্তে হোটেলে গেল। হয়তো হোটেলের সামনে থেকে ছাড়বে। কিন্তু হোটেলের সামনে কোন জিপ দেখা গেলনা। হোটেলের ম্যানেজার কে জিজ্ঞেস করতেই বলল দুটো জিপ তো প্রায় ১ ঘন্টা আগে ছেড়ে গেছে।
মাথায় বাজ পড়লো মুগ্ধ তিতিরের। সাথে সাথে মুগ্ধ ফোন করলো সাফি কে। সাফির মোবাইল বন্ধ। তিতির বলল,
-"মোবাইল বন্ধ কেন?"
-"বন্ধ না। নেটওয়ার্ক প্রব্লেম হবে। ১ ঘন্টা আগে ছাড়লে তো এখন ওরা পাহাড়ে। ওকে বলেছিলাম শহরের বাইরে এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক থাকে না, অন্য সিম যেন নিয়ে নেয়।"
-"কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না। যে টাইমে জিপ ছাড়ার কথা সেটা হতে তো আরো ৫ মিনিট বাকি। এত আগে কেন ছাড়লো! আর যদি ছাড়েই তবে দেখবে না সব মেম্বার্স আছে কিনা?"
-"তোমাকে বলেছিলাম না ওদের ম্যানেজমেন্টে প্রব্লেম আছে।"
-"যাই হোক, এখন কি করবো?"
-"ঢাকা ফিরে যাবে?"
-"নো ওয়ে!!! একবার যখন ঠিক করেছি নাফাখুম যাব। না যেতে পারলে আমি পাগল হয়ে যাব।"
-"কিন্তু জেদ করাটা আই থিংক ঠিক হবেনা। অনেক দূরের রাস্তা।"
-"এখন বাসায় ফিরলে বাবা আমাকে আর কখনো একধরনের ট্রিপে যেতে দেবে না। বাবা চাইছিল না এবারও, ভাইয়া রাজী করিয়েছে। আমি ফিরে যাবনা।"
পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ ভাবছিল কি করা যায়। এরমধ্যেই তিতির বলল,
-"আচ্ছা আমরা দুজন একটা জিপ ভাড়া করে চলে যাই?"
-"সেটা সম্ভব না। থানচির জিপভাড়া ৮/৯ হাজার টাকা। অত টাকা আমার কাছে নেই। ট্রিপের টাকা তো পুরোটাই দিয়ে দিয়েছি রেজিস্ট্রেশনের সময়। আর ওরা থানচি পৌঁছানোর আগে আমরা ওদের কানেক্ট করতে পারবো না কারন, রাস্তার নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবেনা।"
তিতির অবাক হয়ে বলল,
-"ভাড়া এত বেশি?"
-"হ্যা, অনেক দূর না? তার উপর পাহাড়ী রাস্তা। আর ভাড়া সিস্টেম আপ-ডাউন। তুমি ফিরে না আসলেও ভাড়া দিতে হবে।
-"আমার কাছে ২ হাজার টাকার মত আছে।"
-"আমার কাছে ৪/৫ হাজার হবে। কিন্তু তাতেও জিপ পাওয়া যাবে না।"
তিতির টেনশনে পড়ে গেল। বাসায় ও ১০ দিনের আগে ফিরবে না এটা কনফার্ম। আর নাফাখুম ওকে যেতেই হবে। কিন্তু কি করবে এখন? মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে দেখলো খুব সিরিয়াসলি কিছু চিন্তা করছে।
প্রেমাতাল - পর্ব ৪
মৌরি মরিয়ম
মুগ্ধ চিন্তা করতে করতে একসময় বলল,
-"তুমি সিওর যে তুমি আমার সাথে থানচি পর্যন্ত যাবে?"
-"হ্যা। কিন্তু কিভাবে?"
-"সেটা দেখছি তুমি আরেকবার ভেবে বল তুমি সিওর তো?"
-"১০০%"
-"ওকে,এসো আমার সাথে।"
মুগ্ধ বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাটা শুরু করলো। ২ মিনিটের রাস্তা। বাসস্ট্যান্ডের একপাশে অনেকগুলো সিএনজি। মুগ্ধ একজনকে জিজ্ঞেস করলো,
-"মামা থানচি যাবা?"
-"মাহাজনের লগে কতা কুইন।"
মুগ্ধ সিএনজির মহাজনকে খুঁজতে লাগলো। পেয়ে যেতেই তাকে বলল,
-"মামা, থানচি যাব। একটা সিএনজি লাগবে।"
-"আমরা তো মামা নিলগিরি পর্যন্ত যাই। থানচি গেলে পোষায় না।"
-"চলো না মামা। আমাদের গাড়িটা আমাদের রেখে চলে গেছে। মহাবিপদে পড়সি। তোমাদের পাহাড়ে আসছি, তোমরা সাহায্য না করলে কই যামু কও।"
-"মামা, বুঝেন না ক্যা? যাইতে যাইতেই সন্ধ্যা অইয়া যায়। তহন তো আর্মিরা আটকাইয়া দেয়, গাড়ি চালাইতে দেয়না। কাইল্কা ফিরা আওন লাগবো।"
-"ভাড়া একটু বেশি নিও। আর রাতের থাকা খাওয়া আমাদের সাথেই করতে পারবে। ২৮ জনের গ্রুপে আসছি আমরা।"
লোকটা কিচ্ছুক্ষণ ভাবলো তারপর বলল,
-"৩৫০০ টাকা লাগবো।"
-"এত? মামা সিএনজির নিলগিরির ভাড়া তো ১৫০০ টাকা।"
লোকটা হেসে বলল,
-"মামা, আমরা তো ওইদিকে যাই না। অনেক রিস্ক নিয়া যাওন লাগবো। আপনেরা বিপদে আছেন তাই রাজি হইসি।"
-"আচ্ছা, আচ্ছা ৩৫০০ ই দিব।"
লোকটা একজনকে ডেকে বলল,
-"ওই হাসু, দাদারে থানচি লইয়া যা। হেগো লগেই থাকবি খাবি। কাইল্কা আইয়া পড়বি।"
হাসু নামের সেই ছেলেটা বলল,
-"ওস্তাদ, ওইদিকের রাস্তা তো ভালনা। সিওএনজি নিয়া যাওন কি ঠিক অইবো? আর তেলও তো শ্যাষ অইয়া যাইবো।"
-"রাস্তা ভালনা দেইখাই তো তরে কইসি। তুই চালাইলে আমি নিশ্চিত থাকুম। যা ব্যাটা। মেহমানরা বিপদে পড়সে। ত্যাল দুই গ্যালান বেশি লইয়া যা।"
-"আইচ্ছা, কহন যাইবো?"
মুগ্ধ বলল,
-"আমরা এখনি যেতে চাচ্ছি।"
হাসু ছেলেটা বলল,
-"আইচ্ছা, লন।"
মুগ্ধ তিতিরকে অবাক করে দিয়ে মহাজনকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-"ধন্যবাদ মামা। অনেক উপকার করলা।"
মহাজনও বোধহয় এমন কিছু ভাবতেও পারেনি। খুব অবাক হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। তিতিরের কেন জানি খুব ভাল লাগছে। এত স্মার্ট একটা ছেলে কিনা নোংরা শার্ট পড়া একটা সিএনজি ড্রাইভার কে জড়িয়ে ধরলো শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য! এতক্ষণ কিছুটা ভয় কাজ করলেও এখন আর তিতিরের মধ্যে কোন ভয় নেই। এত বড় মনের একটা মানুষের সাথে শুধু থানচি পর্যন্ত না, আরো অনেকদূর যাওয়া যায়। অনেক দূর!
সিএনজিতে ওঠার পর মহাজন কাছে এসে হাসুকে বলল,
-"ঠান্ডা মাথায় গাড়ি চালাবি, তাড়াহুড়া করবি না।"
সিএনজি ছেড়ে দিল। মুগ্ধ মহাজনকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। তারপর নিজের ব্যাগপ্যাকটা কাধ থেকে নামিয়ে পেছনে রাখতে গিয়েই তিতিরের দিকে চোখ পড়লো। কি যেন ভাবছে মেয়েটা। মুগ্ধ বলল,
-"কি ব্যাপার? ব্যগপ্যাক এখনো কাধে কেন? রিল্যক্সে বসো। ৯০ কিলোমিটার যেতে হবে।"
-"আচ্ছা ঢাকা থেকে বান্দরবান ৩০০ কিমি দূরে না?"
-"৩৩৮ কিমি।"
-"আর বান্দরবান থেকে থানচি ৯০ কিমি?"
-"হুম।"
-"ঢাকা থেকে বাসভাড়া বোধহয় জনপ্রতি ৫০০। তাহলে দুজনের ৩০০ কিমির ভাড়া ১০০০ আর ৯০ কিমির ভাড়া ৩৫০০? এত ডিফারেন্স?"
মুগ্ধ হেসে আস্তে আস্তে বলল,
-"প্রথমত, ওটা সোজা রাস্তা ছিল আর এটা পাহাড়ী রাস্তা। দ্বিতীয়ত, ওটা বাস। দুনিয়ার মানুষকে আনে। আর এটা সিএনজি। শুধু আমাদেরকে নিচ্ছে। এটা অনেকটা প্রাইভেট টাইপ হলোনা?"
তিতির নিজের বোকামি মার্কা প্রশ্নে লজ্জা পেয়ে গেল,
-"ওহ, তাইতো।"
-"বান্দরবান থেকে থানচির বাসভাড়া ১০০-১৫০ টাকা মাত্র।"
-"সেকি! তাহলে বাসেই যেতাম।"
মুগ্ধ আবার হেসে দিল। বলল,
-"একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ের জীবন নিয়ে রিস্ক নেয়ার সাহস আমার নেই। তাছাড়া, আমিও বিয়েশাদি করিনি। স্বপ্নের সব যায়গা ঘোরাও হয়নি। এত তাড়াতাড়ি মরার ইচ্ছে নেই।"
তিতিরও হাসলো। বলল,
-"মানুষ বুঝি যায়না?"
-"লোকাল মানুষজন যায়। পিচ্চি পিচ্চি বাস। প্রায়ই এক্সিডেন্ট করে। টাকার চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।"
-"হুম! একটা কথা বলব, কিছু মনে করবেন না প্লিজ।"
-"আরে বলো বলো।"
''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন
-"ভাড়াটা আমি শেয়ার করবো।"
-"ওহ ওটা পুরোটাই সাফির কাছ থেকে আদায় করবো, ভুলটা ওর। আর ও না দিলেও সমস্যা নাই ছোটভাই তো। তোমার শেয়ার করতে হবে না।"
-"কেন? দিস ইজ নট ফেয়ার!"
-"তুমি যদি আমার সমান হতে, আর্ন করতে তাহলে শেয়ার করতাম। তুমি তো ছোট। এই ব্যাপারে কথা বলে আমাকে আর লজ্জা দিওনা প্লিজ!"
কথাটা শেষ করেই মুগ্ধ হাসলো। কি যে অমায়িক সে হাসি! তিতির আর কিছুই বলতে পারল না।
কিছুদূর যাওয়ার পরেই হঠাৎ গাড়িটা উঁচুতে উঠতে লাগলো। তিতিরের মনে হচ্ছিল গাড়িটা ৬০/৭০ ডিগ্রি এংগেলে উঠছে। সিএনজি উল্টে যাবে মনে হচ্ছে। হঠাৎ ও মুগ্ধর হাত চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ভয়ের চোটে নিঃশ্বাস আটকে যাবার মত অবস্থা। উপড়ে উঠে যাওয়ার পরেই ও চোখ খুলল। তারপর দেখলো মুগ্ধ দুহাত দিয়ে ওর দুহাত ধরে হাসছে।
তারপর হঠাৎ মনে পড়ায় জিজ্ঞেস করলো,
-"আচ্ছা তখন সিএনজির মহাজন তেল নেয়ার কথা বলছিল কেন? সিএনজি তো তেলে চলে না।"
-"হ্যা, কিন্তু পাহাড়ে তেলেই চলে তাছাড়া উঁচু রাস্তায় উঠতে পারবে না তো।
তিতির এক ঝটকায় হাত ছেড়ে দিল। বলল,
-"হাসবেন না। রাস্তাটা খুব ভয়ংকর ছিল।"
-"হুম বাচ্চা টাইপের একটা আপহিল ছিল।"
-"এটাকে আপনার বাচ্চা বলে মনে হচ্ছে?"
-"হুম, কারন সামনে আরো বড় বড় আপফিল, ডাউনহিল আছে। আমরা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ২৮০০ ফিট উপরে উঠছি বুঝতে হবে।"
-"সিরিয়াসলি আমরা এত উপরে উঠছি?"
-"হুম!"
-"আপনি এতকিছু জানেন কি করে?"
-"কিছুক্ষণ পর পরই তো মাইলস্টোন, ওখানে ইনফরমেশন দেয়া আছে না? তাছাড়া একটা যায়গায় গেলে সে যায়গা সম্পর্কে জানবো না? প্রথমবার যখন এসেছিলাম তখনই সব জেনেছি। তারপর তো কত এলাম। নাফাখুম একবার গেছি মাত্র। কিন্তু এই রাস্তা দিয়েই নিলগিরি, বগালেক, কেওক্রাডং, তাজিংডং, সাকাহাফং গিয়েছি। কেওক্রাডং ২ বার গিয়েছি। নিলগিরি তো হিসাবই নেই।"
তিতির অবাক হয়ে বলল,
-"আপনি কেওক্রাডং ট্রেকিং করেছেন?"
-"কেওক্রাডং এমন কিছুই না। নিশ্চই মনে পড়ে গেছে ছোটবেলায় পড়েছিলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড়চূড়া কেওক্রাডং। এর উচ্চতা ৩২০০ ফিট। তাই না?"
-"হ্যা।"
-"হুম, কিন্তু ওখানে যাওয়া এমন ডিফিকাল্ট কিছু না। শীতকালে জিপে করে যাওয়া যায়। তবে ওই দিকে কঠিন যা আছে তা হলো জাদিপাই ঝরনা। কেওক্রাডং থেকে ৩ ঘন্টা হেটে যেতে হয়। ৩ ঘন্টা হাটা কোন বিষয় না। কিন্তু ওই রাস্তায় ৩ ঘন্টাকে ৩ দিন মনে হয়। কিন্তু পৌঁছানোর পর সব কষ্ট কোথায় যে যায়। অনেক বড় আর অসম্ভব সুন্দর একটা ঝরনা।"
-"ওহ। আচ্ছা, এখন তাজিংডং এর কথা বলুন। শুনেছিলাম তাজিংডং কেওক্রাডং এর থেকেও উঁচু।"
-"তাজিংডং কেওক্রাডং এর চেয়েও উঁচু আর সবচেয়ে উঁচু সাকাহাফং। আর এদুটোতে উঠতে আমার জান বের হয়ে গেছে। কেওক্রাডং এ তো জিপ যায়, যদিও আমরা বর্ষায় গিয়েছিলাম ঝরনার ভরা রূপ দেখবো বলে। হেটেই যেতে হয়েছিল তখন। কিন্তু এই দুটোতে জিপ তো দূরের কথা হাটা পথও নেই পুরোটা।"
-"তাহলে গিয়েছেন কিভাবে?"
-"ক্লাইম্বিং করে। আর সবচেয়ে বোকামি যেটা করেছিলাম কোন গাইড নেইনি। এক বড় ভাই ছিল। উনি আগে গিয়েছেন, রাস্তা চেনেন গাইড লাগবে না হ্যান ত্যান বলে নিয়ে গেছে। তারপর তো আর রাস্তা চেনে না। হায় খোদা কি বিপদে যে পড়েছিলাম! এক রাস্তায় বারবার হেটেছি অথচ বুঝিনি। বুঝবো কি করে সব তো একই রকম দেখতে পাহাড়, আর একই রকম জঙ্গল। একটা রাস্তা পার হয়েছিলাম মাত্র এক হাত চওড়া। দুইপাশে খাড়া খাদ। একটা পা এদিক সেদিক হলেই ভবলীলা সাঙ্গ!"
-"আপনার অনেক সাহস!"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"অনেক সাহস তো তোমারও। এইটুকু বয়সে তুমি এতগুলো অচেনা মানুষের সাথে পাহাড়ে চলে এলে। আবার এখন একটা অচেনা ছেলের সাথে যাচ্ছো। অনেক রকম বিপদ হতে পারে। ছেলেটা খারাপ হতে পারে। তোমাকে ভুল যায়গায় নিয়ে যেতে পারে। আরো অনেক কিছুই তো হতে পারে।"
একথা শুনে তিতির হেসে দিল। মুগ্ধ বলল,
-"শুধু হাসলে হবে? উত্তর দাও।"
তিতির হেসে উত্তর দিল,
-"বিঃশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর!"
মুগ্ধ আর কথা বাড়ালো না। সিএনজি ক্রমশ উপরের দিকে উঠছে। আবার সামান্য নেমে যাচ্ছে। হঠাৎ করে পাহাড়ের গা ঘেঁষে বায়ে মোড় নিচ্ছে আবার একই ভাবে ডানে। এরকম করতে করতেই ওরা এমন একটা রাস্তায় এল যার ডানপাশে গাছপালা, জঙ্গল। আর বামপাশে খাদ। হঠাৎ মুগ্ধ তিতিরকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে দেখালো,
-"ওই যে দেখছো বাড়িঘর গুলো, ওটা বান্দরবান শহর। একটু আগেই আমরা ওখানে ছিলাম।
-"এত উপরে উঠে গেছি!"
-"হুম!"
ওরা যেখানে ছিল সেখান থেকে শহরটা অনেক নিচে। উপরে খোলা আকাশ। দূরের পাহাড় গুলো দেখে ছোটবেলার আঁকা গ্রামের দৃশ্যের মত লাগছে। পাহাড়গুলোকে একবার মনে হচ্ছে সবুজ, আবার মনে হচ্ছে নীল। রাস্তার পাশে ফুটে আছে অজস্র বুনোফুল। তিতির বলল,
-"অদ্ভুত সুন্দর একটা ঘ্রাণ পাচ্ছি। এটা কিসের ঘ্রাণ জানেন? বাই দ্যা ওয়ে, আপনি কি ঘ্রাণটা পাচ্ছেন?"
-"পাহাড়ের ঘ্রাণ! বুনো ঘ্রাণ। আমি আসক্ত এ ঘ্রাণে, তাইতো বারবার ছুটে আসি।"
একটু থেমে তিতির আবার বলল,
-"আশেপাশের সৌন্দর্য দেখে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি! কি নিশ্চুপ চারপাশ!"
-"সৌন্দর্যের কি দেখেছো? সৌন্দর্য শুরু হবে মিলনছড়ির পর।"
-"ওহ, কিন্তু আমার তো এখানও বেশ লাগছে।"
-"হুম, পাহড়ের বাঁকে বাঁকে সৌন্দর্য!"
-"আসলেই, যা দেখছি তাই ভাল লাগছে। আচ্ছা মিলনছড়ি কতদূর?"
-"২ কিলোমিটার। অলমোস্ট চলে এসেছি।"
কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই মিলনছড়ি এসে পড়লো ওরা। একটু আগে যেখানে ছিল সে যায়গাটা এখন অনেক নিচুতে। রাস্তার একপাশে মিলনছড়ি আর্মিক্যাম্প। তার একটু আগেই অন্যপাশে মিলনছড়ি চেকপোস্ট। চেকপোস্ট বলতে ছোট্ট একটা টিনের ঘর। যার দেয়ালগুলো বারান্দার মত অর্ধেকটা খোলা। পাশেই দুটো গাছ। ভেতরে একটা কাঠের টেবিল, একটা প্লাস্টিকের চেয়ার। একজন আর্মিম্যান খাতা কলম নিয়ে বসে টুরিস্টদের নাম এন্ট্রি করছে। পুরোটাই যেন শিল্পীর আঁকা ছবি। গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার হাসু আর মুগ্ধ নেমে গিয়ে চেকপোস্টে ঢুকলো। নাম এন্ট্রি করে এসে সিএনজিতে তাকিয়েই মুগ্ধর আত্মা উড়ে গেল। তিতির নেই সিএনজিতে। আশেপাশে তাকাতেই তিতিরকে দেখতে পেল। দৌড়ে কাছে যেতেই দেখলো যে পাশে খাদ সে পাশের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে তিতির। আর ওর চোখদুটো ছলছল করছে। মুগ্ধ বলল,
-"এনি প্রব্লেম?"
তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,
-"এতবড় আকাশ আমি আগে কখনো দেখিনি। দূরের ওই পাহারগুলো যেন আমার সাথে পরিচয় হওয়ার অপেক্ষায় চেয়ে আছে। মেঘের এত কাছে আসিনি কখনো। এত ভাল আগে লাগেনি কখনো। বুকের ভতরটায় কেমন যেন করছে।"
এক্সাইটমেন্টে তিতিরের গলা কাঁপছে। মুগ্ধ পরিচিত এই অনুভূতির সাথে। প্রথমবার এখানে এসে ওরও এরকম অনুভূতিই হয়েছিল। মুগ্ধর মনে হলো, ইশ ও যদি তিতিরকে দুনিয়ার সব থেকে সুন্দর সুন্দর পাহাড়গুলোতে নিয়ে যেতে পারতো!
To be continued...
প্রেমাতাল
পর্ব ৫
মৌরি মরিয়ম
মুগ্ধ বলল,
-"মেঘের আরো কাছে নিয়ে যাব তোমাকে। হাত বাড়ালেই মেঘগুলো লুটিয়ে পড়বে তোমার গায়ে।"
তিতির একথা শুনে বলল,
-"কোথায়? ওহ শুনেছিলাম নিলগিরি তে নাকি মেঘ ছোঁয়া যায়। সত্যি কি?"
-"হুম তবে সেটা খুব সকালে। ৮/৯ টা পর্যন্ত। কিন্তু আমরা নিলগিরি পৌঁছাতে ১২/১ টা বেজে যাবে।"
-"ওহ!"
-"আমি অবশ্য বলছিলাম রুইলুই পাড়ার কথা।"
-"সেটা কোথায়? নামও তো শুনিনি।"
-"ওটা একটা মেঘের দেশ! সাজেকের একটা গ্রাম।"
-"সাজেক খাগড়াছড়ি তে না?"
-"না না খাগড়াছড়ি দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সাজেক রাঙামাটিতে।"
-"ও। রাঙামাটিতে হলে খাগড়াছড়ি দিয়ে কেন যেতে হবে?"
-"রাঙামাটি দিয়ে কোন রাস্তা এখনো তৈরী হয়নি।"
-"ওহ! কিন্তু ওখানে আপনি আমাকে কি করে নিয়ে যাবেন?"
প্রশ্নটা শুনে মুগ্ধ কোন উত্তর খুঁজে পেলনা। সত্যি তো, কেন বললো ও একথা! তিতিরও প্রশ্নটা করে বোকা হয়ে গেল। কিন্তু প্রশ্নটাতো এখন আর ফিরিয়ে নেয়া যাবেনা। মুগ্ধ বলল,
-"না মানে তুমি একবার যখন ট্রাভেলিং শুরু করে দিয়েছো, ট্রাভেলিং ছাড়া তুমি থাকতে পারবে না তাই টিওবি থেকে সাজেকে কোন ট্রিপে হয়তো তুমি যাবে আর আমি তো ওদের প্রায় সব ট্রিপেই থাকি। তখন আমি তোমাকে আলো ফুটতে না ফুটতেই ডেকে নিয়ে যাব সেই স্বর্গীয় যায়গায়।"
-"গুড আইডিয়া। টিওবি মানে অরিজিনাল টিওবি আই মিন সাফি ভাইদের টা না। অথরিটির কোন সাজেক ট্যুর হলে আমাকে জানাবেন প্লিজ! আমি যাব।"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"হা হা হা, অরিজিনাল টিওবি!"
-"অবশ্য জিপ মিস করে খারাপ হয়নি। শাপে বর হয়েছে।"
-"কিরকম?"
তিতির কিছু বলার আগেই হাসু ডাক দিল,
-"মামা কহন যাইবেন?"
মুগ্ধ তিতিরকে বলল,
-"এই খেয়ালই ছিল না। চলো চলো.. দেরী হয়ে যাবে আমাদের।"
তিতির সিওএনজিতে উঠতে উঠতে বলল,
-"অনেস্টলি স্পিকিং মিলনছড়ি অনেক সুন্দর। যেতে ইচ্ছে করছে না।"
সিএনজি আবার চলতে শুরু করলো। মুগ্ধ বলল,
-"সামনে এরকম শত শত সুন্দর যায়গা পড়বে, যাকে বলে একেবারে ভিউ পয়েন্ট। সব যায়গায় নেমে ২ মিনিট করে থাকলেও ২ দিনের আগে থানচি যেতে পারবো না।"
-"তাহলে কি আমরা ওই শত শত যায়গার মধ্যে ৪/৫ টা যায়গায়ও নামব না?"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"হ্যা তা নামব।"
কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ তিতিরকে ইশারা করে দেখালো,
-"ওইযে দেখতে পাচ্ছো রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছো ওদিকে গিয়ে পাহাড় কেটে কেটে সিড়ি তৈরী করা হয়েছে। সিড়ি দিয়ে উঠলেই 'মিলনছড়ি হিলসাইড রিসোর্ট' বেশ কয়েকটা কটেজ আছে ওদের। আমি থেকেছিলাম যে কটেজে সেটার নাম ছিল মুনিয়া। কটেজের বারান্দায় গিয়ে আমি তো স্পিচলেস হয়ে গিয়েছিলাম। কি যে সুন্দর! শুধু পাহাড় আর পাহাড়! সব গুলো কটেজ এর নাম পাখির নামে বুলবুলি, টুনটুনি, শ্যামা, চড়ুই, মুনিয়া। তিতির নেই অবশ্য।"
তিতির হেসে ফেলল। মুগ্ধ এবার বলল,
-"নাও এবার বলো জিপ মিস করে কিভাবে শাপে বর হলো?"
-"ও, হ্যা! দেখুন, একেকটা জিপে আমাদের ১৪ জন করে বসতে হত। ৭ জন ডানপাশে, ৭ জন বামপাশে। এতগুলো অচেনা মানুষ মুখোমুখি বসে থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো এদের বেশিরভাগ মানুষই অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলবে তবে সেটা নিজেদের মধ্যে। অন্যদের সাথে পরিচিত হবার কোন দরকার নেই যেন। বাসে আর রেস্টুরেন্ট গুলোতে যেমন হয়েছে। আর আমরা যারা একা একা এসেছি তারা বলদের মত বসে থাকবো। তার চেয়ে এটাই ভাল হয়েছে না? অন্তত ওদের হা হা হি হি থেকে উদ্ধার পাওয়া গেল।"
-"হা হা হা, ওয়েল সেইড.. ওয়েল সেইড।"
-"হুম!"
-"আসলে এসব ট্যুরে কেউ একা একা আসেনা। ফ্রেন্ডস, গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড, ফ্যামিলি এভাবেই আসে। তাই তারা অন্যদের সাথে পরিচিত হবার তাগিদ ফিল করেনা।"
-"কই আপনি তো একা এসেছেন। যদিও আপনার কাজিন আছে কিন্তু সে তো তার ফ্রেন্ড সার্কেলদের সাথেই ছিল পুরোটা সময়। সেই হিসেবে আপনিও একাই এসেছেন।"
-"আসলে আমি যেখানেই যাই একাই যাই। অন্যদের সাথে আমার মেলেনা। খুব হতাশ হই গ্রুপের মানুষদের কিছু কাজকারবার দেখে। এগুলো টিওবির ট্যুরেও থাকে। গ্রুপে গেলে এগুলো থেকে রেহাই নেই।"
-"যেমন? একটু ডিটেইলে বলুন না। আমার তো কোন অভিজ্ঞতা নেই।"
-"যেমন ধরো, এরা অনর্গল হইচই করতে থাকবে। কথা বলুক, কথা বলাতে তো আর কোন প্রব্লেম নেই। এই যেমন আমরাও তো কখন থেকে কথা বলছি। কিন্তু হইচই তো করছি না। হইচই করলে পাহাড়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়। পাহাড় হলো নিরব, নিস্তব্ধ। এখানে এসে নিস্তব্ধতা বজায় রাখা আবশ্যক। হইচই করে পাহাড়েরও যে একটা নিরব ভাষা আছে সেটা ওরা শুনতেই পারে না। বিরাট এক মিস করে ফেলে।"
তিতির দেখলো মুগ্ধ খুব সিরিয়াসলি কথা বলছে তাই ও সিরিয়াসলি বুঝতে চায় ব্যাপারটা। জিজ্ঞেস করলো,
-"সত্যি কি পাহাড়ের কোন ভাষা আছে? আপনি বুঝতে পারেন সে ভাষা?"
-"শুধু আমি কেন তুমিও বুঝতে পারবে। কোন এক পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনে দেখো তারা কি বলতে চায়। আমার মনে হয় তুমি বুঝতে পারবে।"
তিতির ট্রাই করবে, যদি সত্যি পাহড়ের কোন ভাষা থেকে থাকে তবে রা বুঝতে চায় তিতির। তারপর মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-"তারপর হতাশার বাকি কারনগুলো বলুন।"
-"সেকেন্ড কারন হলো ছবি। যেকোন যায়গায় গেলে তার স্মৃতি রাখার জন্য ছবি তোলে মানুষ। খুব ভাল কথা। কিন্তু আজকাল দেখি যাওয়ার পরই শুরু হয়ে যায় ফটোসেশন পর্ব। যতক্ষণ সময় থাকবে ততক্ষণই ছবি তুলতে থাকে, এই পোজে সেই পোজে। আমি অবাক হয়ে যাই। এন্ড তাদের জন্য আমি ডিস্টার্ব ফিল করি। আমার পাহাড়ের সাথে প্রেমে ওরা বিঘ্ন ঘটায়। আমার মোবাইলে দেখো.. আমি যত যায়গায় গিয়েছি তার সব যায়গার দুএকটা ছবি পাবে কিন্তু আমার নিজের কোন ছবি পাবেনা। আরে ভাই ছবি তো ঢাকায় বসেও তোলা যায়।"
তিতিরের হঠাৎ খেয়াল হতেই বলল,
-"আরে.. আমিও তো সারাদিন ছবি তুলতে থাকি কিন্তু বান্দরবান আসার পর থেকে একটা ছবিও তুলিনি। এত সৌন্দর্য দেখে সব ভুলে গেছি। মনেই পড়েনি ছবি তোলার কথা।"
-"কারন তুমি প্রকৃত ট্রাভেলার। আর ওরা ট্যুরিস্ট!"
-"আমি না ট্রাভেলার আর ট্যুরিস্টের ডিফারেন্সটা বুঝিনা।"
-"আচ্ছা, বুঝিয়ে বলছি। ট্যুরিস্টরা কোথাও যাওয়ার আগের ২/৩ মাস ধরে প্ল্যান করে, টাকা জমায়। রুম বুক করে। বিলাশবহুল হোটেলে থাকতে চায়। ভাল খেতে চায়। যেখানে যাওয়ার রাস্তা ভাল, সুযোগ সুবিধা ভাল সেখানে যায়। যেখানে যাবে সেটাকে ব্যাগরাউন্ডে রেখে ছবি তুলে তুলে পুরো সময়টা ব্যায় করবে। ছবির সংখ্যা হবে অগনিত। আর স্পেশালি চিপসের প্যাকেট, কলার খোসা, পানির বোতল ইত্যাদি ভ্রমন স্থানে ফেলে আসবে।"
তিতির হেসে বলল,
-"ওহ! আর ট্রাভেলার রা?"
-"ট্রাভেলার রা হলো, মন চাইলো কোথাও যেতে.. ইন্সট্যান্ট পকেট হাতড়ে দেখবে তার কাছে কত টাকা আছে? যদি ভাল টাকা পয়সা থাকে তাহলে যেখানে মন চায় চলে যেতে পারবে। কিন্তু যদি কম টাকা পয়সা পায় যেমন ধর, ৪ হাজার টাকা পায় তাহলে চলে যাবে সেন্ট মার্টিনস। যদি ৩০০০ টাকা পায় তাহলে ছোটখাটো পাহাড়ে চলে যাবে। ২০০০ পেলে যাবে কক্সবাজার। আর যদি ১০০০ পায় তাহলে সিলেট তো আছেই।"
-"মানে? সিলেট কিভাবে ১০০০ এ যাওয়া যাবে?"
-"আসলে সিলেটের জন্য ১০০০ অনেক বেশি। ট্রেনে করে চলে যাবে। ইকনমি ক্লাসে চড়ে বা স্ট্যান্ডিং টিকেটে। ৩০ টাকার রুমে থাকবে। ১০ টকার ভাত। ১০ টাকার সবজি ১০ টাকার ডাল। মোট ৩০ টাকায় খাওয়া কম্পলিট। তাছাড়া সিলেটে মাংস ভাতও খাওয়া যায় ৭০/৮০ টাকায়।"
-"সিরিয়াসলি? আপনি মজা করছেন না তো?"
-"মজা কেন করবো? ইটস ট্রু!"
-"খাওয়াটা নাহয় বুঝলাম কিন্তু ৩০ টাকায় থাকা যায় কিভাবে? ফ্লোরিং করে নাকি ডরমিটরি সিস্টেমে?"
-"পুরো একটা রুম ভাড়া ৩০ টাকা। রুমে টিভিও আছে। প্রব্লেম একটাই, একটু রিস্কি! মেয়েদের জন্য।"
-"ওহ! হুম আমাদের দেশের সব সুবিধা তো ছেলেদের জন্যই।"
-"মেয়েরা তোমার মত সাহসী হলে মেয়েদের আর কোন প্রব্লেম থাকবে না।"
-"মেয়েদের প্রব্লেমের শেষ নেই কোনো। শুধু সাহস দিয়ে কি হবে?"
-"তুমি কি মিন করছো ঠিক ধরতে পারছি না।"
-"মিন করছি যে মেয়েরা তো বন্দী। ভাইয়া রিকোয়েস্ট না করলে বাবা-মা কখনো আসতে দিতনা। আমি নাহয় ভাইয়ার কারনে যেতে পারছি। কিন্তু আমার মত অনেক মেয়েরা আছে যারা ইচ্ছা থাকা স্বত্তেও বনে জঙ্গলে যেতে পারেনা। কারন, ফ্যামিলি থেকে এসব যায়গায় কেউ যায়না। বয়স্করা এত কষ্ট করতে পারবে না তাই। আর মেয়েগুলোর ঘুরাঘুরিও কক্সবাজার, সেইন্ট মার্টিনস, সিলেট পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে।
-"ঠিক, কিন্তু আজকাল আস্তে আস্তে মেয়েরাও সুযোগ পাচ্ছে। আমি তো আমার বোনকে মাঝে মাঝে নিয়ে যাই গ্রুপে গেলে, ও যদি ফ্রি থাকে। ওর ফ্রেন্ডদের সাথেও যেতে দেয় ফ্যামিলি থেকে।"
-"হুম এখন দেয়। আমাকেও দেয়। কিন্তু যখন আমাদের বিয়েসাদি হবে তখন আর পারবো না।"
-"বাপরে! কোন যুগে পড়ে আছো? তোমাকে দেখলে কিন্তু মনে হয়না তোমার চিন্তাধারা এমন।"
-"যা সত্যি তাই বললাম। যাই হোক, বাদ দিন। আপনি বলুন, একা একা ঘুরেই যদি আপনার এত আনন্দ তাহলে গ্রুপে কেন যান?"
-"একা একা ঘুরে আনন্দ ঠিক আছে তবে মনের মত সঙ্গী হলে দোকলাও প্রব্লেম নেই। বরং ভাল, নিজের ফিলিং শেয়ার করা যায়। আর গ্রুপের কথা যদি বলো সেখানে এত মানুষ সবাই তো আর আমার মনের মত হবে না। আবার একধরনের দূরের আর এক্সপেনসিভ ট্যুর গুলোতে তো গ্রুপ ছাড়া উপায়ও নেই। একেক যায়গার ভাড়া কিরকম তা তো দেখলেই। এসব যায়গায় থাকা খাওয়ার খরচ খুবই কম কিন্তু ভাড়াতেই সব চলে যায়। থানচি থেকে যে নৌকায় যাব তার ভাড়াও প্রায় ৭/৮ হাজার টাকা। তাহলে বোঝো একা তো পোষায় না। আর খরচের ব্যাপারটা আমাকে চিন্তা করতেই হয় কারন, প্রতি মাসেই আমি কোথাও না কোথাও যাই। বৃহস্পতিবার অফিস করে রওনা হই, শুক্র,শনি ঘুরে শনিবার রাতে ব্যাক করে রবিবার থেকে আবার অফিস করি। এরকম প্রতি মাসে অন্তত একবার হয়। আর বড় রকমের ট্যুর বছরে ২/৩ বার।"
তিতিরের চোখগুলো বড় হয়ে গেল।
-"এত ঘুরাঘুরি করেন?"
-"ওই আর কি!"
-"আপনার না স্টাডি কম্পলিট হয়নি তাহলে জব করেন কিভাবে?"
-"ইভেনিং এ মাস্টার্স করছি, প্রাইভেটে।"
-"ওহ!"
হঠাৎ গাড়িটা ডানে মোড় নিতেই টাল সামলাতে না পেরে তিতির মুগ্ধর গায়ের উপড়ে গিয়ে পড়ল। তারপর হয়তো সিএনজি থেকেই পড়ে যেত কিন্তু মুগ্ধ তার আগেই তিতিরকে ধরে ফেলল। তারপর বলল,
-"শক্ত হয়ে বোসো। আমি সময়মত না ধরলে তো পড়ে যেতে।"
ওয়াইজংশন যেতেই মুগ্ধ গাড়ি থামাতে বলল। মুগ্ধ সিএনজি থেকে নেমে বলল,
-"তিতির নামো।"
তিতির নামল। তারপর বলল,
-"রাস্তার ব্যাপারটা দেখেছো?"
তিতির দেখলো এতক্ষণ ওরা একটা রাস্তায় এসেছে। সেই রাস্তাটাই এখানে এসে একটা বাম দিকে নিচে চলে গেছে, পাশে অনেকটা জমির মত কিছুটা সমতল। আরেকটা রাস্তা ডান দিকের বড় পাহাড় ঘেঁষে উপরে চলে গেছে। মোড়টাতে বেশ কয়েকটা দোকানপাট আছে। সব দোকানদার মহিলা। শুধু একটা কাঠের টেবিলে পেঁপে নিয়ে বসে আছে এক বুড়ো-বুড়ী। তিতির বলল,
-"বাহ, যায়গাটা তো বেশ সুন্দর। আচ্ছা, রাস্তাটা এরকম দোতলা টাইপ কেন?
-"দোতলা! ওয়াও.. কিন্তু তোমার এই মোড়টাকে ওয়াইশেপ বলে মনে হচ্ছে না?"
তিতিরের এবার খেয়াল হলো। বলল,
-"আসলেই ওয়াই শেপই তো।"
-"এজন্যই এই যায়গার নাম ওয়াইজংশন।"
-"ওহ!"
-"চা খাও তো?"
-"খুব! বা খেলেই বরং খারাপ লাগে।"
-"তাহলে এতক্ষণ বলোনি কেন?"
-"আমি ভাবিনি এখানে চা পাওয়া যাবে।"
-"আচ্ছা, চলো। চায়ের সাথে আর কি খাবে?"
-"আর কিছুনা। আচ্ছা আমরা কোন রাস্তাটা দিয়ে যাব?"
-"উপরে যেটা গেছে ওটা দিয়ে।"
-"ও। আর নিচের ওই রাস্তাটা দিয়ে কোথায় যায়?"
-"ঠিক নিচের না। এখানে নিচে তবে আস্তে আস্তে উপরে উঠে গেছে। ওটা দিয়ে বগালেক, কেওক্রাডং এসব যায়গায় যায়।"
-"ওহ!"
মুগ্ধ দোকানে বসে বলল,
-"আপু, তিনটা চা দিয়েন।"
তিতির দোকানদার মেয়েটার দিকে তাকালো। মেয়েটা খুব সুন্দর একটা স্কার্ট পড়া। চাকমা টাইপ চেহারা হলেও খুব সুন্দর। তিতিরের স্কিন খুব ভাল। নিজের স্কিন নিয়ে ওর কোনই আক্ষেপ নেই। কিন্তু এই মেয়েটাকে দেখে নিজের প্রতি আক্ষেপই হচ্ছে। ও ফিসফিস করে মুগ্ধকে বলল,
-"মেয়েটা তো ব্যাপক স্মার্ট! আর মারাত্মক সুন্দর।"
-"এই কুনজর দিও না। স্মার্ট হবে না কেন? পাহাড়ে থাকে বলে কি ওরা স্ট্যাইল জানেনা ভেবেছো? আর ওরা এত সুন্দর যায়গায় থাকে, ফ্রেশ ওয়েদার। ওরা তো সুন্দর হবেই। আর তুমি এভাবে বলছো কেন? তুমি কি ওর চেয়ে কম নাকি?"
তিতির লজ্জা পেল। মুগ্ধও অকওয়ারড ফিল করলো। কি বলে ফেলল! প্রসঙ্গ পালটাতে মুগ্ধ তারপর হাসুকে ডাক দিল,
-"এই মামা, এদিক আসো।"
হাসু আসতেই বলল,
-"তুমি ওই কোনার মধ্যে বইসা আছো ক্যান? নেও চা-বিস্কুট খাও।"
হাসু চা নিল। বিস্কুটও নিল।
মুগ্ধ চা খাওয়া শেষ করে তিতিরকে বলল,
-"মজা দেখবে এসো।"
তারপর পেঁপের দোকানের সামনে গেল। তিতিরও সাথে গেল। বুড়ো-বুড়ী ওদের দেখেই হেসে দিল। মুগ্ধ একটা পেঁপে হাতে নিয়ে বলল,
-"দাদা, এটা কত?"
বুড়ো বলল,
-"তিইত তাকা।"
মুগ্ধ আরেকটা পেঁপে নিয়ে বলল,
-"আর এটা?"
বুড়ো একটু ভেবে বলল,
-"এতা পঁয়তিত তাকার মোতন।"
-"মিষ্টি হবে?"
বুড়ো হেসে বলল,
-"মিত্তি হবে।"
-"কেটে দেয়া যাবে?"
-"হি, কেতে দেয়া দাবে।"
মুগ্ধ একটা পেঁপে এগিয়ে দিল,
-"এটা কেটে দেন। আর ওইটা এমনই দিয়ে দেন।"
বুড়ো খুব সুন্দর করে পেঁপেটা কাটলো তারপর ধুয়ে পলিথিনে ভরে দিল। মুগ্ধ সেটা হাতে নিয়ে টাকা দিয়ে তিতিরকে নিয়ে সিএনজিতে উঠলো। সিএনজি ছেড়ে দিল। মুগ্ধ বলল,
-"যে মজাটা দিতে চেয়েছিলাম সেটা কি পেয়েছো?"
-"হ্যা, ওরা কি সুন্দর করে কথা বলে!"
-"খুব মিষ্টি না? আমার তো পাহাড়ীদের কথা শুনলে শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে।"
তিতির বলল,
-"আপনার কি পেঁপে অনেক পছন্দ?"
মুগ্ধ বলল,
-"পেঁপে বান্দরবানের জাতীয় ফল। ঢাকায় সারাবছরে একটা পেঁপেও খাইনা। কিন্তু বান্দরবান এলে ডেইলি ২/৩ টা পেঁপে খাই। এত মিষ্টি পেঁপে আমি পৃথিবীর আর কোথাও খাইনি। একবার খেয়ে দেখো। ঢাকা গিয়ে আর পেঁপে খেতে ইচ্ছে করবে না।"
-"আচ্ছা পরে খাবো।"
-"আরে খাওনা। খুব মিষ্টি। তোমরা মেয়েরা এত ডায়েট করো কেন বলোতো?"
-"আমি ডায়েট করিনা। অনেক খাই, খেলেও আমি মোটা হইনা।"
-"তাহলে খাও।"
তিতির পেঁপে নিল। মুখে দিয়ে ওর মনে হলো চিনি মাখিয়ে দিয়েছে। মুগ্ধ পেঁপে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো,
-"কি মিষ্টি না?"
-"হুম, মিষ্টির জন্য মাথা ধরে যাচ্ছে। বাপরে! মনে হচ্ছে ১ কেজি চিনি মাখানো হয়েছে পেঁপেটাতে।"
মুগ্ধ হাসলো।
কোন মানুষ যে যেকোনো সিচুয়েশনে এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে পারে তা মুগ্ধ আগে জানতো না। আর ঘুমানোর পর যে কারো মুখটা এতটা মায়াবী লাগে তাও ও জানতো না। তিতির ঘুমাচ্ছে, হ্যা সিএনজিতেই ঘুমাচ্ছে। যাতে পড়ে না যায় তাই ওর সামনে দিয়ে হাত বাড়িয়ে সিএনজি ধরে রেখেছে মুগ্ধ। ওর খুব ভাল লাগছে। ওর চোখ দুটো তিতিরের বন্ধ চোক, নাক, ঠোঁট, গাল, নিঃশ্বাস আর কপালের উপর এসে পড়া চুলের উপর ঘুরপাক খাচ্ছে। এতো সত্যি ঘুমকুমারী!
প্রেমাতাল - পর্ব ৬
মৌরি মরিয়ম
তিতিরের ঘুম ভাঙতেই দেখলো মুগ্ধ গুনগুন করে গান গাইছে। ও বলল,
-"আপনি গান গাইতে পারেন?"
মুগ্ধ বেড়ী দিয়ে তিতিরকে আগলে রাখা হাতটা সরিয়ে নিল। তিতির আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসল। তিতিরের ঘুমে জড়ানো কন্ঠস্বরটা মুগ্ধর বুকে গিয়ে লাগলো। মুগ্ধ সত্যি এবার চিন্তায় পড়ে গেল। ও তিতিরের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে না তো? সর্বনাশ! তিতিরকে ভাল লেগেছে এটা ঠিক, কাল যখন বাসে ওর কাধে ঘুমিয়ে পড়েছিল তখন থেকেই। ভাল লাগাতে তো দোষ নেই। কিন্তু প্রেমের মত ভুল ও আর করবে না, খুব শিক্ষা হয়েছে। আর না। ও জানে ও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবে।
মুগ্ধ চুপ করে আছে দেখে তিতির আবার জিজ্ঞেস করল,
-"কি হলো বলুন না, আমি তো আপনাকে গুনগুন করতে শুনলাম।
-"গান কে না গাইতে পারে?"
-"আমি পারিনা। আচ্ছা, আপনি যখন গান গাইতে পারেন আমাকে একটা গান শোনান। গান আমি খুব পছন্দ করি।"
-"এখন?"
-"হুম, এখনই তো গাইছিলেন।"
-"আমি যদি গাইও সিএনজির শব্দে কিছু শুনতে পাবে না। তারচেয়ে থানচি পৌঁছে রাতে শোনাবো।"
-"আমাদের থানচি পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে?"
-"অলমোস্ট।"
-"ও।"
তারপর মুগ্ধ হেসে বলল,
-"তিতির, তুমি এই গুণটা কিভাবে রপ্ত করেছো একটু বলবে? আমি না রাতে ছাড়া ঘুমাতেই পারিনা। আমাকে টিউটোরিয়াল দাও। খুব দরকার।"
-"ওটা আমার জন্মগত গুণ, আর প্লিজ আমার ঘুম নিয়ে আমাকে লজ্জা দেবেন না।"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"আচ্ছা আচ্ছা সরি।"
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। সিএনজি চলেছে আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে। কয়েকটা ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে দেখা গেল বইখাতা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। তারা ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধ বলল,
-"তুমি বলেছিলে সিলেট গিয়েছো, সিলেটের কোথায় গিয়েছো?"
-"মাধবকুন্ড, জাফলং, রাতারগুল আর সিটিতেই একটা চা বাগানে। আর মাজারে তো গিয়েছিই।"
-"সবাই এসব যায়গায়তেই যায়। আমিও প্রথম এসব যায়গাতেই গিয়েছিলাম। কিন্তু নেক্সট বার সিলেট গেলে বিছনাকান্দি মাস্ট যাবে।"
-"বিছনাকান্দি কোথায়? আর ওখানে কি আছে?"
-"বিছনাকান্দি সিলেটেই। তবে যাওয়ায় একটু প্রব্লেম আছে। প্রথমে লেগুনা কিংবা সিএনজিতে করে যেতে হবে। তারপর পায়ে হেঁটে। তারপর নৌকায়। কিন্তু এত কষ্ট করে যাওয়ার পর যায়গাটা দেখে সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। ওখানে আকাশ নীল, পাহাড় নীল। নদীর পানিও নীল। ইন্ডিয়ার একদম সীমান্তে। ইন্ডিয়ার একটা ঝড়নার পানি এসে ওই নদীটায় পড়ে। অনেকটা জাফলং এর মতই, পানির নিচে পাথর। তবে ডিফারেন্স হলো ওগুলো অনেক বড় বড় পাথর আর জাফলং এর পানি যেমন সবুজ, বিছনাকান্দির পানি নীল। শুধু যে নীল তাই নয় স্বচ্ছও। এত স্বচ্ছ পানি যে তুমি গলা সমান পানিতে নেমে গেলেও নিচে তাকিয়ে পায়ের পাতাটা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাবে। তা বলে একা একা নেমো না, স্রোত তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। পানির স্রোত এত বেশি যে অনবরত কলকল ধ্ধনি হতে থাকে। জাস্ট স্পিচলেস!!!"
-"ধুর, আপনি খুব খারাপ! খালি লোভ দেখান।"
মুগ্ধ হাসলো। তিতির বাইরে তাকালো।
আরেকটু সামনে যেতেই তিতির বিমোহিত হয়ে গেল রাস্তার দুপাশের সৌন্দর্য দেখে। দুপাশের পাহাড়গুলোই রাস্তা থেকে অনেক নিচে। বাম পাশের পাহাড়গুলো দেখতে একরকম, ডান পাশের গুলো আবার আরেকরকম। রাস্তার ধারে ফুটে রয়েছে রঙ বেরঙের বুনোফুল আর অচেনা ছোট ছোট বুনোলতা। তিতিরকে সেদিকে তাকিয়ে তাকতে মুগ্ধ বলল,
-"সুন্দর না বুনোলতা গুলো?"
-"হুম।"
-"বলোতো কেমন লাগতো এগুলো না থাকলে?"
-"মানে?"
-"আসলে এগুলো তো আগাছা! এগুলো যদি নিয়মিত কেটে ক্লিন করে রাখা হতো তাহলে কেমন লাগতো?"
-"কি জানি! সেরকম তো আর দেখিনি কখনো। এইতো প্রথম দেখছি।"
-"ভাল লাগতো না। মেঘালয়ে এসব আগাছা নিয়মিত কেটে রাখা হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫০০০ ফিট উপরে কিন্তু সব পাকা রাস্তা। সব কিছু হাতের মুঠোয়। কিন্তু আমার ভাল লাগেনি। এই ২৮০০ ফিট উপরের সাধারণ বুনো সৌন্দর্যই আমার কাছে বেশি ভাল লাগে।"
-"ও।"
মুগ্ধ তিতিরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-"যা ন্যাচারাল তা সব আমার ভাল লাগে।"
তিতিরের কেমন যেন লাগলো বুকের ভেতর। তিতির বুঝলো না!
দরজায় টোকা পড়ল। তারপর ভাবীর গলা পাওয়া গেল।,
-"তিতির, এই তিতির.. ওঠো, আজ না তোমার ৮:৩০ এ ক্লাস। এখনো যে উঠছো না? দেরী হয়ে যাবে তো বাবা।"
তিতির চোখ মুছে পানি খেয়ে গলাটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। তারপর বলল,
-"ভাবী আমি উঠেছি, তুমি যাও.. আমি আসছি।"
মুগ্ধর পাঠানো অডিওটা শুনতে শুনতে মনে পড়ে গিয়েছিল ওদের প্রথম পরিচয়ের সেই বান্দরবান ট্রিপের কথা। আজ ৫ বছর পরেও চোখে ভাসে সব। ওসব ভাবতে ভাবতে কখন যে রাত পার হয়ে সকাল হয়ে গিয়েছে ও টেরই পায়নি। ফ্রেশ হয়ে এসে চেঞ্জ করলো। ক্লাসে যেতে হবে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে চোখ পড়লো বাঁশের পেনহোল্ডার টার দিকে। এই পেনহোল্ডার টা ও নিলগিরিতে উল্টেপাল্টে দেখেছিল কিন্তু কেনেনি। ওর পছন্দ হয়েছিল বুঝে মুগ্ধ কখন যেন কিনে নিয়েছিল। অনেক পরে ঢাকায় আসার পর ওকে দিয়েছিল। জিনিসটাকে আজও খুব যত্নে রেখেছে ও। মুগ্ধর দেয়া প্রতিটা জিনিস, মুগ্ধর সাথে কাটানো প্রতিটা ছোট ছোট স্মৃতিগুলাওকে খুব যত্নে রেখেছে ও। শুধু মুগ্ধকেই রাখতে পারেনি!
''প্রেমাতাল'' বই টি রকমারি তে পেয়ে যাবেন
সেদিন দুপুরের দিকে ওরা নিলগিরি পৌঁছেছিল। সিএনজি পার্কিং এ রেখে ওরা টিকেট কেটে ঢুকলো। তিতির মুগ্ধর ঠিক পাশে পাশে হাঁটছে না। একটু পিছন পিছন হাঁটছে। ছেলেদের পাশাপাশি হাঁটতে ওর অস্বস্তি হয়। তিতিরের যায়গাটা ভাল লাগলো না। সবার মুখে শুনেছে নিলগিরি সুন্দর নিলগিরি সুন্দর। কিন্তু এখানে এসে ওর কাছে মনে হচ্ছে কোনো ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াতে এসেছে। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াগুলো যেমন সুন্দর সাজানো গোছানো থাকে সেরকমই। ও জানে নিলগিরি আর্মিদের যায়গা তবু পাহাড়েও ক্যান্টনমেন্টের মত হবে ভাবেনি। এখানে ভালই ভীর। ওদের মতই অসংখ্য লোকজন এসেছে নিলগিরি দেখতে। প্রায় প্রত্যেকটা দলই মোবাইলে ছবি তোলায় ব্যস্ত। একজনের ছবি তোলা হচ্ছে তারপর পালাক্রমে সেটা দলের সবাইকে দেখানো হচ্ছে। সবাই আবার সেই ছবি এনালাইজ করছে। অথচ কোথায় এসেছে সেটা দেখছেই না! অল্প কয়েকজনকেই দেখা গেল ঘুরে ঘুরে দেখতে। মুগ্ধ ঠিকই বলেছিল।
ওরা পাথরের বানানো সিড়ি দিয়ে একটা কিনার ধরে উপরে উঠছিল। বাম পাশে একটু নিচুতেই খাবার আর পাহাড়ীদের হস্তশিল্পের দোকান। উঁচু পাহাড়টা ছিল ডান পাশে। উঠেই দেখতে পেল পাহাড়ের কিনারে কিনারে পাথর দিয়ে বেশ কয়েকটা চেয়ার টেবিলের মত বানানো। তার পাশে রেলিং দেয়া। পাহাড়ের উপরে চার পাঁচটা কটেজ দেখা যাচ্ছে। কটেজগুলো পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু যায়গার কিনারে কিনারে বানানো। মাঝখানে চারকোণা একটা যায়গায় টাইলস বসিয়ে ড্রইংরুমের মেঝের মত করা হয়েছে। বামপাশে দেখলো বান্দরবানের একটা ম্যাপ যেখানে সব ইম্পরট্যান্ট যায়গাগুলো চিহ্নিত করা আছে। এই একটা জিনিসই শুধু ওর ভাল লাগলো।
তিতির মুখে কিছু না বললেও মুগ্ধ বোধহয় ওর ভেতরকার রিয়াকশনটা বুঝতে পেরেছিল। মুগ্ধ বলল,
-"ভাল লাগছে না না? সব প্লাস্টিক সৌন্দর্য বলে মনে হচ্ছে?"
-"আসলে আমার আফসোস হচ্ছে, এত সুন্দর পাহাড়টাকে কেটে কেটে এরকম ইট পাথরের কটেজ বানানোর কি দরকার ছিল? আবার দেখুন না, ওই যায়গাটাকে পুরো ড্রইংরুম বানিয়ে ফেলেছে।"
মুগ্ধ হেসে ফেলল। তিতির বলল,
-"আপনি বলছিলেন না বুনোলতাগুলো কেটে ফেলায় মেঘালয়ের পাহাড়ী রাস্তাকে আপনার ভাল লাগেনি। আমারও তেমন। যদিও আমি আগে এখানে আসিনি তবু মনে হচ্ছে এগুলো না থেকে স্বাভাবিক একটা পাহাড় হলেই বেশি ভাল লাগতো। এই যায়গার জন্য মানুষের এত লাফালাফি! আমি তো হতাশ হলাম।"
-"তিতির চোখ বন্ধ করো।"
-"কেন?"
-"অপরিচিত হওয়া স্বত্তেও আমাকে এতটা বিশ্বাস করে আমার সাথে এতদূর আসতে পেরেছো, আর এখন একটু চোখ বন্ধ করতে পারবে না?"
তিতির মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে নিজের চোখ বন্ধ করল। মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরলো। তিতির চোখ খুলে ফেলল। মুগ্ধ তিতিরের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
-"এতক্ষণে ভয় পেয়ে হোক আর যাই হোক, তুমি অলরেডি আমার হাত ধরে ফেলেছো। আরেকবার ধরলে আশা করি কোন ক্ষতি হবে না। আর অনেস্টলি স্পিকিং আমার মনে কোন দোষ নেই।"
তিতির ওর ঠোঁটে সেই মিষ্টি হাসিটা বজায় রেখে নিজেই মুগ্ধর হাত ধরলো। তারপর চোখ বন্ধ করলো। মুগ্ধ তিতিরকে ধরে কোথাও একটা নিয়ে যাচ্ছিল। তিতির অজান্তেই হাঁটছিল যেদিকে মুগ্ধ ওকে হাঁটাচ্ছিল। তারপর এক যায়গায় থামলো। তিতিরের পেছনে দাঁড়ালো মুগ্ধ। তিতিরের হাতটা আরো শক্ত করে ধরে বলল,
-"এবার চোখ খোলো।"
তিতির চোখ খুলতেই দেখতে পেল, ওর সামনেই অনেক অনেক নিচে অনেক অনেক পাহাড়। কাছের গুলো বড়, দূরের গুলো ছোট। দূরে যেতে যেতে পাহাড়গুলো যেন একেকটা পিঁপড়ার সমান হয়ে গেল। এখন বুঝতে পারছে এতক্ষণ যে রাস্তা থেকে পাহাড় দেখছিল আর অবাক হচ্ছিল তা নিতান্তই কাছে ছিল। পাহাড়গুলো দেখে মনে হচ্ছে কেউ অনেকগুলো ট্রায়াঙ্গল একটার ওপর একটা এঁকেছে। তারপর সবুজ রং করে দিয়েছে। কোনোটা গাঢ় সবুজ, কোনোটা হালকা সবুজ। এ এক অদ্ভুত সবুজের খেলা। বান্দরবানের একমাত্র নদী সাঙ্গু সর্পিল গতিতে বয়ে চলেছে সেই পাহাড়ের বুক ছিঁড়ে। শেষ প্রান্তটা কোথায় যে শেষ হয়েছে তা বোঝার উপায় নেই। আস্তে আস্তে সব ঝাপসা হয়ে গেছে। তিতিরের চোখের সামনে যা ছিল তার এক-চতুর্থাংশে ছিল এই পাহাড়! বাকি তিন- চতুর্থাংশ ছিল আকাশ। ছোটবেলায় ছবি আঁকার সময় হালকা আকাশী কালারের আকাশের উপর যে গোল গোল সাদা সাদা বাবলসের মত মেঘ আঁকত ঠিক তেমন মেঘ ছিল সে আকাশে। এমন আকাশ আর এমন মেঘ ও কোনদিনও দেখেনি। এত এত বিশালতা আর এত এত স্বচ্ছতা যেন তিতিরের চোখ, মুখ, নাক, কান এমনকি ওর শরীরের প্রত্যেকটি লোমকূপ দিয়ে ঢুকে ওর ভেতরের সব ক্লান্তি, গ্লানি, দুক্ষ, কষ্ট, আক্ষেপ, অভিমান আর না পাওয়াগুলোকে ছেঁকে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। ও কোথায় দাঁড়িয়ে ছিল, কিভাবে দাঁড়িয়ে ছিল তার কিছুই তখন ওর খেয়াল ছিলনা। একটা কথাও বলতে পারলো না কখন ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো তা ও নিজেও টের পেলনা। ঠোঁটে ছিল বিস্ময়ের হাসি। থরথর করে কাঁপছিল। মুগ্ধ দেখলো এ দৃশ্য, খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলো। মুগ্ধ বেশ লম্বা তাই তিতিরের পেছনে দাঁড়িয়েও নিচে তাকিয়ে ওর মুখ দেখতে কোন সমস্যা হলোনা। তিতির ভারসাম্য হারিয়ে ওর বুকের উপর ঢলে পড়েছে। মুগ্ধ দুই হাত দিয়ে তিতিরের দুই হাত ধরে নিজের বুকের সাথে ওর পিঠ ঢেকিয়ে ধরে রেখেছে ওকে।
To be continued...